গত ১২ জুন ২০১৪ ‘এনজেবিডি নিউজ’ মাধ্যমে ‘আমি প্রেসিডেন্ট হতে চাইনি’ শিরোনামে এবং ১৯ জুন ‘আমার দেশ’ পত্রিকায় ‘জেনারেল মইন কবুল করলেন তারেক রহমানকে নির্যাতন করেছেন এক লেফটেন্যান্ট কর্নেল’ শিরোনামে প্রকাশিত জেনারেল মইন উ আহমেদ কর্তৃক তার নিউইয়র্কের বাসায় বসে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। বর্ণিত সাক্ষাৎকারে কিছু কিছু ব্যাপারে তিনি অসত্যের আশ্রয় নিয়েছেন এবং উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা চালিয়েছেন। সেগুলোর উল্লেখপূর্বক প্রকৃত অবস্থান তুলে ধরার মানসেই আমার অদ্যকার এ প্রয়াস।
দুই নেত্রীকে গ্রেফতার প্রসঙ্গে : প্রথমেই ধরা যাক, দু’নেত্রীকে গ্রেফতার
বিষয়ে জেনারেল মইনের দেয়া বক্তব্য। তিনি বলেছেন, ‘দুই নেত্রীকে ধরার জন্য আমার কোন সিদ্ধান্ত ছিল না। এটা করেছে তারা যারা দুর্নীতি দমনের জন্য কাজ করেছিলেন। দুর্নীতি দমনের জন্য কমিটি ছিল। সেখানে একজন উপদেষ্টা দায়িত্বে ছিলেন। তারাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দু’নেত্রীকে গ্রেফতার বিষয়ে আমার কাছে সিদ্ধান্তের জন্য কোন প্রস্তাব আসেনি। তবে আমি মনে করি ওই সময় দুর্নীতি দমন করার জন্য তারা যেটা ভাল মনে হয়েছে সেটা করেছে।’ জেনারেল মইন আরও বলেছেন, ‘দুর্নীতি দমনের জন্য কমিটি ছিল। সেখানে একজন উপদেষ্টা দায়িত্বে ছিলেন। তারাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
জেনারেল মইনের এ বক্তব্য সঠিক নয়। দুর্নীতিসহ গুরুতর অপরাধ দমন অভিযান পরিচালনার লক্ষ্যে ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠন করা হয়েছিল। আমি উপদেষ্টা পদে থাকাকালীন উক্ত কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনরত ছিলাম। তাই আমার বক্তব্য পেশ করার পূর্বে উক্ত কমিটির গঠন প্রণালী এবং দায়িত্বাবলী সম্পর্কে পাঠককুলের সদয় অবগতির জন্য উল্লেখ করা নেহায়েত প্রয়োজন বলে মনে করছি। ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’র গঠনপ্রণালী ও দায়িত্বাবলী ছিল নি¤œরূপ-
১। কেন্দ্রীয় কমিটি
ক। সংগঠন :
(১) চেয়ারম্যান, মেজর জেনারেল এম এ মতিন (অব.), বিপি, উপদেষ্টা;
(২) প্রধান সমন্বয়ক, মেজর জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, এনডিসি, পিএসসি; জিওসি, ৯ পদাতিক ডিভিশন।
সদস্যবৃন্দ
(ক) সকল জিওসি, (দায়িত্বপূর্ণ প্রতিনিধি এবং সমন্বয়কারী);
(খ) সচিব, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়;
(গ) সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশন (সমন্বয়ের নিমিত্তে আমন্ত্রিত);
(ঘ) চেয়ারম্যান, এনবি আর/ডিজি সিআইসি, এনবি আর;
(ঙ) আইজিপি/অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক, এসবি;
(চ) অতিরিক্ত সচিব (লেজিসলেটিভ), আইন মন্ত্রণালয়;
(ছ) ডিজি/অতিরিক্ত মহাপরিচালক, র্যাব;
(জ) উপ-মহাপরিচালক, বিডিআর;
(ঝ) ডেপুটি গভর্নর/এক্সিকিউটিভ পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক (গভর্নর কর্তৃক মনোনীত);
(ঞ) পরিচালক, এনএসআই (ইন্টারনাল);
(ট) পরিচালক (সিটিআইবি), ডিজিএফআই;
(ঠ) ডিএমও, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী;
(ড) যুগ্ম সচিব (রাজনৈতিক), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং
(ণ) অতিরিক্ত/ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (অ্যাটর্নি জেনারেল কর্তৃক মনোনীত)।
খ। দায়িত্বাবলী :
(১) সহায়তাকারী বিভাগ/সংস্থা (ক্ষেত্রমতে) হতে প্রাপ্ত বিভিন্ন অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গের তালিকা মূল্যায়ন করা।
(২) বিভিন্ন অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত তালিকাভুক্ত ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ/পরামর্শ প্রদান করা।
(৩) সহায়তাকারী বিভাগ/সংস্থা (ক্ষেত্রমতে) হতে প্রাপ্ত বিভিন্ন অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গের তালিকা হালনাগাদ করা।
(৪) অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্য পরিচালনার জন্য নির্বাহী বিভাগ/সংস্থা (ক্ষেত্রমতে) বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাথে প্রয়োজনীয় সংখ্যক চার্টার্ড অ্যাকউন্ট্যান্ট/অডিটর/বিশেষজ্ঞ/কনসালটেন্ট (দেশি/বিদেশি) নিয়োগ দানের বিষয়ে সমন্বয় সাধন করা।
(৫) অনুসন্ধান, তদন্ত ও মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত (চৎড়পবফঁৎধষ) এবং আইনানুগ (খবমধষ) বিষয়সমূহ সমন্বয়/ তদারকি/ মনিটরিং (যেমন প্রজোয্য হয় অং ধঢ়ঢ়ষরপধনষব) করা। এ কার্যে প্রয়োজনবোধে এক বা একাধিক সাব-কমিটি নিয়োগ করা।
গ। টাস্কফোর্সের সংগঠন :
১ ী সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার (মেজর/সমমান)।
১ ী র্যাব অফিসার (প্রাপ্যতা সাপেক্ষে)।
১ ী পুলিশ অফিসার।
১ ী এসিসি অফিসার (যদি দুর্নীতি দমন কমিশন প্রয়োজন অনুভব করে)।
১ ী এনবি আর অফিসার।
উল্লেখ্য, ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’র সকল মিটিংয়ে আমরা শুধুমাত্র দুর্নীতি বিষয়ে উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে আলোচনা করেছি এবং তার মধ্যেই আমরা আমাদের আলোচনার ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ রেখেছি। কারণ দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে দুর্নীতি বিষয়ে উত্থাপিত অভিযোগসমূহের সুষ্ঠু ও দ্রুত অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্য পরিচালনার জন্য ‘এসিসি’ বা দুর্নীত দমন কমিশনকে সহায়তা প্রদানই ছিল ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’র দায়িত্ব। যে কারণে গঠনপ্রণালী অনুযায়ী অভিযোগ তদন্তে নিয়োজিত একটি টাস্কফোর্সে একজন মেজর বা সমমানের অফিসারের নেতৃত্বে সদস্য হিসেবে একজন এসিসি অফিসার ছাড়াও একজন করে র্যাব, পুলিশ ও এনবি আর থেকে অফিসার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। দুর্নীতি বিষয়ে উত্থাপিত অভিযোগসমূহের উপর সুষ্ঠু ও যথাযথ অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্য পরিচালনা করাই ছিল টাস্কফোর্সের দায়িত্ব। অনুসন্ধান বা তদন্ত কার্য পরিচালনা শেষে টাস্কফোর্স কর্তৃক তাদের অনুসন্ধান বা তদন্ত প্রতিবেদন ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’র সভায় উপস্থাপন করা হতো। টাস্কফোর্স কর্তৃক উপস্থাপিত অনুসন্ধান বা তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দিক কমিটির সভায় বিশদভাবে আলোচনা-পর্যালোচনা ও বিচার বিশ্লেষণ করা হতো। উল্লেখ্য, দেশের স্বনামখ্যাত আইনজীবীদের কয়েকজন যেমন বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রবীণ আইনজীবী খান সাইফুর রহমান এবং অ্যাডভোকেট কাজলসহ আরো কয়েকজন আইনজীবী প্রতিটি সভায় সশরীরে উপস্থিত থেকে সভায় আলোচিত অনুসন্ধান ও তদন্ত প্রতিবেদনের আইনগত ও আনুষঙ্গিক দিক বিবেচনায় নিয়ে তাঁরা তাঁদের মূল্যবান মতামত প্রদান করতেন। তাঁদের মতামতের উপর ভিত্তি করেই প্রয়োজনীয় সুপারিশ সহকারে উক্ত অনুসন্ধান বা তদন্ত প্রতিবেদনের পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে প্রেরণ করা হতো। কোন ব্যক্তিবিশেষের গ্রেফতার প্রসঙ্গ নিয়ে ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’র সভায় কোন আলোচনা কোনদিন করা হয়নি। আর নেত্রী দু’জনকে গ্রেফতারের প্রসঙ্গ নিয়ে ‘জতীয় সমন্বয় কমিটি’র সভায় আলোচনার প্রশ্নই ওঠে না। অথচ জেনারেল মইন বলেছেন, ‘দুর্নীতি দমনের জন্য কমিটি ছিল। সেখানে একজন উপদেষ্টা দায়িত্বে ছিলেন। তারাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’র সদস্যদের পরিচয় উপরে বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া আইনজীবী হিসেবে আমি যাদের নাম উল্লেখ করেছি, প্রয়োজনবোধে তাদের সকলের কাছ থেকেও আমার বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করা যেতে পারে। তবে দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় যারা গ্রেফতার হয়েছিলেন তারা আইনগত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই গ্রেফতার হয়েছিলেন।
দুঃখের সাথে আরো বলতে হচ্ছে, সত্যকে বিকৃত করে প্রকাশ করার প্রবণতা জেনারেল মইনের আছে। এ বিষয়েও আমি অপর একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান (অব.) দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় গ্রেফতার থাকা অবস্থায় মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি আমার বন্ধু ছিলেন এবং আমরা একই স্টেশনে এক সময় চাকরিরত ছিলাম। উন্নত চিকিৎসার জন্য জেনারেল মোস্তাফিজকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করে বেগম মোস্তাফিজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা হিসেবে উক্ত আবেদনপত্র ও তৎসম্বন্ধীয় কাজপত্রাদিসহ অনুমোদন লাভের জন্য আমি প্রধান উপদেষ্টার অফিসে গমন করি, বেগম মোস্তাফিজের আবেদন বিষয়ে তাঁকে অবহিত করি এবং অনুমোদন প্রদানের জন্য অনুরোধ জানাই। কিন্তু তিনি অনুমতি প্রদানে অসম্মত হন এবং বলেন যে, এ এক প্যান্ডোরা বক্স, একবার খোলা হলে আর বন্ধ করা যাবে না। অবশ্য এ কথাও সত্য যে, সে সময় দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্তদের প্রায় সকলেই কথিত উন্নত চিকিৎসার নামে বিদেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা চালাচ্ছিল। যাহোক, প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে ফিরে এসে আমি জেনারেল মইনকে বিষয়টি অবহিত করি এবং জেনারেল মোস্তাফিজকে চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করে অনুমতির জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে তাঁর পক্ষ থেকে অনুরোধ জানাতে বলি। তিনি সে কাজ করেননি বরং করেছেন তার ঠিক উল্টোটি। পরবর্তী পর্যায়ে আমি জেনেছি যে, জেনারেল মইন বেগম মোস্তাফিজকে বলেছেন যে, জেনারেল মতিন তাঁকে (জেনারেল মোস্তাফিজ) চিকিৎসার জন্য ভারত গমনের অনুমোদন দিচ্ছেন না।
এ ঘটনা বলার উদ্দেশ্য, জেনারেল মইনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন নয়। বরং পাঠকম-লীকে অবহিত করা যে, অতি ছোট ছোট বিষয়গুলোও ক্ষেত্র বিশেষে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ন্ত্রিত হতো। তাই আমি আবার দু’নেত্রীকে গ্রেফতারের প্রসঙ্গে ফিরে আসছি। কারণ, সকল বিবেচনায় নেত্রী দু’জনকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য এক অতি গুরুত্বপূর্ণ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। অথচ জেনারেল মইন বলেছেন, ‘দুই নেত্রীকে ধরার জন্য আমার কোন সিদ্ধান্ত ছিল না। এটা করেছে তারা, যারা দুর্নীতি দমনের জন্য কাজ করেছিলেন। দুর্নীতি দমনের জন্য কমিটি ছিল। সেখানে একজন উপদেষ্টা দায়িত্বে ছিলেন। তারাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ গ্রেফতারকৃত একজন রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর ব্যাপারটি যেখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ন্ত্রিত হতো, সেক্ষেত্রে জেনারেল মইনের বক্তব্যের সূত্র ধরে স্বভাবতই যে প্রশ্ন মনের কোণে ওঠে আসে তাহলো-দু’নেত্রীকে গ্রেফতারের মতো একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে একজন উপদেষ্টার দায়িত্বাধীন সামান্য একটি ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’র উপর ন্যাস্ত করা হয়েছিল কোন বিবেচনায়? তবে শাক দিয়ে যেমন মাছ ঢাকা যায় না, তেমনি এ কথাও আজ আর কারো অবিদিত নয় যে, এ চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা হয়েছিল দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই।
এ পর্যায়ে আরও একটি ঘটনার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক বলে আমি মনে করি। ১/১১’র পর উপদেষ্টা থাকাকালীন এ মর্মে একটি জনশ্র“তি একসময় চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে যে, শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হতে পারে। প্রেস এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতেও চলছিল ‘মাইনাস-২ ফর্মুলা’ সম্পর্কীয় নানাবিধ মুখরোচক আলোচনা। এমতাবস্থায় আমি জেনারেল মইনের কাছ থেকে সময় নিয়ে একদিন সন্ধ্যায় তাঁর বাসায় গমন করি। বাজারে প্রচলিত জনশ্র“তির কথা উল্লেখ করে আমি সরাসরি তাকে জিজ্ঞেস করলাম নেত্রী দু’জনকে গ্রেফতার করার কোন প্রকার চিন্তা-ভাবনা তাঁরা করছেন কী? তিনি নিরুত্তর। আমি তাঁকে বুঝাবার চেষ্টা করলাম যে, নেত্রী দু’জন খুবই জনপ্রিয়, তাঁদেরকে গ্রেফতার করা হলে দেশে গণ-অসন্তোষ দানা বেঁধে ওঠবে, দেশে এক বেসামাল পরিস্থিতির উদ্ভব হবে এবং পরিণামে তা দেশের জন্য এবং বিশেষ করে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য এক বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্রেক করবে। আমি তাঁকে আরো বলি, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অনেক সু-সংগঠিত ও শক্তিশালী, তাদের শাখা-প্রশাখা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। সার্বিক বিবেচনায় তৎপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেয়া সরকারের জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। তিনি আমাকে বললেন, আপনি অযথা ভয় পাচ্ছেন। দেশে ইমার্জেন্সি চলছে, জনগণের ও সেনাবাহিনীর সমর্থন আপনাদের পেছনে রয়েছে, অপেক্ষা করুন এবং দেখুন, কি ঘটে!
তার অল্প ক’দিন পর একদিন সকাল সাড়ে আটটায় তৎকালীন বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মনজুরুল আলম (অব.) পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য সচিবালয়ে আমার অফিসে আসেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্যার, আজ যা করা হচ্ছে তা কি সঠিক হচ্ছে?’ ব্যাপারটি বুঝতে না পেরে আমি তাকে খুলে বলতে বলি। তিনি বললেন কেন, আপনি জানেন না? আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে তাঁর বাসা থেকে গ্রেফতার করার চেষ্টা চলছে এবং টেলিভিশনে সে দৃশ্য দেখানো হচ্ছে। আমি আমার পিএস ড. সাদেককে ডেকে এ ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন কিনা জিজ্ঞেস করলাম। তিনি এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে আমাকে জানালেন। আমি তাকে দ্রুত টেলিভিশন সেটটি খুলতে বলি। অতঃপর টেলিভিশনের পর্দায় যে দৃশ্য আমি অবলোকন করলাম, তা ছিল আমার জন্য নেহায়েত অনাকাক্সিক্ষত।
আমি সবসময়ই নেত্রী দুজনকে গ্রেফতার করার ঘোর বিরোধী ছিলাম যে কারণে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর গ্রেফতার বিষয়ে আমাকে পূর্বাহ্নে কোনো কিছুই জানানো হয়নি। এছাড়াও এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক অপর একটি ঘটনার উল্লেখ এ পর্যায়ে একান্ত প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। একদিন প্রধান উপদেষ্টার অফিসে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টাদের মিটিং সমাপ্তির পর প্রধান উপদেষ্টার অফিসের পাশের একটি কামরায় বসে প্রধান উপদেষ্টা ও সেখানে উপস্থিত জেনারেল মইনের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম যে, তারা শেখ হাসিনাকে যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে দেশে ঢুকতে দেবেন না, ঢাকা বিমানবন্দর থেকেই তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। এ কাজ করা থেকে নিবৃত্ত থাকার জন্য আামি তাদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে অনুরোধ জানালাম। কিন্তু তারা তাদের সিদ্ধান্তে অনঢ়। আমি বুঝতে পারলাম এটা হবে একটা মস্তবড় ভুল পদক্ষেপ। অনেক আলাপ-আলোচনার পর আমি তাদেরকে বললাম, আপনারা কিছু মনে না করলে এবং আপনাদের সম্মতি পেলে আমি আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর দেশে প্রত্যাবর্তনের তারিখ বিলম্বিত করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে দেখতে পারি। যদি তা করতে পারি, আপনাদের সমস্যার সমাধান হবে। চেষ্টা চালিয়ে যেতে তারা আমাকে সম্মতি প্রদান করলেন।
অতঃপর প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে বেরিয়ে বাসায় ফেরার পথে আমি দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক বাহাউদ্দীনকে টেলিফোনে আমার বাসায় আসার জন্য অনুরোধ জানালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি আমার বেইলী রোডের বাসায় এসে হাজির হন। আমি তাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম এবং আসন্ন রাজনৈতিক সংঘাত এড়ানোর জন্যে আওয়ামী লীগের কোনো নেতার সাথে যোগাযোগ করে তার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) আপাতত দেশে ফেরত না আসার পরামর্শ প্রদান করতে বলি। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিমকে জরুরি আলোচনার জন্য আমার বাসায় আসতে অনুরোধ করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই শেখ সেলিমও আমার বাসায় এসে উপস্থিত হন। তাকে সবকিছু খুলে বলার পর তিনি আমার বাসায় বসেই শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেন এবং দেশে প্রত্যাবর্তনের তারিখ পিছিয়ে তার সফরকে আরো দীর্ঘায়িত করার অনুরোধ জানান। শেখ সেলিমের কথা থেকে বুঝতে পারলাম শেখ হাসিনা তাতে রাজি হননি। অতঃপর শেখ সেলিম টেলিফোনটি আমার হাতে দিয়ে কথা বলতে বলেন। আমি তাকে সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে সরাসরি অবহিত না করে, আরো কিছুদিন যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়ে আসতে অনুরোধ জানাই। তিনি আমাকে এ অনুরোধের কারণ জানতে চাইলে আমি তাকে বলি যে, সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেশ কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হতে পারে। আপনার পার্টি থেকেও নেতাকর্মীরা গ্রেফতার হতে পারেন। সে পরিস্থিতি আপনার জন্য বিব্রতকর হতে পারে। কাজেই এমতাবস্থায় আপনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বিলম্বিত করার জন্য আমি তাকে অনুরোধ জানাই। কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তে অনঢ় থাকলেন, আমার অনুরোধ উপেক্ষিত হলো। পরবর্তী ইতিহাস সবারই জানা।
তারেক রহমানকে গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্যাতন প্রসঙ্গে : একদিন সকালে পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানতে পারলাম যে, তারেক রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে এবং তৎপ্রেক্ষিতে তিনি মেরুদ-ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। সংবাদটি আমাকে খুবই মর্মাহত করে তোলে। সেদিন দুপুরের পর ঢাকা সেনানিবাসে ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’র মিটিং ছিল। উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক, এসিসির নিয়োজিত আইনজীবীগণ (যাদের নাম আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি), এসিসির পরিচালক (আইন), ডিজিএফআইর একজন পরিচালক এবং অপরাপর সকল সদস্য। সেদিনকার পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তারেক রহমানকে নির্যাতনের সংবাদটির প্রতি আমি সভায় উপস্থিত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করি এবং সেখানে উপস্থিত ডিজিএফআইয়ের পরিচালকের কাছ থেকে কে বা কারা তারেক রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদকালীন নির্যাতন করেছে আমি তা জানতে চাই। ডিজিএফআইর পরিচালক তা সরাসরি অস্বীকার করেন। আমি তখন রাগতস্বরে বলি, তারেক রহমান একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে, তার শরীরে হাত দেয়ার সাহস কে দেখিয়েছে আমাকে তার নাম বলতে হবে, আমি তার হাত ভেঙে দেব। আমি আরও বলি, এমন একটি গর্হিত কাজ যে বা যারাই করে থাকুক, তাদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে কারো গায়ে হাত দেয়া অন্যায়। আমি ডিজিএফআইর পরিচালককে জিজ্ঞাসাবাদের নামে এ ধরনের নির্যাতন অনতিবিলম্বে বন্ধ করার জন্য বলি। সেদিনকার মিটিংয়ের এসব আলোচনা ও কথাবার্তা তৎকালীন ডিজি, ডিজিএফআই মেজর জেনারেল মোহাম্মদের কানে পৌঁছায়। তিনি পরদিন সচিবালয়ে আমার অফিসে আসেন এবং আমাকে জানান, ডিজিএফআইর লোকজন তারেক রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কিন্তু তাকে প্রহার করা হয়নি। তিনি আরও জানান, তারেক রহমানের মেরুদ-ের ব্যথা যা পত্রিকায় বলা হয়েছে, তা অনেক পুরনো এবং তিনি ক’বছর পূর্বে চিকিৎসার জন্য জার্মান গিয়েছিলেন। বিষয়টি আমাকে পীড়া দিতে থাকে। এর পরদিনই বেইলি রোডস্থ আমার বাসায় বসে খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীমকে বিষয়টি অবহিত করি। তিনিও আমাকে জানালেন যে, তারেক রহমানকে ভীষণভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। আমি তাকে জানালাম, ডিজি, ডিজিএফআই মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আমাকে জানিয়েছেন, তারেক রহমানের মেরুদ-ের এ ব্যথা নাকি অনেক পুরনো এবং তিনি চিকিৎসার জন্যে একবার জার্মানিও গিয়েছিলেন। জবাবে শামীম আমাকে জানালেন, তারেক রহমানের মেরুদ-ে কোনো ব্যথা পূর্বে কখনো ছিল না এবং তিনি ইতিপূর্বে কখনো জার্মানি যাননি। এরপর আমি বিষয়টি জেনারেল মইনের গোচরে আনয়ন করি এবং এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তাকে অনুরোধ জানাই।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন