জাফর ওয়াজেদ
১৯৭৩ ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের বাঙালির জন্য এক আতঙ্কের বছর। গুপ্তহত্যার বছর। অবৈধ অস্ত্রগুলো এ সময় ঝলসে উঠেছিল। কে যে আততায়ী, কে যে হন্তারক, চেনা দুষ্কর তখন। ঘাতকরা চারপাশে নিঃশ্বাস ফেলছিল। দেশজুড়ে অব্যাহত গুপ্তহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড। ২১ মে মওলানা ভাসানী এসব ঘটনাকে আরও প্রসারিত করার জন্য হরতাল পালন করেন। চরমপন্থিরা এতে উদ্বুদ্ধ হয়। ২৭ মে নরসিংদীতে আওয়ামী লীগের একটি মিছিলে সর্বহারা পার্টি গুলি চালালে চারজন নিহত হন। ২৯ মে নড়িয়ায় নিজ বাসভবনে চরমপন্থিদের গুলিতে নিহত হন আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত এমপি নুরুল হক। ঘটনার সঙ্গে সর্বহারা পার্টি জড়িত বলে পুলিশের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ১২ জুন বাগেরহাটের ফকিরহাট থানার বেতাগী পুলিশ ফাঁড়িতে সশস্ত্র হামলা ও লুটপাট। মাওবাদীদের প্রথম ফাঁড়ি আক্রমণ এটি। ১৩ জুন বগুড়ার গাবতলী থানা লুট করে মতিন, আলাউদ্দিন গ্রুপ। ১৮ জুন নওগাঁর নিয়ামতপুর থানার ছাতড়া পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালায় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির অহিদুর রহমান ও আলমগীর কবির। ২২ জুন কুস্টিয়ার দৌলতপুর থানার মাধিয়া পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালায় আবদুল হকের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি। তারা ফাঁড়ির সব অস্ত্রশস্ত্র এমনকি পুলিশের পোশাকও লুট করে নিয়ে যায়। ২৬ জুন পিরোজপুরের কাঁঠালিয়া থানার আমুয়া পুলিশ ফাঁড়ি লুট করে সিরাজ সিকদারের পূর্ব বাংলা সর্বহারা
পাটি। ২৮ জুন রাতে ভোলার চরফ্যাশন থানার সব অস্ত্রশস্ত্র লুট করে মোহাম্মদ তোয়াহা-দিলীপ বড়–য়ার সাম্যবাদী দলের সশস্ত্র ক্যাডাররা। তারা ট্রলারে করে এসে থানায় হামলা চালিয়েছিল। এ অবস্থায় ২০ জুলাই দেশব্যাপী তল্লাশি অভিযানে সেনাবাহিনী তলব করা হয়। সেনাবাহিনী অভিযান চালাতে গিয়ে বিভিন্নস্থানে নানা জটিলতা হওয়ায় কিছুদিনের মধ্যে তাদের প্রত্যাহার করে নিয়ে আসা হয়। গোপন চরমপন্থি দল ও সন্ত্রাসবাদীদের তৎপরতা তদুপরি অব্যাহত থাকে। এ অবস্থায় ২০ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতিকে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতা দিয়ে সংসদে বিল পাস হয়। ২৯ জুন রামগড়ের জালিয়া পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালায় সর্বহারা পার্টি। ৩ জুলাই খুলনার মোড়েলগঞ্জ থানার তেলিগাতি পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ করে প্রচুর অস্ত্র-শস্ত্র লুট করে নেয় আবদুল হকের ইপিসিপি। ৮ জুলাই বরগুনার পাথরঘাটা থানার চরকুয়ানী এবং জেলার বাউফল থানার বগা ফাঁড়িতে পিরোজপুর সশস্ত্র হামলা চালায় সর্বহারা পার্টি। ৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জের বৈদ্যেরবাজার থানার অলিপুরা ফাঁড়ি এবং গোপালগঞ্জের পাটগাঁথিয়া ফাঁড়ি আক্রমণ করে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র লুটে নেয় চরমপন্থিরা। ১২ জুলাই সর্বহারা পার্টি বাউফল থানার ধলিয়া ফাঁড়ি লুট করে। ২৫ জুলাই মুন্সীগঞ্জের লৌহজং থানা ও ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার রামকৃষ্ণ মিশন ফাঁড়ি লুটে নেয় মাওবাদীরা। আগস্ট মাসে দেশে ব্যাপক বন্যায় জানমালের বিস্তর ক্ষয়ক্ষতি হয়। অগণিত মানুষ নিপড়ীত হয় সীমাহীন দুঃখ, কষ্ট ও অভাব-অনটনের মধ্যে। মানুষের এমন নিদারুণ দুঃখ দুর্দশার করুণ চিত্রও কোনো সাড়া জাগাতে পারেনি। উগ্র-বামপন্থি ও স্বাধীনতাবিরোধীদের বিবেকে। তারা অব্যাহত রেখেছিল তাদের পূর্ব-পরিকল্পিত সহিংস অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ। ১ আগস্ট চরমপন্থিরা মানিকগঞ্জের ঘিত্তর থানার জাবড়া ফাঁড়ি লুট করে। ২ আগস্ট কুষ্টিয়ার মিরপুর থানার আমল্লা ফাঁড়িতে লুটপাট চালায়। ৫ আগস্ট নরসিংদীর শিবপুর থানায় সশস্ত্র চরমপন্থিরা বেপরোয়া হামলা চালায়। সর্বহারা পার্টি জড়িত বলে সন্দেহ করা হয়। ৭ আগস্ট বরিশালের বাবুগঞ্জ থানার চানপাশা ফাঁড়িতে আক্রমণ করে সর্বহারা পার্টি। ৯ আগস্ট কুষ্টিয়ার মিরপুর থানার আটগ্রাম ফাঁড়িতে চালানো হয় সশস্ত্র হামলা ও লুটপাট। ১০ আগস্ট ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ থানার উচাখিলা ফাঁড়ি ও ১১ আগস্ট চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার চুনতি ফাঁড়ি লুট হয়। ১৩ আগস্ট গ্রেনেড চার্জ করে চট্টগ্রামের একটি ব্যাংকে ডাকাতি করা হয়। একই দিন বরগুনার পাথরঘাটার জ্ঞানপাড়া রেঞ্জার অফিস, ঝালকাঠির স্বরূপকাঠী থানার ইন্দেরহাট ফাঁড়ি এবং গাজীপুরের কাপাসিয়া থানা লুট করে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যায়। ১৫ আগস্ট বান্দরবানের লামা থানার কৈথান ফাঁড়িতে হামলা করে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যায়। ২০ আগস্ট মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে সংঘটিত হয় সশস্ত্র চরমপন্থিদের জাতীয় রক্ষীবাহিনীর মধ্যে তিন ঘণ্টা গুলিবিনিময়। ২৩ আগস্ট সর্বহারা পার্টি সশস্ত্র হামলা চালিয়ে লুট করে কুমিল্লার হোমনা থানার চন্দনপুরা ফাঁড়ি। ২৫ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের বৈদ্যেরবাজারের আনন্দবাজার হাট থেকে প্রকাশ্যে ৯ ব্যক্তিকে অপহরণ করে চরমপন্থিরা। পরে ৭ জনকে জবাই করে হত্যা করে। ১ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার ধানীখোলা ফাঁড়ি এবং চুয়াডাঙ্গা থানার শরৎগঞ্জ ফাঁড়িতে চরমপন্থিরা হামলা করে অস্ত্রশস্ত্র লুটে নেয়। ২ সেপ্টেম্বর আরিচা ফেরিতে রক্ষীবাহিনী ও চরমপন্থিদের মধ্যে গুলিবিনিময়ে নিহত হয় চার চরমপন্থি। ৩ সেপ্টেম্বর- ফরিদপুরে কোতোয়ালি থানার চানপুর ফাঁড়ি লুট। ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে ব্রাশফায়ারে নিহত হয় ৪ জন ছাত্র। ৭ সেপ্টেম্বর দেশের বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনী ও দুর্বৃত্তদের মধ্যে গুলিবিনিময়ে আহত ৬০ জন। ১৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পটিয়ার কালারপোল ফাঁড়ি সর্বহারা পার্টি লুটে নেয়। ১৪ সেপ্টেম্বর দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হয় চট্টগ্রাম বন্দরের দুজন শ্রমিক। ১৭ সেপ্টেম্বর মতিন-আলাউদ্দিনের ইবিসিপির ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতায় সিরাজগঞ্জ-ঈশ্বরদী ট্রেন লাইনে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে। এতে শিশু ও নারীসহ বহু হতাহত হয়। ২০ সেপ্টেম্বর বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার সারিফল পুলিশ ফাঁড়িতে সর্বহারা পার্টি সশস্ত্র হামলা চালিয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ পুলিশের পোশাকও নিয়ে যায়। ২৮ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর বাঘমারা দামনাশ ফাঁড়ি লুট করে মতিন-আলাউদ্দিন গ্রুপ। নায়েকসহ আটজন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে। স্কুল গৃহে স্থাপিত ফাঁড়ি পুড়িয়ে রাইফেল লুট করে। গোলাগুলিতে মতিন গ্রুপের নেতা অধ্যাপক বাদল দত্ত নিহত হয়। দুজন পুলিশ সদস্য আশ্রয় নিয়েছিলেন স্কুল ঘরের ছাদে। সেখানেই তাদের পুড়িয়ে মারা হয়। এটি ছিল মতিন-আলাউদ্দিনের বড় অপারেশন। ৩ অক্টোবর পাবনার শাহাজাদপুরে রক্ষীবাহিনী ও টিপু বিশ্বাসের গ্রুপের গুলিবিনিময়ে আটজন নিহত হন। ৪ অক্টোবর চরমপন্থিরা মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানা ও খাদ্যগুদাম একই সঙ্গে লুট করে। পরে গুদামে আগুন ধরিয়ে দেয়। ৬ অক্টোবর নেত্রকোনার বারাহাট্টা থানার অস্ত্রশস্ত্র লুট করে নেয় গণবাহিনী। চুয়াডাঙ্গায় রাতে সাতটি হত্যাকাণ্ড ঘটে। ৭ অক্টোবর চুয়াডাঙ্গায় দ্বিতীয় রাতেও হত্যাকাণ্ড ঘটে সাতটি। ১৪টি হত্যাকাণ্ডেই আবদুল হকের পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি জড়িত ছিল। ৯ অক্টোবর ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ড থানা লুট করে নেয় আবদুল হক বাহিনী। ১০ অক্টোবর ঢাকায় গণবাহিনীর হামলায় ৬ জন নিহত হয়। ১৩ অক্টোবর সকালে কুষ্টিয়ার মিরপুর থানার হালসা ফাঁড়িতে এবং বিকালে টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ী ফাঁড়ি লুট হয়। ১৭ অক্টোবর কুষ্টিয়ার মীরপুর থানার খাদিমপুর ফাঁড়িতে গণবাহিনীর হামলায় জানমালের প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়। তারা অস্ত্রশস্ত্র লুট করে নেয়। ২১ অক্টোবর সর্বহারা পার্টির সশস্ত্র হামলায় লুণ্ঠিত হয় পিরোজপুরের উজিরপুর থানার হারতা ফাঁড়ি। ২৩ অক্টোবর রাজশাহীর তানোর থানার পাঁচনদার ফাঁড়িতে মতিন-আলাউদ্দিন গ্রুপ সশস্ত্র হামলা করে সব লুটে নেয়। ২৫ অক্টোবর বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ থানার ভাষানচর ফাঁড়ি লুণ্ঠিত হয়। সর্বহারা পার্টির মারাত্মক হামলায়। এখানে নিহত হয় তিন পুলিশ সদস্য। ২৮ অক্টোবর সর্বহারা পার্টি বরগুনার পাথরঘাটা থানাতে অতর্কিতে হামলা চালায়। পুলিশদের বেঁধে রেখে সব লুট করে নিয়ে যায়। ১ নভেম্বর গণবাহিনীর খন্দকার আবদুল বাতেনের নেতৃত্বে টাঙ্গাইলের পাথরাইলের ফাঁড়িটিতে হামলা করা হয়। গুলিতে থানাটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ও লুণ্ঠিত হয়। ১৪ নভেম্বর সুন্দরবনে সেনাবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সর্বহারা পার্টির সশস্ত্র লড়াই হয়। এতে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে। অনেকে আত্মসমর্পণ করে। ২২ নভেম্বর সিলেটের বালাগঞ্জ থানায় গণবাহিনী অতর্কিতে হামলা করে সব অস্ত্রশস্ত্র লুটে নেয়। ২৩ নভেম্বর গাজীপুরের কালীগঞ্জ থানার বারোবাজার ফাঁড়িতে গণবাহিনী ব্যাপক হামলা করে সব লুটে নেয়। ২৫ নভেম্বর রাজশাহীর তানোর থানার পচনদর ফাঁড়ি লুট করে মতিন-আলাউদ্দিন গ্রুপ। ২৯ নভেম্বর কুমিল্লার মতলব থানায় গণবাহিনী হামলা ও লুটপাট চালায়। থানাটিকে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করে। এখানে স্মর্তব্য, ১৪ অক্টোবর আওয়ামী লীগ, মোজাফফর ন্যাপ ও সিপিবি সমন্বয়ে ‘গণঐক্যজোট’ গঠন করা হয়। এরপরও জাসদের গণবাহিনী, সর্বহারা, মাওবাদী চরমপন্থি, রাজাকার আলবদর সমন্বিত গ্রুপগুলোর গুপ্তহত্যা, নাশকতা ও অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা হ্রাস পায়নি। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলা ও ফাঁড়ি লুটের ঘটনা শুধু জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা ও ভীতির সঞ্চারই সৃষ্টি করেনি, এতে জানমালেরও বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৯৭৩ সালের জাতীয় বিজয় দিবসের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু বেতার টিভিতে জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দেন, তাতে উল্লেখ করেছেন, ‘বিপ্লবের নামে যারা উচ্ছৃঙ্খল স্বেচ্ছাচারে মাতেন, তারা বিপ্লবের মিত্র নন। জনগণেরও বন্ধু নন। আপনারাও এই গুপ্তহত্যা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। আমরা প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ গ্রহণের নীতিতে বিশ্বাসী নই।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন