দুর্ধর্ষ এমরানের কবর এখন মাজার
ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ল্যাবরেটরিতে মানুষরূপী দানব বানিয়েছিলেন। পরে সেই দানবের হাতেই খুন হন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। বাংলাদেশেও অনেক ডনকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
মির্জা মেহেদী তমাল
১৯৭৩ সাল। সন্ধ্যা ৭টা। ৬-৭ জনের দুর্ধর্ষ একটি অস্ত্রধারী গ্রুপ মতিঝিল 'বাংলার বাণী' অফিসের সামনে অবস্থান নিয়ে আছে। তারা অফিসের গেটের আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তাদের হাতে স্টেনগান, পিস্তল আর মরণঘাতী গ্রেনেড। তাদের টার্গেট বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে দৈনিক বাংলার বাণীর সম্পাদক ও যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি। তিনি গেট দিয়ে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের অস্ত্রগুলো গর্জন করে উঠবে-এমনই প্রস্তুতি সন্ত্রাসীদের। শিকারের জন্যে তারা অধীর অপেক্ষায়। দেশের শীর্ষ স্থানীয় ও তৎকালীন সরকারের প্রভাবশালী একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে হত্যার মিশন নিয়ে আসায় অস্ত্রধারীরা উত্তেজনায় কাঁপছে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে কিন্তু শিকার আসছে না। অধৈর্য হয়ে পড়ছে অস্ত্রধারীরা। তাদের নেতৃত্বদানকারী স্টেনগান হাতের এক যুবক রাস্তার পাশের একটি অন্ধকার যায়গায় ঘাপটি মেরে আছে। ইশারা ইঙ্গিতে তিনি এই অভিযান পরিচালনা করছেন।
অস্ত্রধারীরা ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে প্রস্তুত।
হঠাৎ রাস্তার দুই পাশ থেকে দ্রুতগতিতে পুলিশের পিকআপ ছুটে আসতে থাকে। অস্ত্রধারীরা কোনো কিছুই বুঝতে পারছিল না। পিকআপ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দ্রুত নেমে পড়ল বাংলার বাণী অফিসের সামনে। সন্ত্রাসীদের একজন গুলি ছুড়ল। পাল্টা গুলি চালালো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। অস্ত্রধারীরা পালাতে শুরু করল। ধরা পড়ল নেতৃত্বদানকারী সেই যুবকটি। দুর্ধর্ষ সেই যুবকটির নাম এমরান, কাজী আবু এমরান। এই এমরানের পুরো পরিকল্পনায় শেখ মণিকে হত্যার এই প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। কিন্তু এমরানের গাড়ি চালক এই হত্যার মিশনের খবর ফাঁস করে দেওয়ায় পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। স্বাধীনতার পর যে কজন যুবক পথভ্রষ্ট হয়ে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সেই দানবে পরিণত হয়েছিল, তাদের একজন এই আবু এমরান হলেন অন্যতম। ঠাণ্ডা মাথায় অগণিত খুন করেছেন তিনি। এর মধ্যে পল্টনের রহমান-দুলাল হত্যাকাণ্ডটি অন্যতম। এই হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে সারা দেশে তখন হৈচৈ পড়েছিল। রহমান ছিলেন ঘোড়াশালের শ্রমিক নেতা এবং দুলাল ছিলেন উদীয়মান একজন সাংবাদিক। পারিবারিকভাবে সচ্ছল পরিবারের সন্তান হয়েও স্বাধীনতার পর দেশের অধিকাংশ ব্যাংক ডাকাতির নায়ক ছিলেন কাজী আবু এমরান। জীবনের বেশ কিছু সময় তাকে জেলে কাটাতে হয়েছে। জীবদ্দশায় তিনি খুন, ডাকাতিসহ অপরাধের সব বিভাগেই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। করেছেন রাজনীতি। বিএনপির টিকিটে জাতীয় নির্বাচনেও অংশ নিয়েছেন। একসময় সব ছেড়ে ছুড়ে আধ্যাত্দিক জীবন বেছে নেন। তার মৃত্যুর পর তার কবর রাতারাতি মাজারে রূপ নেয়। ভক্ত আশেকানরা সেখানে যান। বছর বছর ওরসও হয় এমরানের মাজারে। ঘোড়াশাল বাজারের বড় মাজারটিই হলো এই কাজী আবু এমরানের মাজার। কাজী আবু এমরানের বাবা কাজী আবদুস সামাদ। গ্রামের বাড়ি ঘোড়াশালের পাঁচদোনা গ্রামে। ঢাকার জিগাতলায় তাদের বাড়ি। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে এসএসসি পাস করে এমরান ভর্তি হন তৎকালীন কায়েদে আযম কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। যুদ্ধের পুরোটা সময় তিনি ছিলেন জেলে। জেল থেকে বেরিয়ে এসে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। প্রথমে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), সেখান থেকে বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন। অতঃপর ভাসানী ন্যাপ (মশিউর)। ভাসানী ন্যাপ (মশিউর) বিএনপিতে বিলুপ্ত হওয়ার অনেক পরে এমরান বিএনপিতে যোগদান করেন।
এমরানকে খুব কাছ থেকে চেনেন এমন একজন তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, এমরানের কাছে অপরাধ ছিল এক ধরনের শিল্পিত কাজ। শিল্প সাহিত্যের মতোই সৃষ্টিশীল ওর অপরাধমূলককাণ্ড। টাকা পয়সার অভাব ছিল না। এরপরেও ব্যাংক ডাকাতি করত ধুমছে। তিনি খুন ডাকাতিসহ নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডের জন্যে দুর্ধর্ষ অপরাধী চক্র তৈরি করেছিলেন। সেই গ্রুপে রাজধানীর পেশাদার খুনি গুলিস্তানের জাফরসহ আরও বেশকয়েকজন চিহ্নিত খুনিও ছিল। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর এমরান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের ছয়তলার একটি কক্ষে ছিলেন দীর্ঘদিন। ১৯৭২ সালে তিনি বে-নজীর আহমেদের একমাত্র কন্যা মুন্নিকে বিয়ে করেছিলেন। পরবর্তীতে তার এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে তার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।
সূত্র জানায়, ১৯৭৫ সালে এমরান জেল থেকে ছাড়া পান। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি আবারও ব্যাংক ডাকাতি শুরু করেন। ওই সময়ে তিনি আবারও গ্রেফতার হন। জিগাতলা থেকে তিনি গ্রেফতারের আগে দেওয়াল টপকাচ্ছিলেন। এ সময় পিছন থেকে তাকে গুলি করা হলে তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তার সঙ্গে এ সময় গ্রেফতার হন তার তিন সহযোগী সাঈদ, বুলবুল এবং সাহাবুদ্দিন। এই তিনজনও ছিলেন সেই সময়ের দুর্ধর্ষ অপরাধী। রাজনীতিক মশিউর রহমানের প্রভাবে এমরান জেল থেকে মুক্তি পান। কিন্তু তার তিন সহযোগী মুক্তি পান না। এমরান মুক্তির এক মাস পরই জেল ভেঙে ওই তিনজন বেরিয়ে যায়। বাইরে থেকে তাদের সহযোগিতা করেন এমরান। এমরান তখন বিএনপিতে যোগদান করেন। এ সময় তার পরিকল্পনায় রাজধানীতে বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটলেও তিনি থাকতেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সূত্র জানায়, পরিবারের পীড়াপিড়িতে দেশ ছাড়েন এমরান। ১৯৭৭-এর শেষ দিকে তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে ইরান হয়ে জার্মান চলে যান। কিন্তু একটি বিশেষ মিশনে অংশ নিতে তিনি '৭৯-তে দেশে ফিরে আসেন। নিষ্ঠুরতা বাদ দেওয়ার জন্য তার স্ত্রী এ সময় বার বার মিনতি করলেও তিনি সাড়া দেননি। স্ত্রীকে বলেছিলেন, তার জীবনের একটি শেষ কাজ আছে। ওটা না করা পর্যন্ত তার শান্তি নেই। ওটাই হবে তার জীবনের শেষ কোনো অপরাধ।
সূত্র জানায়, ঘোড়াশালের রাজনীতির প্রতি দুর্বলতা ছিল এমরানের। সেখানকার শ্রমিক রাজনীতির উচ্চাশা নিয়ে শ্রমিক নেতা রহমানকে হত্যার পরিকল্পনা অাঁটে। তার মতে, এই রহমানই হলেন তার রাজনীতির চলার পথের সবচেয়ে বড় বাধা। যে কারণে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পর থেকেই সুযোগ-সুবিধা খুঁজছিলেন রহমানকে হত্যার জন্যে। একসময় সেই সুযোগ এসেও গেল। ১৯৮১ সালের ৭ মে রাজধানীর বিজয়নগরে তিনি সেই মিশন শেষ করেন। ৩৪ বছর আগে এক সন্ধ্যায় ফিল্মি কায়দায় হামলা চালিয়ে খতম করলেন শ্রমিক নেতা ঘোড়াশাল শ্রমিক লীগ সভাপতি আবদুর রহমান ও অর্থনৈতিক বিষয়ক প্রতিভাদীপ্ত সাংবাদিক বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার ফেরদৌস আলম দুলালকে। ১৯৮১ সালের ৭ মে দুলাল পিআইবিতে একটি কর্মশালায় ছিলেন। সেখান থেকে তিনি বাসস অফিসে ফিরেন। একটি রিপোর্ট জমা দিয়ে তিনি অফিসের নিচে যান। বাসসের নিচে ছিল শ্রমিক লীগের অফিস। দেখা হয় শ্রমিক লীগ নেতা আবদুর রহমানের সঙ্গে। আবদুর রহমান তাকে বলেন, দুলাল চল, মিজান কাকার (পরে এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী) বাসায় যাই। দুলাল তার কথায় রাজি হন। পল্টনের মোড় থেকে একটি রিকশায় চড়ে তারা রওনা হন। তাদের রিকশা বিজয়নগর মোড়ের মুক্তি ঔষধালয়ের সামনে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে একটি ভেসপা মোটরবাইক এসে তাদের রিকশার সামনে এসে ব্যারিকেড দেয়। ভেসপায় ছিল তিনজন। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই চালকের পেছনের দুজনের হাতের অস্ত্রগুলো গর্জে ওঠে। ফায়ার করতে থাকে তারা। এতে রহমানের শরীর ঝাঁজরা হয়ে যায়। দুলালের মাথা ভেদ করে একটি বুলেট। আরেকটি বুলেট তার পেট ঘেঁষে চলে যায়। দুজনই রিকশায় বসা অবস্থায় পেছন দিকে হেলে পড়েন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু ঘটে তাদের। এই জোড়া খুনের ঘটনায় কাজী এমরান ও আযম খানসহ কয়েকজনকে গ্রেফতারের পর বলা হয়, এরাই রহমান-দুলালের খুনি। তবে টার্গেট ছিল রহমান। দুলাল তাদের টার্গেট ছিল না।
দেশ কাঁপানো এই হত্যাকাণ্ডের পর সে রাতেই এমরান বিএনপি অফিসে যান। সেখানকার ফোন থেকে তার স্ত্রীকে কল করে জানিয়েছিলেন, 'মুন্নি আমার কাজ শেষ। আমি আসছি।' এই বলেই ফোন রেখে দেন এমরান। সেখান থেকে তিনি মুহসীন হলে যান। কাপড়-চোপড় গুছিয়ে বেরিয়ে পড়েন। জার্মানি থেকে এসে এমরান নয়াপল্টনের ভাসানী মসিউর স্মৃতি সংসদ অফিসে প্রতি সন্ধ্যায় আড্ডা দিতেন। সেখান থেকেই লোক মারফত খোঁজ নিতেন রহমানের গতিবিধির। রহমান-দুলাল হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেফতার হন এমরান। দীর্ঘদিন পর জেলে থেকে মুক্তি পান। তিনি চলে যান নিজ এলাকা ঘোড়াশালে। রাজনীতিতে মন দেন। বিএনপির রাজনীতিতে তিনি এলাকায় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। '৯১-এর জাতীয় নির্বাচনে তিনি বিএনপির হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে হেরে যান। এর পরের ইতিহাস নাটকীয়। নির্বাচনে পরাজিত হয়ে রাজনীতি থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করেন। রাজনীতি থেকে সরে এবার তিনি নিজেকে ভিন্ন রূপে উপস্থাপন করতে থাকেন। সাধারণ কাপড়-চোপড় ছেড়ে সাদা থান কাপড় পরিধান করতে থাকেন। চুল-দাড়ি কাটা বন্ধ করে দেন। আধ্যাত্দিক জীবন বেছে নেন তিনি। ধর্মীয় একটি তরিকার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলেন। আস্তানা গাড়েন নিজ এলাকার বাড়িতেই। লোকজন আসতে থাকেন তার কাছে। রীতিমতো তিনি ধর্মীয় মুরবি্বতে পরিণত হন। ১৯৯৭ সালের ৯ আগস্ট ঘটনাবহুল জীবনের অধিকারী আবু এমরানের মৃত্যু ঘটে। নিজ আস্তানার কাছেই তাকে দাফন করা হয়। সেখানেই তার কবর পরিণত হয় মাজার শরিফে। সেখানে নিয়মিত ভক্ত আশেকানরা আসেন। আগরবাতি দেন, মোমবাতি জ্বালান। প্রতিবছর তার মৃত্যুর দিনে সেখানে ওরস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রচুর লোক সমাগম হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন