সেই আন্ডারওয়ার্ল্ড কাহিনী (১৮)

ফেরার হয়েও ভয়ঙ্কর শাহাদাত

ল্যাবরেটরিতে মানুষরূপী দানব বানিয়েছিলেন ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। পরে সেই দানবের হাতেই খুন হতে হয় তাকে। বাংলাদেশেও অনেক ডনকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
মির্জা মেহেদী তমাল

অপরাধ জগতের ‘মুকুটহীন সম্রাট’ আর পুলিশের তালিকায় তিনি শীর্ষ সন্ত্রাসী। সরকার তাকে পাকড়াওয়ে পুরস্কার ঘোষণা করেছে লাখ টাকা। মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে এখন তিনি ফেরার। আছেন কলকাতায়। ঢাকার চাঁদার টাকায় সেখানে তিনি আলিশান জীবন-যাপন করছেন। ফেরার হলেও তিনি বাংলাদেশের ব্যবসায়ী এবং ঠিকাদারসহ রাজধানীর নানা শ্রেণি- পেশার মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় আতঙ্ক। তার নাম শুনলে অনেকেই প্রাণভয়ে গোপনে চাঁদা দেন। তার নামে প্রতি মাসে উঠছে কোটি কোটি টাকার চাঁদা। তার অধীনে রয়েছে ১৫-২০ জনের অস্ত্রধারী দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বাহিনী। প্রকাশ্যে তিনি যেমন ভয়ঙ্কর, পলাতক থাকা অবস্থাতেও একই রকম ভয়ঙ্কর। রাজধানীর সবচেয়ে দুর্ধর্ষ অপরাধীদের অধিকাংশ এখনো তার নিয়ন্ত্রণে। তাদের দিয়েই তিনি খুন-খারাবির ঘটনা ঘটাতেন। অন্ধকার জগতের মুকুটহীন এই সম্রাটের নাম হলো শাহাদাত হোসেন। মিরপুরের শাহাদাত নামে পরিচিত। শাহাদাতের সেকেন্ড ইন কমান্ড ব্যাঙ্গা বাবু ধরা পড়ার পর পুলিশের কাছে বলেছে, তিনি নিজে একাই খুন করেছেন ২৬টি। শুধু বাংলাদেশেই নয়, কলকাতায়ও শাহাদাতের রয়েছে একটি দুর্ধর্ষ বাহিনী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওয়ার্ড কমিশনার নিউটন হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত এই আসামি শাহাদাত কলকাতায় রয়েছেন রাজার হালে। তিনি পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের সোর্স হিসেবে কাজ করছেন। আর এ কারণে কলকাতায় আত্মগোপনে থাকা বাংলাদেশি অপরাধীদের কাছেও তিনি পরিণত হয়েছেন আতঙ্ক। অধিকাংশ বাংলাদেশি অপরাধী গ্রেফতার হয়েছেন এই শাহাদাতের দেওয়া তথ্যের কারণেই। তার কারণে অনেক অপরাধী কলকাতা থেকে পালিয়েও গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খাতায় তার নাম শাহাদাত  হোসেন। বাবার নাম নুরুজ্জামান। স্থায়ী ঠিকানা ১/বি, ৭৯/৮০ শাইনপুকুর রোড, শাহআলী, ঢাকা। ২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত মিরপুর থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শাহাদাত। ওয়ার্ড কমিশনার নিউটন হত্যার পর তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যান। সেখানে তার বন্ধু খোরশেদ একজন ভাসমান সন্ত্রাসী। বিভিন্ন অপরাধে যৌথ নেতৃত্ব দেওয়ায় এ গ্রুপটির নাম হয়ে যায় খোরশেদ-শাহাদাত বাহিনী। পশ্চিমবঙ্গের একজন প্রভাবশালী এক ব্যক্তির (পশ্চিমবঙ্গের সাবেক উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা) ছত্রছায়ায় রয়েছেন শাহাদাত। সেখানে মাছের খামারসহ বিভিন্ন ব্যবসা করছেন তিনি। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শাহাদাতের সঙ্গে পারিবারিকভাবে দ্বন্দ্ব ছিল মিরপুর গুদারাঘাটের বাসিন্দা টিপুর। টিপু ছিল শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীরের সহযোগী। তখন ১৯৯৭ সাল। শাহাদাত তখনো সন্ত্রাসী হয়ে উঠেননি। দ্বন্দ্বের কারণে শাহাদাতকে কুপিয়েছিল টিপু। মিরপুর-১ নম্বর এলাকার ‘ডিশ  রেজা’র ছোট ভাই শাহীন ছিল শাহাদাতের বন্ধু। প্রতিশোধ নিতে শাহীন ও ডিশ রেজার সহায়তায় ১৯৯৮ সালে টিপুকে গুদারাঘাট এলাকায় খুন করেন শাহাদাত। এভাবেই অপরাধ জগতে পা ফেলে শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে ওঠেন শাহাদাত হোসেন। একপর্যায়ে পেশাদার কিলারদের দিয়ে একের পর এক হত্যাকাণ্ড। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন। শাহাদাতের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন বাবু ওরফে ব্যাঙ্গা বাবু। ২০১৩ সালে তিনি গ্রেফতার হন। পুলিশ ও অন্যান্য সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সালে সরকারি বাঙলা কলেজ ছাত্র রিংকুকে কলেজ মাঠে খুন করে গলা কেটে মাথা নিয়ে যায় ব্যাঙ্গা। ওই বছরেই ব্যাঙ্গা মিরপুরের লাল্টুকে হত্যা করে। ওই বছর বাঙলা কলেজের জিএস ছাত্রদল নেতা মোহাম্মদ আলীকে খুন করে ব্যাঙ্গা বাবু। সেগুনবাগিচার নবাব আলী হত্যা, মিরপুরের নান্টু হত্যা, ছাত্রদল নেতা বিপ্লব হত্যা, মিরপুরের সাবেক কমিশনার  তৈয়েবুর রহমানের ভাগ্নে যুবলীগ নেতা মাহবুব হত্যা, প্রিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান কাজী শহিদুল্লাহ হত্যা, মুক্তিযোদ্ধা শপিং কমপ্লেক্সের চেয়ারম্যান আফতাব আহমেদ হত্যার হুকুমের আসামি এই ব্যাঙ্গা। মিরপুর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিটুর ছোট ভাই ছাত্রলীগ নেতা মামুন হত্যা, ১২ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার শওকত হোসেন মিস্টার হত্যা এবং মিরপুর ১ নম্বরের মাসুদ ওরফে গোড়া মাসুদ হত্যা মামলার আসামি এই ব্যাঙ্গা বাবু। ১৯৯৮-৯৯ সালে এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে  কেন্দ্র করে ব্যাঙ্গা বাবু তার প্রতিদ্বন্দ্ব^ী সারোয়ারকে খুন করে। ওয়ার্ড কমিশনার সাইদুর রহমান নিউটন হত্যা মামলার রায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও আপিল বিভাগে তিনি খালাস পান। শাহাদাতের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, ওয়ান-ইলেভেনের সময় জরুরি অবস্থা চলাকালে তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের কাছে ই-মেইল করেন। কিন্তু সাড়া পাওয়া যায়নি। এরপর তিনি তৎকালীন আইজিপি নূর মোহাম্মদের কাছে টেলিফোন করলেও সাড়া পাননি। এরপর তিনি র‌্যাবের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাতেও খুব একটা কাজ হয়নি। ওই সূত্র জানায়, কলকাতায় প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে শাহাদাতের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। তাদের দিয়েই বাংলাদেশি কিছু অপরাধীকে ধরিয়ে দেন। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন