সেই আন্ডারওয়ার্ল্ড কাহিনী (১৯)

খুনের জন্য নজরুলের পছন্দ ছিল হাতুড়ি

ল্যাবরেটরিতে মানুষরূপী দানব বানিয়েছিলেন ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। পরে সেই দানবের হাতেই খুন হতে হয় তাকে। বাংলাদেশেও অনেক ডনকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
মির্জা মেহেদী তমাল

তেজগাঁও রেলস্টেশন। পূর্ব দিকেই পরিত্যক্ত রেললাইনের পর বেশ কয়েকটি বগি। সেখানেই কাপড় দিয়ে চোখ আর দড়ি দিয়ে হাত বাঁধা এক যুবককে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ৮-১০ জন তাকিয়ে আছে। তারা অপেক্ষায় তাদের এক বড় ভাইয়ের জন্য। তিনি আসার পর যুবকটির ব্যবস্থা হবে। সন্ধ্যার পর তাদের সেই বড় ভাই সেখানে এসে পেঁৗছলেন। একজন বড় ভাইয়ের হাতে লোহা পেটানোর একটি বড় হাতুড়ি তুলে দিলেন। চোখ বাঁধা যুবকটি তখন অাঁচ করতে পেরেছেন, তার সময় ফুরিয়ে এসেছে। প্রাণরক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে আকুতি, মিনতি করে যাচ্ছেন। কিন্তু সেদিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। হাতুড়ি হাতে নিয়ে সেই বড় ভাই ধীরে ধীরে চোখ বাঁধা যুবকটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। সহযোগীরা যুবকটির হাত-পা চেপে ধরে রেলের পাতের ওপর শুইয়ে দিলেন। এরপরই শুরু হলো সেই বড় ভাইয়ের নিষ্ঠুরতা। যুবকটির হাত ও পা রেলের পাতের সঙ্গে পিষে যাওয়া পর্যন্ত হাতুড়িপেটা করেই যাচ্ছিলেন সেই বড় ভাই। একসময় হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়া যুবকটির লাশ ফেলে রাখা হয় রেললাইনের পাশে কিংবা কোনো পরিত্যক্ত বগির ভিতর। সেই বড় ভাইয়ের নাম নজরুল। পুরো নাম নজরুল ইসলাম। তিনি রেললাইনের ওপর ফেলে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে এমনভাবেই অসংখ্য খুন করেছেন। তার নৃশংসতায় অনেকেই এখন পঙ্গু। খুনের জন্য তিনি পিস্তল বা চাপাতি, রাম দার চেয়ে হাতুড়ি পছন্দ করতেন। তার অধিকাংশ খুনের ঘটনাগুলো ঘটেছে হাতুড়ি দিয়ে।
নিহতদের বেশির ভাগই ছিলেন তার প্রতিপক্ষ আর তেজগাঁও স্টেশন এলাকার অপরাধী। হাতুড়ি পেটানোর এই নজরুল ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়িয়েছেন গোটা তেজগাঁও এলাকায়। ছোটখাটো দেখতে এই দুর্ধর্ষ অপরাধীকে ভয় করতেন ঢাকার অন্য সন্ত্রাসীরাও। এ ছাড়া তেজগাঁও ফার্মগেট এলাকার সন্ত্রাসীরা তার নৃশংসতাকে ভয় করতেন। নজরুলের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জে। বাবা ছিলেন রেলওয়ে মাস্টার। তেজগাঁও রেলওয়ে কলোনিতে তাদের বাসা ছিল। ১৯৮৬ সালে তেজগাঁও রেলওয়ে কলোনিতে নজরুলের স্কুলপড়ুয়া ছোট ভাইয়ের সঙ্গে কলোনির মাসুদের মারামারি হয়। একপর্যায়ে একজন আরেকজনকে ছোরা বসিয়ে দেয়। এ ঘটনার জের ধরে কলোনির লোকজন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা তখন নিত্যদিনকার ঘটনা। স্থানীয়দের উদ্যোগে সেখানে দুই পক্ষের সমঝোতার বৈঠকের সিদ্ধান্ত হয়। এক সন্ধ্যায় বসে সে বৈঠক। কিন্তু বৈঠক চলাকালে স্টেশন এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাতের অাঁধারে বৈঠকেই হামলা চালানো হয়। কুপিয়ে নৃশংসভাবে সেখানে খুন হন মাসুদের বাবা ও ফুফাতো ভাই। এই জোড়া খুনটি পরিকল্পিতভাবেই তখন করা হয়েছিল বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে। এই জোড়া খুনের পর থেকেই নজরুল আরও দুর্ধর্ষ হয়ে পড়েন। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, ভাড়াটে হিসেবে দেশের বিভিন্ন জেলায়ও তিনি গুণ্ডামি করেছেন। অস্ত্র চালিয়েছেন। ওই এলাকায় তার ওপর তখন আর কেউ ছিলেন না। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, এই মাসুদের পরবর্তীতে ছাত্রদলের একজন বড় ক্যাডার হিসেবে নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। যাকে একবার ফার্মগেট এলাকায় কাটা রাইফেল ঠেকিয়ে গুলি চালিয়েছিল। বিএনপির খরচে তাকে সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা করানো হয়। এরপর থেকে তার নাম হয় ল্যাংড়া মাসুদ। আর এই মাসুদকে কাটা রাইফেল ঠেকিয়ে গুলি চালিয়েছিলেন সুইডেন আসলামের সেকেন্ড ইন কমান্ড বিপুল। যাকে পরবর্তীতে আসলাম নিজেই দুই হাত বিচ্ছিন্ন করে খুন করেন। আর ল্যাংড়া মাসুদ পরে নিহত হন রাজধানীর ডিওএইচএস-এ। মাসুদ হত্যাকাণ্ডেও আন্ডারওয়ার্ল্ডের একটি গ্রুপের যোগসাজশ রয়েছে।
তেজগাঁও এলাকার বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নজরুলের অস্ত্রের ভাণ্ডারে প্রচুর অস্ত্র ছিল। কিন্তু তিনি গুলি করার চেয়ে পিটিয়ে হত্যা করতে পছন্দ করতেন বেশি। পেটানোর জন্য তিনি রাখতেন বড় বড় হাতুড়ি। তার অস্ত্রের ভাণ্ডারেও বড় বড় হাতুড়ি থাকত। তেজগাঁও স্টেশন এলাকা ও তার আশপাশ এলাকায় একের পর এক লাশ পড়ে থাকলেও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারত না। ১৯৮৯ সালের এক রাতে তার প্রতিপক্ষ গ্রুপের সন্ত্রাসীরা তাকে রেলওয়ে কলোনিতেই এলোপাতাড়িভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। তার ওই হত্যার মধ্য দিয়েই অবসান ঘটে নজরুলের শাসন। নজরুলের মৃত্যুর পর সেখানে মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়ান চোরা খালেক। তার মৃত্যু পুলিশের নির্যাতনে। এরপর সেখানে এসে দাঁড়ান সেলিম ওরফে রায়পুইরা সেলিম। এই রায়পুইরা সেলিম ওই এলাকায় ফেনসিডিলের গডফাদার ছিলেন। পুলিশ দেখলেই বোমা আর গুলি চালাতেন। তার প্রধান শত্রুই ছিল পুলিশ। তার ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে, দূর থেকে তিনি যদি পুলিশের টুপি দেখতে পেতেন, সঙ্গে সঙ্গেই গুলি চালাতেন। তেজগাঁও এলাকার সন্ত্রাসী গেসু ছিলেন সেলিমের সমন্ধি। সেলিমের হাতেই গেসুর মৃত্যু হয়। সেলিমের স্ত্রী পারভীনও পিস্তল চালাতে পারদর্শী ছিলেন। ২০০২ সালের দিকে সেলিম তেজগাঁও থেকে এক দিন যাচ্ছিলেন উত্তরায়। জসীমউদ্দীন রোডের কাছাকাছি পুলিশের চেকপোস্টে পড়ে। পুলিশ দেখা মাত্রই সেলিম গুলি চালিয়ে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেন। তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। পুলিশের একটি দল তাকে ধাওয়া করে পাকড়াও করে। এরপর জামিনে মুক্তি পেলে পুলিশ আবারও তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করে। তেজগাঁও এলাকায় তাকে গ্রেফতার করতে গেলে তুমুল বন্দুকযুদ্ধ হয়। সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সেলিম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন