মইন কবুল করলেন তারেককে নির্যাতন করেছেন একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেলই

ওয়ান ইলেভেনে সেনা সমর্থিত সরকারের সময় আটক তারেক রহমানকে নির্যাতন করেছে একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। নিউইয়র্কে বাসরত সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ সে সময়ের ঘটনাবলী নিয়ে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তারেক রহমানকে টর্চার করেছে একজন লেফটেন্যান্ট। এ খবর জানার পর সংশ্লিষ্ট অফিসারকে সরিয়ে দেয়ারও নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১২ই জুন নিউইয়র্কের বাসায় দেয়া সাক্ষাৎকারে সাবেক এই জেনারেল মইন নির্বাচনকালীন সমঝোতা, দুর্নীতি বিরোধী
অভিযানে ব্যর্থতা, দু’নেত্রীকে গ্রেপ্তার, কিংস পার্টি গঠন, দেশে ফেরা না ফেরা নিয়ে কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে মইন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে আমার নিজ নামে বাড়ি নেই। সবাই বলেন, আমরা নাকি কোটি কোটি টাকার মালিক। কেউ বিশ্বাস করবে কিনা যে, আমরা এখানে আমার মামার বাসায় থাকি। যখন নিউ ইয়র্কে এসে বিপদে পড়লাম। তখন পথঘাট কিছুই চিনতাম না, রাস্তায় রাস্তায় কাঁদতাম বাইরে বের হলে। কারণ অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এক প্রশ্নে মইন বলেন, আমার ৩০০-৫০০ কোটি টাকা নেই। অত টাকার মালিক হলে নিউ ইয়র্কের মতো একটি জায়গায় আমাকে এত কষ্ট করে থাকতে হতো না। অনেক ভালো থাকতে পারতাম। এখানে আমার একটি গাড়ি নেই। আমাকে ডাক্তারের কাছে গেলে যেতে হয় বাসে করে।
মইন বলেন, এখানে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য আসিনি। একটু সুস্থ হলেই দেশে ফিরবো। এসেছিলাম দুই মাসের জন্য ছেলের কাছে বেড়াতে। কিন্ত ওই সময় কাঁধে ব্যথা দেখা দিল। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরা ধরা পড়লো ক্যানসার। কেমো দিতে হলো। বোনমেরু ট্রান্সপ্লান্টেশন হলো। 
নির্বাচন তিনমাসের স্থলে দুইবছর কেন লেগেছে এমন প্রশ্নে বলেন, দেখুন ওই সময় ওই সরকারের মেয়াদ দুই বছর করা হয়েছিল মূলত একটি নির্ভুল ভোটার তালিকা করার জন্য। ওই সময় ভোটার তালিকা নিয়ে একটা বড় অভিযোগ ছিল। ভুয়া ভোটার ছিল। আমাদের শেষ লক্ষ্য একটা নির্বাচন করা। সেটা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে হলে অবশ্যই একটি নির্ভুল ভোটার তালিকা করতে হবে। একটি নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরির জন্য সময় নেয়া হয়েছে। ওই সময় সম্মিলিতভাবেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। 
কিং পার্টি নিয়ে এক প্রশ্নে মইন বলেন, আমি কখনোই রাজা ছিলাম না। আমার কথায় কিছুই হতো না। কেবল আমার বাহিনী ছাড়া। আমাদের যেখানে সম্পৃক্ততা ছিল সেখানে ছাড়া কাজ করতাম না। সব সরকারের উপদেষ্টারাই করতেন। 
দু’নেত্রীকে গ্রেপ্তার প্রশ্নে বলেন, দেখুন এটা সম্পূর্ণ ভুল। কারণ দুই নেত্রীকে ধরার জন্য আমার কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। এটা করেছে তারাই যারা দুর্নীতি দমনের জন্য কাজ করছিলেন। দুর্নীতি দমনের জন্য কমিটি ছিল। সেখানে একজন উপদেষ্টা দায়িত্বে ছিলেন। তারাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
দু’ নেত্রীকে গ্রেপ্তার বিষয়ে আমার কাছে সিদ্ধান্তের জন্য কোনো প্রস্তাব আসেনি। তবে আমি মনে করি ওই সময় দুর্নীতি দমন করার জন্য তারা যেটা ভালো মনে হয়েছে সেটা করেছে। দু’নেত্রীর সঙ্গে কোনো সমঝোতাও হয়নি। কেউ যদি সমঝোতা করে থাকে তাহলে সেটা তিনি নিজ উদ্যোগে করেছেন। আর আমার নাম বলে থাকলে সেটা তিনি বলতে পারেন তার স্বার্থ হাসিলের জন্য। 
শেখ হাসিনার নিরাপদ এক্সিট দেয়া নিয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, তাদের সঙ্গে আমরা কোনো বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। কারণ আমরা যখন যিনি সরকার থাকেন  তার সঙ্গে কাজ করি। 
তারেক রহমানকে নির্যাতন প্রশ্নে বলেন, তারেক রহমানকে ধরে আনা হয়েছে এটা আমাকে জানানো হয়নি। পরে যখন জানতে পারলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাকে আনার পর টর্চার করা হয়েছেÑ এমন একটা খবর আমার কাছে এলো। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ডেকে পাঠালাম, কেন তাকে মারা হয়েছেÑ এটা জানার জন্য। তিনি তাকে মারা হয়নি বলে জানালেন। এটাও বললেন যে, তিনি ভালো আছেন। টিভিতে দেখা গেল তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। এর কারণ জানতে চাইলে আমাকে জানানো হলোÑ তিনি নাকি বগুড়ায় একবার সিঁড়ি থেকে পড়ে ব্যথা পান। এই জন্য তার পায়ে ও কোমরে ব্যথা রয়েছে। এখন ব্যথা বেড়েছে তাই খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। তাকে নির্যাতন করা হয়েছে এটা আমি যখন শুনলাম তখন ওই অফিসারকে বদলি করে দিলাম অন্যত্র। মইন বলেন, প্রয়োজনের বাইরে কোনো কাজ করিনি। এটা খুব সোজা হিসাব। আমি নাকি তারেক রহমানকে মারতে বলেছি। এটা কখনো হয়। এটা অসম্ভব। কারণ তাকে যে নির্যাতন করেছে বলে পরে জানা গেছে তিনি ছিলেন একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। আপনি বলুন, একজন জেনারেল কি কখনো একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেলকে কোনো নির্দেশনা দেয়। আমি বললে কি তাকে মারার জন্য লে. কর্নেলকে বলতাম। আমিতো বললে ডিজি ডিজিএফআইকে বলতাম। তাকে জিজ্ঞেস করেন, সেই বলুকÑ আমি তাকে ডেকে বলেছি কিনা তারেক রহমানকে নির্যাতন করার জন্য। এটা তিনি বলতে পারবে না।
এক প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি কিংস পার্টি করিনি। কাউকে করতেও বলিনি। আমার নাম দিয়ে নাকি কিংস পার্টি গঠন করার চেষ্টা হয়েছেÑ এমন খবর এলো। ঢাকায় এই জন্য মোটরসাইকেল দিয়ে শোডাউনও করা হলো। আমি যখন এটা শুনলাম সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করতে বললাম। এটাও বলাম যে, আমি কোনো পার্টি করবো না। ক্ষমতাও নেব না। সুতরাং এগুলো চলবে না। সব বন্ধ করো। এরপর আর কিংস পার্টির কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। এক প্রশ্নে বলেন, আমি কোনোদিন প্রেসিডেন্ট হতে চাইনি। প্রেসিডেন্ট হতে চাইলে হতে পারতাম। সেই সুযোগ ছিল। 
লাইনচ্যুত ট্রেন নিয়ে বলেন, আমার দায়িত্ব ছিল ট্রেন লাইনে ওঠানো। সেটা খাদ থেকে তুলে দিয়েছিলাম। কিন্ত সেটা এখন চালাচ্ছে অন্যরা। তারাই ভালো বলতে পারবে। লক্ষ্য ছিল সুষ্ঠু নির্বাচন করা। সেটা করেছি। আমরা ব্যর্থ এটা এমনভাবে বলবো না। কারণ আমরা চেষ্টা করেছি সফল হতে। সরকারকে সহায়তা করেছি। আর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা বলছেনÑ সেটা কারো কারো ব্যাপারে হতে পারে। তবে আমি চেষ্টা করেছি কোনো ব্যক্তিগত লোভ-লালসা কিংবা স্বার্থের কারণে যাতে মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত না হয়।
জেনারেল মাসুদকে নিয়ে এক প্রশ্নে বলেন, দেখুন আমি তার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করে কিছুই বলতে চাই না। তবে এটা বলবো যে, তিনি আগের মতো করে কাজ করতে পারলেন না। কি কারণে তাকে সরে যেতে হলোÑ এটা তিনি ভালো করেই জানেন। আমি তা বলতে চাই না। তবে আমি মনে করি না, যা করেছি তা শতভাগ সঠিক করেছি। তবে চেষ্টা করেছি। আমারও ভুল-ভ্রান্তি হতে পারে। কিন্তু আমার ব্যক্তিস্বার্থ বড় ছিল না।
পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি নিয়ে এক প্রশ্নে বলেন, আমার ভাইয়েরা কোনো টাকাই বানায়নি। তাদের ব্যবসা রয়েছে, তারাতো নতুন ব্যবসায়ী নয়। আমার ভাইয়েরা আমার কাছ থেকে ওয়ান ইলেভেনের সুবিধা পায়নি। তা পেলে তারা প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক হতে পারতো। কিন্তু তা পারেনি। নির্বাচনেও দাঁড়িয়ে পরাজিত হয়েছে। আমি ফেভার করলে কি সেটা হতো। সেতো পাস করতো। বিশ্বাস করবেন কিনা, আমার বাসায় তাদের যাওয়াও নিষিদ্ধ ছিল। ওয়ান ইলেভেনের সময় যাতে বদনাম না হয়। তাদের বলেছি, তোমরা আমার এখানে ঘন-ঘন আসবে না। এলে বদনাম হবে। আমি চাই না, কোনো বদনাম হোক। এই কারণে তারা আমার বাসায় ওই দুই বছরে আসার সুযোগ তেমন পেত না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন