[সম্প্রতি দেশে একাত্তর ও একাত্তর-পরবর্তী রাজনীতির বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে নতুন করে আগ্রহ ও বিতর্ক লক্ষ করা যাচ্ছে। এবার এই বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত ‘বাঙলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএফ’-এর ভূমিকা। বিশেষত একাত্তরে কী প্রেক্ষাপটে এই গোপন বাহিনী গড়ে উঠেছিল এবং তার ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধে ও যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজ জীবনে কীরূপ ফলাফল বয়ে এনেছে, তা নিয়ে সম্প্রতি জাতীয় সংসদে ও গণমাধ্যমে তীব্র বিতর্ক দেখা যাচ্ছে। এই বিতর্কের খানিকটা পটভূমি জানতে এখানে গবেষক আলতাফ পারভেজ-এর ‘মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী: ইতিহাসের পুনর্পাঠ’ শীর্ষক প্রকাশিতব্য গবেষণা গ্রন্থটি থেকে প্রথম দুটি অধ্যায় সংক্ষিপ্ত আকারে পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। আলোচ্য গবেষণা গ্রন্থটি শিগগির প্রকাশিত হবে। এখানে প্রকাশিত অংশে কিছু তথ্যসূত্র বাদ দেয়া হয়েছে, যা আগ্রহী পাঠক মূল গ্রন্থে পাবেন।]
‘মুজিব বাহিনী’র জন্ম : নেতৃস্থানীয় সংগঠকদের দাবি
মুজিব বাহিনীর প্রধান চার নেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। ভারতীয়রা এই নেতাদের আদর করে বলতেন ‘অবিচ্ছেদ্য চার’। মুক্তিযুদ্ধের পর শেখ মণি জীবিত ছিলেন চার বছর। আবদুর রাজ্জাক মারা গেছেন ২০১১ সালের ২৩ ডিসেম্বর। বাকি
দুজন এখনও জীবিত। কিন্তু চারজনের কেউই এই বাহিনীর জন্ম ও কার্যক্রম নিয়ে ক্ষুদ্র আয়তনের সাক্ষাৎকার ছাড়া কোথাও আনুষ্ঠানিকভাবে বিস্তারিত কিছু লিখেননি, বলেননি। বিশেষত মুজিব বাহিনীর প্রধান এক সংগঠক সিরাজুল আলম খান বরাবরই এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক মতামত দিতে অনিচ্ছুক। তবে তার একটি ‘অফিসিয়াল ওয়েবসাইট’ রয়েছে (http://www.serajulalamkhan.co.uk/prson.htm)- যেখানে তাকে মুজিব বাহিনীর পূর্ববর্তী সাংগঠনিক কাঠামো ‘স্বাধীনবাংলা নিউক্লিয়াস’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলাদেশের ‘স্থপতি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সঙ্গত কারণেই এইরূপ বর্ণনা ও দাবি খুবই সংক্ষিপ্ত হিসেবে বিবেচিত হয়।
শেখ ফজলুল হক মণিরও একইভাবে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না, যদিও যুদ্ধোত্তর সময়ে দৈনিক ‘বাংলার বাণী’তে নানান বিষয়ে বিস্তর লিখেছেন তিনি। এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৫ খণ্ডে মুক্তিযুদ্ধের যেসব দলিলপত্র প্রকাশিত হয়েছে, একটি খণ্ড তার পুরোপুরি সাক্ষাৎকার বিষয়ক হলেও তাতে মুজিব বাহিনীর সংগঠকদের কারও বক্তব্য সংকলিত ও সংরক্ষিত হয়নি। এসবই বিস্ময়কর।
তবে একাত্তরে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমর কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই এই প্রভাবশালী ছাত্র ও যুবনেতাদের সম্পর্কে এবং তাদের যুদ্ধকালীন, যুদ্ধপূর্ব এবং যুদ্ধ-পরবর্তী সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম সম্পর্কে গুরুত্বের সঙ্গে মতামত দিয়েছেন। এরূপ মতামত প্রদানকারীদের মধ্যে বিশিষ্ট অনেকে এ-ও দাবি করেছেন, সিরাজুল আলম খান ও তার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগীরা মুক্তিযুদ্ধকালে মূলধারার সশস্ত্র সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন না। এ প্রসঙ্গে মুক্তিবাহিনীর উপ-প্রধান, বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং ২০০৯ পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকারের মন্তব্য : ‘মুজিব বাহিনীর বড় অংশ যুদ্ধ করেছে বলে আমার জানা নেই। মুজিব বাহিনীর নেতৃত্ব পর্যায়ের খুব কম সদস্যই যুদ্ধ করেছেন।’ (পূর্বাপর)
অন্যদিকে, মুজিব বাহিনীর প্রথম ব্যাচের একজন সদস্য সারোয়ার হোসেন মোল্লা, যিনি পরবর্তীকালে রক্ষীবাহিনীর পরিচালক হয়েছিলেন, তিনি বলেন (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১ নভেম্বর ২০১২), ‘আমাদের প্রধান কাজ ছিল লিডারশিপ দেয়া, গাইড করা, ... পলিটিক্যাল কর্মকাণ্ড। তবে শুধু পলিটিক্স দিয়ে তো আর মানুষ ধরে রাখা যায় না, যদি না তাদের শেল্টার দিতে পারি। এ কারণে তখন কিছু কিছু অ্যাকশানে যেতে হয়েছে।’ পদমর্যাদার রকমফের থাকলেও যুদ্ধসংশ্লিষ্টদের এসব বিপরীতমুখী ভাষ্যে মুজিব বাহিনীর ‘যুদ্ধ’ ও ‘অ্যাকশন’ সবকিছুকে ঘিরে ধূম্রজালই কেবল বেড়েছে।
মুজিব বাহিনীর প্রথম সারির সংগঠকদের মধ্যে কেবল প্রয়াত কাজী আরেফ আহমেদ ১৯৯৫ সালে (২৮-২৯ মার্চ) তাদের যুদ্ধকালীন কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্যবহুল একটি লেখা লেখেন ‘দৈনিক জনকণ্ঠে’। তার বক্তব্য অনুযায়ী, পূর্ববাংলাকে স্বাধীন করার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৬২ সাল থেকে ছাত্রলীগে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে গোপন একটি ‘নিউক্লিয়াস’ কাজ করত, যে নিউক্লিয়াসের অপর দুই সদস্য ছিলেন আবদুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমেদ নিজে। পরে আরও অনেকে এই নিউক্লিয়াসে অন্তর্ভুক্ত হন। ওই ‘গোপন’ রাজনৈতিক নিউক্লিয়াসেরই একটি পরিবর্ধিত সংস্করণ হচ্ছে বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট বা বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী। তিনি লিখেছেন, ‘১৯৬৫ সাল থেকে নিউক্লিয়াসের তরফ থেকে আবদুর রাজ্জাক শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।’ আবদুর রাজ্জাক ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক। পরে সাধারণ সম্পাদকও হন।
কাজী আরেফের উল্লিখিত বক্তব্য যে সময়কে নির্দেশ করছে তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যময় দিকও রয়েছে। কাজী আরেফের বক্তব্যের পাশাপাশি ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য’ মামলা (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে যা খ্যাত, যদিও মামলায় উত্থাপিত অভিযোগ পুরোটাই যে সত্য ছিল, সে সম্পর্কে কর্নেল শওকত আলীসহ অভিযুক্তরাই সম্প্রতি স্বীকার করছেন)-এর বিষয়বস্তুকে যৌথভাবে বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন পূর্ববাংলার জন্য শিক্ষাঙ্গনে সিরাজ-রাজ্জাক-আরেফদের যে সময়ে ‘নিউক্লিয়াস’ বা ‘বিপ্লবী পরিষদ’ গঠন করতে উৎসাহ যোগাচ্ছেন এবং নিজে তাতে শরিক হচ্ছেন, ঠিক সে সময়ে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি অফিসাররা সশস্ত্র পন্থায় সামরিক ক্যুর আদলে পূর্ববাংলার ক্যান্টনমেন্টগুলো দখল করে দেশের এ অঞ্চলকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে যে ‘বিপ্লবী সংস্থা বা সেল’ গঠন করে, তাতেও তিনি নিজেকে যুক্ত করছেন।
১৯৬৮ সালে দায়েরকৃত রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য মামলার বিবরণী থেকে দেখা যায়, ১৯৬৪ সাল থেকে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে বাঙালি সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর কর্মকর্তারা একযোগে সেনা ছাউনীগুলো দখল করে পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের বন্দী করার মাধ্যমে পূর্ববাংলাকে স্বাধীন করার জন্য কাজ করছিলেন।
মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন আগরতলা মামলার ২ নং আসামি। তার জন্ম ১৯৩২ সালে পিরোজপুরে। ১৯৫০ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হন। বাঙালি সৈনিকদের সংগঠিত করে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীতে একটি গুপ্ত সংগঠন গঠন করেছিলেন তিনি। তাদের এই ‘উদ্যোগ’-এ স্থানীয় ভারতীয় দূতাবাসের নিয়মিত সহযোগিতা ছিল। এমনকি উপরোক্ত বিপ্লবী পরিষদ ভারতীয়দের সঙ্গে দীর্ঘ যোগাযোগের ভিত্তিতে দুজন সদস্যকে প্রতিশ্রুত অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ভারত নিয়ন্ত্রিত আগরতলাও পাঠিয়েছিল ১৯৬৭ সালের ১২ জুলাই। ১৯৬৭-এর জুলাইয়ের এই যোগাযোগপর্ব সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় পাকিস্তানের লে. জেনারেল কামাল মতিনুদ্দীনের লেখা ‘Tragedy of Errors’ গ্রন্থে। সেখানে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর এই কর্মকর্তা জানাচ্ছেন, ভারতীয় যে দূতাবাস কর্মকর্তা ওই সময় পূর্ববাংলার রাজনীতিবিদ ও সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন তিনি হলেন দূতাবাসের চট্টগ্রামস্থ ফার্স্ট সেক্রেটারি Mr. P. N Ojha ১৯৬৭ সালের জানুয়ারিতে লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর বিজয়ে এই যোগাযোগ বেগবান হয়।
এসবই হচ্ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের জ্ঞাতসারে। সশস্ত্র সামরিক অফিসারদের উল্লিখিত বিপ্লবী সংস্থার সঙ্গে মাঝে মাঝেই করাচি, ঢাকা ইত্যাদি নানান স্থানে বৈঠক করতেন মুজিবুর রহমান। সুতরাং পূর্ববাংলাকে কেন্দ্র করে একটি নতুন দেশের কথা শেখ মুজিবুর রহমান ভেবেছিলেন কি না, সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন তরফ থেকে ওঠা প্রশ্নটি অবান্তর। তবে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ রয়েছেÑ উল্লিখিত লক্ষ্যে তিনি কতটুকু প্রস্তুত করেছিলেন দেশবাসীকে।
বস্তুত, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বাইরে ১৯৬২-৬৩-এর পর থেকে মুজিবুর রহমান জ্ঞাতসারে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার জন্য একাধিক গোপন তৎপরতায় যুক্ত ছিলেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা ভারতীয় সহযোগিতার মাধ্যমেই এগোচ্ছিল। ওপরে কাজী আরেফ আহমেদের দেওয়া ছাত্রলীগকেন্দ্রিক নিউক্লিয়াসের যে বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে, তার পরবর্তী বিকাশকে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য’ মামলার আলোকে মনযোগসহ লক্ষ করলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনেক নতুন অধ্যয়ন-সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য’ মামলার অভিযোগনামা এবং এ ‘অভিযোগ’ সম্পর্কে মামলার অন্যতম অভিযুক্ত কর্নেল শওকত আলীর বক্তব্য বিশেষ তাৎপর্যবহ। তিনি স্পষ্টত জানাচ্ছেন, ‘অভিযোগনামায় উল্লিখিত সব ঘটনা সত্য ছিল।’
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আরেকজন অভিযুক্ত বেসামরিক কর্মকর্তা আহমেদ ফজলুর রহমানও সাংবাদিক আফসান চৌধুরীকে দেয়া তার সাক্ষাৎকারে অনুরূপ সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি জানাচ্ছেন, ‘পাকিস্তানে প্রথম মার্শাল ল’র সময় থেকে স্বাধীনতার চিন্তাটা শুরু। আমরা কয়েকজনÑ রুহুল কুদ্দুস, মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী মিলে... শেখ মুজিবও আসতেন। অধিকাংশ মিটিং হয়েছে আমার শ্বশুরবাড়ি ১০ আগামসি লেনে।... তখন থেকে আমরা বাংলাদেশকে আলাদা করার কথা ভাবছি। আমরা তখন ভারতের সাহায্য গ্রহণের চেষ্টা করি। ইন্ডিয়ার সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ আমিই করেছি। আমাদের যেসব মিটিং হতো সেখানে ইন্ডিয়ার হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারিও আসতেন। ... ভারতীয় গোয়েন্দাদের সঙ্গে আলোচনায় স্বাধীনতার ব্যাপারে সাহায্য চাইতাম। দরকার ছিল আর্মস। ... শেখ সাহেব সব জানতেন। তাকে আগরতলায়ও পাঠানো হয়েছিল।’ ১৯৬২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের সেই আগরতলা যাত্রার অন্তরঙ্গ বিবরণ পাওয়া যায় তার আপন ফুফাতো ভাই মমিনুল হক খোকার তরফ থেকেও। জনাব হক তখন মুজিব পরিবারের সঙ্গে একই বাসায় থাকতেন। আত্মজৈবনিক গ্রন্থে (অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জ্বল) তিনি বিস্তারিত জানিয়েছেন, কীভাবে দুই সিএসপি প্রয়াত রুহুল কুদ্দুস ও আহমেদ ফজলুর রহমান এবং সিলেটের চা-বাগান মালিক মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী মুজিবের ওই যাত্রার আয়োজন করেছিলেন। ঢাকার ফুলবাড়িয়ার পরিবর্তে কুর্মিটোলা থেকে মুজিবুর রহমান সেবার ট্রেনে করে প্রথমে কুলাউড়া যান এবং সেখান থেকে পায়ে হেঁটে সীমান্ত অতিক্রম করেছিলেন। মমিনুল হক খোকাই তাঁকে ট্রেনে তুলে দিয়েছিলেন।
তারপরও অবশ্য ‘আগরতলা মামলা’কে ষড়যন্ত্র হিসেবেই চিহ্নিত করেছিল পূর্ব-পাকিস্তানের তখনকার রাজনীতি এবং সেই রাজনীতি মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েই পাকিস্তান সরকার ওই মামলায় অভিযুক্তদের ছেড়ে দেয় ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আর মুজিবুর রহমান আগরতলা মামলার আটকাবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার পর কাজী আরেফের ভাষ্য অনুযায়ী সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তাকে নিয়ে একটি ‘ফোরাম’ গড়ে তোলা হয়। পরবর্তীকালে, ১৯৭০ সালের কোনো এক সময় ছাত্রলীগের মধ্যে যারা সিরাজুল আলম খানের নিউক্লিয়াসে জড়িত ছিলেন না, তাদের মধ্য থেকে আরও দুজনকে (শেখ ফজলুল হক মণি ও তোফায়েল আহমেদ) ওই ফোরামে যুক্ত করা হয়। এটা ঘটেছিল একই সঙ্গে মুজিবের আগ্রহ এবং ‘নিউক্লিয়াস’ সংগঠকদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে।’
মুজিব বাহিনীর নেতৃস্থানীয় সংগঠক হওয়া ছাড়াও একই সঙ্গে মুজিব বাহিনীর উৎস সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’-এর প্রাথমিক তিন সদস্যের একজন ছিলেন বিধায় কাজী আরেফের মুজিব বাহিনী সম্পর্কিত উপরোক্ত বক্তব্যকে বর্তমান অনুসন্ধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা হিসেবে নেয়া হয়েছে। কাজী আরেফ আহমেদের এ ভাষ্যটি এ কারণেও গুরুত্বপূর্ণ যে, তাঁর দাবি থেকে স্পষ্ট, ১৯৭১-এর অন্তত নয় বছর আগে থেকে পাকিস্তান ভেঙে পূর্ববাংলায় একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করছিলেন তারা এবং আলোচনায় এ-ও দেখা যাবে, আওয়ামী লীগের বয়োজ্যেষ্ঠ অন্যান্য নেতার অজ্ঞাতেই শেখ মুজিবুর রহমান এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন। পরের আলোচনায় আমরা দেখব, এই ‘প্রক্রিয়া’র সঙ্গে কোনো একপর্যায়ে ভারতীয় বিভিন্ন সংস্থার সম্পৃক্তি মুজিবের মাধ্যমেই ঘটে, যদিও আরেফ তা অস্বীকার করেছেন।
ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কথিত ওই নিউক্লিয়াস সম্পর্কে সাংগঠনিকভাবে আরও বিস্তৃত এবং কিছুটা ভিন্নতর বিবরণ দিয়েছেন পরবর্তীকালে নিউক্লিয়াসভুক্ত তৎকালীন আরেক ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রব (কালের কণ্ঠ, ২৪ জানুয়ারি ২০১৩)। ১৯৬৯-৭০-এর ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক আ স ম রবের মতে, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফের বাইরে ‘আরও দুজনকে পরে নিউক্লিয়াসে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়, তারা হলেন ছাত্রলীগ নেতা আবুল কালাম আজাদ ও এম এ মান্নান। ১৯৬৮ নাগাদ এই নিউক্লিয়াস সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ৩০০ ইউনিট গঠন করে। প্রতি ইউনিটে ৯ জন করে সদস্য ছিল। প্রতি মহকুমায় ৪-৫ জন সদস্য থাকতেন। মহকুমার বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঁচজন সদস্য নিয়ে গোপন কমিটি গঠিত হতো। ১৯৬৮-৭০ নাগাদ নিউক্লিয়াসের সদস্য দাঁড়ায় সাত হাজার।’ আ স ম আব্দুর রব অবশ্য তার ভাষ্যে ‘শেখ মুজিবুর রহমান-এর অনুরোধে’ কেবল ফজলুল হক মণিকে নিউক্লিয়াসভুক্ত করা হয় বলে উল্লেখ করেন; তবে এ-ও বলেন, ‘নিউক্লিয়াসের সবাই ভারতে ট্রেনিং নিয়েছিলেন।’
কাজী আরেফ আহমেদ তার বক্তব্যে জানিয়েছেন, শেখ মুজিব সে সময়ই (অর্থাৎ একাত্তরের পূর্বেই) চার যুবনেতাকে (সিরাজ, মণি, রাজ্জাক ও তোফায়েল) ‘পাকিস্তানি সামরিক শক্তির সম্ভাব্য আঘাত মোকাবেলার প্রস্তুতি হিসাবে ছাত্র-যুবকদের জঙ্গি বাহিনী গড়ে তোলার নির্দেশ দেন এবং এভাবেই প্রতিষ্ঠা ঘটে বিএলএফের। এই সংগঠনের সঙ্গে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সংশ্লিষ্টতা আষাঢ়ে গল্প মাত্র।’
কাজী আরেফ আরও লিখেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চের পূর্বে (এবং তাজউদ্দীনের উপস্থিতিতেই) ওই চার যুবনেতাকে ‘কলকাতার ভবানীপুরস্থ একটি ঠিকানা’ দিয়ে সশস্ত্র লড়াই-সংগ্রামের দায়িত্ব ও সামরিক সহায়তার ‘সূত্র’ দিয়েছিলেন এবং মুজিবের নির্দেশ ছিল পাকিস্তানি আগ্রাসনের মুখে যেন রাজনৈতিকভাবে একটি ‘বিপ্লবী কাউন্সিল’ গঠন করা হয়। আরেফ আরও দাবি করেছেন, ‘চার নেতা’ ও বিএলএফের উপরোক্ত বিষয়াদি সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদ সবই জানতেন। ... এবং মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণ ও তত্ত্বাবধানে ভারতীয়দের কোনো রকম হস্তক্ষেপের সুযোগ ছিল না। সম্পূর্ণ স্বাধীন, স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও নিয়ন্ত্রণে মুজিব বাহিনী দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। তবে বিএলএফকে যে ভারতীয় জেনারেল উবান-ই প্রশিক্ষণ দেন, এটা কাজী আরেফ একই লেখায় স্বীকার করেছেন!
বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী সম্পর্কে প্রায় অনুরূপ বক্তব্য রয়েছে সাংবাদিক মাসুদুল হককে দেয়া প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাকের এক ক্ষুদ্র সাক্ষাৎকারে এবং তোফায়েল আহমেদের এক ক্ষুদ্রায়তনের লেখায় (দৈনিক প্রথম আলো, ৩ নভেম্বর ২০১২)। তোফায়েল সেখানে বলেন, একাত্তরের ১৮ ফেব্রুয়ারি আমাদের চার জনÑশেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও আমাকে বঙ্গবন্ধু ডাকেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন, ‘পড়ো, মুখস্থ কর।’ আমরা মুখস্থ করলাম, একটা ঠিকানাÑ ২১ রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা। বলেছিলেন, ‘এইখানে হবে তোমাদের জায়গা। ... আক্রান্ত হলে এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করবে।’ বঙ্গবন্ধু সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। চিত্তরঞ্জন সূতারকে আগেই কলকাতায় প্রেরণ করেছিলেন। ডাক্তার আবু হেনা প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য। তাকেও বঙ্গবন্ধু আগেই পাঠিয়েছিলেন অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে। যে পথে আবু হেনা গিয়েছিলেন, সেই একই পথে তিনি মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, মণি ভাই ও আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। রাজেন্দ্র রোডে আমরা অবস্থান করতাম। ৮ থিয়েটার রোডে অবস্থান করতেন জাতীয় চার নেতা। নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতো।
বিএলএফ-এর প্রতিষ্ঠা বিষয়ে কিছুটা ভিন্ন আরেকটি ভাষ্য পাওয়া যায় মুজিব বাহিনীর আরেক সুপরিচিত সংগঠক অধ্যাপক আফতাব আহমাদ-এর তরফ থেকে (দৈনিক ইনকিলাব, ১৫ এপ্রিল ২০০০)। তার মতে, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্রলীগের সমাজতন্ত্র অনুরাগী র্যাডিক্যাল ধারার কর্মীরা ভিয়েতনাম যুদ্ধের অনুপ্রেরণা থেকে সেখানকার ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রণ্টের আদলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ মুক্ত করার জন্য বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট গঠন করার চিন্তা করতেন। আবার চট্টগ্রাম অঞ্চলের আরেকজন বিএলএফ সংগঠক ডা. মাহফুজুর রহমান দাবি করেছেন, ‘সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে এই চিন্তা থেকে বঙ্গবন্ধু নিউক্লিয়াসের দুইজন ও শাসনতান্ত্রিক গ্রুপের দুইজন মোট চারজনকে নিয়ে যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই বাংলাদেশে বসে বিএলএফ গঠন করেন।’ নিউক্লিয়াস গ্রুপ ও শাসনতান্ত্রিক গ্রুপ বলতে এখানে সিরাজ ও মণি গ্রুপের কথা বলা হচ্ছে।
বিএলএফ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ছাত্র-যুব নেতাদের এসব ভাষ্যের সমর্থনসূচক বক্তব্য পাওয়া যায় প্রান্তিক জেলাগুলোতে অবস্থানকারী তাদের সহযোগীদের কাছ থেকেও। ছাত্রলীগে সিরাজপন্থীরা যে সম্ভাব্য মুক্তিযুদ্ধে ভিন্ন কোনো অবস্থান নিতে যাচ্ছে এবং সে বিষয়ে তারা যে দেশব্যাপী দূরবর্তী জেলার ছাত্র সংগঠকদেরও পরিকল্পিতভাবে নেটওয়ার্কভুক্ত করছিল, তার স্পষ্ট সাক্ষ্য মেলে সে সময়কার বৃহত্তর সিলেটের একজন ছাত্রনেতা মাহবুবুর রব সাদীর বক্তব্যে। সাদী সে সময় ছাত্রলীগে সিরাজপন্থী হলেও তিনি এইরূপ পরিকল্পনার বিরোধিতা করে মুজিব বাহিনীর পরিবর্তে চতুর্থ সেক্টরে যুদ্ধে যোগ দেন। তবে সবাই সাদীর মতো ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন এক্ষেত্রে স্বল্প ব্যতিক্রমদের একজন। সিরাজুল আলম খানের পৃথক কাঠামোর আহ্বানে তার অধিকাংশ অনুসারী ইতিবাচকভাবেই সাড়া দিয়েছে। এইরূপ আরেকজন আঞ্চলিক নেতা সিরাজগঞ্জের আবদুর রউফ পাতাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘মুক্তিবাহিনীর বাহিরে পৃথক একটি বাহিনীতে যোগ দেয়ার এইরূপ আহ্বান নিয়ে আপনাদের মনে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি তখন?’ উত্তরে বর্তমান লেখককে তিনি বলেন, ‘প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু ‘দাদা’র ওপর আমাদের প্রচণ্ড আস্থা ছিল। আমরা ভাবতাম উনি যা করছেন নিশ্চয়ই তা কোনো সুপরিকল্পনার ধাপ মাত্র। আমরা আসলে প্রশ্নহীনভাবে ওনাকে অনুসরণ করতাম।’ উল্লেখ্য, আবদুর রউফ পাতা পরে জাসদেও যোগ দিয়েছিলেন। সম্প্রতি মারা গিয়েছেন তিনি।
ওপরে মুজিব বাহিনী বা বিএলএফ-সম্পর্কিত কাজী আরেফ আহমেদের বক্তব্য এবং তার বক্তব্যের সমর্থনসূচক অন্যান্য (আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আব্দুর রব, আফতাব আহমাদ, মাহবুবুর রব সাদী প্রমুখের) যেসব বক্তব্যের উল্লেখ করা হলো তার সারসংকলন থেকে নিচের দাবিসমূহ উত্থাপিত হয় :
প্রথমত, মুজিব বাহিনী বা বিএলএফ গঠিত হয়েছে ২৫ মার্চের পূর্বেই; আরও স্পষ্টভাবে বললে, এ হলো ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ ‘নিউক্লিয়াস’ নামক গোষ্ঠীরই ধারাবাহিক বিকাশ এবং সম্ভাব্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ভার শেখ মুজিবুর রহমান নিজে এ বাহিনীর ওপর অর্পণ করেছিলেন। কাজী আরেফ আহমেদের বক্তব্যে স্পষ্টভাবে না থাকলেও অন্যান্য সূত্রের এ-ও দাবি, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ এ সময় একটি সশস্ত্র শাখার গোড়াপত্তন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ’৭১-এর শুরু থেকে ইকবাল হলে, বর্তমানে যা জহুরুল হক হল, রাতে নকল রাইফেল নিয়ে ট্রেনিং হতো। অর্থাৎ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ একাত্তরের বহু পূর্বেই ছাত্রদের মাঝে সশস্ত্র কার্যক্রমের সূচনা ঘটিয়েছিল। কেবল ঢাকায় নয়, অন্যান্য অনেক জেলায়ও ২৫ মার্চের পূর্বে এরূপ প্রশিক্ষণের কথা জানা যায়।
দ্বিতীয়ত, মুজিব বাহিনীর কার্যক্রমের সূচনাতে সিরাজুল আলম খানদের নিউক্লিয়াসে ছাত্রলীগের মণি-তোফায়েল-মাখনদের নেতৃত্বাধীন অংশের সমন্বয় ঘটেছিল। নিউক্লিয়াসের একাংশ একটি ‘সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’-এর স্বপ্নও দেখতেন।
তৃতীয়ত, বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর সঙ্গে মুজিবের সম্পর্ক বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদ ওয়াকিবহাল ছিলেন।
চতুর্থত, মুজিব বাহিনী ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড এনালিসিস উইং (Research and Analysis Wing- RAW)-এর সৃষ্টি এ তথ্য সঠিক নয়Ñ যদিও শেখ মুজিব একটি সুনির্দিষ্ট ‘ঠিকানা’ দিয়ে ছাত্রনেতাদের সেখানে যেয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে বলেছেন এবং এক্ষেত্রে দুজন মধ্যবর্তী ব্যক্তি ছিলেন চিত্তরঞ্জন সূতার ও ডা. আবু হেনা। চিত্ত সূতার সম্পর্কে এই লেখার অন্যত্র বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তার মতোই ডা. আবু হেনা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতীয় বিভিন্ন সংস্থার মধ্যকার যোগাযোগের মাধ্যম। সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থেকে তিনি সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মননোয়ন পান এবং প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হন।
পঞ্চমত, মুজিব বাহিনীর সঙ্গে প্রবাসী সরকারের মুখ্য ব্যক্তিদের বৈরিতার বিষয়টি একেবারেই ঠিক নয় বরং তারা এই সংস্থাটি সম্পর্কে পূর্বাপর অবহিত ছিলেন।
মুজিব বাহিনী বিষয়ে উপরোক্ত প্রতিটি দাবি বা মতকেই পরবর্তী আলোচনায় প্রাসঙ্গিক সূত্র ও বাস্তব তথ্যের আলোকে যাচাই করা হবে এবং আমরা দেখতে পাব, এসব অভিমতে সত্য ও মিথ্যার বিপজ্জনক মিশ্রণ ঘটে গেছে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, সিরাজুল আলম খানদের নিউক্লিয়াসের গঠন এবং তার পরবর্তী কাঠামো হিসেবে ‘মুজিব বাহিনী’র উপরে উল্লিখিত বিকাশকে এ পর্যায়ে পূর্ববাংলার তৎকালীন কমিউনিস্ট আন্দোলনের পটভূমিতেও বিবেচনা করা জরুরি। কারণ যুদ্ধকালে এবং যুদ্ধের পর পর দ্রুতই ব্যাপকভাবে মুজিব বাহিনীকে দেশের বামপন্থী বলয়ে মতাদর্শিক এবং শারীরিকভাবেও এক নতুন চরিত্র হিসেবে আভির্ভূত হতে দেখা যাবে। ইতিহাসের ওই সময়টিতে পূর্ববাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটকে অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত বামপন্থীরা যখন ‘শ্রেণী বৈষম্য’ হিসেবে দেখছিল, ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে সিরাজুল আলম খানদের উল্লিখিত ‘নিউক্লিয়াস’ তখন একে ‘জাতিগত বৈষম্য’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে। যে কারণে কথিত নিউক্লিয়াসকে এর উদ্যোক্তারা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে অভিহিত করতেন।
সিরাজুল আলম খানদের নিউক্লিয়াসের একটি সমাজতান্ত্রিক চরিত্র ছিল বলে বিভিন্ন উৎস থেকে শক্তিশালী সাক্ষ্য মেলে। তারপরও কেন খান নিজস্ব নিউক্লিয়াসে ছাত্রলীগের সমাজতন্ত্রবিরোধী গ্রুপের পুরোধাদের অন্তর্ভুক্তি মেনে নিলেন, তার ব্যাখ্যা হিসেবে মনে করা হয় মুজিবের জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার এবং তার মাধ্যমে প্রাপ্তব্য সম্ভাব্য ভারতীয় সহযোগিতা ব্যবহারের স্বার্থে সেটা ঘটেছিল। অন্যদিকে, মুজিব সমাজতন্ত্রের অনুসারী না হওয়া সত্ত্বেও শেখ মণি ও তোফায়েল আহমেদকে এই নিউক্লিয়াসে অন্তর্ভুক্ত করিয়েছিলেন আন্দোলনের ওই ভরকেন্দ্রে তার কর্তৃত্ব বাড়াতে। লক্ষণীয়, ইতিহাসের এই সময়টিতে ‘সমাজতন্ত্রী’ এবং ‘সমাজতন্ত্রবিরোধী’ উভয়ে পরস্পর যুথবদ্ধ হচ্ছে কেবল প্রভাব বলয় বিস্তৃতির প্রয়োজনে, আদর্শগত কোনো বিবেচনা থেকে নয়। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, সে সময় দেশের মূলধারার সমাজতন্ত্রীরা তাদের আদর্শ বপনের জন্য প্রথাগতভাবে শিল্পাঞ্চল ও কৃষক সমাজকে বেছে নিলেও সিরাজুল আলম খান কর্মএলাকা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ইকবাল হল, এস এম হল, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আহসানউল্লাহ হল, ক্যাফেটিরিয়া ইত্যাদি স্থানকে। তিনি তখন ছাত্রদের নিকট-ভবিষ্যতের রাজনীতির ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ মনে করতেন। তার এ অনুমান সত্য প্রমাণিত হয়েছিল।
উল্লেখ্য, পূর্ববাংলায় এ সময় অন্তত একটি মস্কোপন্থি (মণি সিংয়ের নেতৃত্বাধীন) এবং পাঁচটি পিকিংপন্থি ‘কমিউনিস্ট পার্টি বা গ্রুপ’ সক্রিয় ছিল। এসব উপদলের নেতা ছিলেন সুখেন্দু দস্তিদার, মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুল হক, দেবেন শিকদার, আবুল বাশার, আবদুল মতিন, আলাউদ্দিন, কাজী জাফর আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো এবং সিরাজুল হক সিকদার (সিরাজ সিকদার)। মস্কোপন্থি দল দীর্ঘ মেয়াদে শান্তিপূর্ণ সংসদীয় পথে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানো এবং স্বল্পমেয়াদে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও ‘সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ-সামন্তবাদবিরোধী’ একটি গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য যৌথ আন্দোলন গড়ে তোলা এবং পিকিংপন্থিরা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবে পৌঁছাতে কৃষক প্রলেতারিয়েতের সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে বলছিলেন। সশস্ত্র ‘লাইন’-এর কারণে পিকিংপন্থিরা সত্তরের নির্বাচনও বর্জন করে।
আপাতদৃষ্টিতে ৫০ থেকে ৬৫ সময়ে উভয় ধারার কমিউনিস্টদের সদস্য সংখ্যাই বাড়ছিল পূর্ববাংলায়। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় পূর্ববাংলায় যেখানে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সংখ্যা নেমে এসেছিল মাত্র কয়েক শ’তে, সেখানে ১৯৬৬ সালে মস্কো-পিকিং বিরোধ ও ভাঙনের আগে তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় অন্তত তিন হাজারে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, ঠিক এই সময়টিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলেও কমিউনিস্ট শক্তির উত্থান ঘটছিল। বাংলাদেশে অবশ্য শেষ পর্যন্ত জাতীয়তাবাদী উচ্ছ্বাসে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের প্রভাব বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ বাধাগ্রস্ত হয়। ইতিহাসের এ পর্যায়ে পূর্ববাংলায় জাতীয়তাবোধের নির্ধারক ভূমিকা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয় প্রায় উভয় ধারার বামপন্থিরাই। সিরাজুল আলম খানদের ‘নিউক্লিয়াস’ এবং সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে তরুণ মাওবাদীদের ক্ষুদ্র এক কেন্দ্র এক্ষেত্রে ছিল বিশেষ এবং মনযোগ আকর্ষণী ব্যতিক্রম।
বাংলাদেশে গত চার দশকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উচ্ছ্বাসপূর্ণ অনেক গ্রন্থ ও ইতিহাস রচনা হলেও একাত্তর-পূর্ব সময়ে যে কেবল উপরোক্ত দুটি গ্রুপই ‘স্বাধীনতা’র প্রসঙ্গটি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নিয়ে এসেছিল, সে বিষয়ে স্পষ্ট স্বীকৃতি পাওয়া যায় কমই। ‘নিউক্লিয়াস’ অনুসারীরা এক্ষেত্রে কিছুটা স্বীকৃতি পেলেও সিরাজ সিকদারের অনুসারীদের প্রতি সমকালীন ঐতিহাসিকরা পুরোদস্তুর বৈরী হয়ে থেকেছেন। অথচ রাজনীতির এই ধারাটি রণনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের অসামান্য নজির রেখেছিল সে সময়।
যত দূর জানা যায়, ভারতের নকশালবাড়ি আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সিরাজ সিকদার ১৯৬৬ সালে মাও সে তুং চিন্তাধারা গবেষণা কেন্দ্র এবং পরের বছর ‘পূর্ববাংলার শ্রমিক আন্দোলন’ নামে দুটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। সিরাজ সিকদার ও তার অনুসারীরা ১৯৭১ সালের মার্চের বহু আগেই প্রকাশ্যে পূর্ববাংলাকে পাকিস্তানের উপনিবেশ হিসেবে আখ্যায়িত করে পাকিস্তানি শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতার ডাক দেয় এবং নিজেরা সে কাজে নেমে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীসহ বাংলাদেশের মূলধারার মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করতে ভারতের ওপর নির্ভরতাকে যখন অলঙ্ঘনীয় নিয়তি ধরে নিয়ে এগোচ্ছিলেন তখন সিরাজ সিকদার ও তার অনুসারীরা সফলতার সঙ্গে নিজস্ব শক্তিতে দেশেই একাধিক ‘মুক্তাঞ্চল’ গড়ে তুলতে সফল হন (বরিশালে এইরূপ এক মুক্তাঞ্চলেই একাত্তরের ৩ জুন সিকদারের নেতৃত্বাধীন ‘পূর্ববাংলার শ্রমিক আন্দোলন’ পরিবর্তিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি।)
এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার শক্তিশালী উদ্যোগগুলো মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে সিরাজ সিকদারের তাত্ত্বিক ও রণনৈতিক উপরোক্ত অগ্রসরতাকে সব সময় যেমন নীরবতার চাদরে ঢেকে রাখতে পেরেছে, তেমনি দেশের অভ্যন্তরে থেকে অন্যান্য যেসব দেশপ্রেমিক শক্তি প্রতিরোধ গড়ে তোলায় উদ্যোগী ছিল (নরসিংদীর বেলাবো, শিবপুর; কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর; যশোরের নড়াইল-শালিখা-মোহাম্মদপুর-কালীগঞ্জ; নোয়াখালীর হাতিয়া ও লক্ষ্মীপুর, বাগেরহাটের বিষ্ণুপুর ইত্যাদি স্থানে) তাদের অভিজ্ঞতাও মনযোগ পেয়েছে কমই।
দুই.
উত্তাল মার্চে ছাত্রলীগের ‘নিউক্লিয়াস’
যুদ্ধ যেভাবে পূর্ববাংলার নিয়তি হয়ে উঠেছিল
এই লেখার প্রথম অংশে মুজিব বাহিনী সম্পর্কে তোফায়েল আহমেদ, কাজী আরেফ আহমেদ, আ স ম আব্দুর রব প্রমুখের যেসব বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে সে বিষয়ে অন্যান্য ঐতিহাসিক ভাষ্যের তুলনামূলক আলোচনায় যাওয়ার আগে সত্তর-একাত্তরের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, বিশেষত একাত্তরের মার্চে ছাত্রলীগের ‘নিউক্লিয়াস’-এর ভূমিকা সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য উপস্থাপন এ পর্যায়ে প্রাসঙ্গিক হবে। একাত্তরের মার্চে এসে ছাত্রলীগের কথিত ‘নিউক্লিয়াস’-এর রাজনৈতিক তৎপরতা এক চূড়ান্ত ও সিদ্ধান্তসূচক রূপ নেয়। সংক্ষেপে সে সময়কার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা যায় এভাবেÑ সামরিক-বেসামরিক গোপন নানান উদ্যোগে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও মুজিবুর রহমান তখন প্রকাশ্যে ‘ছয় দফা’ভিত্তিক এমন একটি পাকিস্তানের কথা বলছিলেন, যেখানে পূর্ব পাকিস্তান হবে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ, যার হাতে পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষার দায়িত্ব ছাড়া আর প্রায় সব প্রশাসনিক বিষয় থাকবেÑযার মধ্যে রয়েছে পৃথক মুদ্রা ব্যবস্থা, কর ধার্য ও আদায় এবং প্যারামিলিটারি গড়ে তোলার অধিকারও। অর্থাৎ তার দাবি অনুযায়ী মূলত পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশন এবং তার আওতায় পূর্ব পাকিস্তান হবে একটি স্বশাসিত প্রদেশ। ছয় দফা বাস্তবায়িত হলে পূর্ব পাকিস্তান তার সুবিধামতো যেকোনো দেশের সঙ্গে পৃথকভাবে বাণিজ্যিক সম্পর্কও করতে পারত।
সত্তরের নির্বাচনে জনগণ মুজিবের এসব দাবির প্রতি সরাসরি সমর্থন দিয়েছিল বলেই প্রতীয়মান হয়, যদিও নির্বাচনে দ্রব্যমূল্য কমানোর মতো নানা চিত্তাকর্ষক প্রতিশ্রুতিও ছিল তার। বস্তুত মুজিবের ছয় দফার মাঝে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানরা দেশটির পশ্চিম অংশের সঙ্গে অসমতা হ্রাসের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিল। যে অসমতা বাঙালিদের মাঝে বঞ্চনার একটি বোধ সৃষ্টি করে। বিশেষত যখন তারা দেখতে পায়, ‘পশ্চিমের নাগরিকরা তাদের চেয়ে ভালো খায়, ভালো পরে, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা সুবিধা পায় এবং উন্নত যানবাহন ও যোগাযোগ অবকাঠামোর মধ্যে থাকে।’
যদিও দেশটির পূর্ব অংশের চেয়ে পশ্চিমে বাজারের আকার ছিল বড় এবং বাঙালি মুসলমানদের বৃহৎ আয়তনের অর্থনৈতিক উদ্যোক্তা হিসেবে অবাঙালি মুসলমানদের চেয়ে অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা ও মেধার ঘাটতি ছিল ফলে এখানে অর্থনৈতিক বিকাশের গতি ছিল অপেক্ষাকৃত ধীর। কিন্তু পূর্বাংশের বাসিন্দারা দেখেছে, দেশটির বিত্তবান ৪৩টি শিল্পগোষ্ঠীর মাঝে মাত্র একটি বাঙালি (এ কে খান), তখন তারা নিজেদের ‘কোণঠাসা’ ভেবেছে; বিশেষ করে যখন তারা দেখে, সংখ্যায় বেশি হওয়া সত্ত্বেও (৫৬ শতাংশ) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভরকেন্দ্রগুলোতে তাদের প্রতিনিধি কম এবং আঞ্চলিক অসমতা কমাতে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকরা যথেষ্ট আন্তরিকও নন। বঞ্চনার এই বোধ দানা বাঁধায় ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি অর্থনীতিবিদদের মূল্যায়ন ও মতামত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্রনেতারাও একে সফলতার সঙ্গে রাজনীতির প্রধান ইস্যুতে পরিণত করতে পেরেছিলেন।
এ সময় বিশেষভাবে পূর্ব বাংলার উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণী মনে করেছিল, আওয়ামী লীগ ‘ছয় দফা আদায়’ করতে পারলে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে পশ্চিমের মধ্যবিত্তের পাশাপাশি তারও বিকাশের কিছু বাড়তি পরিসর তৈরি হবে। নির্বাচনের পর উঠতি মধ্যবিত্তের সেই আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন করার সংগ্রামেই লিপ্ত ছিলেন মুজিবুর রহমান। তার সেই সংগ্রাম ও দর-কষাকষি একাত্তরের মার্চে এক উত্তেজক ক্রান্তিকালে প্রবেশ করে। লক্ষণীয়, প্রকাশ্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোতেই পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ব্যাপকভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য মুজিবুর রহমান যখন লড়ছেন, তখন শিক্ষাঙ্গনে তার প্রধান শক্তিভিত ছিল ছাত্রলীগ এবং তাদের ভরকেন্দ্র ছিল সংগঠনটির অভ্যন্তরীণ উপরোক্ত ‘নিউক্লিয়াস’।
‘ছয়দফা’য় আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাসের সম্ভাবনা ছাড়াও সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে ইশতেহার প্রকাশ করে তাতে ‘সাম্রাজ্যবাদ-ঔপনিবেশিকতা-বর্ণবাদ’ বিরোধী বক্তব্য থাকায় তরুণদের মাঝে দলটির ছাত্র শাখা ‘ছাত্রলীগ’-এর আবেদন বেড়ে গিয়েছিল। ১৯৬৯-৭০ সময়ের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পূর্ব-পাকিস্তানের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৪২টি কলেজের মধ্যে ১৩২টিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ-সমর্থিত প্যানেল জয়লাভ করে। স্বভাবত সংগঠনটির আত্মবিশ্বাস ও আকাক্সক্ষা তখন তুঙ্গে। পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের সঙ্গে দর-কষাকষিতে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে মুজিবুর রহমানও ছাত্রলীগকে ব্যবহার করছিলেন সর্বোতভাবে। এ সময় তিনি ছয় দফার কথা বললেও এবং তার পক্ষ থেকে আইন উপদেষ্টা ড. কামাল হোসেনসহ অন্যরা ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টাদের কাছে ২৩ মার্চও (১৯৭১) পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমন্বয়ে কনফেডারেশনের প্রস্তাব পেশ করলেও ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াস তখন-
- স্লোগান দিচ্ছে, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ (১ মার্চ);
- তারা বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পতাকায় অগ্নিসংযোগ করছে এবং স্বাধীন বাংলার পতাকা তৈরি ও তা উত্তোলন করছে (২ মার্চ);
- ‘স্বাধীনতা’র ইশতেহার পাঠ করছে শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে পল্টন ময়দানে (৩ মার্চ);
- উর্দু সিনেমা প্রদর্শন বন্ধের জন্য হল মালিকদের ও উর্দু বই বাজার থেকে তুলে নেয়ার জন্য বইয়ের দোকানগুলোর প্রতি নির্দেশ সম্বলিত বার্তা প্রচার করছে (৮ মার্চ);
- ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে বোমা তৈরির রাসায়নিক লুট ও দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্দুকের দোকান থেকে আগ্নেয়াস্ত্র লুট করে (১০ মার্চ)
- বাংলাদেশের জন্য পৃথক জাতীয় সংগীত নির্ধারণ করে নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানের জাতীয় সংগীতের পরিবর্তে সেটাকে জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়া হচ্ছে; (১১ মার্চ)
- উর্দুবাসীদের আবাসস্থল ত্যাগ ও পাকিস্তানি সৈন্যদের চলাচল নিয়ন্ত্রণে ঢাকার পাঁচটি স্থানে চেকপোস্ট বসানো শুরু করছে (১৪ মার্চ);
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের সূচনা করেছে (১৭ মার্চ);
- ঢাকার কয়েকটি পত্রিকায় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’-এর মানচিত্র দিয়ে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করছে; দেশব্যাপী আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন দেশের পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছে ( ২৩ মার্চ);
- পল্টনে গণবাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান করছে। দশ প্লাটুন গণবাহিনীর সদস্য কর্তৃক স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্মান প্রদর্শন এবং মুজিবের হাতে সেই পতাকা তুলে দেওয়া হচ্ছে (২৩ মার্চ);
ছাত্রলীগের উপরোক্ত মার্চ কর্মসূচি মুজিবুর রহমানকে দর-কষাকষির প্রক্রিয়ায় এমন এক চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়, যেখানে পাকিস্তানের কাঠামোতে ছয় দফাভিত্তিক সমাধানের সুযোগ অনেকাংশে কমে যায়। ছাত্রলীগের সিরাজুল আলম খানদের অদৃশ্য ভরকেন্দ্রটি ঠিক এটাই চাইছিল। পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করার মতো ‘সিদ্ধান্ত’গুলো তারাই নিচ্ছিল, মুজিবুর রহমান তা অনুসরণ করতে বাধ্য হচ্ছিলেন কেবল। এমনিতে ‘ছয় দফা’ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার দূরত্ব ছিল খুবই কম। তার পরও ২৩-২৪ মার্চ পুরো সময়জুড়ে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে নিবিড়ভাবে আলোচনা চলছিল এবং অন্যতম আলোচক ড. কামাল হোসেন প্রতিনিয়ত সেই আলোচনার ফলাফলের ইতিবাচক আভাসও দিয়ে যাচ্ছিলেন মুজিবুর রহমানকে। কিন্তু মুজিবের হাতে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দিয়ে ছাত্রলীগ আলোচনার প্রক্রিয়ায় তার অবস্থানকে নিঃশেষ করে দেয় এবং ছয় দফা ও স্বাধীনতার মাঝের স্বল্প ব্যবধানটুকুও লুপ্ত করে দেয়। ছাত্রলীগের এসব কর্মসূচিতে মুজিবের অমত রয়েছে বলেও মনে হয়নি। পরিণতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এ নামে, তখন নিজ বাসভবনে বসে থাকা ছাড়া মুজিবের আর একটাই করণীয় ছিল, ভারতে চলে যাওয়া। কিন্তু তা হতো ভারতীয় গোয়েন্দাদের সঙ্গে তিনি ও তার সহযোগীদের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে পাকিস্তানিদের এত দিনের অভিযোগকে সরাসরি সত্যতা দান।
সিরাজুল আলম খানের পরিকল্পনা অনুযায়ী ছাত্রলীগ নেতারা যেভাবে নানা উদ্ভাবনী তৎপরতার মাধ্যমে মুজিবের স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামকে স্বাধীনতার সংগ্রামে ঠেলে দিয়েছিলেন, তেমনি পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্বও ২৫ মার্চ তাদের নির্মম অপারেশনের মাধ্যমে ‘সমঝোতা’র সব সুযোগ ধ্বংস করে দিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক দলিলপত্র এ-ও সাক্ষ্য দিচ্ছে, একাত্তরে ক্ষমতা হস্তান্তরকেন্দ্রিক সংকটের অন্যতম চরিত্র জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তার জেনারেল বন্ধুরাও চাইছিল পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাক। বিশেষ করে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান অন্তত সে রকমই সাক্ষ্য দিচ্ছেন। মৃত্যুর ২৭ বছর পর ২০০৫ সালে প্রকাশিত তার গোপন এফিডেভিটে ইয়াহিয়া বলছেন, ‘একাত্তরে ভুট্টো যেসব কথা বলেছেন, যেসব গোয়ার্তুমি করেছেন পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্টে নিঃসন্দেহে তা ছিল শেখ মুজিবের ছয় দফার তুলনায় অনেক বেশি আত্মঘাতী। ... নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে মুজিবুর রহমানকে মেনে নিতে ভুট্টো মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। পাকিস্তানকে আলাদা করার জন্য ভুট্টো সিজিএস লে. জে. গুল হাসান খান ও বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল রহিম খানকে নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন, যা আমি অনেক পরে জানতে পারি। ভুট্টো চাইছিল দ্বিখণ্ডিত পাকিস্তানের ক্ষমতা। একপর্যায়ে ভুট্টো এক পাকিস্তানে দুই প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্ব নিয়ে জেদ ধরেন। ভুট্টো যখন এ ধরনের আচরণ দেখান, তখনও ঢাকায় প্রকাশ্য জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণা ছিল পাকিস্তানের একতা ও সংহতির পক্ষে। ... ছয় দফা নিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অবস্থানও ছিল নমনীয়। ... তবে বরাবরই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে একটি উগ্রবাদী গোষ্ঠীও সক্রিয় ছিল।’
ইয়াহিয়ার উপরোক্ত ভাষ্য এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, মুজিব ও ভুট্টোর সঙ্গে মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে তিনিই দরকষাকষি করছিলেন। তার বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান, মুজিবুর রহমান যেমন তার তরুণ অনুসারীদের একাংশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি, তেমনি ইয়াহিয়াও তার জেনারেলদের বাঙালিবিদ্বেষী একাংশের সঙ্গে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সংযোগের বিধ্বংসী ফলাফল থামাতে পারেননি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওই জেনারেলরা পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের উদীয়মান জাতীয়তাবোধের মীমাংসা করতে চেয়েছিলেন গোলাগুলির মাধ্যমে; পূর্ববাংলায় মার্চ-আন্দোলনের গণভিত্তি সম্পর্কে তারা যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন বলে মনে হয় না। অন্যদিকে, মুজিবুর রহমান যে তীব্র দরকষাকষির মাঝেও মর্যাদাপূর্ণ একটি সমঝোতার বিষয়ে চেষ্টারত ছিলেন, যেমনটি ইঙ্গিত পাওয়া যায় ইয়াহিয়ার উপরোক্ত ভাষ্যে তার সমর্থন মিলে মুজিবের অন্যতম আলোচক ড. কামাল হোসেনের তরফ থেকেও। সামরিক শাসন প্রত্যাহার, নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য অধিকতর স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে একাত্তরের মার্চের নাটকীয় সেই দরকষাকষির বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে লিখিত ‘স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা: ১৯৬৬-১৯৭১’ শীর্ষক গ্রন্থের শেষ প্যারাটি শেষ করেছেন ড. কামাল হোসেন এভাবে :
‘২৫ মার্চে ভয়াবহ রাতের আগে সারাক্ষণ আমি একটি টেলিফোন পাওয়ার অপেক্ষা করলাম। এমনকি ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ আমি যখন শেখ মুজিবের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলাম, তখনও শেখ মুজিব আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি ওই টেলিফোন পেয়েছি কি না। ওই টেলিফোন কখনোই আসেনি।’
উল্লিখিত টেলিফোন আসার কথা ছিল দর-কষাকষির আলোচনায় যারা ইয়াহিয়ার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছিলেন- লে. জে. পীরজাদা, বিচারপতি কর্নেলিয়াস প্রমুখের কাছ থেকে। কিন্তু টেলিফোন যে আসেনি সেটা তো এখন ইতিহাসের অংশ। আর ওই টেলিফোন না আসার মধ্যদিয়ে শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তান সংকটের দ্বিতীয় পর্যায় এবং পূর্ব বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক অধ্যায়। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর নানান বিপরীতমুখী আচরণে যুদ্ধই তখন পূর্ববাংলার নিয়তি হয়ে ওঠে। বস্তুত ইয়াহিয়ার প্রতিনিধিরা যখন মুজিবের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসে সমঝোতার পথ খুঁজছেন তখন আবার নিজেদের মতো করে সংঘাতের জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ ক্ষেত্রে আলোচনার আড়ালে ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও পাকিস্তানি জেনারেলদের মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সামরিক অপারেশনের পূর্বপ্রস্তুতি এবং তাদের তরফ থেকে নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থকদের ক্ষমতাসীন হওয়ার ন্যায্য আকাক্সক্ষাকে আইন-শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হিসেবে দেখার গুরুতর ভ্রান্তির বিষয়টি রাজনৈতিক সাহিত্যে বেশ ভালোভাবেই আলোচিত; কিন্তু মুজিবের পক্ষ থেকেও একই সময়ে, এমনকি মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে স্থানীয় ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যে নিবিড়ভাবে যোগাযোগ করা হচ্ছিল সেই বিষয়ে এ পর্যায়ে অন্তত দুটি সূত্র থেকে নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য মেলে। ভারতের পেশাদার কূটনীতিবিদ চন্দ্রশেখর দাসগুপ্ত সেদেশের খ্যাতনামা ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় ২০১১ সালের ১৭ ডিসেম্বর 'Was there an Indian plot to break up Pakistan in 1971’ শীর্ষক লেখায় স্পষ্ট জানাচ্ছেন, ১৯৭১ সালে মার্চের প্রথম দিকেই আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে তাদের পূর্ববাংলার সম্ভাব্য বিচ্ছিন্নতার বিষয়ে আলোচনা হয়। তিনি লিখেছেন,
In early March, Tajuddin Ahmad met secretly with Deputy High Commissioner K.C. Sen Gupta, on Mujib’s instructions, to explore whether India would provide political asylum and other assistance in the event of a liberation war. After consulting Delhi, Sen Gupta gave a response that was insufficiently specific to satisfy Sheikh Mujib. In mid-March, the latter repeated his appeal for assistance at this critical hour for his country...
আরও নির্ভরযোগ্য অপর সূত্র (Srinath Raghavan, 1971: A Global History of the Creation of Bangladesh) থেকে এটা এখন প্রকাশ্য যে, ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার কে সি সেনগুপ্তের সঙ্গে সেদিন মুজিবের পক্ষ থেকে সাক্ষাৎ করেছিলেন ক্যাপ্টেন সুজাত আলী।
মার্চের শুরুতে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের তরফ থেকে ভারতীয়দের সঙ্গে যোগাযোগের সেটাই অবশ্য প্রথম চেষ্টা ছিল না। একই বিষয়ে আরও শক্ত সাক্ষ্য পেয়েছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক তালকুদার মনিরুজ্জামান। খোদ তাজউদ্দীন আহমদের ১৯৭৩ সালের ২৯ আগস্টে গৃহীত সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তিনি জানাচ্ছেন,
'At the Government level, some of the AL leaders contacted a top official of the Indian Deputy High Commissioners office at Dacca in the first week of March….The official concerned then went to Delhi, on the pretext of his daughter’s illness, and came back on 8 after having consulted the `appropriate authority.’ He assured the AL leaders that some help in terms of food-supply at the border and political asylum would be available.’
শেষোক্ত বৈঠকটি হয়েছিল ৫ ও ৬ মার্চ। এইরূপ যোগাযোগ যে সম্ভবত আরও পুরনো বৈঠকেরই ধারাবাহিকতা তার স্বীকৃতি রয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক সাম্প্রতিক একাধিক আন্তর্জাতিক গবেষণায়। যেমন, সাংবাদিক Gary J. Bass তার The Blood Telegram: India’s Secrer War in East Pakistan’-এ নয়াদিল্লির নেহরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরিতে রক্ষিত ‘হাকসার পেপার’ (সাবজেক্ট ফাইল ২২০) থেকে উদ্ধৃত করে জানাচ্ছেন, একাত্তরের ২ মার্চ, (২৫ মার্চের অন্তত তিন সপ্তাহ আগে) মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তার মুখ্য সচিব হাকসার এবং ‘র’ প্রধান কাও-কে জানাচ্ছেন, তিনি ‘বাঙালিদের কেবল ওষুধ এবং খাদ্যই নয়, ভারতের অভ্যন্তরে সীমান্তজুড়ে দ্রুত চলাফেরার জন্য একটি হেলিকপ্টার ও একটি ছোট এরোপ্লেন দিয়েও সহায়তার বিষয় বিবেচনা করছেন। পাশাপাশি এ সহায়তার মধ্যে থাকবে মেশিনগান, মর্টার ও অন্যান্য অস্ত্র এবং গোলাবারুদও।’ উল্লেখ্য, এ সময় (মার্চ ১৯৭১) ভারতীয় কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগে নিয়মিতভাবেই ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দের জায়গায় ‘বাংলাদেশ’ শব্দদ্বয় জায়গা করে নেয়Ñ স্পষ্টত, যা ছিল তাৎপর্যবহ। এ রকম এক যোগাযোগে ডি পি ধর, যখন তিনি মস্কোতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতÑ ইন্দিরা গান্ধীর মুখ্য সচিব হাকসারকে লিখছেন, This resistance must not be allowed to collapse.’ (Gary J. Bass ).
এ পর্যায়ে এ-ও বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ‘বাংলাদেশ’কে যথার্থ উপায়ে ‘সাহায্য’ প্রদানের বিষয় নজরদারি করার জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ক্যাবিনেট সেক্রেটারি কে স্বামীনাথন, স্বরাষ্ট্রসচিব গোবিন্দ নারায়ণ, প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি হাকসার, বিদেশ সচিব কাউল, বৈদেশিক গোয়েন্দা প্রধান কাওকে নিয়ে নীতিনির্ধারণী যে কমিটি করেছিলেন তা-ও গঠিত হয় ঢাকায় ২৫ মার্চের গণহত্যার অন্তত তিন সপ্তাহ আগেÑ ২ মার্চ। এই কমিটিতে পরে শুধু প্রতিরক্ষা সচিব কে বি লালকে সংযুক্ত করে নেয়া হয়েছিল।
চন্দ্রশেখর দাসগুপ্ত, তাজউদ্দীন আহমদ, Gary J. Bass, Srinath Raghavan প্রভৃতি সূত্রগুলো থেকে পাওয়া উপরোক্ত তথ্য-উপাত্ত ও মতামতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাষ্য মেলে ডা. আবু হেনার কাছ থেকেও। তাঁকে যে একাত্তরের ২৫ মার্চের বহু আগে ভারতে পাঠিয়েছিলেন শেখ মুজিব, সেটা ইতিপূর্বে তোফায়েল আহমেদের জবানিতে আমরা জানতে পেরেছি। বাস্তবে ডা. আবু হেনা কী ভূমিকা পালন করেছিলেন সেটা জানতে তার সাক্ষাৎকার নেয়া হয় ২০১৩ সালের ১ মে তার মিরপুরের (১০ নম্বর এলাকার) বাসায়। সেখানে ৭১ বছর বয়সী এই প্রবীণ জানান, ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে প্রথমে শেখ ফজলুল হক মণি এবং পরে শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে তিনি ‘পাসপোর্ট ছাড়াই’ ভারতে যান। সফরটি ছিল ভারতীয়দের অনুরোধে। ভারতীয়রা মুজিবের কাছে অনুরোধ করেছিলেন একজন ‘নির্ভরযোগ্য প্রতিনিধি’ পাঠাতেÑ ভবিষ্যৎ সহযোগিতা নিয়ে কথা বলার জন্য। সেই সূত্রেই তাকে পছন্দ করে পাঠানো হয়। বিশেষ করে ইংরেজি, উর্দু, হিন্দি ইত্যাদি ভাষা জানা এবং গোপনীয়তার সংস্কৃতিতে বিশেষ দক্ষতার কারণে তাকে এই কাজের জন্য ‘নির্বাচিত’ করা হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। ওই সফরকালে ভারতীয় গোয়েন্দারা রাজনৈতিক প্রয়োজনে সীমান্ত খুলে দেয়া, আগতদের প্রশিক্ষণ প্রদান, রেডিও স্টেশন তৈরি ইত্যাদি কয়েকটি বিষয়ে আশ্বাস প্রদান করেছিল। আবু হেনা আরও জানান, সফরকালে তাঁকে চিত্ত সূতারের ঠিকানাতেই পাঠানো হয়। ‘মুজিবুর রহমান সূতারকে আগে থেকে কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে ভারতীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। মুজিব জানতেন, সূতারের সঙ্গে ভারতীয়দের যোগাযোগ ছিল। কিন্তু ভারতীয়রা শুধু সূতারের সঙ্গে কথা বলে সন্তুষ্ট হতে পারছিল না। তারা ‘মুজিবের প্রতিনিধি’ কারও সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চাইছিল। তাই আমাকে পাঠানো হয়। সূতার আমাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের গোয়েন্দা প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করিয়ে দিয়েছিলেন। ... ২৫ মার্চের পর আমি মনসুর আলী, কামরুজ্জামান হেনা ও যুবনেতাদের চিত্ত সূতারের ওই ঠিকানাতেই নিয়ে যাই। পরে সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাকও সেখানে আসেন। সূতার অবশ্য সেখানে ভিন্ন নামে অবস্থান করতেন।’ ডা. আবু হেনা সাক্ষাৎকারে আরও জানান, তার মাধ্যমে সৃষ্ট এই যোগাযোগ ছাড়াও ‘তাজউদ্দীনের সঙ্গে ভারতীয়দের পৃথক যোগাযোগ ছিল’Ñ সেটা তিনি যুদ্ধ শুরুর পর জানতে পারেন।
উল্লেখ্য, ডা. আবু হেনা যুদ্ধের পূর্বে মুজিবের পক্ষ থেকে ভারতীয়দের সঙ্গে উপরোক্ত গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগে ভূমিকা পালন করলেও যুদ্ধ শেষে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তিনি মুজিব কর্তৃক গণপরিষদ সদস্যপদ হারান। তার ভাগ্য বিপর্যয়ের শুরু যুদ্ধক্ষেত্র থেকেই। ‘নিউক্লিয়াস’সংশ্লিষ্ট যুবনেতাদের চিত্ত সূতারের ঠিকানায় পৌঁছে দিলেও ডা. হেনা মুজিব বাহিনীতে যোগ দেননি এবং মুজিব বাহিনী গঠনেরও বিরোধিতা করেন। ফলে চার যুবনেতা যে বাড়িতে অবস্থান করতেন সেখান থেকে ২০ দিন পরে চলে আসেন বা চলে আসতে হয় তাকে। এছাড়া তিনি যুদ্ধের পরপরই সমাজতান্ত্রিক ধারায় দেশ পুনর্গঠনেরও বিরোধিতা করেন। তার মতে, ‘ওই পরিস্থিতিতে এটা ছিল ভুল পথ’Ñ ফলে মুজিব বাহিনীর দুই গ্রুপের কোনটিতেই তার ঠাঁই হয়নি।
ওপরে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বিবিধ সূত্রে ভারতীয়দের ‘যোগাযোগ’-এর যেসব বিবরণ তুলে ধরা হলো, তা যে ১৯৭০ সালে এসে হঠাৎ করে গড়ে ওঠেনি, সে বিষয়ে এ লেখার প্রথম অংশেও একদফা বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। প্রচুর ভারতীয় দালিল-দস্তাবেজসহ সম্প্রতি প্রকাশিত সালাম আজাদের ‘Contribution of India in the war of liberation of Bangladesh’ শীর্ষক গ্রন্থে তৎকালীন ঢাকায় ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার এ কে রায়ের সাক্ষাৎকার থেকেও স্পষ্ট দেখা যায়, ওইরূপ যোগাযোগ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে ভারতীয় সহায়তা ১৯৬৫ থেকে সক্রিয়। খোদ তখনকার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমেই যে এরূপ যোগাযোগ ও সহায়তা চালু হয়, সেই বিবরণও বিস্তারিত আকারে পাওয়া যায় এ কে রায়ের পূর্বে উল্লিখিত বিবরণীতে। অন্যদিকে, শেখ মুজিবুর রহমানের আগরতলা যাত্রা সম্পর্কে তাদের পরিবারের কেয়ারটেকার তার ফুফাত ভাই মমিনুল হক খোকার ইতোমধ্যে উল্লিখিত বিবরণ থেকেও প্রমাণ মেলেÑ ১৯৬২ সালের আগে থেকেই ভারত পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। বলাবাহুল্য, এসব যোগাযোগ পূর্ববাংলার রাজনীতিবিদদের তরফ থেকে ‘স্বাধীনতার জন্য সহায়তা’র লক্ষ্যে পরিচালিত হলেও ভারতীয়দের কাছে তা হাজির হয়েছিল ‘পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার সুযোগ’ আকারে।
মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদের সহযোগী মঈদুল হাসান এক্ষেত্রে ‘পূর্বাপর’ গ্রন্থে আরেকটি ‘যোগাযোগ’ অধ্যায়ের বিবরণ দিয়েছেন এভাবে:
“১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর শেখ সাহেব জেল থেকে বেরোন। ওই বছর অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে ইয়াহিয়ার শাসনামলে তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান। ঠিক একই সময়ে ইন্দিরা গান্ধীও লন্ডনে যান। লন্ডনে মিসেস গান্ধীর সঙ্গে শেখ সাহেবের দেখা হয় হামস্টেড হিথের একটি বাড়িতে। সেখানে ছিলেন আই সিং নামে এক পাঞ্জাবী ভদ্রলোক। আই সিং ছিলেন লন্ডনে ভারতীয় দূতাবাসের কাউন্সিলর। তিনি আসলে ছিলেন লন্ডনে ‘র’-এর প্রধান। শেখ মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধীর বৈঠকের ব্যবস্থা করেছিলেন আই সিং নিজের বাড়িতেই। ১৯৭২ সালে আমি যখন লন্ডনে যাই, তখন আই সিং আমার সম্পর্কে জানতেন। হয়তো পিএন হাকসার বা ডি পি ধরের সুবাদে। ডি পি ধর তখন ভারতের পরিকল্পনামন্ত্রী এবং পি এন হাকসার প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপল সেক্রেটারি। আই সিং নিজেই একদিন এসে আমাকে তার পরিচয় দেন। এবং তাকে কথা বলতে উৎসুকই দেখি। পুরাতন দিনের কথা প্রসঙ্গে আই সিং আমাকে জানান, সেই ১৯৬৯ সালের বৈঠকে তিনি নিজেও উপস্থিত ছিলেন। কেননা এটা একটা সৌজন্যসাক্ষাৎ হিসেবেই শুরু হয়। সেই বৈঠকেই শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমরা জানি, নির্বাচনে আমরা বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতব। কিন্তু ওরা আমাদের ক্ষমতা দেবে না। ঠিক ১৯৫৪ সালের মতো হবে। আবার কেন্দ্রীয় শাসন জারি করবে। ধরপাকড় করবে।’ শেখ সাহেব আরও বলেন, ‘কিন্তু এবার আমি তা হতে দেব না। আমার কিছু ছেলেকে তোমাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আর একটা বেতারযন্ত্র দিতে হবে, যেখান থেকে তারা যাতে প্রচার করতে পারে, বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।’ আই সিংয়ের এই তথ্য আমি বিশ্বাসযোগ্য মনে করি, কেননা হুবহু একই ধরনের গেম-প্ল্যানের কথা আমি শুনেছিলাম ১৯৬২ সালে...।”
ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসনের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী ও সামরিক কর্মকর্তাদের দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে ওঠা উপরোক্ত বিবিধ যোগাযোগের পটভূমিতে ১৯৭১ সালের মার্চে এসে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম যে ভারতের নিজস্ব যুদ্ধে পরিণত হবে, সেটা প্রায় নিয়তি-নির্দিষ্ট হয়েছিল। দীর্ঘ বঞ্চনার বোধ থেকে উৎসারিত পূর্ববাংলার নিরস্ত্র মানুষের দুর্বার এক গণ-আন্দোলনকে তার যৌক্তিক পরিণতি দিতে জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ দেশের অভ্যন্তরে উল্লেখ করার মতো কোনো টেকসই রণনৈতিক প্রস্তুতিই নেননি কেবল ধারাবাহিকভাবে ভারতীয় নেতৃত্ব ও তাদের দূতাবাসে যোগাযোগ রক্ষা করা ছাড়া। ২৫ মার্চ তাই সংগ্রামমুখর নিরস্ত্র মানুষদের এশিয়ার দুর্ধর্ষ এক সেনাবাহিনীর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় নিজ বাড়িতে গ্রেফতারবরণ করলেন, আর তাঁর ‘ছাত্র ও যুবনেতা’রা কয়েকটি কথিত ‘ঠিকানা’ ‘মুখস্থ করে’ ভারতে পাড়ি দিলেন। অথচ মুজিবের নির্দেশ ছিল, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ’ গড়ে তোলার। সমকালীন বিশ্ব ইতিহাসে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের এইরূপ হতবিহ্বল ভূমিকার দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত বিরল। যুদ্ধের সংকল্পে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করে, কিন্তু যুদ্ধের প্রস্তুতি না নিয়ে বরং কামানোর গোলার মুখে ঠেলে দেয়া হলো তাদের। অসহায়, উলঙ্গ প্রতিরোধযুদ্ধ দ্রুতই হুমড়ি খেয়ে পড়ল সীমান্তের ওপারে। এরপর সম্ভাব্য স্বল্প সময়ে আওয়ামী লীগকে পূর্ববাংলায় ক্ষমতাসীন করতে পরিস্থিতির পুরো নিয়ন্ত্রণ নিল ভারত। সবই যেন ছক কাটা ছিল।
তবে স্বাধীনতাযুদ্ধের পূর্বের ও শুরুর মুহূর্তের অসঙ্গতিপূর্ণ রাজনৈতিক ভূমিকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারবরণ বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রটির রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য এ সময় ভিন্ন একটি তাৎপর্য নিয়েও হাজির হয়েছিল, যার ব্যাখ্যা দিয়েছেন ইতিহাসবিদ ড. আহমেদ কামাল ‘কালের কল্লোল’ শীর্ষক এক গ্রন্থে। তার মতে, একাত্তরের ২৫ মার্চ পূর্ববর্তী দুই সপ্তাহে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রস্তুতি সম্পর্কে মুজিবুর রহমান নানান সূত্রেই সংবাদ পাচ্ছিলেন। এ রকম পরিস্থিতিতে করণীয় হিসেবে তিনটি বিকল্প ছিল তার জন্য: এক. জনযুদ্ধের নেতৃত্ব গ্রহণ; যে যুদ্ধের প্রাথমিক উপাদান হিসেবে স্থানীয় প্রতিরোধ সংগ্রামগুলো ততদিনে শুরু হয়ে গিয়েছিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। দুই. ভারতে আশ্রয় নেয়া এবং তিন. পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতারবরণ। মুজিবুর রহমান নিজের ও আওয়ামী লীগের শ্রেণী অবস্থান সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন ফলে ফিদেল কাস্ত্রোর মতো কোনো ভূমিকার প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ এড়িয়ে গেছেন তিনি। আর দ্বিতীয় বিকল্পও বেছে না নেয়ার মধ্যদিয়ে একদিকে পাকিস্তানের শাসক এলিটদের সঙ্গে বোঝাপড়ার ক্ষীণতম একটি সম্ভাবনা জিইয়ে রেখেছিলেন এবং উপরন্তু, ভারতের শাসক এলিটদের সেই বাসনাকেও অনিশ্চয়তায় ফেলে রেখেছিলেন, যার বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের মর্যাদা হতো অঙ্গরাজ্যতুল্য।
অর্থাৎ, একাত্তরের ২৫ মার্চের পূর্বে বহু বছর ধরে বিভিন্ন পরিসরে ভারতের সঙ্গে মুজিবুর রহমান ও তার রাজনৈতিক ও সামরিক সহযোগীদের যে বোঝাপড়া এগিয়েছে এবং যার কিছু কিছু বিবরণ ইতোমধ্যে এ লেখায় তুলে ধরা হয়েছে, সে আলোকে পূর্ব পাকিস্তানকে ঘিরে ভারত যে রাজনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিল ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে মুজিবের ধরা দেয়া তাকে ভয়ানক অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয়। এ সম্পর্কে ড. আহমেদ কামাল আরও লিখেন :
...শেখ মুজিবের পাক সেনানায়কদের হাতে ধরা পড়ার ঘটনাটি ভারতের রাজনৈতিক পরিকল্পনার বিরাট ব্যর্থতা। শেখ মুজিবের মতো একজন জনপ্রিয় নেতা, যিনি তখন জাতির কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছেন, ভারতের আয়ত্তে না থাকাতে তাদের স্বার্থে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক মীমাংসার পথে একটি অনিশ্চয়তা সার্বক্ষণিকভাবেই বিরাজ করতে থাকে। এটা দুই কারণে ঘটে : প্রথমত, শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে ভারতে আশ্রিত আওয়ামী লীগ নেতারা দেশটির সঙ্গে এমন কোনো সম্পর্কে যেতে পারছিলেন নাÑ যেটা শেষ পর্যন্ত মুজিবের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না; দ্বিতীয়ত, ভারতীয় শাসকশ্রেণীর তরফ থেকেও মুজিবের কাছে অগ্রহণযোগ্য হবে এমন কোনো বাড়তি সুবিধা আদায় করার লোভ সংবরণ করতে হচ্ছিল। শেখ মুজিবের অনুপস্থিতি ও পাকিস্তানি শাসকদের হাতে তার অবস্থান ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে নিয়ে ... ভারতের স্বপ্নের জন্য ছিল বিরাট অনিশ্চয়তা।...’
বলাবাহুল্য, এইরূপ ‘অনিশ্চয়তা’রই ফল হলো তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সরকার এবং ওসমানীর অধীনস্থ মুক্তিবাহিনীর বিস্তৃতির পরও মুজিব বাহিনীর সৃষ্টি। এইরূপ অনিশ্চয়তা যে বিপুল উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছিল তার সরাসরি ছাপ পড়ে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের প্রথম সাক্ষাৎকারেই। ‘পূর্বাপর’ গ্রন্থে তাজউদ্দীন আহমদের অন্যতম আলোচিত সহযোগী মঈদুল হাসানের বিবরণ থেকে পাওয়া যায় ভারতীয় সেই উৎকণ্ঠার বাস্তব স্বরূপ :
(একাত্তরের ৩ এপ্রিল রাতে) তাজউদ্দীন আহমদকে ১ সফদার জং রোডের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। তাজউদ্দীন আহমদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি যখন পৌঁছান, মিসেস গান্ধী তখন দীর্ঘ বারান্দায় হাঁটছিলেন হন হন করে। তাকে দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইন্দিরা গান্ধীর প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘শেখ মুজিব কোথায়?’ এবং উত্তরের অপেক্ষা না করেই তার দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, ‘শেখ মুজিব গ্রেফতার হলেন কেন?’ তাজউদ্দীন আহমদ তবু তাকে বলেন, ‘শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন; সরকার গঠন করেছেন; তারপর একটা বিভ্রাটে পড়ে তিনি গ্রেফতার হয়েছেন।’ কিন্তু তার এই কথায় ইন্দিরা গান্ধীর সংশয় কাটেনি।
উপরোক্ত ‘সংশয়’ ও ‘অনিশ্চয়তা’ মুক্তিযুদ্ধে ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে কীভাবে দীর্ঘ ছায়া ফেলেছিল তারই বিবরণ এবার।
তিন.
‘মুজিব বাহিনী’ সম্পর্কে ঐতিহাসিক কিছু ভাষ্য
মুজিবুর রহমান ভারতে না গেলেও ২৫ মার্চের নির্মমতার পর তার সব অনুসারীর সেটা ছাড়া বিকল্প ছিল না। স্বাধীনতাসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক তৎপরতার এটা ছিল নতুন পর্যায়। এ পর্যায়ে আমরা কেবল মুজিবের যুবশক্তি ভিতের যুদ্ধকালীন ভূমিকার দিকেই নজর রাখব, যার আওতায় যুদ্ধকালে বিএলএফ-এর সাংগঠনিক কার্যক্রম সম্পর্কে একে একে ভিন্নধর্মী অনেকগুলো ভাষ্য তুলে ধরা হবে। শুরুতে উদ্ধৃত কাজী আরেফ আহমেদ, তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, আ স ম আব্দুর রব প্রমুখের বক্তব্যের সঙ্গে তুলনা করলে নিচের বিবরণগুলো থেকে বহুরূপ সত্যের সন্ধান পাওয়া যাবে। মিলবে অনেক অসত্যের সন্ধানও। এক্ষেত্রে সিভিল-মিলিটারি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভাষ্য তুলে ধরাই যৌক্তিক হবে। প্রথমে আমরা মুজিবনগর সরকারের প্রশাসনিক সূত্রের অভিমত হিসেবে ‘মূলধারা ৭১’ গ্রন্থ থেকে পাওয়া মঈদুল হাসানের বক্তব্য তুলে ধরব। আর মাঠ পর্যায়ে যোদ্ধাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে একজন সেক্টর কমান্ডারের (রফিকুল ইসলাম, বীরউত্তম, ১ নম্বর সেক্টর) বক্তব্য উপস্থাপন করব।
ইতোমধ্যে এই লেখার শুরুতে মুজিব বাহিনীর উৎস কাঠামো হিসেবে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ নিউক্লিয়াস সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে এবং একাত্তরের মার্চে পাকিস্তানের দু’ অংশের মাঝে বিচ্ছিন্নতাকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে উপরোক্ত নিউক্লিয়াসের তৎপরতার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রে রাজনৈতিক তৎপরতায় গোপনীয়তা ও নাটকীয়তার অনেক উপাদান পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ করে থাকবেন। তবে নিঃসন্দেহে তার আরও বিকশিত রূপ দেখা যাবে পরবর্তী বিবরণগুলোতে। যেমন, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম তার বহুল পঠিত গ্রন্থ ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’তে মুজিব বাহিনী নিয়ে পুরো একটি অধ্যায়ই লিখেছেন, যার শিরোনাম ‘বিশেষ গোপন বাহিনী’। সেখানে তিনি বলেন,
‘...জুন মাস থেকে দেখা গেল বিভিন্ন শিবির থেকে প্রশিক্ষণের জন্য অপেক্ষারত তরুণরা নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। এই যুবকদের গোপনে অন্য ধরনের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা এতই সুপরিকল্পিত ও বিস্তৃত ছিল যে, বিশেষ বিমানে কঠোর নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার মাধ্যমে সেটা হতো। ফলে ভাবতে বাধ্য হলাম, আমাদের বিশ্বাস করা হচ্ছে না। সেক্টর কমান্ডাররা সবাই এতে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। জানিয়ে দেয়া হলো, এ ব্যাপারে নাক গলাবেন না। পরে জানতে পেরেছিলাম ‘র’ই ছিল এর মূল উদ্যোক্তা। ... রাজনৈতিক দিক থেকে এটা ছিল এক সর্বনাশা সিদ্ধান্ত। এ ধরনের গোপন পরিকল্পনার কারণে যুদ্ধের সময়ই মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে মারাত্মক ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। আমরা জানতে পেরেছিলাম, সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক বিবেচনাতেই এই পরিকল্পনাটি গ্রহণ করা হয়েছিল। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ সরকারের কোনো অনুমতি ছিল না। তাদের যেসব মিশনে পাঠানো হতো তার কিছুই আমরা জানতাম না। শুধু শেখ মণি ও ভারত সরকারের অল্প কিছু লোক এসব জানতেন। এই বিশেষ বাহিনী সে সময় মুক্তিযুদ্ধে কোনো বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নি। ওরা ভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রথম থেকে। ‘র’ এই পরিকল্পনার মাধ্যমে অদৃশ্য ও কাল্পনিক কোনো এক শক্তির বিরুদ্ধে নতুন একটা ফ্রন্ট খোলে।...’
মাঠ পর্যায়ের এই অভিজ্ঞতা মুজিবনগর সরকারের প্রশাসনে কীভাবে প্রভাব ফেলে সেটা বোঝার জন্য এবার বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্যে বহুল আলোচিত ‘মূলধারা ৭১’ গ্রন্থের সাহায্য নিতে পারি আমরা। সেখানে যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী লিখেছেন, ‘(১৯৭১ সালের) ১৮ এপ্রিল নবগঠিত বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা দেশের ভেতর থেকে ছাত্র-যুব কর্মী সংগ্রহের দায়িত্ব দেয় শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, রাজ্জাক ও তোফায়েলের ওপর। অজ্ঞাত কারণে অল্পদিনের মধ্যেই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি (সৈয়দ নজরুল ইসলাম) এই চার যুবনেতার ক্ষমতা সম্প্রসারিত করে তাদের রিক্রুটিংয়ের দায়িত্ব ছাড়াও সশস্ত্র বাহিনী গঠন ও পরিচালনার অধিকার প্রদান করেন। এ অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদানের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সম্মতি ছিল না। ... ওসমানী নিজেও এ সম্পর্কে সংশয়মুক্ত ছিলেন না। ... এদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রথম দল আত্মপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়, এ বাহিনী পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কর্নেল ওসমানী তথা বাংলাদেশ সরকারের কোনো এখতিয়ার নেই। ... কেবল প্রশিক্ষণ নয়, এদের অস্ত্রশস্ত্র ও যাবতীয় রসদের যোগান আসত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর বিশেষ উপসংস্থা থেকে এবং ওই উপসংস্থার প্রধান জেনারেল উবান ছিলেন মুজিব বাহিনী গড়ে তোলার দায়িত্বে।’
মঈদুল হাসান ‘মুজিব বাহিনী’র বিরুদ্ধে-
ক. স্বাধীনতাসংগ্রামকে বিভক্ত করা;
খ. বামপন্থীদের বিরুদ্ধাচরণ করা;
গ. সাধারণ মুক্তিযুদ্ধাদের অস্ত্র কেড়ে নেয়া;
ঘ. মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে অবতীর্ণ হওয়া;
ঙ. মুজিবনগর সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করা; এবং
চ. তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণা ও তার প্রাণনাশের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছেন।
মঈদুল হাসানের ভাষায়, ‘মুজিব বাহিনীকে স্বতন্ত্র কমান্ডে রাখার বিষয়ে ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল খুবই জোরাল’ ... এবং তাজউদ্দীনের তরফ থেকে খোদ ইন্দিরা গান্ধীকে মুজিব বাহিনী সৃষ্ট ‘বিড়ম্বনা’ বন্ধে ভূমিকা রাখার জন্য অনুরোধ করা হলেও তা কার্যকর করা যায়নি।
বিএলএফ সম্পর্কে মঈদুল হাসানের এসব বক্তব্যের আংশিক বা পূর্ণ সমর্থন মেলে রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম, এম আর আখতার মুকুল, মণি সিং, এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার, কাজী জাফর আহমেদ, আমীরুল ইসলাম, আবদুল খালেক (প্রবাসী সরকারের স্বরাষ্ট্রসচিব ও আইজিপি) প্রমুখের লেখনীতেও। আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ, মঈদুল হাসান, রফিকুল ইসলাম, এম আর আখতার মুকুল, এ কে খন্দকার, মণি সিং, কাজী জাফর আহমেদ, আমীর-উল-ইসলাম, আবদুল খালেকÑ এরা সবাই মুক্তযুদ্ধকালীন ঘটনাবলি এবং একাত্তরের আগে-পরে বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও প্রশাসনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে এরা অনেকটা আকরগ্রন্থতুল্য উৎস। আবার এ-ও সত্য, কোন না কোনোভাবে সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে এবং ভিন্ন ভিন্ন আদর্শতাড়িত ছিলেন বিধায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে এদের বর্ণনায় আবেগ ও রাজনীতির মিশেল ঘটাও অস্বাভাবিক নয়।
এরূপ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, পূর্বোক্ত ভাষ্যকারদের প্রদত্ত বিবদমান ও বিরোধপূর্ণ তথ্যের মধ্যে কোনটিকে সঠিক বলে ধরে নেয়া যাবে? এক্ষেত্রে মুজিব বাহিনী সম্পর্কিত তথ্যের একটা নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে মেজর জেনারেল এস এস উবানের শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারেÑ কারণ তিনিই ছিলেন কার্যত এই বাহিনীর প্রশিক্ষক ও সর্বাধিনায়ক। ভারতীয় এই গেরিলাযুদ্ধ বিশেষজ্ঞ তার ‘ফ্যানটম অব চিটাগং : ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গ্রন্থে মুজিব বাহিনী এবং এ বাহিনীর সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বইটির বাংলা অনুবাদ করেছেন হোসাইন রিদওয়ান আলী খান। এই লেখার অন্যত্রও মূলত এই অনুবাদ থেকেই উবানের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। উবান কেন তার বইয়ের শিরোনামে মুজিব বাহিনীকে ‘ফিফথ আর্মি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, তা এক গভীর বিস্ময়ের বিষয়। কারণ বর্তমানে রাজনৈতিক সাহিত্যে এবং ব্যবহারিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এই শব্দদ্বয় দ্বারা সাধারণত এমন ধারার বিশ্বাসঘাতকদের বোঝানো হয়ে থাকে যারা স্বীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বা রাষ্ট্রের শত্রুদের স্বার্থে কাজ করে।
যা-ই হোক, মূলত উবানের গ্রন্থ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সূত্র [যেমন-ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম, এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান, মণি সিং-এর সাক্ষাৎকার ও লিখিত বক্তব্য]-এর ভিত্তিতে মুজিব বাহিনী সম্পর্কে এইরূপ সাধারণ ধারণা প্রকাশ পায় যে, বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর গঠন ছিল পূর্বপরিকল্পিত; ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস উইং-‘র’ (Research and Analysis Wing- RAW)-এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে এই বাহিনীর গঠন ও বিকাশ এবং যুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রতি মুজিব বাহিনীর ছিল বৈরিতা ও আনুগত্যহীনতা।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ওপরে উল্লিখিত জেনারেল উবানের সংশ্লিষ্টতার বহু বিবরণ পাওয়া যায়। কিন্তু কে এই জেনারেল উবান এবং কেনইবা তাকে মুজিব বাহিনী গড়ে তোলার জন্য ‘র’ কর্তৃক বাছাই করা হয়েছিল, সেই বিষয়ে কমই অনুসন্ধান করা হয়েছে। এ অধ্যায়ের বিভিন্ন আলোচনায় সে বিষয়েও কৌতূহলোদ্দীপক অনেক তথ্য পাওয়া যাবে; বিশেষত, ‘র’-এর সে সময়কার প্রধান রাম নাথ কাও সম্পর্কে বহির্বিশ্ব যাঁকে ‘বাংলাদেশের ¯স্রষ্টা’ হিসেবে জানে!
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জেনারেল উবানের সংশ্লিষ্টতা রাম নাথ কাও-এর মাধ্যমে। উবান ও তাঁর যুদ্ধকালীন ভূমিকা সম্পর্কে মূল গ্রন্থে বহু বিবরণ পাঠক দেখতে পাবেন। সেই ‘ভূমিকা’র পটভূমি হিসেবে এখানে রাম নাথ কাও সম্পর্কে সংক্ষেপে পরিচিতিমূলক কিছু তথ্য উপস্থাপন করা প্রাসঙ্গিক।
১৯৪৭ সালে দুটি গোয়েন্দা সংস্থা (আইবি ও সামরিক গোয়েন্দা) দিয়ে যাত্রা হলেও উইকিপিডিয়ায় ‘List of Indian Intelligence Agencies’-এ বর্ণিত তথ্য অনুযায়ী ভারতে এখন চিরায়ত অর্থে গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে অন্তত ১১টি। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সর্বাধিক আলোচিত রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস উইং বা RAW (‘র’)। ১৯৬৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর আইবি (IB) বা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো ভেঙে এই সংস্থাটি গড়ে তোলা হয়, যার কর্মএলাকা ‘বহির্বিশ্ব’। শেষোক্ত গোয়েন্দা সংস্থার প্রথম চিফ ছিলেন রামেশ্বর নাথ কাও বা রাম নাথ কাও। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের কাছে তিনি ‘রামজি’ নামেও পরিচিত। ১৯৪০ সালে ভারতীয় পুলিশে যোগদানের মাধ্যমে তিনি গোয়েন্দা জীবন শুরু করেন। নেহরু পরিবারের অতি নির্ভরযোগ্য এই ব্যক্তিকে দিয়েই রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস উইংয়ের গোড়াপত্তন করেন মিসেস ইন্দিরা গান্ধী। জন্ম-পরবর্তী নয় বছর সংস্থাটির প্রধান ছিলেন কাও। ১৯৭১ সালে কাওয়ের আনুষ্ঠানিক পদ ছিল ভারতের ক্যাবিনেট সেক্রেটারিয়েটে ‘সেক্রেটারি (গবেষণা)’। সাধারণত রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস উইংয়ের চিফদের আনুষ্ঠানিক বা প্রকাশ্য পদ ওটিই হয়ে থাকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় দিল্লির প্রশাসন মহলে একটি সত্য সবাই মেনে নিতেন, ইন্দিরা গান্ধী যে চার ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ শেষে তার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন তাদের একজন হলেন কাও (অন্য তিনজন ছিলেন ডি পি ধর, পি এন হাকসার এবং টি এন কাউল)। ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে তার ঘনিষ্ঠজনরা এ-ও জানতেন, গান্ধী প্রতিদিন অফিস ছাড়ার আগে শেষ সাক্ষাৎকারটি দিতেন কাওকে। মুজিব বাহিনী ও উবানকে কাওই সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং তা ইন্দিরার সম্মতিতেই। ইন্দিরা ও ‘র’-এর মাঝে কাও ব্যতীত কারও ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগই ছিল না।
উল্লেখ্য, কাও ৫৭ বছর বয়সে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সফর করার কিছুদিন পরই শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। ভারতীয় তরফ থেকে তখন বলা হয়েছিল, কাও এসেছিলেন শেখকে সম্ভাব্য অভ্যুত্থান সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য। কাও কীভাবে জানতে পারলেন বাংলাদেশে অভ্যুত্থান হতে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে এক কৌতূহলোদ্দীপক ভাষ্য রয়েছে ‘ইনসাইড র’ গ্রন্থের লেখক অশোকা রায়নার বিবরণীতে। তিনি লিখেন,
পঁচাত্তরের আগস্টের তিন মাস আগে ‘র’ এজেন্টরা জিয়াউর রহমানের বাসায় মেজর ফারুক, মেজর রশীদ ও ওসমানীর একটি সভার তথ্য লাভে সমর্থ হয়। তিন ঘণ্টাব্যাপী আলোচনায় একজন অংশগ্রহণকারী উদ্দেশ্যহীনভাবে কাগজে কিছু লিখে ফেলেন ও পরে তা অমনোযোগিতাবশত বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেন। সেই দোমড়ানো কাগজটি আবর্জনার স্তূপ থেকে একজন কেরানি (‘র’ এজেন্ট) সংগ্রহ করতে সমর্থ হয় এবং পরে তা দিল্লিতে সদর দপ্তরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। (ঢাকায়) অভ্যুত্থান আসন্ন বুঝতে পেরে কাও একজন রপ্তানিকারকের ছদ্মবেশে ঢাকায় পৌঁছেন। ... পূর্ব নির্ধারিত একটি স্থানে মুজিবের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। এক ঘণ্টা স্থায়ী হয় আলোচনা। অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় জড়িত সন্দেহভাজনদের নাম উল্লেখ করার পরও মুজিব তা গুরুত্ব দিয়ে আমলে নেননি।
চাকরি জীবন থেকে অবসর গ্রহণের ২৫ বছর পর ২০০২ সালের ২০ জানুয়ারি ৮৪ বছর বয়সে দিল্লিতে মারা যান আর এন কাও। ভারতের এলিটরা দক্ষিণ এশিয়ার জনসমাজে তাদের প্রভাববলয় নির্মাণে অসামান্য অবদান রাখার জন্য প্রতিবছর আনুষ্ঠানিক এক মেমোরিয়াল লেকচারের মাধ্যমে কাওকে স্মরণ করে থাকে। মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর কাওকে ‘র’ থেকে সরিয়ে দেয়া হলে সংস্থাটির প্রধান হন দ্বিতীয় ব্যক্তি শংকরণ নায়ার। তার জীবন-বৃত্তান্তেরও সবচেয়ে শক্তিশালী দিক ছিল একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানে দক্ষতা প্রদর্শন। ইন্দিরা গান্ধী দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতাসীন হলে কাও আবার তার উপদেষ্টা হন। তাঁকে ক্যাবিনেট বিভাগের সিনিয়র উপদেষ্টা করা হয়।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্ব গোয়েন্দা জগতে কাওকে ‘বাংলাদেশের স্রষ্টা’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে এই বিবেচনার সময় অনেকেই বিস্মৃত হন, একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানে কাওয়ের সফলতার প্রধান স্থপতি ছিলেন আসলে শংকরণ নায়ার (K. Sankaran Nair), যিনি কাও থাকাবস্থায় ছিলেন ‘র’-এর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। ‘র’ সৃষ্টির পূর্বে আইবির পক্ষে আগরতলাকে কেন্দ্র করে পূর্ব-পাকিস্তান ডেস্কের ‘দায়িত্ব’ নায়ারই পালন করতেন। ১৯৭৭ সালে কাওয়ের পর ‘র’-এর প্রধান হন তিনি। মাত্র কয়েক মাস তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন। কাও ও নায়ার ‘র’ থেকে বিদায় নেয়ার পর মোরারজি দেশাইর শাসনামলে বাংলাদেশের শাসকদের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ব্যাপক উন্নতি ঘটে। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় আসার পর তা আবার ব্যাহত হয়। এই অভিজ্ঞতার কারণেই বাংলাদেশ-ভারত স্বাভাবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘র’-কে প্রধান দেয়াল মনে করেন প্রথমোক্ত দেশের কূটনীতিবিদরা এবং আওয়ামী লীগ বহির্ভূত রাজনীতিকরা।
চার.
‘মুজিব বাহিনী ও স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স
বহুমুখী আন্তর্জাতিক স্বার্থের সম্মিলন
এ লেখার শুরুর দিকে আমরা দেখেছি, শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পূর্বেই সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদদের নেতৃত্বে ছাত্র-যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার জন্য পিরোজপুরের আওয়ামী লীগ নেতা চিত্তরঞ্জন সূতারের মাধ্যমে ভারতকে অনুরোধ জানিয়ে রেখেছিলেন। এ কাজে ডা. আবু হেনার সংশ্লিষ্টতাও ইতোমধ্যে বিস্তারিত আকারে তুলে ধরা হয়েছে। দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে ১৯৬৭-১৯৬৮ সালে সশস্ত্র বাহিনী ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের বাঙালি অফিসারদের ‘পরিকল্পনা’ (আগরতলা যড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য’ মামলায় উল্লিখিত) ব্যর্থ হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান এভাবেই ভারতীয়দের সঙ্গে আরেকটি ফ্রন্ট খোলা রেখেছিলেন।
উল্লেখ্য, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ হিসেবে কথিত ঘটনাবলিতে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের তৎকালীন প্রথম সেক্রেটারি মি. ওঝার (জ. ঘ. ঙলযধ) সংশ্লিষ্টতার কারণে ১৯৬৮ সালের ৭ জানুয়ারি তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। অন্যদিকে, শেখ মুজিব রাজনৈতিক সাহায্যের জন্য ১৯৬৩ সালে যে গোপনে ত্রিপুরা গিয়েছিলেন সে বিষয়ে ত্রিপুরার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের স্বীকারোক্তিমূলক বিবরণ রয়েছে। তিনি এ-ও জানান, ‘শেখ মুজিবকে সর্বপ্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।’ একই বিষয়ে আ স ম আব্দুর রবেরও সমর্থনসূচক বক্তব্য রয়েছে। উপরোক্ত সূত্রসমূহ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে পাকিস্তানের দুই অংশের বিচ্ছিন্নতার বিষয়ে ভারত একাত্তরের বহু আগে থেকে সংশ্লিষ্ট। সুতরাং বাংলাদেশে অনেক লেখক যেমনটি দাবি করেন, ‘আওয়ামী লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সাদৃশ্য’ ভারতকে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের প্রশ্নে দোদুল্যমানতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে, তা ¯্রফে বাস্তবতাবর্জিত। কারণ বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতার যুদ্ধে ভারত একাত্তরের পূর্বেই শামিল ছিল।
ভারতীয় সেই সংশ্লিষ্টতার এক বিশাল যোগসূত্র ছিলেন চিত্তরঞ্জন সূতার। এ পর্যায়ে তাঁর সম্পর্কে নবীন পাঠকদের জন্য কিছু তথ্য তুলে ধরাও প্রাসঙ্গিক হবে। চিত্তরঞ্জন সূতার ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বরিশাল থেকে এমপি হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ করতেন তিনি। তারও আগে ছিলেন শিডিউল কাস্ট ফেডারেশনের সঙ্গে। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার পর তিনি ‘ন্যাপ’-এ যোগ দেন। আবার ১৯৬৪ সালে তিনি এবং বৃহত্তর ফরিদপুরের বাসিন্দা ডা. কালীদাস বৈদ্য মিলে গঠন করেন ‘গণমুক্তি দল’ যে দলের প্রতীক ছিল মোমবাতি। ১৯৬৮ সালে সূতার আগরতলা হয়ে কলকাতা চলে যান। পরের বছরই ঢাকায় এক জনসভায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে যায় তার গণমুক্তি দল। পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে সূতারের জনভিত্তি হিন্দু সম্প্রদায় হলেও এই জনগোষ্ঠীর অপেক্ষাকৃত অগ্রসর অংশের সঙ্গেই ছিল মূলত তাঁর সখ্য। তার বিশেষ একটি সাংগঠনিক দক্ষতার দিক ছিল, দুই বাংলাতেই হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরোক্ত অগ্রসর চিন্তার মানুষদের ভৌগোলিক নানা নস্টালজিয়া এবং অধরা স্বপ্নের মাঝে একটি যোগসূত্র হিসেবে কাজ করতেন তিনি। মুজিব বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা যুবনেতাদের সঙ্গে আর এন কাও এবং জেনারেল উবানের যোগসূত্র স্থাপন করেন এই সূতার।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনেও জনাব সূতার আওয়ামী লীগের মনোনয়নে পার্লামেন্ট সদস্য হন। তবে পার্লামেন্টের অধিবেশনগুলোতে প্রথম দুই-একদিন ব্যতীত কমই দেখা যেত তাকে। মূলত কলকাতাতেই থাকতেন তিনি। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সূতারের এতই গুরুত্ব ছিল যে, ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠার পর এর কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই হয়েছিল তাঁর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের নতুন সরকার তাৎক্ষণিকভাবে সূতারের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে। ভুজঙ্গ ভূষণ রায় নামে তাঁর একটি ভারতীয় পাসপোর্ট ছিল বলেও কথিত রয়েছে।
১৯৭১-এর মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের পূর্ব থেকে চিত্তরঞ্জন সূতার অবস্থান নিয়েছিলেন কলকাতার ভবানীপুরস্থ ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোডে ‘সানী ভিলা’ নামক বাড়িতে। এ বাড়ি সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদের বিশেষ সহকারী মঈদুল হাসান বলেছেন, ‘এই বড় বাড়িটা ছিল ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর একটা অফিস ও অতিথি ভবন। সেখানে মুজিব বাহিনীর যুবনেতারা ও ‘র’-এর প্রতিনিধি চিত্তরঞ্জন সূতার থাকতেন। যুবনেতারা এখানে থাকাবস্থায় ছদ্মনামও নিয়েছিলেন। শেখ ফজলুল হক মণির ছদ্মনাম ছিল মণি বাবু, সিরাজুল আলম খানের ছদ্মনাম ছিল সরোজ বাবু, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ নাম নেন রাজু বাবু ও তপন বাবু। এই বিবরণ পাওয়া যায় সাংবাদিক আমির হোসেনের কাছ থেকে। যিনি বর্তমানে ঢাকার ‘ডেইলি সান’ কাগজে যুক্ত। আমির হোসেন উপরোক্ত ‘বাবু’দের সঙ্গে সানী ভিলাতেই নিচতলায় থাকতেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল যুবনেতা শেখ মণির নির্দেশনা মতো ‘বাংলার বাণী’ প্রকাশ করা।
যুবনেতাদের উপরোক্ত ছদ্মনাম ধারণ ছিল কৌতূহলোদ্দীপক। যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা পরিবার-পরিজনকে ঝুঁকিপূর্ণ জীবনে ফেলে এসে বিদ্রোহ করে স্বনামে যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াইয়ে নেমে পড়েছেন এবং যখন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদদের অধিকাংশই স্বনামে প্রবাসী সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয়; তখন যুবনেতাদের কলকাতার নিরাপদ পরিবেশে পরিচয় গোপন করার এইরূপ প্রচেষ্টা বিস্ময় উদ্রেকের কারণ হয় এবং ‘সানী ভিলা’ সম্পর্কে বাড়তি কৌতূহল তৈরি করে।
একাত্তরের মার্চের পর এ বাড়িতেই সূতারের মাধ্যমে প্রথমে ভারতীয় শীর্ষ গোয়েন্দা ব্যক্তিদের সঙ্গে এবং পরে জেনারেল উবানের সঙ্গে উল্লিখিত চার যুবনেতার বৈঠক হয়। চিত্ত সূতারই এসব বৈঠকের ব্যবস্থা করেছিলেন, আর জেনারেল উবানকে এ প্রক্রিয়ায় শামিল করে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’। সে সময় এই সংস্থার প্রধান ছিলেন রাম নাথ কাও Ñ যার সম্পর্কে ইতোমধ্যে পরিচিতিমূলক তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
উপরোক্ত যুবনেতাদের সঙ্গে বৈঠকের স্মৃতিচারণ করে নিজ গ্রন্থে উবান দাবি করেছেন, (পৃ. ২৫) ভারতে কেউ এই যুবনেতাদের চিনত না। উবানরাই এদের ‘খুঁজে বের করেছেন।’ মাঠ পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরুর পরও কেন এই ‘খোঁজপর্ব’ শুরু হলো উবান তার কোনো ব্যাখ্যা দেননি। তবে ইঙ্গিত দিয়েছেন (পৃ. ২১), মুক্তিবাহিনী গড়ে ওঠার পরও ‘আসল কাজ’টি সারার জন্য ভারতীয় সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ মুজিব বাহিনীর মতো একটি বাহিনী গড়ার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছিল। যদিও চূড়ান্ত অপারেশনের সময় কেবল মুজিব বাহিনী নয়, ‘স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স’ নামের পুরোপুরি আনকনভেনশনাল আরেকটি ফোর্সকেও ভারতীয়রা পার্বত্য চট্টগ্রাম দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করায়। এই ফোর্সের দায়িত্ব ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারত নিয়ন্ত্রিত মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের খুঁজে বের করা এবং নিশ্চিহ্ন করা।
এসময় শেখ মণি প্রায় সার্বক্ষণিক জেনারেল উবানের সঙ্গী ছিলেন। ‘মুজিব বাহিনী’র যোদ্ধারা থাকার পরও কেন উবান ‘স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স’কে বাংলাদেশে ঢোকাচ্ছিলেন, যে গোপন বাহিনীটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনস্থ নয় এবং যার সৃষ্টিই হয়েছিল গণচীনকে মোকাবেলার আন্তর্জাতিক গোপন প্রকল্পরূপে, সে বিষয়ে শেখ ফজলুল হক মণি বা মুজিব বাহিনীর তরফ থেকে উবানের কাছে কোনো প্রশ্ন বা বিরোধিতা ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না কোথাও। এই ঘটনাবলির সবচেয়ে চমকপ্রদ দিক হলো রাঙ্গামাটি ও সন্নিহিত সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়া এই স্পেশাল ফোর্স গড়ে ওঠার সময় (১৯৬২ সালের নভেম্বরে) এর জন্য আর্থিক, অস্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণ সহায়তা দিয়েছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা সিআইএ। মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণ কাজে ব্যবহৃত দেরা দুনের অবকাঠামোর প্রায় সবই সিআইএর সহায়তায় তৈরি হয় মূলত ওই স্পেশাল ফোর্সকে প্রশিক্ষণের জন্যই। এই লেখার মূল গ্রন্থে তার সুদীর্ঘ বিবরণ পাবেন পাঠক।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারতীয় স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের কার্যক্রম নিয়ে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ-সাহিত্যে কোনো আলোচনা দেখা যায় না। কিন্তু ভারতীয় দিক থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংশ্লিষ্টতার একটি বড় উপাদান ছিল এই ‘ফোর্স’ এবং তার ‘টার্গেট’ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম। জেনারেল উবান ছিলেন এই ফোর্সের প্রথম ইন্সপেক্টর জেনারেল এবং ‘র’ সৃষ্টি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ‘ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো বা আইবি’ ওই ফোর্সকে নিয়ন্ত্রণ করত। এই জেনারেল উবানকেই দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সকে একটি ‘বাহিনী’ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। উবান পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন শুরু করলেও যুদ্ধের চূড়ান্তপর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে মূলত এগিয়ে দেন তাঁর স্পেশাল ফ্রন্টিয়ারদের। কেন এটা ঘটেছিলÑ এ পর্যায়ে তার কিছু পটভূমি ব্যাখ্যা করা প্রাসঙ্গিক হবে।
একাত্তর-পূর্ব সময়ে ভারতীয় শাসক এলিটরা মনে করত ফিজোর নেতৃত্বে নাগাল্যান্ডের এবং লালডেঙ্গার নেতৃত্বে মিজোরামের স্বাধীনতা সংগ্রাম পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার (Inter-Services Intelligence বা আইএসআই) তৎপরতার ফল। বাস্তবে Angami Zapu Phizo-এর নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিল ১৯৪৭ সালেই নাগাল্যান্ডকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করেছিল এবং চঁ খধষফবহমধ-এর নেতৃত্বে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টও পঞ্চাশের দশক থেকেই মিজোরামের স্বাধীনতার লক্ষ্যে ভারতের অভ্যন্তরে সশস্ত্র সংগ্রাম চালাচ্ছিল। পরে একপর্যায়ে তীব্র দমনাভিযানের মুখে তাদের অনেক যোদ্ধা পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে আশ্রয় নেয়।
ভারত বরাবর মনে করত, পার্বত্য চট্টগ্রামে নাগা ও মিজোরা যে লুকিয়ে আছে, সেটা আইএসআইয়ের সহায়তার কারণেই সম্ভব হচ্ছে। এর পাল্টা কর্মসূচি হিসেবেই পূর্ব পাকিস্তানকে দেশটির মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার কর্মসূচির দিকে এগিয়ে যেতে নিজস্ব গোয়েন্দাদের সবুজ সংকেত দেয় ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা। ‘র’-এর সিনিয়র কর্মকর্তা বি. রমন এ সম্পর্কে তার গ্রন্থে (র-এর কাউবয়েরা) সুস্পষ্টভাবে আলোকপাত করেছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আইএসআইয়ের চালানো কার্যক্রমের অবসান ঘটাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষীদের পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সহায়তার সিদ্ধান্ত নেন।’ আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি যে এইরূপ উদ্যোগ আসলে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সময় থেকে নয়, তারও আগে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সময় থেকে শুরু হয়েছে।
ভারতীয় এই উদ্যোগে ইসরায়েলেরও সংশ্লিষ্টতা দেখা যায়। পাকিস্তান থেকে পূর্ববাংলার বিচ্ছিন্নতাকে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’ দেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি মুসলিম শক্তিকে দুর্বল করার সুযোগ হিসেবে। ইসরায়েলের এই চেতনার প্রকাশ যে ভারতীয় মনস্তত্ত্বেও প্রবলভাবে শেকড় গেড়েছিল, তার এক চমৎকার নজির দিয়েছেন খ্যাতনামা ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার সম্প্রতি ঢাকার ‘ডেইলি স্টার’ পত্রিকা থেকে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ ‘Beyond the Lines’-এ।
নায়ার দেখিয়েছেন, একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বরই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে অস্ত্রসমর্পণের জন্য প্রস্তুত থাকার পরও এবং সেভাবে প্রক্রিয়া শুরুর পরও বিষয়টি ঘটে ২৪ ঘণ্টা পরে এবং নজিরবিহীনভাবে খোলা মাঠে। কেন এটা ঘটেছিল? এ সম্পর্কে তখনকার ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জেকব সাংবাদিক নায়ারকে জানাচ্ছেন, ‘New Delhi wanted to humiliate Islamabad by showing that Muslim country had laid down arms before a Jew.’ উল্লেখ্য, জেনারেল জেকব ছিলেন একজন ইহুদি।
বর্তমান লেখার কাঠামোতে এ বিষয়ে আরও ব্যাপকভিত্তিক তথ্য উপস্থাপনের সুযোগ কম। এখানে শুধু এটুকু উল্লেখ করা হচ্ছে যে, গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে ‘র’ গঠিত হওয়ার পরপরই ভারত সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে তার একটি আউটপোস্ট প্রতিষ্ঠা করে। এই অফিসটি মূলত ব্যবহৃত হতো বিদেশে পাকিস্তানের বিভিন্ন দূতাবাসে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিবিদদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য। এই লিয়াজোঁতে ‘র’কে সহায়তা করে ‘মোসাদ’। এ বিষয়ে ‘র’-এর কর্মকর্তা বি. রমন নিজ গ্রন্থে লিখেছেন (পৃ. ১৫৭),
“১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বরে ‘র’ গঠিত হওয়ার পরপরই আর এন কাওয়ের সৃষ্ট প্রথম পোস্টগুলোর একটি হয় জেনেভায়। তিনি এই পোস্টটিকে ইসরাইলের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে গোপন লিয়াজোঁ স্থাপন এবং ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর রাজনৈতিক, সামরিক ও কূটনীতিক সোর্সগুলোর সাথে স্পর্শকাতর বৈঠক অনুষ্ঠানের পয়েন্ট হিসেবে কাজে লাগাতো। ... এই পোস্টটি গঠনের পর প্রায় ১০ বছর মোসাদ এটাকে তার যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। ... জেনেভায় বহু গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এগুলোর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ১৯৭১ সালের পূর্বে বাংলা ভাষাভাষী কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকগুলো। এসব বৈঠকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাভাষী কূটনীতিকদের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হতো।” ...
মুক্তিযুদ্ধকালে ইসরায়েল কেবল জেনেভা থেকেই বাংলাদেশের ঘটনাবলিতে যুক্ত ছিল না, বরং সরাসরি যুদ্ধ ময়দানেও তাদের সক্রিয়তার পরোক্ষ ইঙ্গিত মেলে। যেমন, মুজিব বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অন্যতম সংগঠক অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী এ বিষয়ক তার গ্রন্থে অন্তত দুটি স্থানে ইসরায়েলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘একপর্যায়ে মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং ও অস্ত্রসম্ভার কমিয়ে দেয়ায় আমরা তাদের (ভারতের) মতিগতি সম্পর্কে আরও সন্দিহান হয়ে পড়লাম। এমতাবস্থায় আমরা বিকল্প উৎস হিসেবে ইসরায়েলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করি।’ এত দেশ থাকতে মুজিব বাহিনী কেন ইসরায়েল থেকে অস্ত্র সংগ্রহে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলÑ বিশেষত যেখানে দেশটির সঙ্গে খোদ ভারতেরই কূটনৈতিক সম্পর্কও ছিল না তখন, সে বিষয়ে অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী তার গ্রন্থে আর কিছু বর্ণনা করেননি। তবে নেতৃস্থানীয় একজন মুজিব বাহিনী সংগঠক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ইসরায়েল তাদের দুই শত যোদ্ধাকে সে দেশে নিয়ে প্রশিক্ষণের সুযোগ দিতে চেয়েছিল, কিন্তু ভারতীয়রা তাতে রাজি হয়নি। অন্যদিকে, লে. জেনারেল নিয়াজি তার স্মৃতিকথা (দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান) লিখেছেন, ‘(মুক্তিযুদ্ধকালে) বাংলাদেশি নেতৃবৃন্দ ২৫ লাখ ডলার মূল্যের অস্ত্র ক্রয়ের জন্য জাপানে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার করেছিলেন’Ñ এমন গোয়েন্দা তথ্য তাদের কাছে ছিল।
উল্লেখ্য, ইসরায়েল যুদ্ধকালেই স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, যদিও প্রবাসী সরকার আরব দেশগুলোর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ভয়ে সেই স্বীকৃতি গ্রহণ করেনি। ইসরায়েল এ সময় বাংলাদেশের জন্য বিমানে করে ওষুধ সামগ্রীও পাঠায় ভারতে। কিন্তু ‘বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের তরফ থেকে সেই ওষুধ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়’Ñ বলে জানিয়েছেন ডেভিড যোহর, যিনি সে সময় বোম্বেতে ইসরায়েলের একজন ভাইস-কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। ডেভিড এ-ও জানাচ্ছেন, উল্লিখিত ওষুধ সামগ্রী পরে আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অক্সফামের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং তারা সেটা ‘ব্রিটেনের অনুদান’ হিসেবে ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিল। এ বিষয়ে মূল গবেষণায় বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। উল্লেখ্য, যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ইসরায়েল আবারও আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে ইসরায়েল-ভারত সখ্যের বিষয়ে সম্প্রতি গবেষক Srinath Raghavan ও Gary J. Bass-এর পক্ষ থেকে আরও যেসব সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে সে বিষয়ে প্রকাশিতব্য গ্রন্থে আলোকপাত করা হয়েছে। এসব তথ্য এবং বি রমন ও আবদুল মান্নান চৌধুরীর উপরে উল্লিখিত লেখা বিশেষ করে শেষোক্ত জনের বক্তব্য নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রহস্যময় এক অধ্যায়ের আভাস দিচ্ছে, যার ভরকেন্দ্রে পাওয়া যাচ্ছে জেনারেল উবানের মুজিব বাহিনীতেও। আন্তঃরাষ্ট্রীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্রে ইসরায়েল ও মুজিব বাহিনীর কাছাকাছি আসতে পারা শেষোক্ত সংগঠনের অতি স্বাধীন সত্তার ইঙ্গিত দেয়।
জেনারেল উবান এ-ও জানিয়েছেন, তার কার্যক্রমের জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল অরোরার কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন না। সরাসরি ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেক শ এবং ‘র’-এর প্রধান আর এন কাওয়ের কাছে জবাবদিহি করতেন তিনি। এ নিয়ে জেনারেল অরোরা ছিলেন বিক্ষুব্ধ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হস্তক্ষেপের ধরন সম্পর্কে ভারতীয় সামরিক প্রশাসনে যে মতদ্বৈধতা ও একাধিক প্রকল্প ছিল মুজিব বাহিনীর সৃষ্টি, তার মোটাদাগের এক প্রমাণ।
যেহেতু গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ সরাসরি ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতো সে কারণে এটা স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায়, তার নির্দেশ ছাড়া ওই ভারতীয় গোয়েন্দারা ‘মুজিব বাহিনী’ নামক প্রকল্প নিয়ে এগোতে পারতেন না। কিন্তু কেন এইরূপ একাধিক প্রকল্প সৃষ্টি হলোÑ মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক সাহিত্যে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয় কমই। বর্তমান লেখক মূলগ্রন্থে প্রধানত এই দিকটি নিয়েই অনুসন্ধান করেছেন। এখানে কেবল সংশ্লিষ্ট একটি গৌণ বিষয় নতুন করে যুক্ত করা যায় যে, তাজউদ্দীন আহমদ ও তার সহযোগীরা ভারতে প্রবেশ এবং ইন্দিরা গান্ধী পর্যন্ত পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিশেষ সহায়তা পেয়েছিলেন। বিএসএফের এই ‘সাফল্য’ গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’কে কিছুটা ম্লান করে দেয়। মণি-সিরাজ-রাজ্জাক-তোফায়েলদের ভিন্ন কাঠামোতে বাহিনীবদ্ধ করে তারা সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে। লক্ষণীয়, একাত্তরে ‘যুদ্ধ’টি বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের জন্য হলেও তাতে দক্ষতা প্রদর্শন এবং কর্তৃত্ব ও খবরদারিত্ব করা নিয়ে ভারতীয় সামরিক আমলাতন্ত্রে রীতিমতো মনস্তাত্ত্বিক প্রতিযোগিতা চলছিল তখন। নিশ্চিতভাবেই এখন বলা যায়, ভারতীয় সেনাবাহিনী, বিএসএফ ও ‘র’-এর পেশাগত দক্ষতা প্রদর্শনের ওই প্রতিযোগিতার বলি হয়েছে হবু বাংলাদেশের ‘জাতীয় ঐক্য’Ñ কারণ রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশে গত চার দশকে অনেক রক্তাক্ত বৈরিতার উৎস খুঁজে পাওয়া যায় ভারতীয় সামরিক আমলাতন্ত্রের প্রতিযোগিতামূলক ওইসব ‘সাফল্য’র মাঝে।
ইতোমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষক হিসেবে জেনারেল উবান ও তার নিয়ন্ত্রণাধীন ‘স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স’ সরাসরি ভারতীয় সেনাবাহিনী নয়, বরং ‘র’ গঠিত হওয়ার পর এই সংস্থার মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতো। পূর্ববাংলা থেকে যাওয়া ছাত্র ও যুবনেতাদের আলাদা বাহিনী গড়ে তোলার প্রকল্পে ‘ইন্দিরা গান্ধীকে সম্মতিসূচক জায়গায় আনতে মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বাহিনীর মূল নেতৃত্ব দীর্ঘ আলাপচারিতায় ইন্দিরা গান্ধীকে এটা বোঝাতে সক্ষম হন, তাদের অধীনে দেশজুড়ে বিপুল তারুণ্য রয়েছে এবং এদের যদি ‘মুক্তিবাহিনী’র সেক্টর কমান্ডারদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়, তা হলে ধীরে ধীরে এরা মস্কো কিংবা পিকিং যেকোনো এক ঘরানার কমিউনিস্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে; এ থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন স্বতন্ত্র একটি কাঠামো। ইন্দিরা এক পর্যায়ে ছাত্রনেতাদের বক্তব্যে নিজস্ব স্বার্থের যৌক্তিকতাও খুঁজে পেয়েছিলেন। ইন্দিরার ওই ‘নিজস্ব স্বার্থ’ সম্পর্কে এ পর্যায়ে সামান্য আলোকপাত করা জরুরি। তবে তার আগে ছাত্র-যুবনেতাদের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর উপরে উল্লিখিত যোগসূত্র ও তার ফলাফল সম্পর্কে দিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের ফেলো গবেষক Srinath Raghavan-এর নি¤েœাক্ত বক্তব্যটুকু উদ্ধৃত করা প্রাসঙ্গিক হবে :
...a small group of influential young leaders refused to work with the Bangladesh government. Led by Mujib’s nephew, Fazlul Haq Moni, this group, we may recall, had opposed the establishment of the government in exil. Moni claimed that before being arrested Mujib had entrusted him and four of his associates in the student movement with carrying on the struggle for the liberation of Bangladesh. His report was apparently corroborated by intelligence gathered by the RAW. Moni quickly established a good relationship with the intelligence chief, R. N. Kao.
Owing to the lack of clarity about Mujib’s intentions, Mrs. Gandhi allowed Kao to organize a separate militia under Moni’s leadership known as the Mujib Bahini —that would function independent of the Bangladesh government and the Mukti Fauj. The Mujib Bahini was also regarded as insurance against the possibility of the liberation movement being captured by the ultra-left Maoists...
তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মুক্তিবাহিনীর ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের পরও ভারত কর্তৃক মুজিব বাহিনী সৃষ্টির কৌশলগত তাৎপর্যের কিছু ইঙ্গিত দেখা যায় উপরোক্ত বর্ণনা থেকে। মুজিব বাহিনী সৃষ্টির ক্ষেত্রে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বাড়তি আর কী কী বিবেচনা কাজ করেছে এ পর্যায়ে সে বিষয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের ওই সময়টিতে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের একটা অংশ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় পাকিস্তানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করা এবং একটি সমঝোতায় পৌঁছানোরও চেষ্টা শুরু করেছিল। উক্ত উদ্যোগে ভারতের একেবারেই সায় ছিল না।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক সাহিত্যে বরাবর আপসরফার এই উদ্যোগকে খন্দকার মোশতাকের বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হলেও গবেষক ই. ত. কযধংৎঁ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্প্রতি উন্মুক্ত দলিলপত্র যার অধিকাংশ মূলত দেশটির সে সময়কার ‘ডিপ্লোম্যাটিক ক্যাবল’ উপস্থাপন করে দেখিয়েছেন, এই প্রচেষ্টায় শুরুর দিকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সংখ্যাগরিষ্ঠের সায় ছিল। ‘মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে তা বামপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে’Ñ এইরূপ বক্তব্যের প্রতি লাগাতার যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন তারা এপ্রিল থেকে। আলাপ-আলোচনার প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করেন কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সাংসদ কাজী জহিরুল কাইউম (কলকাতায়) এবং পররাষ্ট্রসচিব মাহবুবুল আলম চাষী (দিল্লিতে)। তবে ভারত প্রথম থেকে এইরূপ যোগাযোগ কঠোর নজরে রেখেছিল এবং ডি পি ধরের জোরালো কূটনীতি তাজউদ্দীনকে আপসরফার উদ্যোগ থেকে সরিয়ে আনে এবং মোশতাককে কোণঠাসা করে ফেলা হয়। ২১ সেপ্টেম্বর এক বৈঠকে সৈয়দ নজরুল ইসলামকেও নিরস্ত্র করার জোরালো প্রয়াস নেন ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অশোক রায়। লক্ষণীয়, বামপন্থা উত্থানের ভয় দেখিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মোশতাক আহমদরা যখন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আপসরফায় সহায়তা চাচ্ছেন, একই সময়ে একই ভীতির বয়ান চলছিল বিএলএফ গঠনের লক্ষ্যে ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি ‘চার যুবনেতা’র তরফ থেকেও।
কাইউম-মোশতাক-নজরুলদের উদ্যোগ সফল হলে তাকে মোকাবেলা করেও যুদ্ধ জারি রাখার একটি বিকল্প হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল তখন চার ছাত্র-যুবনেতার সহযোগীদের। পূর্বোক্ত তিনটি প্রধান বিবেচনাÑ তথা : মুজিব বাহিনীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নাগা ও মিজোদের খোঁজে এসএফএফ-কে পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢুকিয়ে দেয়া, মাওবাদী যোদ্ধাদের হাত থেকে পূর্ববাংলার ‘মুক্তিযুদ্ধকে রক্ষা’ এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার ও তার মূল বাহিনীর কোনো ধরনের সমঝোতার উদ্যোগের বিকল্প হিসেবে রাজনৈতিকভাবে অধিক নির্ভরযোগ্য আরেকটি বাহিনীকে প্রস্তুত রাখার বিবেচনা থেকেই শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি ভিন্ন আরেকটি বাহিনী গঠনে হাত দিয়েছিল ভারত। এমনকি উবানের দাবি থেকে প্রতীয়মান হয়, এটা তার কাছে ‘পবিত্র যুদ্ধ’ (যড়ষু ধিৎ)-এর মতোই ব্যাপার ছিলÑ বিশেষত মুজিব বাহিনী ও এসএসএফের প্রধান প্রশিক্ষক যখন বলেন, গুরু সন্ন্যাসী শ্রী শ্রী ঠাকুর সীতারাম ওঙ্কার অন্তত এক বছর পূর্বেই এইরূপ যুদ্ধ ও ‘দায়িত্ব’ সম্পর্কে আধ্যাত্মিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন তাঁকে!
‘পবিত্র যুদ্ধ’ কিংবা কৌশলগত বিবেচনা, যে কারণেই হোক না কেন, সামরিকভাবে ভারত যে প্রবাসী সরকারের মূল বাহিনীর চেয়ে মুজিব বাহিনীকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছে, তার অন্তত একটি প্রমাণ হিসেবে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর একটি মন্তব্যের উল্লেখ করা যায়। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের সময় এক ব্যক্তিগত বিদায়ী সাক্ষাৎকারে জেনারেল উবানকে মিসেস গান্ধী বলেছিলেন : ‘বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের সকল সাফল্যের মেরুদণ্ড ছিলেন আপনি।’ ইন্দিরা গান্ধীর এই মন্তব্য যে কেবল কথার কথা থাকেনি তার প্রমাণ হিসেবে দেখা যায়, উবানই একমাত্র অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় জেনারেল যিনি দেশটির সর্বোচ্চ সামরিক পদকের একটি ‘অতি বিশ্বস্ত সেবা পদক’ পান।
যত দূর জানা যায়, একাত্তরের মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে মুক্তিবাহিনীর অজান্তে বা মুক্তিবাহিনীর উষ্মাকে অবজ্ঞা করেই যুবনেতা মণি-সিরাজ-রাজ্জাক-তোফায়েল মনোনীত তরুণদের জেনারেল উবানের মাধ্যমে সামরিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং নভেম্বর পর্যন্ত এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলে। ‘ভারতের সামনে তখন শতাব্দীর সেরা সুযোগ’Ñ বাংলাদেশের গবেষক আফসান চৌধুরীর কাছে পাকিস্তানকে বিভক্ত করার সম্ভাবনাকে এই ভাষাতেই ব্যাখ্যা করেন ১৯৭১ সালে ভারতের ইনস্টিটিউট অব ডিফেন্স স্টাডিজের পরিচালক ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ কে. সুব্রানিয়াম।
সুব্রানিয়ামের এরূপ মনে করার অনেকগুলো বাস্তব কারণ ছিল। যদিও প্রধানত মনে করা হয়, ভারত তখন এটাই ভেবেছিল, পাকিস্তানকে বিভক্ত করা গেলে অন্তত সীমান্তের একটি দিকে বাড়তি সৈন্য মোতায়েনের ব্যয়ভার থেকে রেহাই পাওয়া যাবে; কারণ ভারতকে তখন চীন সীমান্ত, পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানÑ এই তিন দিকে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে সৈন্য সমাবেশ করে রাখতে হতো। বাংলাদেশের অভ্যুদয় তাকে ওই অবস্থা থেকে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণে রেহাই দিয়েছে। তবে উপরোক্ত বিবেচনা ছাড়াও ভারতের নিকট আরেকটি জরুরি (অজ্ঞাত কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যে প্রসঙ্গটি বরাবর কম গুরুত্ব দিয়েছেন) বিবেচনা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্তির মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে উদীয়মান মাওবাদী বিপ্লবকে পর্যুদস্ত করা। ১৯৭০-এর দশকে দরিদ্রক্লিষ্ট ভারত আসাম, মনিপুর, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ডের স্বাধীনতাসংগ্রামীদের পাশাপাশি পশ্চিমবাংলার বাঙালি তরুণদের নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে প্রকৃতই উদ্বিগ্ন ছিল গণচীন যাকে তাৎক্ষণিকভাবে অভিহিত করেছিল, ‘অ ঢ়বধষ
তরুণদের মাঝে নকশালবাড়ি মডেলের তীব্র আবেদন এবং চীনের উপরোক্ত প্রতিক্রিয়ার পর যেকোনোভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কমিউনিস্টদের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখা এবং এই যুদ্ধের ডামাডোলে সম্ভাব্য নির্মম পন্থায় নকশালবাড়ি আন্দোলনের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়াকেও ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা একটি রণকৌশলগত কর্তব্য হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন সঠিকভাবেই। এ বিষয়ে উপরে ঝৎরহধঃয জধমযধাধহÑএর উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়েছে। মুজিব বাহিনী গঠনের পটভূমি বর্ণনা করতে যেয়ে একই প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ৭ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার কাজী নূরুজ্জামান আত্মজৈবনিক গ্রন্থে লিখেছেন,
The Indian authorities took sole responsibility to train the cream of the crop. They (Mujib Bahini) were trained as political comandos, in some forest area near Dehra Dun....While the liberation war was going on, in India the leftist Naxalite movement was making its influence felt under the leadership of Charu Mojumder. This influence reached and strengthened a faction of the left movement in what was then East Pakistan. College students were attracted of this fraction. The Indian authorities realized that many college students with lefties ideas would join the liberation forces and possibly help to build a leftist ideology in Bangladesh. The political comandoes (Mujib Bahini) were established to neutralized such a possibility.
উল্লেখ্য, ‘নকশালবাড়ি আন্দোলনের সংগঠকরা এ সময় (১৯৭১ সালে) বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে ভারতের সক্রিয়তা এবং সিকিমের ভারতভুক্তিরও বিরোধিতা করছিলেন।’ ফলে একদিকে দেশের ভেতরে এইরূপ আদর্শের সংগঠনকে দমন না করে এবং হবু বাংলাদেশে এদের বিকাশের সম্ভাবনা নসাৎ না করে স্বস্তি পাচ্ছিল না দিল্লি। ওপরের উদ্ধৃতিতে কর্নেল নূরুজ্জামান যাদের বলছেন ‘পলিটিক্যাল কমান্ডো’Ñ সেই মুজিব বাহিনীর সৃষ্টির উপরোক্ত আঞ্চলিক ‘চড়ষরঃরপড়-সরষরঃধৎু’ পটভূমিটিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্যে নজর না দেয়া বিস্ময়কর বৈকি।
এই লেখার পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখব চারু মজুমদার ও কানু সান্যালের নেতৃত্বে শুরু হওয়া নকশালবাড়ি বিদ্রোহ, যা একপর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত ছেড়ে সর্বভারতীয় আবেদন সৃষ্টি করতে শুরু করেছিল, তার দমনে ভারত যে বাহিনীটিকে বিশেষভাবে কাজে লাগিয়েছিল সেই সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ)-এর অভিজ্ঞতার আলোকেই স্বাধীনতার পর পর বাংলাদেশে গড়ে তোলা হয় রক্ষীবাহিনী এবং তা ভারতের প্রশিক্ষকদের মাধ্যমেই এবং মুজিব বাহিনীর একাংশকে দিয়েই। অভিযোগ রয়েছে, এই রক্ষিবাহিনীর হাতেই বিচারবহির্ভূতভাবে নিহত হন সিরাজ সিকদারসহ স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম প্রজন্মের কয়েক হাজার বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী। যেভাবে ভারতেও সিআরপিএফের হাতে খুন হয় চারু মজুমদারসহ অসংখ্য মানুষÑ কেউ সমাজ বিপ্লবের সশস্ত্র চেষ্টার কারণে, কেউবা তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের দায়ে, এমনকি কেউ কোনো কারণ ছাড়াই।
স্মরণযোগ্য, একাত্তরের পূর্বে পাকিস্তানের শাসকরাও একই মডেলে গড়ে তুলেছিল স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ বা এসএসজি। সিআরপিএফের মতোই ১৯৫৬ সালে গঠিত এসএসজির দায়িত্ব ছিল ‘কাউন্টার টেরোরিজম’। ভারত ও পাকিস্তানে এইরূপ সংস্থাগুলোর পত্তন হচ্ছিল ঔপনিবেশিক ধাঁচে জনগণকে ‘দমন’-এর মনস্তত্ত্ব থেকে। সিআরপিএফ গড়ে তোলা হয়েছিল সরাসরি ঔপনিবেশিক ‘ক্রাউন রিপ্রেজেনটিটিভ পুলিশ’ (যার সৃষ্টি ১৯৩৯ সালে)-এর অবশেষ থেকে। এভাবে দেখা যাচ্ছে, দফায় দফায় ‘স্বাধীন’ হলেও এ অঞ্চলের জনগণÑ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে যে শাসক শ্রেণীকে পায় তারা আসলে ঔপনিবেশিক ‘রাষ্ট্র’-এর শাসকদের মতোই ‘শক্তি’কেই শাসনের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে।
ক্রাউন রিপ্রেজেনটিটিভ পুলিশের কাঠামোটিকেই ১৯৪৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর স্বাধীন ভারত সিআরপিএফ নাম দেয় ‘সিআরপিএফ এক্ট’ নামে একটি আইনের মাধ্যমে। এরও প্রধান কর্মক্ষেত্রের রাশভারী নাম হলো ‘কাউন্টার ইনসারজেন্সি’। আর এই কর্মপ্রয়াসে তার প্রধান পদ্ধতি ‘এনকাউন্টার’-এ টার্গেটকে খুন করা। এই সংস্থার সবচেয়ে আদুরে শাখাটির নাম Commando Battalion for Resolute Action (COBRA)- শুধু নকশালদের মোকাবেলা করা যার কাজ। তবে নকশালদের হত্যার পাশাপাশি সিআরপিএফের প্রধান কুখ্যাতির আরেক ক্ষেত্র ছিল নির্মম নির্যাতনের পদ্ধতিগত ব্যবহার। এটা ‘তথ্য’ বের করার নামে হলেও কার্যত তার মূল সামাজিক লক্ষ্য ছিল সমাজ পরিবর্তনকামী তরুণদের ভয় ধরানো এবং তাদের ইচ্ছাশক্তিকে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া। বাংলাদেশে রক্ষীবাহিনীও তার কর্মকালে একইরূপ পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল বলে রাজনীতিবিদদের তরফ থেকে বিস্তর অভিযোগ ওঠে। ভারতে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে, সিআরপিএফের তৎপরতার সঙ্গে বাংলাদেশে রক্ষীবাহিনীর কর্মকাণ্ডের আরও কয়েকটি মিলের দিক হলো সেখানেও সিদ্ধার্থ শংকর রায়, প্রিয়রঞ্জন দাস মুন্সি প্রমুখের মাধ্যমে কংগ্রেস সরকার মূল দমনাভিযান শুরু করলেও সিপিএমের মতো বামপন্থী দাবিদার দলগুলো দ্বিধাহীনভাবে সিআরপিএফের কাউন্টার ইন্সারজেন্সিকে সমর্থন যুগিয়ে গেছেÑ যেমনটি ঘটেছে বাংলাদেশেও, রক্ষিবাহিনীর তৎপরতায় বামপন্থী সিপিবি ও ন্যাপের সমর্থনমূলক ভূমিকার মাধ্যমে। আবার সিআরপিএফের উলঙ্গ ব্যবহার সত্ত্বেও ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ’ করতে না পেরে সেখানে যেমন পঁচাত্তরের জুনে ইন্দিরা গান্ধী ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করেছিলেন; এখানেও তেমনি চুয়াত্তরের ডিসেম্বরে একই ধরনের ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করে শেষরক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।
সিআরপিএফের আদলে রক্ষিবাহিনীর সৃষ্টি অভিযোগ এবং তাতে নানান রূপে ভারতের সংশ্লিষ্টতার দাবি বিশেষভাবে তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে যখন তা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তির আলোকে বিবেচনা করা হয়। ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ স্বাক্ষরিত ২৫ বছর মেয়াদি ওই চুক্তিতে ‘যেকোনো পক্ষ আক্রান্ত হলে বা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে উভয় পক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে পারস্পরিক মতবিনিময়ের মাধ্যমে তাদের দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভীতি দূরীকরণের জন্য উপযুক্ত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে’ বলে ঐকমত্য হয়েছিল (১০ নম্বর অনুচ্ছেদে)। আরও উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশের ‘ভেঙে পড়া প্রশাসন পুনর্গঠনে সহযোগিতার জন্য’ আইএএস অফিসার এ আর গুপ্তের নেতৃত্বে আমলাদের যে দলটি ভারত থেকে এদেশে এসেছিলেন তারাই ‘শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত’ করা ও ‘ভীতি দূর করা’র নানান প্রশাসনিক উপায় সম্পর্কে সেই সময়কার সরকারকে অভিজ্ঞ করে তুলেছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
ঠাণ্ডাযুদ্ধ বা ¯œায়ুযুদ্ধকালীন পারস্পরিক বৈরিতা সত্ত্বেও নকশাল ধারার আমূল পরিবর্তনবাদী রাজনীতি ঠেকাতে ওই সময়কার বাংলাদেশ ও ভারতের শাসক শ্রেণীর মিলিত স্বার্থের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থও যে এক হয়ে গিয়েছিল, তার কিছু কৌতূহলোদ্দীপক নজির পাওয়া যায় ১৯৭২ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত বাংলাদেশকে নিয়ে লেখা ঘবংিবিবশ-এর প্রচ্ছদ রচনাটিতে। বর্তমান লেখাটি প্রকাশিতব্য যে গ্রন্থের অংশ তার পরিশিষ্টে সংযুক্ত উক্ত প্রতিবেদনে পাঠকের নজরে পড়বে, যুক্তরাষ্ট্র যেমন বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ও অরাজকতার মাঝে ‘বিপ্লব’ ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনায় তখন উদ্বিগ্ন ছিল, তেমনি সোভিয়েত ইউনিয়নও এই মর্মে উদ্বিগ্ন ছিল যে, এখানকার বিপ্লবটি যেন ‘রাশিয়ার মতো’ হয়Ñ ‘চীনের মতো’ নয় । পরাশক্তিদের পারস্পরিক এইরূপ উদ্বেগ ও প্রত্যাশা আবার জানাজানি হচ্ছে গোয়েন্দাগিরির মাধ্যমে!
পাঁচ.
প্রবাসী সরকারের প্রতি মুজিব বাহিনীর আনুগত্যহীনতা ও বৈরিতা
এই লেখায় ইতোমধ্যে মুজিব বাহিনীর সৃষ্টি ও বিকাশ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত হলেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিবরণ দেওয়া হয়েছে। সেখানে এ-ও দেখা গেছে, কীভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় কমিউনিজমবিরোধী এবং বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী নির্যাতিত জাতিগুলোর মুক্তিসংগ্রামবিরোধী বিভিন্ন আন্তঃদেশীয় প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছিল এই বাহিনীর উত্থানপর্বÑ যদিও মধ্য ও নি¤œসারির কর্মী-সংগঠকরা এরূপ সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না বলেই সাধারণভাবে প্রমাণ মেলে। বর্তমান পর্যায়ে মূলত একাত্তর সালে কলকাতায় এই বাহিনীর ভূমিকা এবং তাকে ঘিরে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারে সৃষ্ট ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে আলোকপাত করা হবে। এই বিবরণ থেকে দেখা যাবে, মুজিব বাহিনী সৃষ্টির মধ্যদিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরেই যুদ্ধকালে কীরূপ উপদলীয় কোন্দলের সৃষ্টি হয় এবং তা প্রতিনিয়ত কীভাবে রাজনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টির ঝুঁকির মধ্যে রেখেছিল সরকারকে। গুরুত্বপূর্ণ অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তির জীবননাশের আশঙ্কাও তৈরি করে তা।
সাধারণভাবে যেকোনো যুদ্ধেই ‘চেইন অব কমান্ড’ বা স্বপক্ষীয় ঊর্ধ্বতনের প্রতি স্তরে স্তরে নিম্ন পদস্থদের আনুগত্যের বিষয়টি সর্বাগ্রে জরুরি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী সরকারই ছিল বৈধ ক্ষমতার একমাত্র কেন্দ্র। কিন্তু এই কেন্দ্রের প্রতি মুজিব বাহিনীর নেতৃত্বের আনুগত্যহীনতা ছিল প্রকাশ্য। খোদ মেজর জেনারেল এস এস উবান বলেছেন: ‘(মুজিব বাহিনীর) চার যুবনেতার তাজউদ্দীনের প্রতি কোনো আনুগত্য ছিল না’ এবং যুদ্ধের পরও এই আনুগত্যহীনতা বহাল ছিল। সম্ভবত এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই সাংবাদিক এনায়েতুল্লাহ খান ‘হলিডে’তে তাঁর লেখায় মুজিব বাহিনীকে অভিহিত করেছিলেন Super-autonomous এক বাহিনী হিসেবে। তিনি মুজিব বাহিনী সৃষ্টির কয়েকটি কারণও ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে :
‘স্বাধীনতাযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী গেরিলাযুদ্ধে রূপ নেয়ার সম্ভাবনা ছিল; সেক্ষেত্রে ‘লিবারেশন আর্মি’ ধাঁচের কিছু গড়ে উঠলে তাকে মোকাবেলার জন্য, বিশেষত ঐরকম যুদ্ধে র্যাডিক্যাল সামাজিক শক্তিসমূহের বিপরীতে শক্তির ভারসাম্য রাখার জন্য মুজিব বাহিনীকে সৃষ্টি করা হয়। এর অন্য আরেকটি লক্ষ্য ছিল, পাকিস্তানের আটকাবস্থা থেকে মুজিব ফিরে না এলে এমন একটি শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য প্রস্তুত রাখাÑ যারা নিজেদের মুজিবের সরাসরি উত্তরাধিকার হিসেবে দাবি করতে পারে। শেষোক্ত লক্ষ্যের কারণেই প্রবাসী সরকারের আরেক অংশের সঙ্গে এর বিরোধ বাধে।’
সরকারপ্রধান ও সামরিক বাহিনীর প্রধানের প্রতি আনুগত্যহীনতা বিদ্রোহতুল্য হলেও যুদ্ধকালে মুজিব বাহিনীর সংগঠকরা কখনোই এর জন্য বৈরী জবাবদিহিতার মুখে পড়েননি সরাসরি ভারতীয় প্রশ্রয়ের কারণে। নিজেদের কর্মকাণ্ডের বৈধতা দিতে যেয়ে তারা মনে করতেন, শেখ মুজিবের নির্দেশ ছিল তার অনুপস্থিতিতে সিরাজুল আলম খান, শেখ মনি, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ সামরিক সংগঠন এবং তাজউদ্দীন আহমদ রাজনৈতিক কাঠামোর নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু মুজিবের অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতা সংগ্রামের রাজনৈতিক ভরকেন্দ্র হয়ে উঠলে এবং সামরিক ভরকেন্দ্র হিসেবে ভিন্ন এক কাঠামো (মুক্তিবাহিনী) নির্মাণে ব্রতী হলে প্রথোমক্তরা (বিশেষত ফজলুল হক মণি) প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। এবং নিজেদের সামগ্রিক মুক্তিসংগ্রামের প্রধান ভিত্তি ও শক্তি হিসেবে ভারতে তুলে ধরতে শুরু করেন। এমনকি তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রী হওয়া এবং সরকার গঠনকে ‘ষড়যন্ত্র’ মনে করতেন মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দ। সাংবাদিক মাসুদুল হককে দেয়া সাক্ষাৎকারে আবদুর রাজ্জাক বলছেন,
‘তিনি (তাজউদ্দীন) সরকার গঠন করেছেন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী করে। এই হলো ক্ষোভের কারণ। বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন সে অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না।...প্রধানমন্ত্রী যদি কেউ হন তো বঙ্গবন্ধুই হবেন। বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী করে তিনি উপ-প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। আবার উপ-প্রধানমন্ত্রী হলে তো সৈয়দ নজরুল ইসলামই হবেন।...তিনি (তাজউদ্দীন) এটা কেন করলেন? কমান্ড কাউন্সিল না করে তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন।...আমার ধারণা, তিনি মনে করেছিলেন বঙ্গবন্ধু আর ফিরে আসবেন না। সুতরাং তিনি প্রধানমন্ত্রী এবং মুক্তিযুদ্ধের নায়ক হিসেবে থাকবেন এবং এই বুদ্ধিটা অন্য জায়গা থেকে দেওয়া হয়েছিল।...
এরকম বক্তব্য থেকেই প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি মুজিব বাহিনীর সাধারণ মনোভাবটি আঁচ করা সম্ভব। এরকম বহু ভাষ্যে প্রমাণ হয়, তাজউদ্দীন আহমদের প্রতি ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখের বৈরিতা ছিল প্রকাশ্য এবং তীব্র। উপরোক্ত ছাত্র-যুবনেতারা তাজউদ্দীনবিরোধী এই বৈরিতায় অন্তত ৪২ জন আওয়ামী লীগ নেতাকেও সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন বলে দাবি করেছেন আমীর-উল-ইসলাম। এবং তাজউদ্দীনের কার্যক্রম যে উক্ত নেতৃবৃন্দের মনঃপূত হচ্ছে না সে বিষয়ে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে সম্মিলিতভাবে আপত্তিও উত্থাপন করা হয়েছিল।
মুজিব বাহিনীর নেতারা তাজউদ্দীন আহমদকে কীভাবে চরম বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতেন তার নজির হিসেবে তৎকালীন সচিব হোসেন তওফিক ইমাম-এর লেখনি থেকে আগরতলা সার্কিট হাউসের অভিজ্ঞতাটি এ পর্যায়ে তুলে ধরা যায়। শিলিগুড়ির মূর্তি সেনাক্যাম্পে ভারতীয়দের হাতে বাংলাদেশের ‘প্রথম সামরিক অফিসার ব্যাচ’-এর পাসিং আউট প্যারেড শেষে উক্ত ঘটনাটি ঘটে। এইচ টি ইমাম ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন,
‘রাতে শেখ মণি কয়েকজন সাথী নিয়ে এলেন সার্কিট হাউসে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কামরায় বৈঠক করতে করতে উত্তেজিত হয়ে চিৎকার আরম্ভ করলেন। অনেকেই সমবেত হলেন। রাগের কারণÑ প্রধানমন্ত্রী ও কর্নেল ওসমানী সম্পর্কে তার নানা অভিযোগ। ওসমানী কেন মুজিব বাহিনীর কার্যকলাপ সম্পর্কে অভিযোগ করছেন, আর প্রধানমন্ত্রী কেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তা প্রকাশ করছেন!...বলাবাহুল্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রকাশ্যে এরকম উঁচু গলায় এবং রাগতস্বরে কথা বলা মোটেই আমাদের মান-সম্মান বৃদ্ধি করেনি।’
মুজিব বাহিনীর নেতৃত্বের তাজউদ্দীন আহমদের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতার ধরন সম্পর্কে খোদ মুজিব বাহিনীর একজন সংগঠক অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী তার গ্রন্থে লিখেছেন, ‘...আমাদের অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মণি একপর্যায়ে সিরাজ ভাইকে আগরতলায় খবর দিয়ে আনলেন। কী কারণে জানি না মিজানুর রহমান চৌধুরীও আগরতলায় উপস্থিত ছিলেন। তাকে সামনে রেখে শত শত গেরিলা যোদ্ধার উপস্থিতিতে আগরতলার সংসদ ভবনে মণি ভাই, সিরাজ ভাই বাংলাদেশ সরকারের যৌথ কমান্ড গঠনের প্রচেষ্টাকে অনাস্থা জানালেন।’
পূর্বোক্ত ঘটনার আরও স্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন [বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৫ জানুয়ারি ২০১৩] মুক্তিযুদ্ধকালীন যুবশিবিরের উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং গণপরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট আহমেদ আলী এভাবে:
মুজিব বাহিনী গঠনের বিরোধিতার কারণে বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আগরতলায় একটি কর্মিসভার আয়োজন করেছিল। জহুর আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামরুজ্জামান এবং মিজানুর রহমান চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। সভায় শেখ মণিসহ যুব ও ছাত্রনেতারা মুজিব বাহিনী গঠনে বিরোধিতার জন্য তীব্র ভাষায় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বক্তব্য পেশ করা কালে কে একজন হঠাৎ মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করলে সমস্বরে চিৎকারের মাধ্যমে তা পাস হয়ে যায়। ব্যাপারটার ভয়াবহ পরিণতি অনুধাবন করে আমার পাশে বসা মিজান চৌধুরীকে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অনুরোধ করলে তিনি বলে ওঠেন, এই আগুনের মধ্যে আমি দাঁড়াতে পারব না। বুঝলাম এ ব্যাপারে তারও ইন্ধন রয়েছে।
বাস্তবে মুক্তিযুদ্ধকালে শেখ ফজলুল হক মণিসহ চার যুবনেতার রাজনৈতিক উচ্চাশা অস্পষ্ট ছিল না। মুজিবের অনুপস্থিতিতে পূর্ববাংলায় সৃষ্ট রাজনৈতিক শূন্যতা তারাই পূরণ করছেন, এটাই ছিল তাদের ধারণা। মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দের প্রতি সর্বোচ্চ পক্ষপাতিত্ব থাকার পরও তাই জেনারেল উবান লিখেছেন, ‘মি. তাজউদ্দীনের প্রতি এই যুবনেতারা (উপরোক্ত চারজনের কথা বলা হচ্ছে) এমন প্রচারণা চালাত যে, তিনি জবরদখল করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।’ স্বাধীনতার পরও এইরূপ মনোভাবের প্রকাশ দেখা যায়। যেমন, আবদুর রাজ্জাক মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ১৮ বছর পর ১৯৮৯ সালের জুনে এক সাক্ষাৎকারে (সাপ্তাহিক এখনই সময়) বলেন, ‘তাজউদ্দীন নিজেই নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, আমরা বুঝলামÑএটা ষড়যন্ত্র। তিনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পালন করলেন না। আমরা এটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারলাম না।’
যুদ্ধকালে উপরোক্ত ক্রোধের তীব্রতা ছিল ব্যাপক। মঈদুল হাসান দাবি করেছেন, মুজিব বাহিনীর চার প্রধান নেতার অন্তত দু’জন সেসময় তাজউদ্দীন আহমদকে হত্যার অসফল চেষ্টাও চালিয়েছিলেন। মঈদুল হাসানের এরূপ দাবি ফারুক আজিজ খানের দ্বারাও সমর্থিত হয়। স্পারসো’র অবসরপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফারুক আজিজ খান যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। যে কারণে তার ভাষ্যের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
গবেষক কামাল হোসেন তার ‘তাজউদ্দীন আহমদ: বাংলাদেশের অভ্যূদয় ও তারপর’ গ্রন্থে উল্লিখিত হত্যা চেষ্টার সত্যতা সম্পর্কে যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের সাক্ষাৎকার থেকে প্রাপ্ত তথ্যেরও উল্লেখ করেছেন। তাজউদ্দীন আহমদকে হত্যার অন্তত দুটি চেষ্টার কথা উল্লেখ করেছেন মঈদুল হাসানসহ একাধিক লেখক। একটি ঘটনায় হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রেরিত যুবক নিজেই তাজউদ্দীন আহমদের কাছে এসে আত্মসমর্পণ করেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিভিন্ন সাহিত্যে এই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। অপর ঘটনাটির বিবরণ পাওয়া যায় কেবল যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রীর সেক্রেটারি ফারুক আজিজ খানের গ্রন্থে। আজিজ খান লিখেছেন, :
In October, he (D P Dhar) cautioned the prime minister (Mr. Tajuddin) about the strong opposition that developed within the AL against him. When the meeting was going on (between the two) in the BSF office a telephone came and I was informed that a young man was detained by the BSF guards with a hand grenade and some explosive in his possession inside the 8 Theatre Road office compound…।’
ফারুক আজিজ খান এ-ও জানাচ্ছেন, মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন স্বদেশভূমিতে মন্ত্রী থাকাবস্থায়ও ‘বিশেষ মহল’ থেকে নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। বিশেষ করে চুয়াত্তরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে তাজউদ্দীন আহমদ উক্ত নিরাপত্তাহীনতার কারণেই, যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে রাইফেলের জন্য কিছু গুলি এবং একটি পিস্তল ক্রয় করেন। অন্যদিকে, মন্ত্রিত্ব থেকে অপসারিত হওয়ার পরও যে তাজউদ্দীন আহমদকে ব্যাপকভিত্তিক গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হতো এবং কারা কারা তার সঙ্গে দেখা করে সেটাও যে উচ্চপর্যায়ে রিপোর্ট হতো, সেই বিবরণ পাওয়া যায় অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলামের স্মৃতিচারণধর্মী গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ: জাতি গঠনকালে এক অর্থনীতিবিদের কিছু কথা’য়।
তাজউদ্দীন আহমদ হত্যার চেষ্টা সম্পর্কে যুদ্ধকালে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আইজি গোলক মজুমদার এক স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘(বাংলাদেশের) কয়েকজন যুবনেতা বিক্ষুব্ধ হয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রতিযোগী আরেক মুক্তিবাহিনী গঠন করেন এবং কিছু (ভারতীয়) দিশেহারা আমলার সাহায্যে অধিকতর অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্র জোগাড়ে সমর্থ হন। তাদের একজন তাজউদ্দীন সাহেবের প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে পিস্তল হাতে অতর্কিতে তার ঘরে ঢুকে পড়েন...।’
এইরূপ ঝুকিপূর্ণ অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষেও যুবনেতাদের দাবিকৃত মর্যাদার স্বীকৃতি প্রদান করা সম্ভব ছিল না; এমনকি মুজিবের কথিত ‘নির্দেশ’ সত্ত্বেও। কারণ এপ্রিলের শুরুতেই স্বজনদের ওপর পাকিস্তান বাহিনীর নির্মমতায় ক্রুদ্ধ হাজার হাজার তরুণ ছুটে আসছিল প্রতিরোধ যুদ্ধের তালিম নিতে। ইতোমধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রণাঙ্গনগুলোতে সে যুদ্ধের সামরিক নেতৃত্বও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এবং ৪ এপ্রিল হবিগঞ্জের মাধবপুরে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে ম্যানেজারের বাংলোতে সম্মিলিত মুক্তিফৌজ গঠন ও আতাউল গণি ওসমানীর প্রতি তার পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয়ে যাওয়ায় এতদবিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদকে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তবে বিএলএফ নেতৃবৃন্দের লাগাতার চাপের কারণে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জুনে উভয়পক্ষের (তাজউদ্দীন আহমদ ও বিএলএফ) রাজনৈতিক শক্তি যাচাইয়েরও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সর্বশেষ নির্বাচনে যারা পূর্বপাকিস্তান থেকে প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের এক সম্মেলন আহ্বান করতে তাজউদ্দীন আহমদকে তারা অনুরোধ করেন। সেই অনুযায়ী একাত্তরের ৫ জুলাই খন্দকার মোশতাক আহমদের সভাপতিত্বে জলপাইগুড়ির বাগডোগরায় পূর্ববঙ্গীয় পরিষদ সদস্যদের সমাবেশ হয়। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নিরাপত্তা সুরক্ষার মাঝেই হয় এই সভা । সভায় পরিষদ সদস্যের বাইরে আওয়ামী লীগ দলীয় কিছু নেতৃবৃন্দও উপস্থিত হন। শুরুতেই তাতে শেখ আবদুল আজিজ বক্তৃতা আরম্ভ করেন তাজউদ্দীন আহমদের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে। এসময় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ নিয়ে তাতে হস্তক্ষেপ করেন গাজীপুরের ময়েজউদ্দিন আহমেদ। মোশতাক আহমদ এ সময় সভাটি স্থগিত করে দিতে চাইলেও ৬ জুলাই পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিলÑ যদিও আবদুর রব সেরনিয়াবত, তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখকে সভা ছেড়ে চলে যেতে দেখা যায়। এদেরই কারও অনুসারী তরুণ সংগঠকরা তাজউদ্দীন আহমদ ও প্রবাসী সরকারকে ‘চোর’, ‘প্রতারক’ ইত্যাদি শব্দ বলতেও দ্বিধা করেননি সেদিন। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের নেতা এ এ মোহাইমেন সম্মেলনের বিবরণ দিয়ে লিখেছেন (ঢাকা আগরতলা মুজিবনগর) ‘...তাজউদ্দীনকে চোর, প্রতারক ইত্যাদি বলে এমন অশ্লীল ভাষায় রব, মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী প্রমুখ গালি দিতে শুরু করলো যে লজ্জায় মাথা তুলতে পারছিলাম না। মাইকের গোটা দুই হর্ন রাস্তায়ও ফিট করে রাখা ছিল। বারান্দায় বেরিয়ে দেখি প্রচুর লোক দাঁড়িয়ে গেছে বক্তৃতা শোনার জন্য।...’
তবে শেষ পর্যন্ত এই সমাবেশ প্রবাসী সরকারের রাজনৈতিক অবস্থান রক্ষা করলেও বিএলএফ-কে নিয়ন্ত্রণ তো দূরের বিষয়Ñ স্বাধীনভাবে মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম পরিচালনাও সম্ভব ছিল না সেই সরকারের পক্ষে। এমনকি বিএলএফ-কে ‘নিয়ন্ত্রণ’-এর জন্য তাজউদ্দীন আহমদ ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম আগস্টে সরাসরি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে দাবি জানালেও তাতে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বরং এই বাহিনীকে মাঠ পর্যায়ে জবাবদিহিতাহীন ‘স্বচ্ছন্দ’ করে দিতে উবানের চাপে জেনারেল অরোরা ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ একপর্যায়ে নির্দেশ দেয়, ‘সীমান্তের কেবল ২০ মাইলের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম সীমিত থাকবে। অভ্যন্তরে যুদ্ধের দায়িত্ব বিএলএফ-এর।’ আপাতদৃষ্টিতে এটাকে মুক্তিবাহিনী ও বিএলএফ-এর মধ্যে একটি আপসরফা বলে মনে হলেও কার্যত এর মাধ্যমে এই বাহিনীর প্রতি ভারতের অগ্রাধিকারভিত্তিক পক্ষপাত প্রকাশ পায়। এবং সরাসরি যুদ্ধে যুক্ত হওয়ার বহু আগেই ভারতীয়রা যুদ্ধক্ষেত্রের নীতি ও কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এসময় মুজিব বাহিনীকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ স্বতন্ত্র একটি ‘রিৎবষবংং ংুংঃবস’ এবং ‘পড়ফব ড়ভ পড়সসঁহরপধঃরড়হ’-এর ব্যবস্থা করে দেয়।
একই সময়ে দেশের ভেতরে জনগণের কাছে মূলধারার মুক্তিবাহিনীর বিপক্ষে বিএলএফ ক্যাডারদের অধিক গ্রহণযোাগ্য ও নির্ভরযোগ্য হিসেবে প্রমাণ করতেই তাদের নাম দেওয়া হয় ‘মুজিব বাহিনী’। আনুষ্ঠানিকভাবে এই নাম ধারণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোকপাত করতে যেয়ে বাহিনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক মার্শাল মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, অক্টোবরে বিএলএফ-এর শীর্ষ ১০০ সংগঠক দেরাদুনের কাছাকাছি কালশিতে মিলিত হন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামরিক বিষয়গুলোতে ঐকমত্য গড়ে তুলতে। যাকে মনিরুল ইসলাম বলছেন, বিএলএফ-এর ‘কাউন্সিল অধিবেশন’। তার ভাষায় এই কালশি অধিবেশনেই বিএলএফকে ‘মুজিব বাহিনী’ নামে অভিহিত করা হয়। এই সিদ্ধান্তের আর্থসামাজিক কারণ ব্যাখ্যা করতে যেয়ে মনিরুল ইসলাম তার গ্রন্থে লিখেছেন, ‘মুজিবের অনুপস্থিতিতে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতা ও সামরিক-বেসামরিক আমলাচক্রের অশুভ চক্রান্ত প্রতিহত করে মুজিবের দর্শন বাস্তবায়িত করার সংগ্রামে এই নাম পরিবর্তন সহায়ক হবে এবং মুজিবের দর্শনের সৈনিকদের সংগঠন ‘মুজিব বাহিনী’ জনগণের মাঝে দ্রুত বিস্তার লাভ করতে সক্ষম হবে বলে বিবেচিত হয়।’
তবে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের মুজিব বাহিনী সদস্য জিয়ারুল ইসলাম বর্তমান লেখককে বলেছেন, প্রশিক্ষণ পর্যায়ে এবং পুরো যুদ্ধকালে ‘মুজিব বাহিনী’ নামেই তারা যুদ্ধ করেছেন। তার ভাষায়, ‘এই বাহিনীর নাম যে বিএলএফ সেটা যুদ্ধের পরে শুনতে পাই।’ জিয়ারুল ইসলাম ছিলেন মুজিব বাহিনীর ‘পঞ্চম কোর্সের সদস্য’।
বিএলএফ-এর ‘মুজিব বাহিনী’ নামকরণ যখনি হোকÑ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে এই বাহিনী সৃষ্টি ও ভারতীয় বিভিন্ন ‘কর্তৃপক্ষ’-এর নানামুখী তৎপরতায় কর্নেল ওসমানীসহ সেক্টর কমান্ডাররা স্পষ্টত নাখোশ ছিলেন। কিন্তু এ ছিল কার্যত অনিবার্য। এর রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে তখনই ভারতীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও কানাঘুষা শুরু হয়। সেই সময়কার একজন খ্যাতনামা ভারতীয় বামপন্থী তাত্ত্বিক শিবদাস ঘোষ (সাধারণ সম্পাদকÑএসইউসি আই) ১৯৭১-এর ২৪ এপ্রিল যুদ্ধকালেই তাদের পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় ‘সহায়তা’র রাজনৈতিক তাৎপর্য তুলে ধরতে যেয়ে বলেছিলেন, ‘ভারতের সরকার একচেটিয়া পুঁজিবাদী চরিত্রের সরকার। সে ইতোমধ্যে সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র অর্জন করেছে। পশ্চিমা দেশগুলোর মতো সাম্রাজ্যবাদী অভিসন্ধি না থাকলেও স্বল্প পরিমাণ সম্প্রসারণবাদী মনোভাব তার নাই, এটা বলা যায় না। বাংলাদেশকে সাহায্য করার ব্যাপারে এই মনোভাব কাজ করবে আমাদের সরকারের। সরকার স্বভাবতই বাংলাদেশের আন্দোলনকে সমর্থন করা এবং তাকে সাহায্য করার নামে সেই দেশের উপর খবরদারি বা অন্তত ট্রেড এন্ড কমার্সের স্বার্থে খানিকটা প্রভাবের পরিধি বিস্তার করার চেষ্টা করতে পারে এবং বাংলাদেশে একটি তাঁবেদার সরকার খাড়া করার চেষ্টা করতে পারে।’
শিবদাস ঘোষের উপরোক্ত দূরদর্শী অনুমান ও তার পরবর্তী সত্য-মিথ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও একেবারে অমূলক প্রমাণিত হয়নি তা। এ বিষয়ে স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশ-ভারত যৌথ অর্থনৈতিক নীতিকৌশলগুলো এবং তার ফলাফল নিয়ে বর্তমান লেখক মূল গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তবে এ পর্যায়ের কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা হলো, যুদ্ধ শেষে মাত্র এক বছরের মধ্যে ‘মুজিব বাহিনী’র সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য দ্বারা ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’-এর ডাক দিয়ে সৃষ্ট জাসদের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি আদর্শিক প্রভাব দেখা গিয়েছিল শিবদাস ঘোষ এবং তার দল এসইউসি আই-এরই। তার পেছনে অবশ্য ভিন্ন আরেক আত্মগত উপাদান কাজ করেছে। বাংলাদেশের চট্টগ্রামের বাড়বকুন্ডের তরুণ মুবিনুল হায়দার চৌধুরী ব্যক্তিগত কারণে ভারতে অবস্থানকালে এসইউসি আই-এর রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বৃহত্তর কুমিল্লার বামপন্থী নেতা হাবিবুল্লাহ চৌধুরীর মাধ্যমে মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর পরিচয় হয় সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে। ভারতে মুবিনুল হায়দারের বড় ভাই থাকতেন। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর নিয়োগপ্রক্রিয়া থেকে পালিয়ে সেসময় মুবিনুল হায়দার তার ভাইয়ের কাছে অবস্থান করছিলেন। ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর হাবিবুল্লাহ চৌধুরীর সাথে এ বিষয়ে বর্তমান লেখকের কথোপকথনকালে তিনি এ সম্পর্কিত ‘যোগসূত্র’ তৈরির বিবরণ দেন। হাবিবুল্লাহ চৌধুরী এখন আর রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত নেই। কুমিল্লাতেই অবস্থান করেন তিনি। জাসদ সৃষ্টির কালে তিনি চাঁদপুর এলাকায় ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি ও বর্তমান বাসদ নেতা খালেকুজ্জামান মিলে চাঁদপুরে জাসদের গোড়াপত্তন করেছিলেন।
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে জন্মগ্রহণকারী হাবিুবুল্লাহ চৌধুরী ও মুবিনুল হায়দার চৌধুরী পরস্পর নিকটাত্মীয়। স্বাধীনতার পরপরই মুবিনুল হায়দার চৌধুরীকে এসইউসি-আই পাঠিয়েছিল বাংলাদেশের নতুন ধারার বামপন্থী রাজনীতির উত্থান পর্যবেক্ষণ এবং তাদের সঙ্গে সম্ভাব্য সম্পর্কের সম্ভাবনা যাচাইয়ের জন্য। বাংলাদেশে জাসদের ব্যানারে নতুন ধারার বামপন্থী তারুণ্যের উত্থান কলকাতায়ও ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল তখন। এসইউসি-আই এ ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ের পরিস্থিতি যাচাইয়ে বিশেষ তৎপর ছিল। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই মুবিনুল হায়দার এসইউসি আই-এর অভিজ্ঞতা ও আদর্শের আলোকে সিরাজুল আলম খানকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেনÑ এদেশেও অনুরূপ আদলে আরেকটি কমিউনিস্ট পার্টির গোড়াপত্তনে। পরে মুবিনুল হায়দারের মাধ্যমে এসইউসি-আই নেতা শিবদাস ঘোষের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের দীর্ঘ বৈঠকও হয় ভারতে। জাসদ বিষয়ে সম্প্রতি দৈনিক ‘প্রথম আলোতে’ কলাম লিখে আলোচিত মহিউদ্দিন আহমদ তার পূর্ববর্তী এক গ্রন্থে লিখেছেন, শিবদাস ঘোষ ও সিরাজুল আলমের উপরোক্ত যোগাযোগ ঘটেছিল তেহাত্তরের আগস্টে এবং শিবদাস ঘোষের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের বৈঠক হয়েছিল ‘কয়েক দফা’। ফল হিসেবে দেখা যায়, বামপন্থী দল হিসেবে সিরাজুল আলম খানের অনুসারীরা যখন ‘জাসদ’ গড়ে তুলছেন তখন তার সঙ্গে এসইউসি-আই’র অনেক সাংস্কৃতিক মিল। এমনকি মুবিনুল হায়দার চৌধুরী তাদের এক পার্টি দলিলে এও মন্তব্য করেছেন, ১৯৭৪ সালে গৃহীত জাসদের প্রথম থিসিস, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লাইন, রণনীতি-রণকৌশলÑ শিবদাস ঘোষের সঙ্গে জাসদের তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খানের আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে রচিত। জেলে আটক জাসদ নেতারা তখন শিবদাস ঘোষের ‘কেন এসইউসিআই ভারতবর্ষের মাটিতে একমাত্র সাম্যবাদী দল’ শীর্ষক পুরো পুস্তিকাটি সাধারণ খাতায় লিখে এক কারাগার থেকে আরেক কারাগারে সতীর্থদের পৌঁছে দিতেন বলেও জানা যায়।
অন্যদিকে, জাসদে মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর অন্তর্ভুক্তির পটভূমি এবং এই অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে দলে সৃষ্ট রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তখনকার জাসদ এবং বর্তমানে বাসদ নেতা খালেকুজ্জামান সাম্প্রতিক এক ভাষণে (১৩ ডিসেম্বর ২০১০) নি¤েœাক্ত বিবরণ দিয়েছেন:
জাসদ হওয়ার পর এক তাত্ত্বিক সংকটের মধ্যে সেøাগান উঠেছিল ‘আমরা লড়ছি সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য।’ কিন্তু বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে? বিপ্লবটা কী ধরনের হবে? বিপ্লবের স্তর কী? দলের নীতিগত-পদ্ধতিগত সংগ্রাম কী হবে? এই বিষয়গুলো ছিল অস্পষ্ট। তার সম্বন্ধে কোনো পরিষ্কার ধারণা আমাদের নেই। সে সময়, কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তা-ভাবনা আমাদের পার্টির নেতা কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর মাধ্যমে আমরা পেলাম। তিনি আগে থেকেই এর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।...কমরেড শিবদাস ঘোষের যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ...সেটা জাসদ গ্রহণ করে। কিন্তু গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে তার যে অনুশীলন, এটাকে উপেক্ষা করে গেছে।
খালেকুজ্জামান কথিত ‘উপেক্ষা’রই সংশোধিত ফল পরবর্তীকালে ‘বাসদ’-এর সৃষ্টি। তবে প্রথমে জাসদ এবং পরে বাসদ সৃষ্টিতে শিবদাস ঘোষের বিপুল তাত্ত্বিক প্রভাব কাজ করলেও মুবিনুল হায়দার চৌধুরী শুরুতে সচেতনভাবে নিজেকে আড়াল করে রাখতেন। এ বিষয়ে দলীয় কর্মীদের এক শিক্ষা শিবিরে তাঁর মন্তব্য হলো, ‘কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছিলেন তুমি ওখানে গেছ, ওখানে নেতা হবে না; তুমি সামনে আসবে না; তুমি যদি সামনে আস তাহলে ইন্ডিয়ান পার্টি হিসেবে সেই পার্টি ব্রান্ড হয়ে যাবে। তা হলে আর পার্টি দাঁড়াতে পারবে না।’ কথিত ‘পার্টি’টি দাঁড় করানোর এতসব সযতœ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জাসদ কেন ২-৩ বছরের মধ্যে হোঁচট খেল সে ব্যাখ্যাও সবিস্তারে দিয়েছেন মুবিনুল হায়দার চৌধুরী সম্প্রতি বাসদের ভাঙ্গনকালে প্রকাশ্য এক লেখায় নি¤েœাক্ত উদ্ধৃতিতে। লেখাটিতে জাসদের উত্থান ও পতন- উভয় প্রসঙ্গেই বক্তার গভীর এবং মনোযোগ আকর্ষণী পর্যবেক্ষণ লক্ষ করা যায়। লেখক দেখিয়েছেন, কীভাবে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’-এর সেøাগান তরুণ সমাজকে ¯্রফে ‘ধরে রাখা’র প্রয়োজনীয়তা পূরণ করেছিল মাত্র।
স্বাধীনতাযুদ্ধের পর পর শাসক বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে মানুষের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা, মুক্তির আকাক্সক্ষা যখন মার খেতে শুরু করলো, তার বিরুদ্ধে ছাত্র-যুবক-তরুণদের প্রবল প্রতিবাদের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে জাসদ গড়ে ওঠে। এই ছাত্র-যুবকরা শাসকদের লুটপাটে যুক্ত হতে চায়নি। জাসদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সেøাগান আসলে একটা আকাক্সক্ষাকে প্রতিফলিত করেছিল। কিন্তু কেমন করে সমাজতন্ত্র হয়, কেমন করে বিপ্লবের উপযোগী পার্টি হয়, এসব কিছুই তাদের সামনে পরিষ্কার ছিল না। এ সম্পর্কে জাসদ নেতাদের মধ্যে স্বচ্ছ-স্পষ্ট কোন ধারণাও ছিল না। আমার মাধ্যমে কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে তারা একটি প্রয়োজনের হাতিয়ার খুঁজে পেলেন, যা দিয়ে ছাত্র-তরুণদের আকৃষ্ট করা যায়, ধরে রাখা যায়। এটা তাদের প্রয়োজনবাদিতার ঝোঁক, উপস্থিত প্রয়োজনের তাগিদ। কিন্তু শিবদাস ঘোষের বিপ্লবী চিন্তাকে ধারণ করে নিজেদের জীবন পাল্টানোর প্রশ্ন যখন এলো, তখন কিন্তু এরা আর তা করতে পারলেন না। এ তাদের সাধ্যের মধ্যেই ছিল না। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, জাসদ নেতারা সব ব্যক্তিগতভাবে অসৎ ছিলেন। তারা বুর্জোয়া মানবতাবাদী চিন্তার কাঠামোর মধ্যেই আটকে ছিলেন। সেখান থেকে নিজেদের ভেঙেচুরে সর্বহারা শ্রেণীর আদর্শে নতুনভাবে গড়ে তোলার কাজটি করতে পারলেন না। এদিক থেকে জাসদ ব্যর্থ হয়ে গেছে...।
উল্লেখ্য, জাসদ সৃষ্টির সময় মুজিব বাহিনীর সিরাজ অনুসারীদের প্রবলভাবে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’মুখী হওয়ার পেছনে বাহিনী বহির্ভূত ব্যক্তি হিসেবে মুবিনুল হায়দার চৌধুরী ছাড়াও আরেকজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলÑ তিনি হলেন, অর্থনীতিবিদ ড. আখলাকুর রহমান; যিনি প্রথমে করাচিতে ইউনাইটেড ব্যাংকে কাজ করেছেন এবং পরে পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতার পর পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যাপনার চাকরি নেন আখলাকুর রহমান। অর্থনীতি পড়েছিলেন তিনি ম্যানচেস্টারে ও ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে (পিএইচডি)। অর্থনীতি বিষয়ে তার একটি স্বতন্ত্র গবেষণা সংস্থাও ছিল। জাসদ পরিবারে প্রাতিষ্ঠানিক বিবেচনা থেকে আখলাকুর রহমানই ছিলেন সবচেয়ে মেধাবী ও পলিটিক্যাল ইকোনমিতে উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত। পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগেও পড়িয়েছিলেন তিনি। ভারত বিভক্তির পূর্ব থেকে তিনি সাম্যবাদী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। যুক্ত ছিলেন ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে। সিরাজুল আলম খানের অনুসারী জঙ্গি তরুণদের নিয়মিত পাঠচক্রের মাধ্যমে মার্কসবাদী মতাদর্শে দীক্ষা দিয়ে জাসদকে বামপন্থী দল হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় তার অবদান বিপুল।
১৯৭৩ সালের আগস্ট থেকে পরবর্তী চার মাস আখলাকুর রহমান জাসদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণে যুক্ত ছিলেন নিবিড়ভাবে। বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে জাসদ কার্যালয়ের দোতলায় প্রত্যহ ভোরে মার্কসবাদের ওপর সাইক্লোস্টাইল করা পাঠ উপকরণ দিয়ে দলের অগ্রসর ক্যাডারদের নিয়ে এই প্রশিক্ষণ হতো। পাশাপাশি এই দলের তাত্ত্বিক অবস্থানও নির্মাণ করে দিয়েছিলেন তিনি। জাসদের প্রাথমিক পর্যায়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলিল, বিশেষত ‘বাংলাদেশের কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ’ শীর্ষক জাসদের মুখ্য তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরিতে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখেন তিনি। বাহাত্তরে ড. আখলাক সাপ্তাহিক ‘হলিডে’ কাগজে বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বরূপ বিশ্লেষণ করে কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেন, সেটাই হবু জাসদ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার সম্পর্কের রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরি করে। ইতোমধ্যে মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর মাধ্যমে সীমান্ত পেরিয়ে আসা ‘উৎপাদন পদ্ধতি’র যে রূপ বিশ্লেষণকে সিরাজুল আলম খানের কাছে যৌক্তিক মনে হচ্ছিলো আখলাকুর রহমানের দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল তার কাছাকাছি। ফলে নবীন দলটির সঙ্গে তার সম্পর্কটি দ্রুত বিকশিত হয়। জাসদের মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠে ১৯৭৩-৭৪ জুড়ে বামপন্থী রাজনীতির তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে প্রায়ই লিখতেন তিনি। আশির দশকে এসে আখলাকুর রহমানের সঙ্গে জাসদের সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে যায়। এসময় তিনি মার্কসবাদের ওপর তার পুরানো বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে আখলাকুর রহমানের পাশাপাশি অন্য যে নেতৃস্থানীয় অর্থনীতিবিদ জাসদ কর্মীদের ‘মার্কসবাদ’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি’ বিষয়ে অনিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সুপরিচিত অধ্যাপক ড. আবু মাহমুদ। অর্থনীতিবিদ আনিসুর রহমানও জাসদের প্রথম দিকে বিভিন্ন সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকতেন। পল্টনে জাসদের প্রথম কাউন্সিল সভাতেও তিনি আলোচক ছিলেন। এক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনাযোগ্য দিক হলো, জাতীয় পরিসরে অধ্যাপক আনিসুর রহমান তখন ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ।
উল্লেখ্য, ড. আনিসুর রহমান ছিলেন সেই বুদ্ধিজীবী দলের অন্যতম সদস্য যারা ১৯৬৫ থেকে ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের আর্থিক বঞ্চনার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানকে দায়ী করে ‘টু ইকোনমি থিওরি’ দিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অন্যান্য যেসব অধ্যাপক টু ইকোনমি থিওরির প্রবক্তা তাদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক আতোয়ার রহমান, অধ্যাপক আবু মাহমুদ, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ প্রমুখ। অধ্যাপক রেহমান সোবহানই এই বিষয়ে বেশি সরব ছিলেন। আর এই অধ্যাপক গোষ্ঠীকে বিশেষ উৎসাহ যোগাতেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। যাকে বলা হতো ‘শিক্ষকদের শিক্ষক’।
পাকিস্তানের দুই অংশের মাঝে বৈষম্যের চিত্র উপস্থাপন শেষে ফবংঢ়ধৎরঃু থেকে রক্ষা পেতে উপরোক্ত অধ্যাপকরা ঐ সময় যে সমাধান চিন্তা তুলে ধরেন তা সেই রাজনীতিবিদদের হাতকেই শক্তি যুগিয়েছিল যারা পূর্ববাংলাকে পৃথক করাই পাকিস্তানের তখনকার বিরাজমান সংকটের সমাধান হিসেবে ভাবছিলেন। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমে সহায়ক ভূমিকায় ছিলেন ‘ইত্তেফাকে’ তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ‘মুসাফির’ নামক কলাম এবং হামিদুল হক চৌধুরীর ‘অবজারভারে’ অর্থনীতি বিষয়ক নানামুখী রিপোর্ট।
যুদ্ধ পরবর্তীকালে বামপন্থী অধ্যাপকদের সরাসরি মানসিক প্রেরণা, উৎসাহ ও সংশ্লিষ্টতা সত্ত্বেও জাসদের সাংগঠনিক কাঠামো মোটেই সমাজতান্ত্রিক পার্টিগুলোর প্রথাগত আদলে গড়ে উঠছিল না। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের পার্থক্য ছিল কমই। বহু দশক ধরে এতদঞ্চলে এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশেও সমাজতান্ত্রিক বা কমিউনিস্ট ঘরানার দলগুলোর সংগঠন যেভাবে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের জনপদে দীর্ঘ সংগ্রাম-সংগঠনের মাধ্যমে গড়ে ওঠে, তাদের সংগঠনের যেরূপ বিশেষ শ্রেণীভিত্তি থাকে, মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব যেভাবে শ্রেণীচ্যুতির প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে দল পরিচালনার সর্বোচ্চ পর্যায়ে দায়িত্ব পায়Ñ জাসদের চর্চা ছিল তার চেয়ে ভিন্নতর। এর বড় প্রমাণ হিসেবে দেখা গেল, স্রেফ ভারতবিরোধী লড়াকু একটা ইমেজের কারণে মেজর এম এ জলিল নতুন দলটির প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন। যদিও তিনি ছিলেন একজন সফল সেক্টর কমান্ডার, বীর মুক্তিযোদ্ধাÑ কিন্তু প্রথম আবির্ভাবেই একটি সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হিসেবে তার অভিষেক ছিল বিস্ময়কর। তাজউদ্দীন আহমদ ও আবদুর রাজ্জাকের আসার সম্ভাবনা নাকচ হয়ে যাওয়ার পর জাসদ প্রথমে সভাপতি হিসেবে ড. আলীম আল-রাজিকে পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তিনি প্রস্তাবে রাজি হন নি।
প্রথাগত বামপন্থী আদলের বাইরে এসে মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী সময়ে যেভাবে ছাত্রলীগের সিরাজপন্থী ‘নিউক্লিয়াস’ তার রাজনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সাফল্য পায় তারই পুনরাবৃত্তি আশা করছিলেন একই সংগঠকরা যুদ্ধ-পরবর্তী ‘সমাজতন্ত্র’-এর সংগ্রামে জাসদ গড়ে তুলে। ‘মাল্টিক্লাস’ ভিত্তি নিয়েই তারা সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য শ্রেণী সংঘাতের দিকে এগোতে ছিলেন মরিয়া। ভিন্নমতও দেখা দেয় শিগগির। এ বিষয়ে জাসদের প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির কৃষিবিষয়ক সম্পাদক মাহবুবুর রব সাদীর পর্যবেক্ষণ এ পর্যায়ে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। বর্তমান লেখককে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আওয়ামী লীগের পরিধি থেকে বেরিয়ে একটি ভিন্ন দল গড়ে তোলার সময় নির্ধারণে সিরাজুল আলম খান অনন্য বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু সেই দলের আদর্শ নির্ধারণে তিনি পরিচয় দিয়েছেন চরম অপরিণত জ্ঞানের। তার মাথায় ছিল রাশিয়ার ছক। কিন্তু বাংলাদেশে মানুষ তখনও বলশেভিক ধাঁচে বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তখন নতুন দলের রাজনৈতিক লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দেয়া। গণতন্ত্র বিনির্মাণ করা। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আত্মগত শর্ত তখন এদেশে ছিল না। যে দেশে শ্রমিক শ্রেণীরই বিকাশ ঘটেনি সেখানে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কীভাবে হবে? তখন কোনোভাবেই বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক হতে পারে না। কিন্তু জাসদ সেই আওয়াজই দিল। সিরাজ ভাই কখনোই ভুল স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি ভিন্নমতও পাশ কাটিয়ে যেতেন।...আমরা যা করেছি মানুষ তা চায়নি। অনেক পরে আমার মনে হয়েছে মুজিবের ধ্বংস সাধনের জন্যই বোধহয় এসব হচ্ছিল।’
শুরুর মুহূর্তেÑ বিশেষ করে জাসদের পরিচয় যখনও কেবলি ‘ছাত্রলীগের রব গ্রুপ’Ñ তখন দলটির রাজনীতি ও সংগঠনসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে এ দলের বাইরে বামপন্থী পরিমণ্ডলে সবচেয়ে সরাসরি তাত্ত্বিক প্রশ্ন তুলেছিলেন পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির সিরাজ সিকদারÑ দেশব্যাপী প্রচারিত দুটি দলিলের মাধ্যমে। এই দলিল দু’টি ছিল: ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলÑ ছাত্রলীগের রব গ্রুপের নিকট কয়েকটি প্রশ্ন’ (আগস্ট ১৯৭২) এবং ‘সমাজতন্ত্র, শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লব প্রসঙ্গে’ (অক্টোবর ১৯৭২)।
এই দলিল দুটিতে সিরাজ সিকদারের মন্তব্য ছিল: প্রথমত. জাসদ মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্রের কথা বললেও সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের কথা বলে না; সর্বহারার একনায়কতন্ত্র ছাড়া মার্কসবাদ ফ্যাসীবাদ হিসেবে আবির্ভূত হয়; দ্বিতীয়ত. জাসদ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলছেÑ অথচ পূর্ববাংলায় এখনো জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসম্পন্ন; এরা আসলে মুজিববাদীদের উৎখাত করে কেবল ক্ষমতা দখল করতে চাইছে; তৃতীয়ত. জাসদ মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্রের কথা বলছেÑ অথচ সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি ছাড়াই তারা এটা বলা শুরু করেছে, যা বিস্ময়কর! এটা শ্রেণী বিশ্বাসঘাতকতা হয়ে দাঁড়াবে। এটা সর্বহারা শ্রেণীকে অপ্রস্তুত করে রাখার নামান্তর। চতুর্থত. শ্রেণী সংগ্রাম ও শ্রেণী রাজনীতির কথা বলার পরও জাসদ কর্তৃক বিভিন্ন জেলায় অন্যান্য বামপন্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে অবতীর্ণ হওয়ার যথার্থতা নিয়েও প্রশ্ন করেন সিরাজ সিকদার। সবশেষে তিনি বলেন, জাসদের ‘ভুল লাইন’ এ দলের কর্মীদের সরকারের পেটোয়া বাহিনীগুলোর নিপীড়নের খোরাকে পরিণত করবে।
জাসদের ‘লাইন’ ভুল ছিল কি নাÑ সেটা বিতর্কের বিষয় হলেও এই দলের প্রথম প্রজন্মের মেধাবী তরুণদের বিরাট সংখ্যক যে সিরাজ সিকদারের আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করে তৎকালীন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছিলেন, তার সত্যতা তুলে ধরছে দলটির নিহত কর্মীদের বিশাল এক তালিকা যার অসম্পূর্ণ একটি সংকলন বর্তমান লেখকের প্রকাশিতব্য গ্রন্থের সংযুক্তিতেও মুদ্রিত হবে। সম্প্রতি জাসদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সখ্যের পটভূমিতে এসব হারিয়ে যাওয়া রাজনৈতিক কর্মীদের পরিবারগুলোতে এ প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয় যে, একাত্তর-পরবর্তী সংঘাতে নিহত তাদের স্বজনদের মৃত্যুর জন্য তাহলে কে জবাবদিহি করবে এবং কে সেই জবাবদিহিতা আদায় করবে?
লেখক ও গবেষক
altafparvez@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন