কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে রক্ষা পেতে চেয়েছিল পিচ্চি হান্নান
ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ল্যাবরেটরিতে মানুষরূপী দানব বানিয়েছিলেন। পরে সেই দানবের হাতেই খুন হন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। বাংলাদেশেও অনেক ডনকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের গরিব-এ-নেওয়াজ এভিনিউ। সেখানকার ২ নম্বর বাড়িটি র্যাবের ৪০ জনের একটি চৌকস দল ঘিরে ফেলেছে। এদের প্রত্যেকের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। অস্ত্রের নলগুলো ওই বাসার ভিতরের দরজার দিকে তাক করা। হঠাৎ ভিতর থেকে দরজা খুলে বেরিয়ে আসলেন এক যুবক। তার দুই হাত দুই পকেটে ঢোকানো। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই যুবকটি দুই পকেট থেকে কাউবয় স্টাইলে দুটি পয়েন্ট ২২ বোরের পিস্তল বের করলেন। র্যাব সদস্যদের টার্গেট করে গুলি ছুড়তে লাগলেন। হঠাৎ এমন আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না র্যাব সদস্যরা। তাদের মধ্যে দুজন ইতিমধ্যে লুটিয়ে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। অন্য সদস্যরা পাল্টা গুলি চালাচ্ছেন। মধ্যরাতে গোলাগুলিতে উত্তরা এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অস্ত্রধারী যুবকটির শরীরে বেশ কয়েকটি গুলিবিদ্ধ হয়। ওই অবস্থাতেই যুবকটি কমান্ডো স্টাইলে লাফিয়ে পাঁচিল টপকে বাড়ির বাইরে চলে যায়। সঙ্গে তার দুই সহযোগীও। দ্রুত তারা চড়ে বসলেন
বাইরে পার্ক করে রাখা মাইক্রোবাসে। র্যাব সদস্যরা এ সময় গাড়ি লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। ততক্ষণে মাইক্রোবাসটি হাওয়া। ২০০৪ সালের ২৪ জুন হাতের নাগালে পেয়েও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নানকে। কমান্ডো স্টাইলে র্যাবের সামনে দিয়েই গুলি করতে করতে পালিয়ে যান তিনি। কিন্তু দুই দিন পর সাভারের এক হাসপাতালে তাকে ধরে ফেলে র্যাব। পিচ্চি হান্নান তখন ধূর্ত র্যাবকে কোটি টাকা ঘুষ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বলেন, 'টাকাটা নিয়ে ছেড়ে দিন স্যার'। পরে ক্রসফায়ারে তার মৃত্যু হয়। আবদুল হান্নান ওরফে পিচ্চি হান্নান। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের আরেক ডন। যিনি রাজধানীর মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করতেন। শীর্ষ স্থানীয় এই মাদক ব্যবসায়ীর মূল আস্তানা ছিল ঢাকার কারওয়ান বাজার। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে হত্যা, ডাকাতি চাঁদাবাজি, অপহরণ, নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধের দায়ে ২৩টিরও বেশি মামলা ছিল। এর মধ্যে বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান মণ্ডল হত্যা মামলা, ওয়ার্ড কমিশনার শাহাদাত হোসেন হত্যা মামলা, এসআই হুমায়ুন কবির হত্যা মামলা রয়েছে। এ ছাড়া ফার্মগেট, পান্থপথে পথ চলতে গিয়েও গুলি করে হত্যা করার ঘটনা রয়েছে তার অপরাধ জীবনে। চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জের চরদুখিয়া ইউনিয়নের ওয়াজিউল্লাহর পাঁচ সন্তান। এর মধ্যে হান্নান দ্বিতীয়। ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন তিনি। রাজধানীতে তার বাবার কাঁচামালের ব্যবসা ছিল। প্রথম পর্যায়ে তিনি কারওয়ান বাজারে সেই কাঁচা মালের ব্যবসাই দেখাশোনা করতেন। কালক্রমে ছিনতাই চুরির মতো অপরাধ করে হাত পাকিয়ে খুন, ডাকাতি আর অপহরণের মতো ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। চাঁদপুরের এই হান্নান ১৯৯৬ সালে রাজধানীর কারওয়ান বাজার পান্থপথ এলাকায় মাদক ব্যবসা শুরু করেন। ওই সময়ে স্টার বেকারির পাশে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে সশস্ত্র হামলা চালায় পিচ্চি হান্নান। গুলি করে হত্যা করে রানা নামে এক যুবককে। ওটাই ছিল খুনের হাতে খড়ি। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। গড়ে তোলেন শক্তিশালী বাহিনী। পিচ্চি হান্নানের অস্ত্রের ভাণ্ডারে তখন অত্যাধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র। রাজধানীর আরেক ডন কালা জাহাঙ্গীরকে হত্যা করে নিজের শক্তি সামর্থ্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটান আন্ডারওয়ার্ল্ডে। পুলিশ ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সব সরকার আমলেই সরকারের কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতেন। পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ছিলেন, যারা সরাসরি সহযোগিতা করতেন পিচ্চি হান্নানকে। এমন পুলিশ কর্মকর্তাও ছিলেন, যিনি কিনা পিচ্চি হান্নানের ফেনসিডিল ভর্তি ট্রাক পাহারা দিয়ে খালাস করাতেন। আর এ জন্যে পিচ্চি হান্নান মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতেন।
রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ কালা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কালা জাহাঙ্গীর আর পিচ্চি হান্নান মূলত এক সঙ্গেই বিভিন্ন অপরাধ করতেন। খুনের ঘটনাগুলোতেও তারা থাকতেন একসঙ্গে। '৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তারা বিএনপির একই প্রার্থীর হয়ে কাজ করেছেন। তারা আন্ডারওয়ার্ল্ডের ত্রাস হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে সমর্থ হয়। পিচ্চি হান্নান ও কালা জাহাঙ্গীরের এই গ্রুপের মাসে চাঁদা উঠত কোটি টাকার ওপর। রাজধানীতে তারা গাড়ি-বাড়িসহ বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। সূত্র জানায়, পিচ্চি হান্নান চলাফেরা করতেন নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দেহরক্ষী থাকত চারপাশ ঘিরে। তাদের প্রত্যেকের হাতে থাকত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। কোনো এলাকায় তিনি যাওয়ার পরিকল্পনা করলে অগ্রবর্তী দল গিয়ে সিগন্যাল দেওয়ার পর তিনি রওনা দিতেন।
গ্রেফতার ও মৃত্যু : উত্তরা ২ নম্বর গরিব-এ-নেওয়াজ এভিনিউ'র ২ নম্বর বাড়িটি একজন প্রবাসীর। পিচ্চি হান্নানের ব্যবসায়ী বন্ধু বাবুল টাওয়ারের মালিক বাবুলের মাধ্যমে উত্তরার ওই বাসায় যেতেন পিচ্চি হান্নান। ওখানে পিচ্চি হান্নান এবং তার বন্ধু-বান্ধব মিলে ফুর্তি করতেন। পিচ্চি হান্নান নিয়মিত সেখানে যেতেন। র্যাব এ সংবাদ পাওয়ার পর ২৫ জুন অভিযান চালায় ওই বাসায়। কিন্তু পিচ্চি হান্নান গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পালাতে সমর্থ হয়। ওই বাসা থেকে গ্রেফতার হয় পিচ্চি হান্নানের সহযোগী জাকির, বাবুল, দেবাশীষ, সাহেব আলী ও নিটেলসহ আরও কয়েকজন। ওদিকে গুলিবিদ্ধ পিচ্চি হান্নান তার দুই সহযোগীকে নিয়ে প্রথমে আশুলিয়া যান। সেখানে যুবদলের এক নেতার বাসায় গিয়ে রক্তমাখা কাপড় পরিবর্তন করেন। সেখান থেকে তারা সাভারের আরেক যুবদল নেতার বাসায় যান। ওই নেতাই সাভারের ইনসাফ ক্লিনিকে ভর্তি করার ব্যবস্থা করেন। ক্লিনিকে পিচ্চি হান্নানের শরীর থেকে কয়েকটি গুলি বের করা হয়। দুই দিন পর র্যাব জানতে পারে এ খবর। র্যাবের একটি দল সেখানে গিয়ে হাজির। দোতলার একটি কক্ষে ছিলেন পিচ্চি হান্নান। র্যাবের এক সদস্য তাকে জিজ্ঞাসা করেন, ২৪ জুনে তারা গুলিবিদ্ধ হয়েছিল কিনা। পিচ্চি হান্নান তখন খুব বিনয়ের সঙ্গে বলে, না স্যার আমি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছি। র্যাব তখন বলে, তুই পিচ্চি হান্নান। ঘাবড়ে যায় হান্নান। তখন র্যাবের কর্মকর্তাদের পিচ্চি হান্নান বলে, ভাই আমি এই মুহূর্তে এক কোটি টাকা দেব, আমাকে ছেড়ে দিন। মোবাইল ফোনটা দেন ভাই, টাকা আনতে বলি। এতে র্যাব কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাকে সেখান থেকে আদালতে নেওয়া হয়। সেই দিনই র্যাব কার্যালয়ে আনার পর অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে বের হয় র্যাব। আশুলিয়ায় ক্রসফায়ারে নিহত হয় হান্নান। হান্নানের সহযোগী নিটেল ও সাহেব আলীও ক্রসফায়ারে নিহত হয়। অনুসন্ধানে এই তিনজনের ক্রসফায়ার নিয়ে বেশ কয়েকটি তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, রাজধানীর দুর্ধর্ষ ডন কালা জাহাঙ্গীর আত্দহত্যা করেছে-এমন তথ্য প্রচার করেছে পিচ্চি হান্নান। কারণ কালা জাহাঙ্গীরকে পরিকল্পিতভাবেই হত্যা করা হয়েছে। আর এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তারই ঘনিষ্ঠ পিচ্চি হান্নান। কালা জাহাঙ্গীরকে হত্যার পর পিচ্চি হান্নান নিজেকে সমগ্র ঢাকার ডন বলে দাবি করেন। কিন্তু তা বেশি দিন আর থাকতে পারেননি। কালা জাহাঙ্গীরের হত্যাকাণ্ডের মাত্র ছয় মাসের মাথায় পিচ্চি হান্নান নিহত হয়। সূত্র জানায়, নিটেলের বাসায় কালা জাহাঙ্গীরকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। গেন্ডারিয়ার অপর টেরর কচিও এই হত্যার পরিকল্পনায় ছিল বলে জানা গেছে। জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর তার স্ত্রীকে বিয়ে করেন সেই কচি। কচি এখন তার স্ত্রীকে নিয়ে বিদেশ রয়েছেন। সূত্র জানায়, কালা জাহাঙ্গীরের বাড়ি বগুড়া জেলায় বলে তার প্রতি দুর্বল ছিলেন বিএনপির এক নেতা। পিচ্চি হান্নান, নিটেল ও সাহেব আলী ছিলেন তার হত্যাকাণ্ডের সময়। আবার এই তিনজনই পরবর্তীতে একসঙ্গে ক্রসফায়ারে নিহত হয়। কালা জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর সঙ্গে তাই অনেকেই এই তিনজনের মৃত্যুর যোগ সূত্র খোঁজার চেষ্টা করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন