মহারাজা আর যুবরাজ ধরতে পুরস্কার ঘোষণা
ল্যাবরেটরিতে মানুষরূপী দানব বানিয়েছিলেন ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। পরে সেই দানবের হাতেই খুন হতে হয় তাকে। বাংলাদেশেও অনেক ডনকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
মির্জা মেহেদী তমাল
আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ অপরাধীরা ’৯০ সালের পর এমনই বেপরোয়া হয়ে পড়ে যে, তাদের লাগাম টেনে ধরাটা একসময় পুলিশের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেড আসামিরা নিজেদের ‘মহারাজা’ আর ‘যুবরাজ’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে খুন, চাঁদাবাজি, অপহরণ করতে থাকে। এক গ্রুপ বহু গ্রুপে পরিণত হয়। আধিপত্য বিস্তারে শুরু হয় গ্যাং কিলিং। খুন পাল্টা খুনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সব খানে। এসব অপরাধী রাজধানী ছাপিয়ে দাপিয়ে বেড়াতে থাকে বিভিন্ন জেলা পর্যন্ত। খুনাখুনি করতে গ্রুপগুলোর কাছে আসতে থাকে ভয়ঙ্কর সব আগ্নেয়াস্ত্র। মানুষ তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। এমনই এক টালমাটাল পরিস্থিতিতে সরকার সন্ত্রাসীদের তালিকা প্রকাশ করে। তাদের ধরিয়ে দিতে ঘোষণা করা হয় পুরস্কার। তবুও সন্ত্রাস থেমে থাকেনি। সন্ত্রাসীরা জেলখানা থেকে কলকাঠি নাড়ছে। কেউ বিদেশে থেকেই চাঁদাবাজি করছে। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে বিবেচনা করা হতো সাবেক যুবলীগ নেতা আওরঙ্গকে। একসময়ের জনপ্রিয় এই রাজনৈতিক নেতা কীভাবে নাম লেখালেন আন্ডারওয়ার্ল্ডে তা নিয়ে বিস্তর তর্ক রয়েছে। একাধিক সূত্র জানায়, ১৯৮১ সালে রাজধানীর সাকুরা বার-এর সামনে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যকে হত্যার অভিযোগ আনা হয় সেই যুবলীগ নেতা আওরঙ্গের বিরুদ্ধে। এরপরই ভারতে পালিয়ে যান তিনি। এই যুবলীগ নেতা ছাড়াও নব্বইয়ের দশকে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে প্রভাবশালী আরও দুজনের নাম পাওয়া যায়। একজন হলেন লিয়াকত এবং মানিকগঞ্জের মুশফিকুর রহমান হান্নান ওরফে বড় হান্নান। বলা হয়ে থাকে সেসময় এই দুজনই ছিলেন সেই যুবলীগ নেতার প্রধান শক্তি। রাজনৈতিক কারণে তাদের সন্ত্রাসের পথে হাঁটতে হয়। সূত্র মতে, ১৯৯১ সালে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে উত্থান ঘটে সুব্রত বাইন এবং গোলাম রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগরের। পুলিশের সূত্র জানায়, আন্ডারওয়ার্ল্ডে আশির দশকের একজন সন্ত্রাসীর অনুপস্থিতিতে তার দলের সদস্যরা সুব্রত বাইন এবং টোকাই সাগরের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। সেভেন স্টার আর ফাইভ স্টার নামে দুই ভাগ হয়ে যায় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড। সেভেনে স্টারের নেতৃত্ব দেন সুব্রত বাইন। আর ফাইভ স্টার বাহিনী গড়ে তোলেন লিয়াকত। লিয়াকতের ফাইভ স্টার গ্রুপে যোগ দেয় পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর, আরমান, জিসান, রনি, বিকাশ, প্রকাশ, নিটেল, আলাউদ্দিন, কিলার আব্বাস, আগা শামীম, কাজল এবং অশ্রু। অন্যদিকে সুব্রত বাইনের সেভেন স্টার বাহিনীতে যোগ দেয় মুরগি মিলন, তানভীরুল ইসলাম জয়, টোকাই সাগর, ইমাম হোসেন ইমাম, মোল্লা মাসুদ, সাইদুর রহমান নিউটন, তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ, তানজিল, কচি, টিক্কা, আসিফ, কালা লিয়াকত, জরিফ, নাটকা বাবু, মুরাদ, মানিক, চঞ্চল, জুলু এবং জন। তারা সবাই তখন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের একেকজন কুখ্যাত সন্ত্রাসী। লিয়াকতের সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন সুইডেন আসলাম হাত মেলায় সুব্রত বাইনের সঙ্গে। আর এতে আন্ডারওয়ার্ল্ডে শক্তি বাড়ে সুব্রত বাইনের। এ দশকে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে চলতে থাকে গ্যাং কিলিং। একই সময় সুব্রত বাইনের গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যান গোপীবাগের ‘সন্ত্রাসী’ আসিফ। যোগ দেন লিয়াকত গ্রুপে। ২০০০ সালের ২৯ আগস্ট খুন হন আসিফ, তার বডিগার্ড গিয়াসউদ্দিন টিপু এবং সহযোগী রিপন। খিলগাঁওয়ের ৪৪৬/সি নম্বর বাড়ি থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এই গ্যাং কিলিংকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপই দল ভারি করতে থাকে। বাড়াতে থাকে অস্ত্রশস্ত্র। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে আসতে থাকে অত্যাধুনিক অস্ত্র। সূত্র জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পিচ্চি শামিম এবং টোকাই মিজান এ সময় যোগ দেয় লিয়াকতের গ্রুপে। সুব্রত বাইন এবং লিয়াকত গ্রুপে চলতে থাকে খুন-পাল্টা খুন। নিজ নিজ দলের কলহেও মারা যায় বেশ কজন। এই দুই গ্রুপের কলহ আর আন্ডারওয়ার্ল্ডে ক্ষমতা দখলের বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়ে ২০০০ সালে। এ সময় সেভেন স্টার এবং ফাইভ স্টার গ্রুপ ঢাকা সিটি করপোরেশনের টেন্ডার দখলের জন্য জড়িয়ে পড়ে প্রকাশ্য বন্দুকযুদ্ধে। দুই পক্ষের বন্দুকযুদ্ধে মারাত্মক আহত হয় টোকাই মিজান। পাঁচটি বুলেট লাগলেও বেঁচে যায় সে। আর এ সময়ই দুই গ্রুপের সংঘর্ষ মারাত্মক আকার ধারণ করে। চলতে থাকে খুন-পাল্টা খুন। ২০০০ সালের ১৮ মে পুরান ঢাকার জজ কোর্ট এলাকায় ফিল্মি কায়দায় খুন করা হয় হুমায়ুন কবির মিলন ওরফে মুরগি মিলনকে। সেভেন স্টার গ্রুপের পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর এবং ডাকাত শহিদ এই হত্যা মিশনে সরাসরি অংশ নেয়। পুলিশের একাধিক সূত্রের মতে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘিরে যে সোনা চোরকারবারি হতো, তার নেতৃত্ব দিত মুরগি মিলন। ফাইভ স্টার গ্রুপের সঙ্গে একসময় ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল এমন একজন জানান, লিয়াকতের ফাইভ স্টার গ্রুপে থাকলেও একসময় দলের সঙ্গে বেইমানি করে টিক্কা। গোপনে সাহায্য করতে থাকে সেভেন স্টার প্রধান সুব্রত বাইনকে। ২০০১ সালে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয় টিক্কা। পরে হাসপাতালে তার মৃত্যু ঘটে। সন্ত্রাসী জগৎ থেকে বেরিয়ে আসা অনেকেই জানান, একসময় আন্ডারওয়ার্ল্ডের এসব ‘ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীরা’ দুটি গ্রুপে ছিল। এক সময় অনেক নামে ভাগ হয়ে যায় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড। ব্ল্যাক প্যান্থার, টাইগার, পাইথন আর কোবরা। ভয়ঙ্কর বিষধর হিংস্র প্রাণীর নামে গড়ে ওঠে নানা বাহিনী। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড ১৩টি ভাগে ভাগ করে চলতে থাকে সন্ত্রাসী কাজ। রাজধানীর কলাবাগান, গ্রীন রোড, পান্থপথ, সোবহানবাগ নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে তানভীরুল ইসলাম জয়। সুইডেন আসলামের দখলে থাকে ফার্মগেট, নিউ ডিওএইচএস, রাজাবাজার, তেজতুরিবাজার ও কারওয়ানবাজারের একাংশ। মিরপুরের ডন বনে যান বিকাশ কুমার বিশ্বাস আর তার ভাই প্রকাশ কুমার বিশ্বাস। আর মোহাম্মদপুরের একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফের হাতে এবং আরেক অংশের দখল নেয় ছাত্রদল নেতা পিচ্চি হেলাল। ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগের এক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে জোসেফ গ্রুপের মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া কাঁঠালবাগান, কারওয়ানবাজারের একাংশ, হাতিরপুল, এলিফ্যান্ট রোডের দখল নেয় পিচ্চি হান্নান। হাজারীবাগের ট্যানারি এলাকা, রায়েরবাজার এবং জিগাতলার আন্ডারওয়ার্ল্ডের দখল নেয় লেদার লিটন, সিদ্ধেশ্বরীতে খুরশিদ আলম রাশু, ধানমন্ডি, রায়েরবাজার ও মোহাম্মদপুরের একাংশে ইমন, মিরপুরের একাংশে কিলার আব্বাস, মিরপুর ও পশ্চিম কাফরুল এলাকায় কালা জাহাঙ্গীর এবং জুরাইন, পোস্তগোলা ও গেণ্ডারিয়ার নিয়ন্ত্রণ থাকে কমিশনার শাহাদাতের হাতে। পরে কালা জাহাঙ্গীর বাহিনীর হাতে কমিশনার শাহাদাত খুন হলে তার এলাকার নিয়ন্ত্রণ পায় কালা জাহাঙ্গীর। এ ছাড়া পুরান ঢাকায় আগা শামিম এবং ইস্কাটন, মৌচাক, মগবাজার ও বাংলামোটর এলাকার নিয়ন্ত্রণ থাকে লিয়াকত-হান্নান বাহিনীর হাতে। সন্ত্রাসীদের মধ্যে এ সময় শুরু হয় খুন পাল্টা খুন। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে দিনে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয় সন্ত্রাসীরা। চাঁদাবাজি খুনসহ নানা অপরাধে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের এমন টালমাটাল সময়ই আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ১৯৯৮ সালে সন্ত্রাসীদের তালিকা প্রকাশ করে। পরে ২০০১ সালে দ্বিতীয়বারের মতো সরকার ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর নামের তালিকা প্রকাশ করে। তালিকাভুক্তদের মধ্যে কালা জাহাঙ্গীর, প্রকাশ বিশ্বাস, মোল্লা মাসুদ, সুব্রত বাইন, পিচ্চি হান্নান, আলাউদ্দিন, আগা শামিম ও আমিন রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগরকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১ লাখ টাকা এবং লিয়াকত ও তার ছোট ভাই কামরুল হাসান ওরফে হান্নানসহ ১২ জনকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে গণপিটুনিতে মারা যান আলাউদ্দিন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন