বৈঠকী খুনের জনক আকবর শেঠ
ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ল্যাবরেটরিতে মানুষরূপী দানব বানিয়েছিলেন। পরে সেই দানবের হাতেই খুন হলেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। বাংলাদেশেও অনেক ডনকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
মির্জা মেহেদী তমাল
১৯৮০ সাল। বর্ষাকাল। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকার কেরানীগঞ্জের রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। লোকজন খুব একটা নেই। দোকানপাটও বন্ধ। সেখানকার একটি এলাকার নাম বরিসুর। সন্ধ্যা থেকে চার রাস্তার মোড়ের একটি টিনশেডের বাসায় তখন খুব হৈহুল্লোড়। গান বাজছে উচ্চৈঃস্বরে। মদের নেশায় চুর ৮-১০ জন যুবক। নিজেরাই নিজেদের মধ্যে চিৎকার-চেঁচামেচি করে যাচ্ছে। তাদের সেই আনন্দ উল্লাস আর চিৎকারের শব্দ প্রবল বর্ষণের শব্দের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। রাত ৯টায় হঠাৎ পাঁচ-ছয় জন অস্ত্রধারীর আগমন। তাদের দুজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। বাকিদের হাতে ক্ষুরধার রামদা আর চাপাতি। ওরা মদের আসরে ঢুকেই বুঁদ হয়ে থাকা যুবকদের মধ্যে দুজনকে আলাদা করে নিল। সেখানেই চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়িভাবে কুপিয়ে শরীর ছিন্নভিন্ন করে ফেলল। মৃত্যু নিশ্চিত করতে দুজনের বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি চালাল। রক্তাক্ত নিথর দুটি দেহ গাড়িতে তুলে তারা লাপাত্তা। পরে ওই দুজনের লাশ মিলল নদীর ধারে। দাওয়াত কবুল করে মদের আসরে এসে
এভাবেই নির্মম খুনের শিকার হন আইয়ুব ও মিন্টু নামে দুই যুবক। আর তাদের দাওয়াত করে এনেছিলেন পুরানা ঢাকার তৎকালীন সন্ত্রাসের গডফাদার আকবর হোসেন, যিনি আকবর শেঠ নামেই পরিচিত। দাওয়াত দিয়ে এনে আইয়ুব আর মিন্টুর খুনের মতো এমন অসংখ্য খুন করেছেন এই আকবর শেঠ।
জানা গেছে, দাওয়াত দিয়ে খুন করার এ কৌশলটি আন্ডারওয়ার্ল্ডে 'বৈঠকী খুন' নামে পরিচিত, যার জনক বলা হয়ে থাকে আকবর শেঠকে। সেই সময়ে 'বৈঠকী খুন' খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে খুনিদের কাছে। বৈঠকী খুনের কারণেই এখনো পুরানা ঢাকায় কেউ কখনো দাওয়াত বা বৈঠকের কথা বললে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সদস্যরা তা কবুল করেন না। আকবর হোসেন ওরফে আকবর শেঠের বাসা নয়াবাজারের আইউবউল্লাহ সড়কে। জিয়া সরকারের আমলে তিনি ছিলেন নয়াবাজার থেকে শুরু করে সদরঘাট পর্যন্ত গোটা এলাকার ত্রাস। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, সেই সময়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে কারও কথা বলার সাহস ছিল না। রংবাজি আর মাস্তানিতে আকবর শেঠের নাম তখন মানুষের মুখে মুখে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন, এমন কাউকে তিনি এ দুনিয়াতেই রাখতেন না। তার মাস্তানি এমনই এক পর্যায়ে উঠেছিল, শখ করে এলাকার লোকজন আকবর নামের শেষে 'শেঠজি' জুড়ে দিয়েছিলেন। তবে সাধারণ মানুষ তা খুব একটা জানতেন না। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আরমানিটোলা স্কুলের মাঠে একটি জনসভায় অংশ নেন। বিএনপির ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা এই আকবর সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কথিত আছে, জিয়াউর রহমান তাকে 'আকবর শেঠ' সম্বোধন করে ডাক দিয়ে মঞ্চে আসতে বলেন। সেই তখন থেকেই তার আসল নাম আকবর হোসেনের স্থলে হয়ে যায় আকবর শেঠ।
আকবর শেঠের অন্যতম শিষ্য ছিলেন নয়াবাজারের আরেক ত্রাস আলীজান। বৈঠকের আয়োজন করতেন আকবর শেঠ, আর তার শিষ্য আলীজানকে দিয়েই দাওয়াত দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। সেই দাওয়াতে এসেই বহু লোক প্রাণ হারিয়েছেন। এমন গল্প আছে নয়াবাজারের মানুষের মুখে মুখে। মাস্তানিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে বার্ধক্যের কোঠায় পা রেখে ব্যবসা, সমাজসেবা, জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে খ্যাতির শীর্ষে উঠে এসেছিলেন আকবর শেঠ। ঠিক ওই সময়ই তিনি নির্মম খুনের শিকার হলেন। খুন হলেন শিষ্যের হাতেই। ক্ষমতার লোভ, লালসা থেকে সৃষ্টি হওয়া পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটান শিষ্য আলীজান। যে এলাকায় বুক চিতিয়ে হাঁটতেন আকবর শেঠ, সেই নিজ এলাকাতেই তাকে দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে খুন করেছেন আলীজান ও তার সহযোগীরা।
সূত্রগুলো জানায়, পুরান ঢাকা এমনই এক রহস্যময় জটিল জায়গা, যেখানে অলিতে গলিতে স্বল্পপরিসরে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য চলে। প্রকৃত বাণিজ্যের আড়ালে অবৈধ বাণিজ্য করে থাকেন সেখানকার কিছু ব্যবসায়ী। ব্যবসাবান্ধব এই পুরান ঢাকার সব কিছুই ছিল আকবর শেঠের নিয়ন্ত্রণে। শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যই নয়, সেখানকার আচার-বিচার, সব কিছুই হতো আকবর শেঠকে ঘিরে। একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রেখেছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে গোপনে গোপনে সংগঠিত হলেও, প্রকাশ্যে কেউ কখনো তার সামনে দাঁড়াতে পারেননি। পুরান ঢাকার পশুর হাট থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক বিষয়গুলোও দেখতেন আকবর শেঠ। কিন্তু দিন যত এগোতে থাকে ভিতরে ভিতরে তার শত্রুপক্ষ সংগঠিত হতে থাকে।
আকবর শেঠের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, যৌবনের সেই মাস্তানির ঘারানা থেকে ধীরে ধীরে সরে আসতে থাকেন আকবর শেঠ। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার কিছু কিছু বিষয় থেকে সরে আসতে পারেননি। কিন্তু ঘরের শত্রু বিভীষণ- এ প্রবচনটি ভুলে গিয়েছিলেন আকবর শেঠ। ১৯৯১ সালের জুলাইয়ে নয়াবাজার গরুর হাট নিয়ে তার শিষ্য আলীজানকে বকাঝকা দেন আকবর শেঠ। দুই দিন পর অন্য একটি পারিবারিক বিষয় নিয়ে আলীজানের ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন আকবর শেঠ। রাস্তায় শত শত লোকের সামনে আলীজানের গালে চড় মারেন আকবর শেঠ। এতে আলীজানের আত্দসম্মানে লাগে। সেখানে আলীজানের ভাতিজা ও তাদের বন্ধুবান্ধবও ছিল। ক্ষোভে আলীজান সেখান থেকে চলে যান। আলীজানের ভাতিজা আসাদসহ অন্যরা আলীজানকে বলতে থাকেন, তারা এর চরম প্রতিশোধ নেবেন। তাদের এ প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা জেনে যান আকবর শেঠ। পরে এলাকার লোকজন দিয়ে আলীজানকে ডেকে আনা হয় আকবর শেঠের সামনে। সেখানে সমঝোতা হয় তাদের। আর এর জন্য আকবর শেঠ আলীজানকে ২০ হাজার টাকাও দেন। তারা কোলাকুলি করে যে যার দিকে চলে যান। সূত্র জানায়, উপর দিয়ে ঘটনার নিষ্পত্তি ঘটলেও পুরান ঢাকার প্রসিদ্ধ ব্যবসা কেন্দ্রের আধিপত্য বিস্তার ও সুযোগ-সুবিধার বহু বিতর্কিত ঘটনার ঝগড়া নেপথ্যে থেকেই যায়; যা খুনের মধ্য দিয়ে পুরনো শত্রুতার নিষ্পত্তি ঘটে। ১৯৯১ সালের ১৩ আগস্ট। আকবর শেঠ তার বন্ধু সুলতানকে নিয়ে রাত পৌনে ১২টার দিকে নয়াবাজার তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পারভেজ ট্রান্সপোর্ট থেকে বাসায় ফিরছিলেন। তারা ছিলেন রিকশায়। বাসার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন তারা। কিন্তু গলির ভিতরেই ওত পেতে বসে ছিল খুনির দল। তাদের মধ্যে ছিলেন আলীজান, ফজলু, নাইয়ুম, আলীজানের ভাতিজা আসাদসহ আরও কয়েকজন। চাপাতি আর রামদা নিয়ে রিকশার পেছন থেকে তারা হামলা চালান। চাপাতির কোপে রক্তাক্ত আকবর শেঠ রিকশা থেকে রাস্তায় পড়ে যান। তার বন্ধুর শরীর থেকেও বের হচ্ছে রক্ত। তিনি রিকশা থেকে নেমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে টিপু সুলতান রোডের দিকে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন। কিন্তু রক্তাক্ত আকবর শেঠ আর উঠতে পারছিলেন না। জনাকীর্ণ ওই রাস্তায় খুনিরা তাকে এলোপাতাড়ি কোপাচ্ছিলেন। একজন গলায় পোঁচ দিতে শুরু করেন। শেষে আকবর শেঠকে কয়েক রাউন্ড গুলি করা হয়। খুনিরা তাদের মিশন শেষ করেই গুলি করতে করতে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।
১৯৭৮ সাল থেকে রংবাজি শুরু করা ঢাকার এই ডন ছিলেন অত্যন্ত শৌখিন। হালকা পাতলা গড়নের এই লোকটি সাদা পোশাক পরতে ভালোবাসতেন। নয়াবাজারের ব্যবসায়ীদের অনেকেই বলেছেন, রংবাজি করতে আকবর শেঠের অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল না। তার এক হুঙ্কার ছিল তপ্ত বুলেটের চেয়েও ভয়ঙ্কর। আকবর শেঠকে খুনের দায়ে আলীজান এখন জেলে। অন্য আসামি ফজলু জেলে থাকতেই মারা যান। ভাতিজা আসাদ আছেন বিদেশে। পুলিশের কাছে খবর আছে, তিনি এখন ইতালিতে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন