সেই আন্ডারওয়ার্ল্ড কাহিনী (১০)

গ্যাং কিলিং মাস্টার সুব্রত বাইন

ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ল্যাবরেটরিতে মানুষরূপী দানব বানিয়েছিলেন। পরে সেই দানবের হাতেই খুন হন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। বাংলাদেশেও অনেক ডনকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের সঙ্গে তুলনা করা যায়।

তিনি আন্ডারওয়ার্ল্ডের গ্যাং কিলিং মাস্টার। রাজধানী ছাপিয়ে তিনি বিভিন্ন জেলায় মানুষ খুন করেছেন। তার নামে উঠছে কোটি কোটি টাকার চাঁদা। ট্রিপল, ডাবলসহ নানা কৌশলে তিনি খুনের ঘটনা ঘটান। দিন-রাত তার কাছে কোনো পার্থক্য নেই। যখন-তখন লাশ ফেলতে পারেন। বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকার অন্যতম সদস্য তিনি। পুলিশের ঘুম হারাম করে দেওয়া এই দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীর ভয়ঙ্কর সব অপরাধে আন্ডারওয়ার্ল্ড পর্যন্ত থাকে অস্থির। তার অপরাধের পরিধি শুধু দেশের সীমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সীমানা পেরিয়ে ভিন দেশেও তিনি ভীষণ তৎপর। নেপালের জেল ভেঙে পালিয়েছেন তিনি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পুলিশেরও তিনি তালিকাভুক্ত শীর্ষ অপরাধী। তাকে গ্রেফতারে বাংলাদেশ সরকার যেমন ইন্টারপোলের সহযোগিতা চেয়েছে, তেমনি বাংলাদেশি শীর্ষ এই অপরাধীকে পাকড়াওয়ে ভারত সরকারও ইন্টারপোলের সহযোগিতা চেয়েছিল। তিনি সিঙ্গাপুর, চীন, মালয়েশিয়া এবং দুবাইতে
ব্যবসা করছেন ভিন্ন নামে। তার সঙ্গে ভারতের ডন দাউদ ইব্রাহিমের যোগাযোগ রয়েছে বলেও খবর রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে।
বাংলাদেশের শীর্ষ এই অপরাধীর নাম সুব্রত বাইন। আন্ডারওয়ার্ল্ডে গ্যাং কিলিং জনপ্রিয় করে তোলেন অপরাধ জগতের এই মুকুটহীন সম্রাট। রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডের শক্তিশালী দুটি গ্রুপের মধ্যে অন্যতম সেভেন স্টারের তিনি জনক। ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশের পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন। বর্তমানে তিনি কলকাতায় কারাগারে আটক রয়েছেন। সুব্রত বাইনের বাবার নাম বিপুল বায়েন। মা কুমুলিনি বায়েন। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। পারিবারিক জীবনে তিনি তিনটি বিয়ে করেছেন। বাংলাদেশে দুটি, পশ্চিমবঙ্গে একটি। তার প্রথম স্ত্রীর নাম লুসি। সেই ঘরে তার দুই সন্তান। দ্বিতীয় স্ত্রী সুইটির সঙ্গে তার ডিভোর্স হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া এলাকার মেয়ে জামেলা খাতুন তার তৃতীয় স্ত্রী। তার সঙ্গেই তিনি রয়েছেন। ১৯৯৭ সালে নয়াপল্টন এলাকার একটি হাসপাতাল থেকে গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরাম সুব্রতকে তার ১২ সহযোগীসহ গ্রেফতার করে। সুব্রত বাইন জেলে থাকার সময় তার স্ত্রী লুসির সঙ্গে তার গ্রুপের এক যুবকের প্রেম হয়। পরবর্তীতে সুব্রত বাইন জেল থেকে বেরিয়ে এসে তার স্ত্রী লুসিকে নিজেই বিয়ে দেন ওই যুবকের সঙ্গে। সুব্রত বাইনের বাবা মা টঙ্গীর নিজস্ব বাড়িতে থাকেন।১৯৮৭ সাল থেকে মগবাজার কেন্দ্রিক আন্ডারওয়ার্ল্ডে বিচরণ করতে শুরু করেন সুব্রত বাইন। রফিক মার্ডার দিয়ে খুনাখুনিতে জড়ান সুব্রত। এরপর একে একে ট্রিপল, ডাবল মার্ডার।গ্যাং কিলিং : ২০০০ সালের ২৯ আগস্ট। রাজধানীর খিলগাঁও ৪৪৬/সি নম্বর বাড়ির নিচতলার একটি ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয় তিন যুবকের লাশ। তিনজনকেই হত্যার পর এসিড দিয়ে মুখ ঝলসে দেওয়ার চেষ্টা করে খুনিচক্র। এরপরও তিনজনকেই শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এদের একজন হলেন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ শীর্ষসন্ত্রাসী গোপীবাগের আসিফ, তার দেহরক্ষী গিয়াসউদ্দিন টিপু এবং সহযোগী রিপন। এ ঘটনার বেশ কিছুদিন আগে ঢাকার আগামাসী লেনের একটি পরিত্যক্ত কারখানার ভিতর খুন হন মামুন, গোপাল কর এবং নুরুল ইসলাম নামে তিন যুবক। এই তিনজনই আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ অপরাধী। আরজত পাড়ার গোসাইঘাটে খুন হন তিন স্বর্ণ ব্যবসায়ী।  ঢাকার এসব গ্যাং কিলিংয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ ডন সুব্রত বাইন জড়িত। এ ছাড়া রাজধানীতে আরও বেশ কয়েকটি গ্যাং কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে, যার প্রায় প্রতিটিতেই সুব্রতের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা। আন্ডারওয়ার্ল্ডে সুব্রত বাইনের আবির্ভাবের পর গ্যাং কিলিংয়ের ঘটনা বেড়ে যায়। মূলত সুব্রত বাইনই আন্ডারওয়ার্ল্ডের গ্যাং কিলিং জনপ্রিয় করে তোলেন। অভিযোগ ওঠে, এসব হত্যাকাণ্ডে তাকে সহায়তা করেন একই দলের সুইডেন আসলাম। এই গ্যাং কিলিংকে কেন্দ্র করে দু’গ্রুপই দলভারি করতে থাকে। বাড়াতে থাকে অস্ত্রশস্ত্র। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে আসতে থাকে অত্যাধুনিক অস্ত্র। ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে উত্থান ঘটে সুব্রত বাইনের। পুলিশ সূত্র জানায়, আন্ডারওয়ার্ল্ডে হান্নানের অনুপস্থিতিতে তার দলের সদস্যরা সুব্রত বাইনের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। সেভেন স্টার আর ফাইভ স্টার নামে দুই ভাগ হয়ে যায় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড। সেভেন স্টারের নেতৃত্ব দেন সুব্রত বাইন। আর ফাইভ স্টার বাহিনী গড়ে তোলেন যুবলীগ নেতা লিয়াকত। লিয়াকতের ফাইভ স্টার গ্রুপে যোগ দেয় পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর, আরমান, জিসান, রনি, বিকাশ, প্রকাশ, নিটেল, আলাউদ্দিন, কিলার আব্বাস, আগা শামীম, কাজল এবং অশ্রু। অন্যদিকে সুব্রত বাইনের সেভেন স্টার বাহিনীতে যোগ দেয় মুরগি মিলন, তানভীরুল ইসলাম জয়, টোকাই সাগর, ইমাম হোসেন ইমাম, মোল্লা মাসুদ, সাইদুর রহমান নিউটন, তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ, তানজিল, কচি, টিক্কা, আসিফ, কালা লিয়াকত, জরিফ, নাটকা বাবু, মুরাদ, মানিক, চঞ্চল, জুলু এবং জন। এরা সবাই তখন ঢাকাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের একেকজন কুখ্যাত সন্ত্রাসী। লিয়াকতের সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন সুইডেন আসলাম হাত মেলায় সুব্রত বাইনের সঙ্গে। আর এতে আন্ডারওয়ার্ল্ডে শক্তি বাড়ে সুব্রত বাইনের। ২০০০ সালের ১৮ মে পুরান ঢাকার জজকোর্ট এলাকায় ফিল্মি কায়দায় খুন করা হয় হুমায়ুন কবির মিলন ওরফে মুরগি মিলনকে। পুলিশ জানায়, সেভেন স্টার গ্রুপের পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর এবং ডাকাত শহিদ এই হত্যা মিশনে সরাসরি অংশ নেয়। পুলিশের একাধিক সূত্রের মতে, শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘিরে যে স্বর্ণ চোরকারবারি হতো, তার নেতৃত্ব দিতেন মুরগি মিলন। ফাইভ স্টার গ্রুপের সঙ্গে একসময় ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, এমন একজন জানান, লিয়াকতের ফাইভ স্টার গ্রুপে থাকলেও একসময় দলের সঙ্গে বেইমানি করে টিক্কা। গোপনে সাহায্য করতে থাকে সেভেন স্টার প্রধান সুব্রত বাইনকে। ২০০১ সালে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে বন্দুযুদ্ধের পর ধরা পড়েন টিক্কা। গুলিবিদ্ধ টিক্কা পরে হাসপাতালে মারা যায়।ভারতে সুব্রত : মুরগি মিলন খুনের পর সুব্রত বাইন দেশ ছেড়ে পালান। তিনি কলকাতায় আত্মগোপন করেন। মোহাম্মদ আলী নামে তিনি কলকাতার অপরাধীদের নিয়ে গড়ে তোলেন বড় একটি চক্র। কলকাতার বালিগঞ্জে রয়েছে তার প্রাসাদোপম বাড়ি। সেখান থেকেই ১৩ লাখ রুপির জাল নোটসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ২০০৮ সালের ১১ অক্টোবর কলকাতা পুলিশের হাতে প্রথম গ্রেফতার হন সুব্রত। তিনি সেখানে মোহাম্মদ আলী নাম পরিচয়ে চলতে থাকেন। কলকাতা থেকে জামিনে মুক্তি পান তিনি। কলকাতার মোহাম্মদ বাপি নামে এক ব্যক্তি তাকে সহায়তা করতে থাকেন। একটি ফুটবল টিমের কর্মকর্তা হয়ে তিনি সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করেন। এরপর তিনি চান আর দুবাই গিয়ে ব্যবসা করেন। পরিচয় হয় দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে। দুবাই থেকে তারা যান নেপাল। কিন্তু তখনই ভারত সরকার তার নামে ইন্টারপোলে রেড নোটিস জারি করে। নেপালে আত্মগোপন করেন। ২০০৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সুব্রত বাইন সেখানে গ্রেফতার হন। ২০১২ সালের ৮ নভেম্বর সুব্রত বাইন ১২ সহযোগীসহ নেপালের কারাগার থেকে সুড়ঙ্গ কেটে পালান। এরপর ২৭ নভেম্বর কলকাতা পুলিশের হাতে ফের গ্রেফতার হন। এরপর থেকে তাকে দেশে ফেরাতে ভারতের সঙ্গে একাধিকবার বাংলাদেশ চিঠি চালাচালি করে। কিন্তু তাকে দেশে ফেরত আনা যায়নি। সর্বশেষ তথ্য মতে, গত মাসে আলীপুর কারাগারে আটক সুব্রত বাইনের কাছ থেকে সাতটি সিম কার্ড ও একটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে। যা লালবাজার পুলিশ হেড কোয়ার্টারে জমা রয়েছে। ওই সীমগুলো দিয়েই তিনি ঢাকায় নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। চাঁদাবাজি করছেন। চাঁদার টাকা রাজধানীর একটি মার্কেটের একজন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে নিয়মিত যাচ্ছে সুব্রত বাইনের কাছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন