অদৃশ্য ডন কালা জাহাঙ্গীর
ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ল্যাবরেটরিতে মানুষরূপী দানব বানিয়েছিলেন। পরে সেই দানবের হাতেই খুন হন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। বাংলাদেশেও অনেক ডনকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
মির্জা মেহেদী তমাল
২০১০ সালের ৯ এপ্রিল যশোরের বেনাপোলে গ্রেফতার হন ঢাকার রামপুরার সন্ত্রাসী শাহজাদা। এই শাহজাদা ছিলেন কালা জাহাঙ্গীরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। পুলিশের জেরার মুখে শাহজাদা জানান, ২০০৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর কালা জাহাঙ্গীর নিজ মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন। পরে গুলশানের কড়াইল এলাকার একটি কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। দাফনের সময় তাদের আরেক সহযোগী লম্বা শামীম উপস্থিত ছিলেন। সেই শামীমের কাছ থেকেই জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর সংবাদ পান বলে শাহজাদা পুলিশকে জানিয়েছেন। আরেক সূত্রের খবর, যশোরের সীমান্তবর্তী গহিন এলাকায় প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন কালা জাহাঙ্গীর। পরে তার মুখ ও শরীর এসিডে ঝলসে দেওয়া হয়। পুলিশ তাকে শনাক্ত করতে পারেনি। আবার এমন খবরও আছে, যমুনার পাড়ে তাকে হত্যার পর নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়। অপর একটি সূত্র জানায়, মোহাম্মদপুর কলেজ গেট এলাকায় নিটেলের বাসায় খুন হয় জাহাঙ্গীর। পরিকল্পিতভাবে তাকে
সেখানে গুলি করে হত্যা করে পিচ্চি হান্নান। সেখানে সাহেব আলি ও নিটেল উপস্থিত ছিল। এই তিনজন পরে ক্রসফায়ারে নিহত হয়। তবে কালা জাহাঙ্গীরের পরিবারের কাছেও নেই কোনো সঠিক তথ্য। তবে তাদের অনেকের দাবি, জাহাঙ্গীর জীবিত। নাম-পরিচয় পাল্টে ভিনদেশে বসতি স্থাপন করেছেন। স্ত্রী ও এক কন্যাসন্তান নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করে ভালোই দিন কাটছে তার। বাংলাদেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডের মোস্ট ওয়ান্টেড ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি এই কালা জাহাঙ্গীর। পুরস্কার ঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর মধ্যে এক নম্বরের দুর্ধর্ষ এই সন্ত্রাসীর বাঁচা-মরা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে যেমন নানামুখী তথ্য রয়েছে, তেমনি আন্ডারওয়ার্ল্ডে রয়েছে নানা গুজব আর কল্পকাহিনী। দেশের ইতিহাসে কালা জাহাঙ্গীরের মতো আর কোনো সন্ত্রাসীকে নিয়ে এমন গল্প-গুজব সৃষ্টি হয়নি। অন্ধকার জগতের মুকুটহীন এই ‘ডন’ এখন অনেকটাই ‘কিংবদন্তি’তে পরিণত। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর সব গ্যাংস্টারের কোনো না কোনো খোঁজ ইন্টারপোলসহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে রয়েছে। বাংলাদেশি এই দুর্ধর্ষ অপরাধীর কোনো খবর জানে না বাংলাদেশ পুলিশ ও আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল। কালা জাহাঙ্গীর ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড আসামি। তার বিরুদ্ধে ছয়জন ওয়ার্ড কমিশনারসহ ১২টি হত্যা মামলা রয়েছে। তার মধ্যে আটটিতে খালাস পেয়েছেন তিনি। অন্যগুলো বিচারাধীন রয়েছে। নানা রহস্যের স্রষ্টা এই অপরাধী এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন মাত্র একবার। তার একটি মাত্র ছবি রয়েছে পুলিশের কাছে। যা ১৮ বছর আগেকার। যে কারণে পুলিশ তাকে চেনে না। দৃশ্যমান না হলেও তার নামে নিয়মিত চাঁদা উঠছে। হালে আন্ডারওয়ার্ল্ডে কালা জাহাঙ্গীরকে ‘অদৃশ্য মানব’ বলা হয়ে থাকে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, কল্পকাহিনী আর গুজবের যত ঘটনাই থাক, কালা জাহাঙ্গীর মৃত না জীবিত- তা পুলিশ এখনো নিশ্চিত নয়। মোস্ট ওয়ান্টেড জাহাঙ্গীর পুলিশের খাতায় এখনো পলাতক। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, কোনো কিছু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত পলাতক হিসেবেই থেকে যাবে দুর্ধর্ষ এই ‘অদৃশ্য মানব’। কালা জাহাঙ্গীরের প্রকৃত নাম ফেরদৌস জাহাঙ্গীর। যিনি অপরাধের সব শাখাতেই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। দেশের দুর্ধর্ষ অপরাধীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন শক্তিশালী বাহিনী ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’। তার সংগ্রহে সবচেয়ে বেশি ক্ষুদ্রাস্ত্র ছিল বলে পুলিশের কাছে খবর ছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই রাজধানীতে সন্ত্রাসীদের শীর্ষ স্থানটি দখল করে নেন জাহাঙ্গীর। শাসন করেন আন্ডারওয়ার্ল্ড। তার বাহিনীর নামে কাঁপতো আন্ডারওয়ার্ল্ড। ঘুম হারাম ছিল পুলিশ ও গোয়েন্দাদের। ১৯৯২ সালের পর রাজধানীতে সংঘটিত আলোচিত খুনের অধিকাংশই ঘটেছে এই কালা জাহাঙ্গীরের হাতে। খুন আর চাঁদাবাজিতে শীর্ষে থাকা এই দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী এক সময় হয়ে ওঠেন ঢাকার ডন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই নয়, জাহাঙ্গীরের সঠিক কোনো তথ্য নেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের কোনো সদস্যের কাছেও। গোয়েন্দাদের কাছে যা রহস্যজনক। এখনো বড় মাপের কোনো সন্ত্রাসী ধরা পড়লে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়গুলোর মধ্যে কালা জাহাঙ্গীরের বিষয়টিও স্থান পায়। পুলিশ তাদের নানা প্রশ্ন করেন। জানতে চান, কালা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে তার যোগাযোগ বা সর্বশেষ কোথায় দেখা-সাক্ষাৎ বা কথা হয়েছে। কিন্তু সঠিক কোনো তথ্যই পুলিশ বিগত ১৫ বছরেও জানতে পারেনি। পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, এমন এক সময় গেছে যখন কালা জাহাঙ্গীরকে পাকড়াও করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল মরিয়া। বিশেষ করে ৯৬’ এর জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে কালা জাহাঙ্গীরকে ধরতে পুলিশ ও গোয়েন্দারা ব্যাপক তৎপরতা চালায়। ওই নির্বাচনে কালা জাহাঙ্গীর বিএনপির এক প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে ভোলায় গিয়েছিলেন। জাহাঙ্গীরের সঙ্গে বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। পুলিশের কতিপয় সদস্যের সঙ্গেও ছিল তার গভীর সম্পর্ক। পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, নিহত বা নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ প্রচার করাটা কাউকে রক্ষা করার একটি কৌশল। এমন তথ্য ছড়িয়ে পড়ার পর সাধারণত পুলিশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটিকে গ্রেফতারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এই সুযোগে দেশত্যাগ বা পরিচয় পাল্টে আত্মগোপনে চলে যায় অপরাধীরা। কালা জাহাঙ্গীরের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটতে পারে বলে ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা। কালা জাহাঙ্গীরের ঘনিষ্ঠ লোকজনও তার সম্পর্কে জানবে না, এটি অবিশ্বাসযোগ্য। এ ছাড়া কালা জাহাঙ্গীরের স্পষ্ট কোনো ছবি না থাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাকে চেনে না। হদিস না মিললেও আন্ডারওয়ার্ল্ডে কালা জাহাঙ্গীর এখনো জীবন্ত।
যেভাবে কালা জাহাঙ্গীর : অনুসন্ধানে জানা যায়, বগুড়ার ছেলে ফেরদৌস জাহাঙ্গীরের জন্ম ১৯৭৭ সালে। বাবার নাম গোলাম রহমান। বগুড়ার ধুনট থানার বনানীগাঁও তাদের গ্রামের বাড়ি। তার স্কুলশিক্ষিকা মা তাকে রাজধানী ঢাকায় নিয়ে আসেন। ঢাকায় তার মায়ের সঙ্গে ইব্রাহিমপুরের ১৩১/১ নং আদর্শপল্লীর বাসায় থাকতেন। ১৯৯২ সালে এসএসসিতে পাঁচ বিষয়ে লেটারসহ স্টার মার্ক পেয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখিয়েছিলেন তিনি। ভর্তি হন তেজগাঁও কলেজে। তবে কাফরুল এলাকার লিটন আর মাসুম নামে দুই যুবকের সঙ্গে বিরোধ হয় জাহাঙ্গীরের। শান্ত-ভদ্র জাহাঙ্গীর তাদের ছুরি মেরে বসে। এ ঘটনায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এরপর ২১ দিনের হাজতবাস। এই হাজতবাসই পাল্টে দেয় সবকিছু। শুরু হয় অন্ধকার জগতের এক নতুন জীবন। কম কথা বলা ভদ্র-নম্র এই জাহাঙ্গীর এক সময় হয়ে ওঠেন হিংস্র। ফেরদৌস জাহাঙ্গীর থেকে হয়ে ওঠেন কালা জাহাঙ্গীর। গড়ে তোলেন ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’। অবৈধ অস্ত্রের মজুদও ছিল এই কালা জাহাঙ্গীরের কাছেই। তার হাতে একে একে খুন হতে থাকেন ওয়ার্ড কমিশনার, আইনজীবী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে ব্যবসায়ী। অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে থাকেন জাহাঙ্গীর। নতুন এক ডনের আবির্ভাবে আন্ডারওয়ার্ল্ডে শুরু হয় অস্থিরতা। রাজধানীর দুর্ধর্ষ এই সন্ত্রাসীর হাতেই সবচেয়ে বেশি আলোচিত খুনের ঘটনাগুলো ঘটেছে। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এবং এর পরবর্তী সময়ে ঢাকা শহরের চাঁদাবাজির অনেকাংশই তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ১৯৯৬ সালে কিসলু হত্যার মধ্যদিয়ে পেশাদার কিলার হিসাবে নাম লেখান জাহাঙ্গীর। এরপর কিরন হত্যা, আইনজীবী হাবিব মণ্ডল, আদালত পাড়ায় মুরগি মিলন, কমিশনার শাহাদত, কমিশনার নিউটন হত্যাসহ আলোচিত বেশ কয়েকটি খুনে নিজেই অংশ নিয়ে গুলি চালান জাহাঙ্গীর। আন্ডারওয়ার্ল্ডে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন সে। তার যোগাযোগ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, শীর্ষ সন্ত্রাসী হওয়ার পর পুলিশ তাকে কখনো গ্রেফতার করতে পারেনি। তার অবস্থান কখন কোথায় তা তার ঘনিষ্ঠ দু’একজন ছাড়া আর কেউ জানতে পারত না। যে কারণে প্রতিপক্ষরাও তাকে পাকড়াও করতে পারত না। ২০০১ সালে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিলে পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। এই তালিকায় তার নাম রাখা হয় সর্ব শীর্ষে। এরপরই আত্মগোপনে চলে যান জাহাঙ্গীর।
কালা জাহাঙ্গীর জীবিত! : ‘প্রতিকূল পরিবেশ হলে আন্ডারওয়ার্ল্ডের টপ হিরোদের তিনটি পথ বেছে নিতে হয়, আজীবন জেলে থাকা, না হয় প্রতিপক্ষের হাতে খুন হওয়া অথবা দেশ ত্যাগ করা। এ ছাড়া চতুর্থ কোনো পথ আর খোলা নেই। যারা ভিরু তারা কোনো কিছু না বুঝে আত্মহত্যা করেন।’ এ কথাগুলো কালা জাহাঙ্গীরের। তার এক আত্মীয়ের কাছে এভাবেই কথাগুলো বলেছিলেন আজ থেকে ১৫ বছর আগে। জাহাঙ্গীরের পরিবারের অনেকেই তাই আত্মহত্যার ঘটনাটি কখনো বিশ্বাস করেনি। তাদের দাবি জাহাঙ্গীর আত্মহত্যা করতে পারে না। বরং তিনি জীবিত আছেন। ভালো আছেন। ভারতের ব্যাঙ্গালোর সিটিতে বসবাস করছেন এবং সেখানেই এক কন্যাসন্তানের বাবা হয়েছেন। এটাই বিশ্বাস তার গ্রামের বাড়ি বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনাপাড়ের কামালপুর এবং বর্তমানে তার মায়ের বসবাসস্থল ও শেরপুরের লোকজনের। তারা বিভিন্ন সূত্রে খবর পেয়েছেন, জাহাঙ্গীর ভারতের ব্যাঙ্গালোর শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন এবং সেখান থেকে হংকং, সিঙ্গাপুর, নেপাল, ভুটানসহ অন্যান্য জায়গায় ব্যবসা করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পুলিশের খাতায় নিশ্চিত না হয়ে কারও মৃত্যু হয়েছে এমন রেকর্ড রাখা হয় না। কালা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে এখনো অনেক জায়গায় মামলা রয়েছে। সেখানে তাকে মৃত বলে দেখানো হয়নি। পুলিশের খাতায় তিনি এখনো ফেরারি আসামি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন