সুইডেন আসলামের স্টাইল সন্দেহ হলেই কতল
ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ল্যাবরেটরিতে মানুষরূপী দানব বানিয়েছিলেন। পরে সেই দানবের হাতেই খুন হন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। বাংলাদেশেও অনেক ডনকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
রাজধানী ঢাকার পূর্ব রাজাবাজার নাজনীন স্কুল। মূল ফটক বন্ধ। ভিতরে এক যুবকের আর্তচিৎকার। বাঁচাও, কে আছো আমাকে বাঁচাও ... ওরা আমাকে মেরে ফেলল। ও মা ... মাগো ... আমাকে ওরা মেরে ফেলছে। স্কুলের ফটকের বাইরে তখন এক বৃদ্ধা চিৎকার করছেন। বলছেন, 'গেট খোল। বাবারা তোমরা গেটটা খুলে দেও। আমার ছেলেকে মের না। আমাকে মেরে ফেল, তবুও তোমরা ওর জীবনটা ভিক্ষা দেও।' মিনিট বিশেক পর স্কুলের ভিতর থেকে আর আর্তচিৎকারের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। ফটক ভিতর থেকে খুলে গেল। ৮-১০ জন যুবক একে একে বেরিয়ে আসছেন। তাদের শরীর, হাতে-মুখে টাটকা রক্ত লেগে আছে। সেই বৃদ্ধা মায়ের সামনে দিয়েই তারা বেরোচ্ছেন। বৃদ্ধা মা তাদের প্রশ্ন করছেন, আমার ছেলে কই? ও বাবারা, আমার ছেলেরে কী করছ? কোনো জবাব কেউ দিচ্ছিলেন না। গেট দিয়ে সর্বশেষ বেরিয়ে এলেন এক যুবক। মাথায় চুল কম। জিন্সের প্যান্ট ও কালো রঙের টি-শার্ট পরা। এক হাতে পিস্তল আর অন্য হাতে রক্তমাখা বেয়নেট। যুবকটি স্কুল থেকে বেরিয়েই পাগলপ্রায় ওই বৃদ্ধা মাকে বললেন, 'এত চিল্লাইতেছেন কেন। কাজের সময় এত চিল্লাইলে
ভালো লাগে না। যান, আপনার পোলা ভিতরে আছে'। শেষ কথাটি শুনেই ভিতরে ছুটলেন মা। স্কুলের ভিতরে ক্লাসরুমের পাশের বারান্দায় রক্তে ভেসে যাওয়া ছেলের নিথর দেহ খুঁঁজে পেলেন তিনি।
ভালো লাগে না। যান, আপনার পোলা ভিতরে আছে'। শেষ কথাটি শুনেই ভিতরে ছুটলেন মা। স্কুলের ভিতরে ক্লাসরুমের পাশের বারান্দায় রক্তে ভেসে যাওয়া ছেলের নিথর দেহ খুঁঁজে পেলেন তিনি।
১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা এটি। সাত-সকালে ঠিক এভাবেই পৈশাচিকতার এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন শেখ আসলাম। আন্ডারওয়ার্ল্ডে যিনি সুইডেন আসলাম নামে পরিচিত। বৃদ্ধা মাকে স্কুলের বাইরে রেখে ভিতরে তার ছেলে শাকিলকে এভাবেই সেদিন নির্মমভাবে খুন করেছিলেন। খুনের পর আসলাম ওই স্কুল থেকে বেরিয়েই উৎসুক জনতার উদ্দেশে বলেছিলেন, আপনারা কি কেউ কিছু দেখেছেন? ভিড় করা লোকজনের জবাব পাওয়ার আগেই আসলাম বলে দেন তাদের, 'নাহ, আপনারা কিন্তু এখানে কাউকেই দেখেননি। যদি দেখে থাকেন, শাকিলের মতোই ভাগ্য নিতে হবে'। এ কথা বলেই সেদিন মোটরসাইকেলে করে দলবল নিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার কাছ থেকে রোমহর্ষক ঘটনার নানা তথ্য সম্পর্কে জানা গেছে।
রাজধানীতে সুইডেন আসলামের এমন নৃশংসতার উদাহরণ রয়েছে বহু। দিনদুপুরে প্রকাশ্যেই তিনি খুন করতে ভালোবাসতেন। রাজধানীতে চাঞ্চল্যকর 'ট্রিপল মার্ডার' থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন। আর প্রতিটি হত্যাকাণ্ডই ছিল তার নিজ প্রয়োজনে। যাকেই তিনি বিশ্বাসঘাতক বা দুশমন বলে সন্দেহ করতেন, তাকেই দুনিয়া থেকে হটিয়ে দিতেন। তার স্টাইল, 'সন্দেহ হচ্ছে একে। তাই কতল করতেই হবে।' আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন সুইডেন আসলাম খুনখারাবি করেই দেশ ছাড়তেন। চলে যেতেন সুইডেন। খুন করার প্রয়োজন হলেই আবার দেশে ফিরতেন। সুইডেন থেকে তিনি যখন দেশে ফিরতেন, আন্ডারওয়ার্ল্ড অস্থির হয়ে উঠত। এটা প্রত্যেকেই জানতেন, আসলাম যেহেতু ঢাকায় এসেছেন, কাউকে না কাউকে প্রাণ দিতেই হবে। তার গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত এ বিষয়টি ছিল প্রমাণিত। তার পুরো নাম শেখ আসলাম। সুইডেন প্রবাসী ইতিকে বিয়ে করার পর তিনি সুইডেনের নাগরিকত্ব পান। সেই থেকে তার নাম হয় সুইডেন আসলাম। ঢাকার নবাবগঞ্জ দোহারে তার গ্রামের বাড়ি। বাবার নাম শেখ জিন্নাত আলী। ঢাকার ফার্মগেটে তাদের বাসা। সাত ভাইবোনের মধ্যে আসলাম দ্বিতীয়। ভাইদের মধ্যে তিনি বড়। আসলাম এসএসসি পাস করেন তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুল (বর্তমানে তেজগাঁও সরকারি স্কুল) থেকে। স্কুলজীবনে তিনি ভালো ফুটবল খেলতেন। আন্তঃজেলা স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতায় তিনি খেলেছেন। তেজগাঁও কলেজ থেকে তিনি এইচএসসি পাস করেন। ইতির সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর তার চাচাতো বোন সিমিকে বিয়ে করেন আসলাম। জেলে যাওয়ার পর এই সিমি এবং তার এক ছোট ভাই তাসফিক আহমেদ শিমুল তার সাম্রাজ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন।
যেভাবে উত্থান : ফার্মগেট এলাকা একসময় নিয়ন্ত্রণ করতেন আজাদ-বাপ্পি নামে দুই ভাই। ১৯৮৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে ফার্মগেট নিউ স্টার হোটেল থেকে বাপ্পিকে জোর করে তুলে নিয়ে যান আসলাম ও তার লোকজন। মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে বাপ্পির ওপর চলে নির্মম নির্যাতন। একপর্যায়ে কোমল পানীয় ফান্টার একটি বোতল ভেঙে বাপ্পির শরীরে ঢুকিয়ে দেন আসলাম। রক্তাক্ত বাপ্পিকে চলন্ত মাইক্রোবাস থেকে মিরপুরের দিকে ফেলে দিয়ে আসেন আসলামরা। এরপর এই আসলামের নাটকীয় উত্থান। যেন রূপকথার কোনো গল্প। যিনি ফান্টার ভাঙা বোতল দিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ড যাত্রা শুরু করেছিলেন, সেই আসলামই রাজত্ব করেছেন একে-৪৭সহ সব অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। লাশ ফেলতে শুরু করলেন। সুইডেন যেতেন। লাশ ফেলার প্রয়োজন হলে দেশে ফিরতেন। ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯৭ সালে গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিলেন। মূলত ওই সময় থেকেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের গতি প্রকৃতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটে। পেশাদার অপরাধীদের নিয়ে গ্যাং তৈরি করে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। রাজধানীতে এমন শক্তিশালী দুটি গ্রুপের মধ্যে আসলামের 'সেভেন স্টার' গ্রুপটি ছিল অন্যতম। যেখানে সুব্রত বাইন, টোকাই সাগর, পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর, টিক্কা, পিয়ালসহ আরও ভয়ঙ্কর অপরাধীরা ছিল। পুরান ঢাকা থেকে শুরু করে সাভার পর্যন্ত তার গ্রুপের লোকজন প্রাধান্য বিস্তার করে রাখত। পুরস্কার ঘোষিত এ সন্ত্রাসীকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন এসি আকরাম গ্রেফতার করে রাষ্ট্রপতি পদক পেয়েছিলেন। এর আগে ফার্মগেট এলাকা থেকে গ্রেফতারের সময় পুলিশের সঙ্গে তুমুল বন্দুকযুদ্ধ হয়।
সুইডেন আসলামের এই নজিরবিহীন উত্থানে অস্থির হয়ে ওঠে গোটা আন্ডারওয়ার্ল্ড। যারা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড শাসন করেছিলেন, তারাও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন সুইডেন আসলামের এই অগ্রযাত্রায়। পুলিশের চোখের ঘুম হারাম হয়ে যায়। সোনা চোরাচালান থেকে শুরু করে রাজধানীর চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও কিলিং মিশনে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন আসলাম। ঢাকার সাভার থেকে শ্যামপুর, টঙ্গী থেকে কেরানীগঞ্জ- এমন কোনো এলাকা ছিল না, যেখানে সুইডেন আসলামের ক্যাডার ছিল না। এমন একটি সময় ছিল যখন তার ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা তার নির্দেশ মতো জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিল। এমন এক পরিস্থিতিতে ১৯৯০ সালের মধ্যেই ঢাকার অন্যতম ডন হয়ে ওঠেন সেভেন স্টার গ্রুপের নেতৃত্বদানকারী সেই সুইডেন আসলাম।
উল্লেখযোগ্য খুন : রাজাবাজারে শাকিল হত্যাকাণ্ড দিয়ে খুনি হিসেবে হাত পাকান সুইডেন আসলাম। গ্রেফতারের আগে সর্বশেষ খুন করেন ঢাকার যুবলীগ নেতা গালিবকে। এই গালিব খুনের পরই ১৯৯৭ সালে শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে আসলামের নাম ঘোষণা করে সরকার। তাকে গ্রেফতারে ১ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৭ সালে শাকিল খুনের পর পুরান ঢাকার আগামাসি লেনে তিনজন খুন হন। মামুন, গোপাল কর এবং নুরুল ইসলাম নামে আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই তিন যুবককে গুলি করে হত্যা করেন আসলাম ও তার সহযোগীরা। সুইডেন থাকতেই আসলামের সঙ্গে তার স্ত্রী ইতির দ্বন্দ্ব হয়। সুইডেন থেকে ইতি ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে বিয়ে করেন আসলাম গ্রুপের মামুনকে। আসলাম সুইডেন থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন মামুনকে হত্যার জন্য। আগামাসি লেনে আগা শামীমের আস্তানায় মামুনকে সমঝোতার কথা বলে নেওয়া হয়। মামুন সেখানে যান ভারতীয় সন্ত্রাসী গোপাল কর ও গোপীবাগের নুরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু সেখানে এই তিনজনকেই গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর আসলামের সেকেন্ড ইন কমান্ড বিপুলকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। মামুনের সঙ্গে বিপুলের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এ কারণেই বিপুলকে তেজতুরী বাজারের একটি মাঠে নিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। আসলাম একটি ধারালো অস্ত্র দিয়ে বিপুলের দুই হাত বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করেন। এরপর কলাবাগানে খুন করেন কিসলুকে। সর্বশেষ ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ তেজকুনিপাড়ায় খুন হন যুবলীগ নেতা মাহমুুদুল হক খান গালিব। এ ছাড়াও তার হাতে আরও বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। তার বিরুদ্ধে ঢাকার বিভিন্ন থানায় সর্বমোট ১৯টি মামলা রয়েছে। যার মধ্যে কয়েকটি হত্যা, চাঁদাবাজি ও ডাকাতির মামলা। আসলামের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানায়, অত্যন্ত চতুর প্রকৃতির লোক আসলাম। ফার্মগেট এলাকা একসময় নিয়ন্ত্রণ করতেন চাইনিজ, শাকিলসহ আরও বেশ কয়েকজন। তাদের কারণে আসলাম কখনো মাথা উঁচু করে চলতে পারতেন না। চাইনিজের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তেই ইতিকে বিয়ে করেন। ইতি হলেন চাইনিজের বোন। চাইনিজ সুইডেনে চলে গেলে শাকিল ঢাকায় একা হয়ে যান। সেই পুরনো ক্ষোভ মেটাতেই শাকিলকে নৃশংসভাবে খুন করেন আসলাম।
জেলে-বাইরে একই রকম : দেশের যে জেলেই থাকুন না কেন আসলাম সেখান থেকেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ করতেন। কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় দুটি মোবাইল ফোনে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম। ইতিপূর্বে একাধিকবার অভিযান চালিয়ে মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে তার কাছ থেকে। জানা গেছে, ওই কারাগারের কর্তাব্যক্তিদের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করেই দীর্ঘদিন ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে আসছেন এই ডন। শুধু আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীই নয়, মোবাইল ফোনে কারাগার থেকে এই সন্ত্রাসী প্রভাবশালী রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এমনকি প্রশাসনের বেশ কয়েকজন কর্তাব্যক্তির সঙ্গেও নিয়মিত কথা বলতেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন