ব্যাঙ্গা বাবুর নেশা ছিল খুন
ল্যাবরেটরিতে মানুষরূপী দানব বানিয়েছিলেন ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। পরে সেই দানবের হাতেই খুন হতে হয় তাকে। বাংলাদেশেও অনেক ডনকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
মির্জা মেহেদী তমাল
ছেলেটিকে মাটিতে ফেলে কয়েকজন শক্ত করে ধরে রেখেছে। এরপর একজন ধারালো একটি রামদা ওই ছেলেটির গলায় চালিয়ে দিল। রক্ত ঝরছে, ফিনকির মতো। সেই রক্তে ঘাতকদের শরীর ভিজে যাচ্ছে। অসহায় ছেলেটির তখন কী প্রাণপণ চেষ্টা। হাত-পা ছুড়ছিল। গো গো শব্দ বেরোচ্ছে। একসময় হাত-পা ছোটাছুটি বন্ধ হয়ে গেলেও রামদা হাতের যুবকটির জবাই করা যেন শেষ হচ্ছিল না। সে রামদা চালিয়ে যাচ্ছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না শরীর থেকে মাথাটা আলাদা না হচ্ছিল। এরপর দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা মাথাটা ফুটবল বানিয়ে খেলার চেষ্টা করে।
এটি খোদ রাজধানীর ঘটনা। ১৪ বছর আগে এক রাতে মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের মাঠে এভাবেই নৃশংসভাবে খুন করা হয় একই কলেজের ছাত্র রিংকুকে। ঘাতক রিংকুর মাথা দিয়ে ফুটবল খেলার পর সেটি নিয়ে চলে যায়। আর নিষ্ঠুর এই ঘাতক হলো মিরপুরের বাবু, নাজমুল হাসান বাবু। আন্ডারওয়ার্ল্ডে ব্যাঙ্গা বাবু নামে পরিচিত। রাজধানীর পেশাদার কিলারদের মধ্যে অন্যতম একটি নাম হলো ব্যাঙ্গা বাবু। খুন করা তার নেশা, খুন করা তার পেশা। কখনো জবাই করে, কখনো গুলি করে- দুভাবেই সে খুন করতে পারদর্শী। এমনিভাবে রাজধানীতে সে একাধারে খুন করেছে ২৬টি। পুলিশ ও অন্যান্য সূত্র জানায়, একসময় ভালো ফুটবল খেলত এই বাবু। গোলকিপার হিসেবে অনেক পুরস্কারও পেয়েছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বল ধরত। মিরপুরে তার বন্ধুরা তাকে ব্যাঙ্গের সঙ্গে তুলনা করত। সেই থেকে তার নাম হয় ব্যাঙ্গা বাবু। সূত্র জানায়, একসময় ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর একজন শাহাদাতের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিল এই ব্যাঙ্গা বাবু। কিন্তু পরবর্তীতে সে নিজেই দল গঠন করে চাঁদাবাজি-খুনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। ব্যাঙ্গা বাবু শুধু রাজধানীতেই নয়, ভাড়াটে কিলার হিসেবেও সে খুন করেছে বিভিন্ন জেলায়। ব্যাঙ্গা বাবুর সিরিজ খুনের কারণে পুলিশের ঘুম হারাম হয়ে যায়। অবশেষে পুলিশের হাতে পাকড়াও হয় এই ব্যাঙ্গা বাবু। স্বস্তি ফিরে আসে পুলিশ বাহিনীতে। গত তিন বছর ধরে এই ব্যাঙ্গা বাবু আটক রয়েছে কারাগারে। মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার পশ্চিমপাড়া গ্রামের বাসিন্দা হাতেম আলীর ছেলে ব্যাঙ্গা বাবু। ছোটবেলা থেকেই বেড়ে উঠেছে রাজধানীর মিরপুর এলাকায়। থাকত শাহ আলী এলাকার সি ব্লকের ৬ নম্বর রোডের ১২ নম্বর বাড়িতে। ১৯৯৩ সালে তার বাবা মারা যান। তখন থেকে সংসারের হাল ধরে ব্যাঙ্গা বাবু ও তার বড় ভাই। কয়েকটি সেলাই মেশিন কিনে বাসায় বসে জামা তৈরি করে মার্কেটে ও দোকানে বিক্রি করত। ধীরে ধীরে কারখানা গড়ে তোলে। কারখানার ব্যবসা নির্বিঘ্ন করতে গিয়ে ১৯৯৭ সাল থেকেই মিরপুরের বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে তার ওঠাবসা। সন্ত্রাসী বাহিনী আলী গ্রুপ, নান্টু গ্রুপ, ইকবাল গ্রুপসহ আরও একাধিক দলের সন্ত্রাসীর সঙ্গে চলতে থাকে। এসব সন্ত্রাসী গ্রুপ বিভিন্ন গার্মেন্ট মালিক, কর্মী ও বস্তিবাসীর ওপর অন্যায়-জুুলুম-নির্যাতন, চাঁদাবাজি ও ছিনতাই কর্মকাণ্ড চালাত। ১৯৯৯ সালে ব্যাঙ্গা বাবুর ছোট ভাই হিসেবে পরিচিত বাপ্পী ও আকরামের কাছে চাঁদা দাবি করে বসে নান্টু গ্রপের সন্ত্রাসীরা। না দিলে মারধর করে। তারা ব্যাঙ্গাকেও ছুরিকাঘাত করে। পরে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে।১৯৯৮-৯৯ সালে এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ব্যাঙ্গা বাবু তার প্রতিদ্বন্দ্বী সারোয়ারকে খুন করার মধ্য দিয়ে খুনি হিসেবে হাত পাকায়। এরপর ২০০১ সালে ব্যাঙ্গা মিরপুরের লাল্টুকে হত্যা করে। একই বছর সরকারি বাঙলা কলেজের ছাত্র রিংকুকে কলেজ মাঠে খুন করে গলা কেটে মাথা নিয়ে যায় ব্যাঙ্গা। খুনের নেশা পেয়ে বসে ব্যাঙ্গা বাবুকে। ওই বছর বাঙলা কলেজের জিএস ছাত্রদল নেতা মোহাম্মদ আলীকে গুলি করে হত্যা করে। সেগুনবাগিচার নবাব আলীকেও একই কায়দায় খুন করে। এরপর একে একে খুন করে ছাত্রদল নেতা বিপ্লব, মিরপুরের সাবেক কমিশনার তৈয়েবুর রহমানের ভাগ্নে যুবলীগ নেতা মাহবুব, প্রিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান কাজী শহিদুল্লাহ, মুক্তিযোদ্ধা শপিং কমপ্লেক্সের চেয়ারম্যান আফতাব আহমেদ, মিরপুর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিটুর ছোট ভাই ছাত্রলীগ নেতা মামুন, ১২ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার শওকত হোসেন মিস্টার, মিরপুর ১ নম্বরের মাসুদ ওরফে গোড়া মাসুদকে। এসব সিরিজ খুনের পর আন্ডারওয়ার্ল্ডে তার নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। শাহাদাতের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করতে থাকে। ২০১২ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজবাড়ীর স্বরূপচর গ্রাম থেকে ব্যাঙ্গা বাবুকে গ্রেফতার করে গোয়ালন্দ থানা পুলিশ। গ্রেফতারের পর সে মিথ্যা পরিচয়ে পুলিশকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। পরে পুলিশি অনুসন্ধানে তার আসল পরিচয় বেরিয়ে আসে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন