খুন আর সোনা লুটই ছিল টোকাই সাগরের কাজ
ল্যাবরেটরিতে মানুষরূপী দানব বানিয়েছিলেন ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। পরে সেই দানবের হাতেই খুন হতে হয় তাকে। বাংলাদেশেও অনেক ডনকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
শিল্পী রফিকুন নবী বা রনবী’র টোকাই চরিত্রটি বাস্তবের এমন কিছু পথশিশুর প্রতিনিধিত্ব করে, যারা মানুষের ফেলে দেওয়া আবর্জনা কুড়িয়ে নিয়ে যায়। থাকে রাস্তার ডাস্টবিনের পাশে, ফুটপাথে, ফেলে রাখা কংক্রিটের পাইপের ভিতর, পার্কের বেঞ্চিতে, ভাঙা দেয়ালের পাশে, কাঠের গুঁড়িতে, ঠেলাগাড়ির ওপর, ইটের ওপর মাথা পেতে। তার পাশে থাকে কুকুর, কাক। তার পোশাক বলতে একমাত্র লুঙ্গি।
এখানে এমন এক টোকাইর কথা বলা হচ্ছে, বাস্তবে পুরোটাই উল্টো। তার নামের আগে ‘টোকাই’ শব্দটি থাকলেও আদতে এই ব্যক্তিটি কয়েকশ কোটি টাকার মালিক। তাকে রাস্তায় বা পাইপের ভিতর থাকতে হয় না। দেশ-বিদেশে রয়েছে তার বিশাল বিশাল প্রাসাদোপম অট্টালিকা। আর এই বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন তিনি মাস্তানি করে। তার নাম আমিনুর রসুল সাগর, যিনি টোকাই সাগর নামে পরিচিত। দুর্ধর্ষ সেভেন স্টার গ্রুপের অন্যতম সদস্য এই টোকাই সাগর খুন, চাঁদাবাজি ও বিমানবন্দরকেন্দ্রিক নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তার অস্ত্রের ভাণ্ডারে ছিল অত্যাধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র। বলা হয়ে থাকে, টোকাই সাগরের অস্ত্রের ভাণ্ডারে যে ধরনের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ছিল, তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও ছিল না। খুন আর সোনার চোরাচালান লুট করাই ছিল টোকাই সাগরের কাজ। রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই গডফাদার মাস্তানি করেই কয়েকশ কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন, যা দেশের ইতিহাসে বিরল। তবে অঢেল সম্পদের মালিক হলেও তিনি দেশে থাকতে পারেননি। একদিকে পুলিশ, অন্যদিকে প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী-সব সময় তাকে থাকতে হয়েছে লোকচক্ষুর আড়ালে।মূলত টোকাই সাগরের এই সোনা চোরাচালানকে কেন্দ্র করেই রাজধানীর শীর্ষ অপরাধীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। গড়ে তোলা হয় দুই গ্রুপের অস্ত্রের মজুদ। খুন পাল্টা খুনে রাজধানীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় গ্যাং কিলিং। রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটতে থাকে। বাংলাদেশ সরকার এই দুর্ধর্ষ অপরাধীকে ধরিয়ে দিতে লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ২৩ শীর্ষ অপরাধীর অন্যতম এই টোকাই সাগর বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আত্মগোপন করে আছেন। বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯১ সালে উত্থান হওয়া এই সাগরের কাজ ছিল বিমানবন্দর এলাকায় ঘাপটি মেরে বসে থাকা। অস্ত্রের মুখে চোরাচালানি চক্রের সোনার চালান লুটে নেওয়া। সোনার চালান লুট করতে করতে একসময় তিনি নিজেও চোরাচালানে যুক্ত হয়ে পড়েন। দেশের শীর্ষস্থানীয় চোরাকারবারিদের সঙ্গে তার ওঠাবসা শুরু হয়। আর এই লাভজনক অবৈধ ব্যবসা ঠিক রাখতে আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ অপরাধীদের নিয়ে গড়ে তোলেন আলাদা বাহিনী, যার নাম দেওয়া হয় সেভেন স্টার গ্রুপ। সুইডেন আসলাম, সুব্রত বাইনসহ শীর্ষস্থানীয় অপরাধীদের নিয়ে গড়া এই গ্রুপটির সন্ত্রাসী তৎপরতায় আন্ডারওয়ার্ল্ড যেমন অস্থির হতে থাকে, হারাম হতে থাকে পুলিশের ঘুম। সেভেন স্টার গ্রুপের কিলিংয়ের ঘটনার অধিকাংশেই টোকাই সাগরের জড়িত থাকার প্রমাণ পায় পুলিশ। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত টোকাই সাগর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় বেপরোয়া হয়ে পড়েন। চলে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা ও সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে তার ছিল দহরম-মহরম। বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে গাড়িসহ মালামাল ডাকাতির ঘটনা তাদের বেড়ে যায়। অঢেল সম্পদ ও সবচেয়ে বেশি আগ্নেয়াস্ত্রের মালিক হওয়া এই সাগর একসময় হয়ে ওঠেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন। সূত্রে জানা গেছে, চোরাকারবারিদের সোনার চালান বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই খবর চলে আসত সাগরের কাছে। এরপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিমানবন্দর সড়কেই সোনার চালানের গাড়ির গতি রোধ করা হতো। চালক ও মালিককে বের করে দিয়ে গাড়িসহ সোনার চালান লুটে নিয়ে যেতেন সাগর। এ কাজটি প্রথম পর্যায়ে আশকোনা, দক্ষিণখান এলাকার অপরাধীদের নিয়ে করতেন তিনি। পরে এ কাজে আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ অপরাধীরা জড়িয়ে পড়ে। সূত্রগুলো জানায়, ১৯৯১ সালে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে উত্থান ঘটে সুব্রত বাইন ও টোকাই সাগরের। আন্ডারওয়ার্ল্ডে যুবলীগের হান্নানের অনুপস্থিতিতে তার দলের সদস্যরা সুব্রত বাইন ও টোকাই সাগরের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। সেভেন স্টার আর ফাইভ স্টার নামে দুই ভাগ হয়ে যায় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড। সেভেন স্টারের নেতৃত্ব দেন টোকাই সাগর আর সুব্রত বাইন। আর ফাইভ স্টার বাহিনী গড়ে তোলেন লিয়াকত। লিয়াকতের ফাইভ স্টার গ্রুপে যোগ দেয় পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর, আরমান, জিসান, রনি, বিকাশ, প্রকাশ, নিটেল, আলাউদ্দিন, কিলার আব্বাস, আগা শামীম, কাজল ও অশ্রু। অন্যদিকে টোকাই সাগরের সেভেন স্টার বাহিনীতে যোগ দেন মুরগি মিলন, তানভীরুল ইসলাম জয়, ইমাম হোসেন ইমাম, মোল্লা মাসুদ, সাইদুর রহমান নিউটন, তোফায়েল আহমেদ ওরফে যোশেফ, তানজিল, কচি, টিক্কা, আসিফ, কালা লিয়াকত, জরিফ, নাটকা বাবু, মুরাদ, মানিক, চঞ্চল, জুলু ও জন। এরা সবাই তখন ঢাকাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের একেকজন কুখ্যাত সন্ত্রাসী। লিয়াকতের সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন সুইডেন আসলাম হাত মেলান সুব্রত বাইন আর টোকাইয়ের সঙ্গে। আর এতে আন্ডারওয়ার্ল্ডে শক্তি বাড়ে সাগরের। পরে অবশ্য দলবদলের ঘটনা ঘটে। এ দশকে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে চলতে থাকে গ্যাং কিলিং। একই সময় সুব্রত বাইনের গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যান আগামসি লেনের ‘সন্ত্রাসী’ আসিফ। যোগ দেন লিয়াকত গ্রপে। ২০০০ সালের ২৯ আগস্ট খুন হন আসিফ, তার বডিগার্ড গিয়াসউদ্দিন টিপু ও সহযোগী রিপন। খিলগাঁওয়ের ৪৪৬/সি নম্বর বাড়ি থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। আগারগাঁও বস্তি দখলকে কেন্দ্র করে সুব্রত বাইন গ্রুপের সদস্য জন এ হত্যাকাণ্ড ঘটায় বলে জানা যায়। অভিযোগ ওঠে, এ হত্যাকাণ্ডে তাকে সহায়তা করেন সেভেন স্টারের সুইডেন আসলাম। আসিফের বড় ভাইয়ের বন্ধু ছিলেন জন। পুলিশের একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। এই গ্যাং কিলিংকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপই দল ভারী করতে থাকে। বাড়াতে থাকে অস্ত্রশস্ত্র। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে আসতে থাকে অত্যাধুনিক অস্ত্র।২০০০ সালের ১৮ মে পুরান ঢাকার জজকোর্ট এলাকায় ফিল্মি কায়দায় খুন করা হয় হুমায়ুন কবির মিলন ওরফে মুরগি মিলনকে। সেভেন স্টার গ্রুপের পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর ও ডাকাত শহিদ এ হত্যা মিশনে সরাসরি অংশ নেন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘিরে সোনা চোরাকারবার নিয়ে টোকাই সাগরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাধে। আর দ্বন্দ্বের কারণেই মিলন খুন হন আদালতপাড়ায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন