কিলিং মেশিন মোল্লা মাসুদ
ল্যাবরেটরিতে মানুষরূপী দানব বানিয়েছিলেন ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। পরে সেই দানবের হাতেই খুন হতে হয় তাকে। বাংলাদেশেও অনেক ডনকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
মির্জা মেহেদী তমাল
১৯৯৭ সাল। ঈদের কয়েক দিন বাকি। রমজান মাসের শেষ সময়টাতে রাজধানী খুব ব্যস্ত। মার্কেট, বিপণিবিতান, ফুটপাথ, রাস্তায় ভীষণ ভিড়। মানুষের দম ফেলার সময় নেই। বিকালের দিকে মিরপুর চিড়িয়াখানা সড়ক দিয়ে মামুন তার স্ত্রীকে নিয়ে মার্কেটিং করে রিকশা করে যাচ্ছিলেন। তাদের হাতে বেশ কয়েকটি ব্যাগ। হঠাৎ তাদের রিকশার দুই পাশ দিয়ে দুটি মোটরসাইকেল অতিক্রম করে কয়েক গজ সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। মামুন বিপদ আঁচ করেই তার নিজ কোমর থেকে দ্রুত পিস্তলটি হাতে তুলে নিলেন। ততক্ষণে মোটরসাইকেল থেকে দুই যুবক নেমে দাঁড়িয়েছেন। একজনের দুই হাতে দুটি পিস্তল। আরেকজনের এক হাতে একটি। কালবিলম্ব না করে মামুন গুলি ছুড়তে শুরু করলেন। মুহূর্তেই দুই হাতে দুই পিস্তল ধরা যুবকটি শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তার দুই হাতের পিস্তলও তখন গর্জে উঠছে। অব্যর্থ গুলি। চারটি গুলি মামুনের শরীরে বিদ্ধ হলো। মুহুর্মুহু গুলির শব্দে প্রকম্পিত হলো গোটা এলাকা। শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়া যুবককে দেখে পথচারীরা তখন ভেবেছিল, সে প্রশাসনের লোক। যে কারণে যে যার মতো ঘটনাস্থল থেকে সরে গেল। রক্তাক্ত মামুনের দেহ পড়ে রইল রাস্তার ওপর। তার স্ত্রীকেও আর
দেখা যাচ্ছিল না। ঘাতক ওই যুবকটি মামুনের দেহের সামনে এসে দাঁড়াল। সে এতটাই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে যে, মামুনের নিথর দেহে আবারও গুলি চালাতে লাগল। তার সহযোগীরা এসে তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছে। এক পর্যায়ে জোর করেই তাকে সেখান থেকে সরিয়ে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল। ঘাতক ওই যুবকটির নাম মাসুদ। আন্ডারওয়ার্ল্ডে মোল্লা মাসুদ নামে পরিচিত। সে নিজ হাতে অন্তত দুই ডজন খুন করেছে। অপরাধ সাম্রাজ্যে সবাই তাকে কিলিং মেশিন হিসেবে জানে। সব কটি খুনই করেছে অপরাধ সাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাট দুর্ধর্ষ ডন সুব্রত বাইনের হয়ে। মোল্লা মাসুদ সেভেন স্টার গ্রুপের একমাত্র স্ট্রাইকার। আন্ডারওয়ার্ল্ডে খুনিকেই স্ট্রাইকার বলা হয়। সেভেন স্টার গ্রুপের প্রধান সুব্রত বাইনের সেকেন্ড ইন কমান্ড মোল্লা মাসুদের বাড়ি ঝালকাঠির মহাদেবপুর। তার বাবার নাম আমজাদ হোসেন। বাসা ঢাকার রমনার মিরবাগে। ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম ঘোষণা করা হয়। এ তালিকায় মোল্লা মাসুদ ছিল ১৩ নম্বরে। তাকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণার পাশাপাশি সারা দেশেই ছবিসহ পোস্টার করা হয়। দেশের ইমিগ্রেশনে তার ছবি টাঙিয়ে দেওয়া হয়। ইন্টারপোল তার নামে রেড নোটিস হুলিয়া জারি করে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে। মোল্লা মাসুদ পুলিশের তাড়া খেয়ে দেশের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আস্তানা গাড়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সেখানে গ্রেফতার হয় মোল্লা মাসুদ। এসএসসি পাসের পর মোল্লা মাসুদ ভর্তি হয় সিদ্ধেশ্বরী কলেজে। ওই কলেজে থাকার সময় জড়িয়ে পড়ে অপরাধ কর্মকাণ্ডে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ছাত্রলীগ থেকে মনোনয়ন চায়। না পেয়ে ছাত্রদলে ধরনা দেয়। সেখান থেকেও সে মনোনয়ন পায় না। শেষে ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগদান করে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভিপি পদে নির্বাচন করে। নির্বাচনে হেরে যায় মাসুদ। শিবিরে যোগদানের পর কয়েক মাস সে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের দেহরক্ষী হিসেবেও কাজ করেছে। যোগ দেয় সুব্রত বাইনের গ্রুপে। আন্ডারওয়ার্ল্ডে মাসুদ নামে আরও বেশ কয়েকজন থাকায় তার নামের আগে যোগ হয় ‘মোল্লা’ শব্দটি। শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল বলেই তার নাম হয়ে ওঠে মোল্লা মাসুদ। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সুব্রত বাইনের গ্রুপে যোগদানের পর মোল্লা মাসুদকে বেশ কয়েকটি কাজে পাঠানো হয়। যেখানে তাকে হুমকি-ধমকির জন্য পাঠানো হতো, সে খুন করে চলে আসত। চাঁদা দাবি করতে চিঠি নিয়ে গেলেও খুন করা ছাড়া ফিরে আসত না। যে কারণে শুধু খুনের কাজেই তাকে ব্যবহার করত সুব্রত বাইন। মোল্লা মাসুদের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, মোল্লা মাসুদ তার গ্রুপের সবাইকে বলত, কাম (আন্ডারওয়ার্ল্ডে খুন করাকে কাম বলে) ছাড়া তার ভালো লাগে না। গুলি করার পর ফিনকির মতো রক্ত বেরোতে না দেখলে তার মনে হয় না যে কিছু একটা করেছে। মাসুদের ভাষায়, ‘চোখের সামনে দাপরায়া দাপরায়া কেউ মরতাছে, তা দেখলে খুব ভালো লাগে।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন