জাতির পিতা প্রস্তাব : স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলীর অতৃপ্তি; মেজর (অব.) মো. আখতারুজ্জামান

শেখ রাজ্জাক আলী চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৯১ সালের এপ্রিলে তিনি যখন ডেপুটি স্পিকার হলেন। আমরা অনেকেই প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে এসেছি। নতুন গণতান্ত্রিক সরকার হবে। দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। সবারই উৎসাহ-উদ্দীপনা তুঙ্গে। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অবিশ্বাস্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা দেশে-বিদেশে সবাই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ তড়িৎ সংবাদ সম্মেলন করে এক অদৃশ্য শক্তির গোপন অাঁতাতের মাধ্যমে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলে দাবি করেছিল। যাই হোক, ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ৩০০ আসনের ২৯৪টির মধ্যে বিএনপি ১৪০টি, আওয়ামী লীগ ৮৪টি, জাতীয় পার্টি ৩৫টি, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াত ১৮টি, সিপিবি ৫টি, বাকশাল ৪টি, ন্যাপ ১টি এবং অন্যান্য দল ও স্বতন্ত্র ৭টি আসন পেয়েছিল।
১ মার্চ বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুরু হয়ে গেল ষড়যন্ত্রের নতুন খেলা। বিএনপিকে বাদ দিয়ে অন্য সব দলকে
ঐক্যবদ্ধ করার খেলা সেদিন থেকে শুরু হলো। আওয়ামী লীগ, জাপা, জামায়াতসহ বাকি সব ছোট দল নিয়ে একটি নতুন অাঁতাত তৈরি করে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতীয়মান করে দেওয়া যে, বিএনপি ছাড়া বাকি দলগুলো ঐক্যবদ্ধ এবং তারা সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ। অতএব অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন যেন নতুন জোটের নেতা বা নেত্রীকে সরকার গঠন করার আহ্বান জানান। কিন্তু সেদিন জামায়াত বেঁকে বসেছিল। জামায়াত সেদিন জানিয়ে দিয়েছিল তারা পতিত স্বৈরাচার এরশাদের সঙ্গে যাবে না। জামায়াত যদি সেদিন এরশাদের সঙ্গে যেতে রাজি হতো তাহলে বিএনপির বিপক্ষে আওয়ামী লীগের ৮৪, জাপার ৩৫, জামায়াতের ১৮ ও কমিউনিস্টদের ৫, বাকশালের ৪ এবং স্বতন্ত্র ও অন্যদের মিলে আওয়ামী লীগের পক্ষে হতো ১৫৪, যা সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট ছিল। ৪ মার্চ '৯১ সালে সন্ধ্যায় জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে সাংবিধানিক মীমাংসা ছাড়া মন্ত্রিপরিষদ গঠন না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন কিন্তু সেদিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবার আওয়ামী লীগ নেতাদের জানিয়ে দেন কাউকে প্রধানমন্ত্রী বানালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির নিরপেক্ষতা হারানোর কোনো সম্ভাবনা ছিল না। পর দিন ৫ মার্চ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ৫ এপ্রিল, ১৯৯১ সংসদের অধিবেশন আহ্বান করেছিলেন। একই দিনে গণতন্ত্রী পার্টি, বাকশাল, ন্যাপ ও সিপিবি সংসদীয় পদ্ধতিতে রাজি হলে বিএনপিকে সমর্থন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল।
১১ মার্চ, ১৯৯১ সাল। জাতির জীবনের আরেকটি অশুভ দিন। সেদিন জামায়াত অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে সরকার গঠনে বিএনপিকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে আসে। সেদিন থেকে অশান্তির পথে বাংলাদেশের রাজনীতির পথচলা শুরু হয় যার অবসান আজও হয়নি। সেদিন জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন না দিলে কী হতে পারত? তখনো ৬টি আসনের নির্বাচন শেষ হয়নি। ওই সময় সরকার গঠনের জন্য ১৪০টি আসন পাওয়া বিএনপিকে সরকার গঠন করতে আর মাত্র ৭টি আসনের প্রয়োজন ছিল। অথচ ৫ মার্চ '৯১ গণতন্ত্রী পার্টি, বাকশাল, ন্যাপ ও সিপিবি ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি যদি সংসদীয় পদ্ধতিতে রাজি থাকে তাহলে তারা বিএনপিকে সমর্থন দেবে। সেদিন গণতন্ত্রী পার্টি, বাকশাল, ন্যাপ ও সিপিবির মোট আসন ছিল ১১টি যা বিএনপির সরকার গঠন করার জন্য যথেষ্ট ছিল। বিএনপি সেদিন সে পথে না হেঁটে প্রয়াত বিএনপি নেতা মতিন চৌধুরীর চালে পা দিয়ে জামায়াতের খপ্পরে পড়ে। সেদিন যদি ওই রকম একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত না নিয়ে বামদের পরামর্শ মতো সংসদীয় ব্যবস্থায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারত তাহলে জামায়াতের সঙ্গে অাঁতাত করার ঐতিহাসিক ভুলটি বিএনপিকে করতে হতো না এবং জামায়াতেরও বর্তমান দুরবস্থা হতো কি না তার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তখন বিএনপির স্বপ্ন ছিল রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা। কিন্তু ওই সময় এরশাদের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা থাকায় রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার বাস্তবতা ছিল না। কিন্তু মতিন চৌধুরীদের মতো পাকিস্তানঘেঁষা তখনকার কতিপয় রাজনৈতিক নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার অলীক স্বপ্ন দেখিয়ে নেত্রীকে বিভ্রান্ত করে ফেলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত বিএনপি রাষ্ট্রপতির শাসনব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছিল কিন্তু ততদিনে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে এবং সে ক্ষতি থেকে বিএনপি আর কখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি।
ইতিহাস কী নির্মম, মতিন চৌধুরী তার ব্যক্তিগত উচ্চাশা ও অভিলাষ পূরণ করতে গিয়ে সারা জাতিকে এক মহাদুর্যোগের মধ্যে ফেলে দিয়ে গেছেন, যার গোলক-ধাঁধা থেকে জাতি এখনো বেরিয়ে আসতে পারছে না। সেদিন জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন নয় তাদের মৃত্যু পরোয়ানা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে দিয়ে এসেছিল। সেদিন যদি তারা সরকার গঠনের প্রক্রিয়ার ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ না করত তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতো কি না তা নিয়ে অনেকের মনে সন্দেহ আছে। মতিন চৌধুরীর অভিলাষ ও ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশের পাকিস্তানপন্থি বলে এক অদ্ভুত রাজনীতির জন্ম হয়েছে যার কোনো বাস্তবতা নেই কিন্তু অপবাদ ও অপপ্রয়োগ আছে এবং এই কলঙ্ক নিয়ে বিএনপি এক অন্ধকার রাজনীতির আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। মতিন চৌধুরীর সেদিনের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কারণে বিএনপিকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের পক্ষে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যার দায়দায়িত্ব নিয়ে বিএনপিকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, মতিন চৌধুরীদের ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতির কারণে '৭৯-এ জন্ম নেওয়া বিএনপিকে '৭১-এর অপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে। '৯১ সালে সরকার গঠনের অপ্রয়োজনীয় ও অশুভ অাঁতাত বিএনপির বর্তমান প্রজন্মের রাজনীতিতে ভুল অবস্থান সৃষ্টি করে দিয়েছে, যার ফলে বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা ও বিএনপির রাজনীতি এক সমার্থক পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু '৭১ ও '৭৫-এর ১৫ আগস্টের দায়দায়িত্ব বিএনপির ওপর যে বর্তায় না সে কথাটিও বিএনপি আজকে স্পষ্ট করে বলতে সাহস পায় না। তাই বলা যায়, ১১ মার্চ '৯১ বিএনপি ও জামায়াতের এক অশুভ দিনক্ষণ।
১১ মার্চের পর দ্রুত রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হতে থাকে। অবশেষে ১৫ মার্চ '৯১ সালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি উপদেষ্টা পরিষদ বিলুপ্ত করে দেন। আওয়ামী লীগ ও সিপিবি বাদে ১৭ মার্চ '৯১ সালে ১২ জন এবং ১৮ মার্চ ১৫৩ জন সংসদ সদস্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে শপথ গ্রহণ করেন। এক ঐতিহাসিক পটভূমিকায় গণতন্ত্রের প্রতি সম্মান জানাতে গিয়ে পতিত স্বৈরাচার সরকারের স্পিকারের কাছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা শপথ নিতে পারেন না, তাই সেদিন সবাই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে শপথ নিয়েছিলেন। তারপরে ১৯ মার্চ '৯১ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি তখনকার সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী করে ১০ জন পূর্ণমন্ত্রী ও ২১ জন প্রতিমন্ত্রীর এক মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। একই দিনে আওয়ামী লীগ ও সিপিবির সংসদ সদস্যরাও শপথ গ্রহণ করেন। ২০ মার্চ, ১৯৯১ সালে দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া শপথ গ্রহণ করেন। কিন্তু অত্যন্ত ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত মতিন চৌধুরী সেদিন শপথ নেননি। তার সে ঔদ্ধত্যপনার জন্য মতিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা উল্টো তাকে পরবর্তীতে পূর্ণমন্ত্রী করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। মজার বিষয় হলো, রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থায় যাওয়ার জন্য মতিন চৌধুরী গং তড়িঘড়ি করে মুক্তিযুদ্ধের শত্রু জামায়াতের সঙ্গে ১১ মার্চ '৯১-এ বিএনপির সঙ্গে অাঁতাত করলেন, সেই মতিন ২০ মার্চ '৯১ শপথ না নেওয়ার কারণ হিসেবে বললেন সংসদীয় পদ্ধতির সরকার না হলে তিনি মন্ত্রী হবেন না। সেলুকাস, কী বিচিত্র এ দেশ এবং এ দেশের মানুষ, যেখানে সব কিছুই সম্ভব। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই মতিন চৌধুরী ও তার গংদের জন্য বিএনপির ভরাডুবি হয়েছিল।
২১ মার্চ '৯১ সরকারিভাবে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাকে বিরোধী দলের নেত্রী ঘোষণা করা হয়। ২৭ মার্চ '৯১ মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইলাম প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান। লক্ষণীয় নতুন মন্ত্রিপরিষদ শপথ নেওয়ার সাত দিন পর মার্কিন সরকার বিএনপি সরকারকে অভিনন্দন জানায়, যা কোনো অবস্থাতেই স্বাভাবিক বা সৌজন্যমূলক ছিল না। কারণ, তখন বিএনপি ক্ষমতায় আসবে তা মার্কিনিরাসহ কোনো পশ্চিমা রাষ্ট্রের মূল্যায়নে ছিল না। শুধু তাই নয়, ওই সময় পর্যন্ত বিএনপি তথা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে পরাশক্তিদের কোনো সংযোগ বা সম্পর্ক ছিল না। এমনকি ২০ মার্চ শপথ নেওয়ার অনুষ্ঠানটিও ছিল খুবই অনাড়ম্বর। শপথের পরে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের সময় সেখানে কোনো গার্ড অব অনার ছিল না এবং ছিল না কোনো ফুলের মালা। দেশের ভিতরে এবং বাইরে কেউই সেদিন বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখতে চায়নি। চাটুকারিতা নয় বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বলছি, সেদিন বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব হয়েছিল শুধু বেগম খালেদা জিয়ার স্নায়ুর প্রচণ্ড শক্তির কারণে। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের অভিনন্দন জানানোর পর দিন ২৮ মার্চ '৯১ সংসদের ৩০টি মহিলা আসনের ২৮টি বিএনপি এবং ২টি জামায়াতকে বণ্টন করার পর তারা ওই দিনই বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একসঙ্গে চলার আরেকটি সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল এবং দুটি দলের পরস্পরবিদ্বেষের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। সেদিন যদি সংসদের মহিলা আসনগুলো নিজেদের স্বার্থে শুধু নিজেদের বলয়ে বিলি-বণ্টন না করে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের মধ্যে বিলি-বণ্টন করে দেওয়া হতো তাহলে সেই মহৎ ও সঠিক কাজের ফলাফল বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবহমানকাল জারি থাকত। হয়তো ওইভাবে সেদিন সংসদের মহিলা আসন বণ্টনের কারণে রাজনৈতিক বিদ্বেষ কিছুটা হলেও কমে আসত। তা ছাড়াও মহিলা আসন সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের মধ্যে বিলিবণ্টনের একটি নতুন ইতিবাচক ধারা সৃষ্টি হতো, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হতো। কিন্তু সেই বিচক্ষণ ও সুদূরপ্রসারী চিন্তার অধিকারী রাজনীতিবিদের বড় আকাল আমাদের। সময় তার আপন খেয়ালে চলতে থাকল। ৪ এপ্রিল '৯১-এর রাতে বিএনপির সংসদীয় সভায় আবদুুর রহমান বিশ্বাসকে স্পিকার ও শেখ রাজ্জাক আলীকে ডেপুটি স্পিকার মনোনীত করা হয়। পর দিন ৫ এপ্রিল '৯১-এ পঞ্চম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয় এবং জাতীয় সংসদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিভক্তি ভোটে আবদুর রহমান বিশ্বাসকে স্পিকার ও শেখ রাজ্জাক আলীকে ডিপুটি স্পিকার নির্বাচিত করা হয়। সেই থেকে শেখ রাজ্জাক আলীর সঙ্গে আমার পরিচয় ও সম্পর্ক। শেখ রাজ্জাক আলী প্রথমে জামায়াতের সমর্থনে ডেপুটি স্পিকার হতে রাজি ছিলেন না, কারণ তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির দাবিদার ছিলেন। পরে যখন জানতে পারলেন জামায়াত শুধু বিএনপিকে সরকার গঠনেই সমর্থন দেবে না স্পিকার আবদুর রহমান বিশ্বাসকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দিলে তাকে ভোটও দেবে তখন রাজ্জাক আলী তাকে স্পিকার করতে হবে এই শর্তে জামায়াতকে মেনে নিলেন। এর পরের ইতিহাস সবারই কম-বেশি জানা। বিএনপিতে কোণঠাসা হয়ে গেলেন মুক্তিযোদ্ধারা আর অন্যদিকে জামায়াত-আওয়ামী লীগ পরস্পর জানিদুশমন হয়ে গেল, যার খেসারত জাতি আজও দিয়ে যাচ্ছে।
আমি শেখ রাজ্জাক আলীর খুবই আস্থাভাজন একজন সংসদ সদস্য ছিলাম। তিনি মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে তার রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা শেয়ার করতেন। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক হিসেবে আমাদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস ছিল। সংসদে আমার বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ এলে আমি সম্মানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলতাম যার জন্য তিনি আমার প্রশংসা করতেন। তা ছাড়া সংসদীয় সরকার গঠনের প্রক্রিয়ায় আমি দলের ভিতর সোচ্চার কণ্ঠ ছিলাম বলে শেখ রাজ্জাক আলী আমাকে খুবই স্নেহ করতেন এবং খুবই আস্থায় রাখতেন। একদিন সংসদে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা সম্পর্কিত এক আলোচনায় আমার ইতিবাচক মন্তব্য ও শ্রদ্ধাবোধের প্রসঙ্গ ধরে স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী আমাকে একদিন প্রশ্ন করলেন, যেহেতু আমি বঙ্গবন্ধুকে সম্মান করে কথা বলি এবং জাতির পিতা হিসেবেও স্বীকার করি তাহলে জাতির পিতার একটি বিল আমি কেন সংসদে আনি না। বিষয়টি ওই সময় খুবই স্পর্শকাতর ছিল, তাই আমি প্রথমে শেখ রাজ্জাক আলীর কথাটি বুঝতে পারিনি। পরে তিনি আমাকে আদ্যোপান্ত বুঝিয়ে বললেন। তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা ছিল কেউ যদি সংসদে জাতির পিতার বিল আনে তাহলে তিনি তা সংসদে উত্থাপনের অনুমতি দেবেন। আমি তখন ম্যাডাম ও দলের অন্য নেতাদের বিরূপ মনোভাবের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি আমাকে বললেন, ম্যাডামের মনোভাব ইতিবাচক এবং আরও অনেক সিনিয়র নেতার সমর্থন পাওয়া যেতে পারে। তিনি এ বিষয়টি নিয়ে আমাকে বেশ কয়েকবার তাড়া দিয়েছিলেন কিন্তু আমি সাহস পাইনি। কারণ ততদিনে বিএনপিতে আমার অবস্থান অনেক নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। তা ছাড়া শেখ রাজ্জাক আলীর সঙ্গে ভারতে সার্কের স্পিকার সম্মেলনে গিয়ে ফারাক্কার পানির দাবিতে জোরালো বক্তব্য দিলে আমি উভয় সরকারের রোষানলে পড়ি। দিল্লিতে বাংলাদেশের তৎকালীন হাইকমিশনার আমার বক্তব্যকে ভারতবিদ্বেষী বলে আমার বিরুদ্ধে একটি গোপন প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেন, যার ফলে আমি তখন খুব বেকায়দায় ছিলাম। তবে সেদিন যদি সাহস করে জাতির পিতার প্রস্তাবটি সংসদে উপস্থাপন করতে পারতাম তাহলে আমিও ইতিহাসের পাতায় শেখ রাজ্জাক আলীর নামটি লেখার অনুঘটক হতে পারতাম। কিন্তু নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সেদিন জাতির পিতার প্রস্তাবটি সংসদে উত্থাপন করতে আমি চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি, যার জন্য আমি তার বিদেহী আত্দার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।
শেখ রাজ্জাক আলী অনেক বেদনা ও অতৃপ্তি নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমি তার অনুরোধ রাখতে পারিনি। আমাদের গণতান্ত্রিক পথচলার পেছনে শেখ রাজ্জাক আলীর অবদান হয়তো আমরা অনেকে স্বীকার করতে চাইব না, কিন্তু তিনি একজন গণতান্ত্রিক মানুষ ছিলেন এবং জাতির গণতান্ত্রিক পথযাত্রায় তার অনেক অবদান আছে। তিনি ম্যাডামের প্রতি অকৃত্রিম অনুগত ছিলেন। যে কারণে শেখ রাজ্জাক আলীর মতো নেতারা ম্যাডামের কাছ থেকে ছিটকে গেছেন, তার কারণ আমরা সবাই জানি কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারি না। তাই শেখ রাজ্জাক আলী সব অতৃপ্ততা নিয়ে নীরবে চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা শেখ রাজ্জাক আলীকে বেহেশত নসিব করুন। আমিন।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন