আহমেদ ছফা আমার প্রিয় একজন লেখক । যিনি সব সময় সত্য কথা বলতে ভয় পেতেন না এবং সকল অন্যায় এর প্রতিবাদ করতেন । এই সেই ছফা যিনি স্বাধীনবাংলাদেশে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ এর পরিবারকে গৃহহীন করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন এবং তাদের পাশে দারিয়েছিলেন । আজ উনার লিখা একটি বই সম্পূর্ণ তুলে ধরছি আপনাদের জন্য ।
মুজিবের শাসন: একজন লেখকের অনুভব - আহমদ ছফা
চোদ্দই আগস্টের রাতে আমি নতুন ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার সাতাশ
নম্বর সড়কের একটি হোস্টেলে এক বন্ধুর সংগে ঘুমাতে গিয়েছিলাম। সাতাশ নম্বর আর বত্রিশ নম্বর সড়কের ব্যবধান বড় জোড় তিন থেকে চার'শ গজ। এই বত্রিশ নম্বরেই দারাপুত্র পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন বাংলাদেশের রাস্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান।
আনুমানিক রাত এগারোটা হবে হয়ত। বত্রিশ নম্বর পেরোবার সময় খাকি পোষাক পরা আট দশজন পুলিশ দেখলাম। কয়েকজন অফিসার, বাকিরা সেপাই। বন্দুক উঁচিয়ে রাস্ট্রপতির বাসভবনের সামনের সড়কের মুখে পাহারারত।
এই পথে বেশ ক'দিন থেকে যাওয়া আশা করছি। প্রায়ই দেখতাম ঘুণটি ঘরে দু'জন থেকে তিনজন সেপাই দাঁড়িয়ে। কোন অফিসার দেখেছি মনে পড়ে না। আজ পাহারাদারদের দল ভারি দেখেও মনে কোন ভাবান্তর আসেনি।
আগামিকাল পনেরোই আগস্ট বেলা দশটার দিকে রাস্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এককালের বাংলাদেশের আগ্নেয়আত্মার জ্বালামুখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানিত অতিথি হিসেবে আগমন করছেন। হয়ত সেজন্য এই অধিকসংখ্যক সেপাই-সান্ত্রীর আনাগোনা। এখন পর্যন্ত সবকিছু পুর্ব-নির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুসারে ঘটে আসছে। কোথাও কোনো ঝঞ্জাট ঘটেনি।
শেখ মুজিবুর রহমানের আগমনোপলোক্ষে বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে ছড়ানো-ছিটানো বিশ্ববিদ্যালয়ে চলেছে সাজানো গোছানোর পালা। রাস্তার এবড়ো-থেবড়ো গর্তগুলোতে সুরকি পড়েছে। রোলার ঘুরছে, পীচের আস্তরণ বসেছে। গত এক পক্সকাল ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে, কলভবনে, বাণিজ্যভবনে, বিজ্জানভবনে জোর মেরামতির কাজ চলছে। অনেকদিন অনাদরে মৃত জন্তুর কন্কালের মত দাঁড়িয়ে থাকা ন্যাড়ামুড়ো দেয়ালগুলো চুণ, সুরকির প্রসাধন স্পর্শে হেসে উঠেছে। সমস্ত এলাকাটায় একটা সাজ সাজ রব, তাড়াহুড়ো ব্যস্ততা এসব তো আছেই।
রাতের আঁধারে শক্তহাতে আলকাতরা দিয়ে দাবড়া করে লেখা শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারকে চ্যালেন্জ করা দেয়াল লিখনসমূহ নবীন চুনের প্রলেপের তলায় ঢাকা পড়েছে। সুন্দরীর ললাটের সিন্দুর বিন্দুর মত বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সুউচ্চ শুভ্র প্রাচীরের কপোলদেশে শিল্পীর নিপুণ তুলিতে লেখা সুন্দর সুন্দর লিখনমালা দৃস্টিকে দূর থেকে টেনে নিয়ে যা্য়। শেখ মুজিব বন্গবন্ধু, বাঙালি জাতির ত্রানকর্তা, সমাজতান্রিক সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের মহানায়ক, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার লৌহমানব ইত্যাদি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন, তাই বিশ্ববিদ্যালয় নানান রঙের চিত্রলেখায় সেজে সুন্দর হয়ে উঠেছে। চারদিকে একটা উৎসবের হাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়াঢাকা কালো কালো সাপের শরীরের মত চেকন বাঁকা রাস্তাগুলোর মোড়ে মোড়ে উল্লসিত অভিনন্দন বুকে ধারন করে রাতারাতি ঝাঁক বেঁধে দাঁড়িয়ে গেছে নানান রঙের প্ল্যাকার্ড। তোরণরাজি মাথা তুলেছে। সর্বত্র একটা উৎকন্ঠার ভাব। আগামীকাল কাঁটায় কাঁটায় বেলা দশটায় তিনি আসছেন।
প্রায় এক পক্ষকাল ধরে দিনে রাতে কাজ চলছে। উপাচার্যের আহার নেই, নিদ্রা নেই। সাড়ে সাত লক্ষ টাকা নগদে বলিয়ে দিয়েও মনে মনে তিনি সস্তিবোধ করতে পারছেন না। দৈবাৎ যদি কোন ত্রুটি থেকে যায়, আর সেখানেই যদি মহামানবের দৃস্টি আটকে যায়, তিনি মুখ দেখাবেন কেমন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাস্ট্রপতির এটা প্রথম আনুষ্ঠানিক আগমন। তিনি শুধু রাস্ট্রপতি নন, বাঙালি জাতির পিতা, মুক্তিদাতা, বাংলার হাটের মানুষ, ঘাটের মানুষ, মাঠের মানুষের বন্ধু বন্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সরকার সমর্থক ছাত্রদলটির হোমরা-চোমরা কর্মীদেরও বেশ ব্যস্তদিন কাটছে। তারা দিবসে কাজের তদারক করে, রজনীতে পাহারায় থাকে। বাংলাদেশে দুস্ট লোকের অভাব নেই। রাস্ট্রপতির আগমনের সন্গে সম্পুর্ণ সংগতিহীন অলুক্ষণে কোন দেয়াল লিখন লিখে যেতে পারে, অনেক অর্থব্যয়ের শ্রমের শিল্পকর্মগুলোর অংগহানি ঘটাতে পারে, সুন্দর চিত্রলেখাসমুহের লাবণ্যহানি করতে পারে, এরকম কিছু ঘটা অস্বাভাবিক নয়। তাই আগেভাগেই এই শতর্কতামুলক ব্যবস্থা।
পুরো দায়িত্বটা রাস্ট্রপতির জ্যেস্ঠপুত্র শেখ কামাল গ্রহণ করেছেন। তিনি তাঁর দীর্ঘ দেহ এবং বাহু বিশিস্ট বন্ধুদের নিয়ে অবিরাম চরকার মত ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের গোঁড়া সমর্থক ছাত্র এবং শিক্ষকদের মনোভংগিটা এরকম যে, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে চরণ ফেলামত্রই বাংলাদেশে একটি অভিনব যুগের অভ্যুদয় ঘটবে।
শেখ মুজিবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ে আগমটা ছিল কৌশলগত দিক দিয়ে তাঁর নতুন শাসনতান্ত্রিক বিধি চালু করার পথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। উনিশ শ' পচাঁত্তর সাল শুরুর দিকে তিনি বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক কার্যকলাপ একেবারে নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছেন। বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের বেশকিছুকে জেলে ভরেছেন। তাঁর একনায়কত্বের প্রতিস্পর্ধী তরুণ বয়স্ক রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মীদের খুশীমাফিক হত্যা করেছেন এবং সে কথা বলে প্রকাশ্যে গর্ববোধ করতেও তাঁকে দেখা গেছে।
প্রধানমন্রির স্থলে সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন রাস্ট্রপতি হয়ে বসেছেন। তাঁর নিজের দল আওয়ামী লীগ অন্য দুটো সমর্থক দল বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চালিত ন্যাশনাল আওয়মী পার্টির কেউ কোনো ওজর আপত্তি উত্থাপন করেননি। বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার সংগে জড়িত এই তিনটি দলের প্রত্যেকটিরই টিকে থাকার জন্য শেখ মুজিবের ছত্রছায়ায় দাঁড়ানোর ছিল একেবারে অপরিহার্য। মুজিব থাকলে তাঁরা সবাই আছেন, তিনি নেই তো কেউ নেই। তাই তাঁদের কারো পক্ষে এই জননন্দিত অধিনায়কের কোনো সিদ্ধান্তকে দলীয় কিংবা আন্ত:দলীয় শৃংখলা প্রয়োগ করে রাশ টেনে ধরা অসম্ভব ছিল।
প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়েই তিনি তাঁর প্রতি সমর্থনবিমুখ পত্র-পত্রিকাসমুহের মুখ প্রায় বন্ধ করে নিয়ে আসছিলেন। বিরোধী পত্রিকাগুলোতে সরকারি বিজ্গ্জাপন বন্ধ করে দিয়ে, সাংবাদিকদের গ্রফতার করে, সম্পাদকদের জেলে পুরে, ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করে ইত্যাদি নানা ছলছুতোর সাহায্যে অনেকগুলো দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং পাক্ষিক পত্রিকার প্রকাশ সাফল্যজনকভাবে বন্ধ করে দিতে পেরেছিলেন। এই চরম মার হজম করেও যে গুটিকয়েক পত্রিকা প্রাণ নিয়ে কোনোরকমে বেঁচেছিল, সগুলোর বিরুদ্ধে কোন রকমের অভিযোগহীনতাকেই অভিযোগ হিসেবে দাঁড় করিয়ে সরকারি ক্ষমতা প্রয়োগ করে বন্ধ করে দিলেন।
তারপরে বাংলাদেশে শেখ মুজিবের বিরোধী কোন দলের মালিকানাধীন কোন পত্রিকা ছিলনা। ব্যক্তি মালিকানাধীন পত্রপত্রিকার সংখ্যাও ছিল একেবারে অল্প। শেখ সাহেবের নিজের দল আওয়ামী লীগ এবং তাঁর সমর্থক দুটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি ও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চালিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এই তিনটি রাজনৈতিক দলকে তিনি অংগুলি হেলনে সামনে পেছনে ডাইনে বাঁয়ে যেদিকে ইচ্ছে পরিচালনা করতেন। এই দলগুলোর ঘোষিত রাজনৈতিক দর্শন যা-ই হোক না কেন, কার্যত তাঁরা শেখ মুজিবুর রহমানের সব রকম নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। অংগদলসমুহের পরামর্শে নাকি নিজের বিবেচনা অনুসারে তা বলা খুব মুশকিল। তিনি সরকারি দলটি এবং সরকারের অন্ধ সমর্থক দল দুটোকে ভেংগে একটি মাত্র জাতীয় দল গঠন করার সিদ্ধান্ত ঘোষনা করলেন। আর নতুন জাতীয় দলের নামকরন করলেন, "বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ" সংক্ষেপে বাকশাল। বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষনার পরে তখন পর্যন্ত যে কয়টি ব্যক্তি বা দলীয় মালিকানাধীন পত্রিকা বাংলাদেশ সরকারের সংগে আপোস রফা করে বেঁচেছিল, সগুলোকে পুরোপুরি সরকারি আওতায় নিয়ে আসার জন্য তিনি সুদীর্ঘ বাহু প্রসারিত করলেন।
বাংলাদেশে ব্যাক্তি বা দলীয় মালিকানাধীন দৈনিক, সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকার সংখ্যা ছিল একেবারে স্বল্প। অনেকগুলোই সরকারি কোপানলে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে। আইয়ুব আমলে প্রত্যক্ষভাবে সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকার সংখ্যা ছিল মাত্র দুটি। একটি বাংলা, অন্যটি ইংরেজি। বাংলা পত্রিকাটির নাম ছিল "দৈনিক পাকিস্তান"। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর "দৈনিক বাংলা" নামে আত্মপ্রকাশ করে। ইংরেজি পত্রিকাটির নাম ছিল "মর্নিং নিউজ"। এ দুটি পত্রিকা ছাড়া স্বাধীনতার পর সরকারের প্রত্যক্ষ এখতিয়ারে আরো তিনটি পত্রিকা চলে আসে। তার দুটি দৈনিকের মধ্যে একটি বাংলা এবং একটি সাপ্তাহিক চলচ্চিত্র পত্রিকা। ইংরেজি দৈনিকটির পাকিস্তান নাম ছিল, "পাকিস্তান অবজারভার"। স্বাধীনতার পর "বাংলাদেশ অবজারভার" নাম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলা কাগজটি আগে থেকেই "দৈনিক পূর্বদেশ" নামেই পরিচিত ছিল এবং চলচ্চিত্র পত্রিকাটির নাম ছিল "চিত্রালী"। এই পত্রিকা তিনটির মালিক জনাব হামিদুল হক চৌধুরী যিনি ন'মাসের স্বাধীনতা যু্দ্ধের সময়ে দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যদের কার্যকলাপ সমর্থন করেছেন এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্থনের পূ্র্বে পাকিস্তানে আশ্রয়গ্রহন করেছিলেন। তাই পরিত্যাক্ত সম্পত্তি হিসেবে পত্রিকা তিনটির প্রকাশনার দায়িত্ব সরাসরি সরকারকেই গ্রহণ করতে হয়েছিল।
শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে বাংলাদেশ যুব আওয়ামী লীগ প্রসিডিয়ামের সভাপতি কেন্দ্রীয় বাকশালের অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা এবং রাস্ট্রপতির বুদ্ধিবিবেচনার একমাত্র ভরসা বলে কথিত জনাব শেখ ফজলুল হক মনি স্বাধীনতার পরে একেবারে শূন্যাবস্থা থেকেই তিন তিনটি পত্রিকার জন্মদান করেছিলেন। একটি ছিল বাংলাদেশের বিচারে ইর্ষাযোগ্য মানের অধিকারী ইংরেজি দৈনিক, নাম "বাংলাদেশ টাইমস", বাংলা দৈনিকটির নাম "বাংলার বাণী" এবং চলচ্চিত্র পত্রিকাটির "সিনেমা" নামে পরিচিত ছিল। স্বাধীনতার পূর্বে তিনি স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় সাব এডিটরের কাজ করতেন। শেখ মুজিবুর রহমানের তিন বছরের শাসনকালে জনাব শেখ ফজলুল হক মনির মত অনেকেই এরকম সামান্য অবস্থা থেকে অকল্পনীয় অর্থ-সম্পদের মালিক হতে পেরেছেন। অবশ্য তাদের বেশিরভাগেরই রাজনৈতিক উচ্চাকাংখা ছিলা না বলে টাকা-পয়সাকে এমন সুন্দর লাভজনকভাবে বিনিয়োগ করতে পারেননি। ওপরে বর্ণিত তিনটি বাংলা এবং তিনটি দৈনিকের প্রত্যেকটিই সরকার সমর্থন করে যেত। এই সমর্থন অনেক সময় এতো দাসোচিত এবং অমার্জিত রুপ গ্রহণ করত যে, রুচিবান মানুষদের পিড়িত না করে ছাড়ত না। এই সকল পত্রিকার সম্পাদক এবং সাংবাদিকেরা সরকারের সুনজরে পড়ার জন্য তোষামোদ এবং তোয়াজে কে কার চাইতে অধিকদুর যেতে পারেন সেজন্য রীতিমত প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতেন। যদিও সেসব লেখা পাঠ করে বিবমিষা ছাড়া নিরপেক্ষ পাঠকের মনে আর কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারত না।
রাজধানী ঢাকা থেকে তখন প্রকাশিত উল্লিখিত ছয়টি দৈনিক পত্রিকা ছাড়া আরো কয়েকটি পত্রিকা তখোনো ছিল। তার মধ্যে জনপ্রিয়তায় যেটি সবগুলোকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, সে পত্রিকার নাম "দৈনিক ইত্তেফাক"। এই পত্রিকাটির সংগে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নানা উত্থান-পতন ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। আওয়ামী লীগের প্রথম সভাপতি মওলানা ভাসানী এই কাগজটির প্রতিষ্ঠাতা হলেও প্রখ্যাত সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন ওরফে মানিক মিয়া ছিলেন পত্রিকাটির মালিক এবং সম্পাদক। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রাতিম্বিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী তফাজ্জল হোসেন সাহেব নিজেও ছিলেন একজন আওয়ামী লীগার, শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ঘনিষ্ঠ সহচর এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর পরামর্শ-বুদ্ধি-বিবেচনা আওয়ামী লীগ মহলে অপরিসীম মর্যাদা এবং গুরুত্বসহকারে গৃহীত হত। জন্মের শুরু থেকেই এই পত্রিকাটি আওয়ামী লীগকে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন দান করে আসছিল। উনিশ শ' পয়ষট্টি সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবিকে তৎকলীন পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় করার পেছনে শেখ মুজিবুর রহমান যে ভুমিকা পালন করেছিলেন, "ইত্তেফাক" পত্রিকা এবং সম্পাদক তফাজ্জল হোসেনের অনন্য সাংবাদিকতার প্রতিভা তাঁর চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেননি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন আন্দোলনের প্রতি জোরাল সমর্থন প্রকাশ করার অভিযোগে আই্য়ুব খান সরকারের গভর্নর মোনেম খান পত্রিকাটির প্রকাশ বন্দ্ধ করেছিলেন এবং ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিলেন। উনিশ শ' উনসত্তর সালের আইয়ুব বিরোধী অভ্যুত্থানের সময়ে প্রবল জনমতের চাপে সাময়িক সরকারকে বাধ্য হয়ে এই পত্রিকাটির ওপর থেকে নিষিধাগ্জা প্রত্যহার করে নিতে হয়। "ইত্তেফাক" যেসব সময়ে আওয়ামী লীগকে অকুন্ঠ সমর্থন করে আসছিল ইত্তেফাকের ভুমিকাটি অতটা মর্যাদাবিবর্জিত ছিলনা। এই কাগজে মাঝে মাঝে গণতান্রিক মূল্যবোধের প্রশ্নটি তুলে ধরার চেষ্টা করত। ব্যক্তিস্বাধীনতা, আইনের শাসন, নাগরিক অধিকার ইত্যাদির সপক্ষে কখনো-সখনো, দু'চার কথা নরমে-গরমে সাহস করে লিখে বসত। "ইত্তেফাক" ছাড়া অপর প্রাচীন দৈনিক পত্রিকাটির নাম "আজাদ"। পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা, মুসলিম লীগের পুরোধা, কৃতবিদ্য পন্ডিত এবং এক সময়ের বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের নাম করা সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক মওলানা আকরম খাঁ ছিলেন এই প্রাচীনতম পত্রিকাটির প্রতিস্ঠাতা সরকার ঘেঁষা। বাংলাভাষা আন্দোলন ছাড়া তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং কেন্দ্রের মধ্যে স্বার্থ-সংস্লিষ্ট ব্যাপারে যখনই বিরোধ উপস্হিত হত সব সময়েই কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থন করত। মওলানা আকরম খাঁ যতদিন বেঁচে ছিলেন এই সুচিহ্নিত ভুমিকা "আজাদ" পত্রিকা অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করেছে। মাওলানা সাহেবের মৃত্যুর পর আজাদের প্রাক্তন ভুমিকার অনেক পরিবর্তন ঘটলেও পত্রিকা হিসেবে পূর্বের জনপ্রিয়তা হারিয়ে বসেছিল। পরিচালনার ত্রুটিই সম্ভবত এর মুখ্য কারণ। স্বাধীন বাংলাদেশে কোন রকমের ধারদেনা করে আজাদ পত্রিকার দিন চলছিল। সরকারের বিরোধিতা করার তো প্রশ্নই ওঠেনা। মাঝখানে একবার সরকার পত্রিকাটিকে নিয়েও গিয়েছিলেন।
মোজাফফর আহমদের বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পত্রিকাটির নাম "সংবাদ"। এই কাগজে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছাড়াও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি সমর্থন জ্জাপন করত। এই দুটি দলই যৌথভাবে ভারত থেকে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে কিম্বা বলা যায় তারও আগে থেকে অধিকাংশ বিষয়ে আওয়ামী লীগকে ছায়ার মত অনুসরন করে আসছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এই পার্থক্য কমতে কমতে একেবারে শুন্যের কোটায় এসে ঠেকেছিল। অধিকন্তু তিনদল মিলেমিশে একদল সৃষ্টির পরে একদলীয় সরকার পদ্ধতির মুখ্য নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের যাবতীয় কার্যকালাপের প্রতি সমর্থন যোগানো পত্রিকাটির একটি নৈতিক কর্তব্যও হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই পত্রিকাটিতেও সরকারি কার্যকলাপের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত হত। স্বাধীনতার পর "জনপদ" নামে আরেকটি বাংলা দৈনিক ঢাকা থেকে আত্মপ্রকাশ করে। আওয়ামী লীগের এককালীন সভাপতি এবং পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভার সদস্য জনাব কামরুজ্জামান ছিলেন পত্রিকাটির নেপথ্য মালিক। এটিও ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক পত্রিকা। "দি পিপল" নামে একটি দৈনিক ইংরেজি পত্রিকা স্বাধীনতা সংগ্রামের কিছুকাল পূর্বে জন্মলাভ করেছিল। জনৈক উঠতি বাঙালী ধনী ছিলেন পত্রিকাটির স্বত্তাধিকারী। উনিশ শ' একাত্তর সালের মার্চর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আগুন লাগিয়ে কাগজটি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতে গাণ্দ্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠানের অর্থানুকুল্যে কাগজটির পুন:প্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশে পুনরায় কাগজটির প্রকাশ ঘটার পর থেকে সব সরকারকেই সমর্থন দান করেছিল। উনিশ শ' একাত্তর সালের পয়লা জানুয়ারি একবার মাত্র সরকারি গুলিবর্ষন করার প্রতিবাদ করে গরম খবর পরিবেশন করেছিল বলে প্রচন্ড হুমকির মুখে ভাল ছেলের মত সুর পাল্টাতে বাধ্য হয়।
উনিশ শ' পচাত্তর সালের শুরুর দিকে বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক কার্যকলাপ একেবারে পুরোপুরি বন্দ্ধ ঘোষনার পরে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সমর্থক পত্রিকা গণকন্ঠের প্রকাশ রুদ্ধ, সম্পাদক দেশের খ্যাতনামা কবি জনাব আল মাহমুদ কারারুদ্ধ এবং ছাপাখানায় তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। এর পূর্বেও "গণকন্ঠ" পত্রিকাটি বন্দ্ধ করার জন্য সরকার নানাধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। পত্রিকাটিতে সরকারি বিজ্জাপন দেয়া হত না, দুয়েকবার ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়েছে। আইনের ফ্যাঁকড়া তুলে মুদ্রণ এবং প্রকাশের পথে কৃত্তিম সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। মাঝখানে একবার বন্দ্ধও করে দেয়া হয়েছিল। সাংবাদিকদের সমবেত দাবির মুখে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ বন্ধ ঘোষনার সাথে সাথে প্রকাশ রহিত হয়ে গেল। গণকন্ঠের পিছু পিছু সরকার বিরোধী দলীয় ইংরেজি "সাপ্তাহিক ওয়েভ" এবং "হলিডে" কিছুদিন পর্যন্ত টিকে থাকে পরেছিল। পরে দুটোকেই বন্ধ করে দেয়া হয় এবং আপত্তিজনক সংবাদ পরিবেশনের দায়ে "হলিডে" সম্পাদক জনাব এনায়েতুল্লাহ খানকে জেলখানায় প্রেরণ করা হয়। জনাব আলী আশরাফ সম্পাদিত বাংলা "সাপ্তাহিক অভিমত" - এরও একই পরিণতি ঘটে।
বিরোধীদল তো ছিলই না। বিরোধীদলীয় পত্রপত্রিকাগুলোকেও নির্মমভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সরকার সমর্থক পত্রিকাসমুহ এবং সরকারের অন্য দুটো অংগদলের মুখপত্রগুলো প্রতিটি স্বৈরাচারী পদক্ষেপকে একেবারে নির্লজ্জভাবে অভিনন্দিত করে যাচ্ছিল। তথাপি শেখ মুজিবুর রহমান একদলীয় শাসন কায়েম করার প্রাক্কালে বাংলাদেশে পত্র-পত্রিকার সংখ্যা একেবারে কমিয়ে এনে গণমতের বাহনগুলোর কর্তৃত্ব নির্ভরযোগ্য হস্তে অর্পণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র চারটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হবে ঠিক হল। দুটি বাংলা এবন দুটি ইংরেজি এবং এটাও ঠিক হল যে বাদ বাকি পত্রিকাসমুহ বন্ধ করে দেয়া হবে। "ইত্তেফাক" কাগজটিকে পুরোপুরিভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসা হল। "ইত্তেফাক" ছাড়া অপর যে বাংলা কাগজটি বেঁচে থাকবে সেটির নাম "দৈনিক বাংলা"। ইংরেজি কাগজ দুটির নাম "বাংলাদেশ অবজারভার" এবং "বাংলাদেশ টাইমস"। এসব পত্রিকাগুলো একেবারে সরকারি পত্রিকা এবং সাংবাদিকেরা সরকারি কর্মচারীরুপে চিহ্নিত হবেন বলে ঘোষনা দেয়া হল।
একসংগে অনেকগুলো পত্রপত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে গোটা দেশের সাংবাদিকবৃন্দ এক ভয়াবহ সংকটে নিপতিত হন। এই নির্মম অর্তসংকটের দিনে সাংবাদিকেরা সবান্ধবে বেকার হয়ে পড়ার ফলে তাঁদের সামনে বেঁচে থাকার দ্বিতীয় কোন পন্থা উম্মুক্ত রইল না। যে চারটি পত্রিকা প্রকাশিত হবার সিদ্ধান্ত পাকাপাকি হয়ে গেছে, সেগুলোতে কোনো রকমে স্থান করে নেয়ার জন্য প্রতিটি সাংবাদিকই মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। এই ধরনের পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের কাছ থেকে এর চেয়ে ভিন্ন কোন আচরন আশাও করা বোধহয় সম্ভব ছিলনা। অবশ্য শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার তাঁদের কর্মসংস্থান করে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতিও দান করেছিলেন এবং সরকার থেকে তাঁরা অল্প-স্বল্প মাইনেও পাচ্ছিলেন। এই অনিশ্চিত শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে সাংবাদিকদের মাথায় যে চিন্তাটা প্রথমে এসেছিল তাতে বাহ্যত দাসোচিত আত্মসমর্পন এবং সুবিধাবাদি চরিত্রের পরিচয় স্পষ্টতভাবে ফুটে উঠলেও বাংলাদেশের পরিস্থিতির বিচারে তাই-ই ছিল একান্ত বাস্তব এবং যুক্তিসংগত। প্রতিটি আলাদা আলাদা পত্রিকার সাংবাদিকেরা ভাবলেন তারা আগেভাগে যদি সরকারি দলে যোগ দেয়ার আবেদনপত্রে সই দিয়ে বসেন, সরকার অনুকম্পা করে তাঁদের কথাটি বিবেচনা করে দেখবেন। এই ধরনের মনোভাবের বশবর্তী হয়ে যাবার বেশ কয়েকদিন পূর্বে "দৈনিক পূর্বদেশ" পত্রিকার সাংবাদিকবৃন্দ সদলবলে বাকশালের কেন্দ্রীয় দফতরে গমন করে সই করা আবেদনপত্রসমুহ জমা দিয়ে এসে মনে করলেন, যা্ক্ নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। এই ঘটনার পর থেকে অন্যান্য চালু এবং বাতিল পত্রিকার কর্রমরত সাংবাদিকদেরও বোধদয় ঘটল। তাঁরা ভাবলেন, পূর্বদেশের সাংবাদিকদের মত তাঁরাও যেয়ে যদি বাকশালের সদস্যপদের আবেদনপত্রে সই না করেন, তাহলে তাদের চাকুরি হবে না এবং চালু পত্রিকায় কর্মরত থাকলে চাকুরিটি টিকবে না। সরকারি পত্রিকায় সরকারিদলের লোকদের কাজ পাবার নৈতিক দাবীই সবচেয়ে বেশী। তারপর থেকে সাংবাদিকেরা দিগ্বিদিক জ্ঙান হারিয়ে দল বেঁধে নিয়মিত বাকশাল অফিসে ধাওয়া করতে থাকলেন। প্রতিটি পত্রিকার সরকারসমর্থক সাংবাদিকেরা উদ্যোগী হয়ে সহযোগী এবং কলাকুশলীদের টেনে নিয়ে জাতীয় দলের অফিসে হাজিরা দিতে আরম্ভ করলেন। রাস্ট্রের তৃতীয় স্তম্ভ বলে কথিত সংবাদপত্রের কারিগরদের একাংশ পেশাগত মর্যাদা, স্বাধীনতাস্পৃহা, সত্য এবং ন্যায় - সাংবাদিকতাবৃত্তির সংগে সংস্লিষ্ট ইত্যাদি মহত অনুষংগসমুহ বাদ দিয়ে যে নাটকের অবতারনা করেছিলেন বাংলাদেশের সমাজে অনতিবিলম্বে তার প্রভাব অনুভুত হতে শুরু করে। অবশ্য সাংবাদিক মাত্রেই যে বাকশালে যোগ দেয়ার জন্য লালায়িত ছিলেন তেমন কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। চাপের মুখে বাকশাল সদস্যপদের আবেদনপত্রে সই করে একজন সাংবাদিককে আমি সত্যি সত্যি নিজের চোখে কাঁদতে দেখেছি। বেশ ক'জন সাংবাদিক ভয়ভীতি অগ্রা হ্য করে শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকতার আদর্শ এবং নীতিতে অটল ছিলেন। "ইত্তেফাক" পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব আসাফউদ্দৌলা রেজা আবেদনপত্রে সই করেননি। এই অভিযোগে সরকারি ব্যবস্থাপনায় "ইত্তেফাক" প্রকাশ পাওয়ার সময় তাঁর চাকরি চলে যায়।
বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সভাপতি ঘোষনা করেছিলেন যে আমলা, কর্মরত সাংবাদিক, স্বায়ত্বশাসিত এবং আধা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানসমুহের কর্মচারীবৃন্দ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক যে কেউ বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সদস্যপদের জন্য আবেদন করতে পারবেন। অবশ্য কাকে সদস্যপদ দেয়া হবে, কাকে হবে না সটি সম্পুর্নভাবে কর্তৃপক্ষের বিবেচনার বিষয়।
যে কেউ ইচ্ছে করলে সরকারি দলে যোগদান করতে পারবে, এটা ছিল সরকারি ঘোষনা। আসলে যোগ না দিলে কারো নিস্তার পাবার উপায় ছিলনা। ভেতরে ভেতরে সমস্ত সরকারি বেসরকারি দফতর স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পত্রিকার সাংবাদিক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক এবং বুদ্ধিজীবীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছিলেন যে, সবাইকে জাতীয়দলে যোগ দেয়ার আবেদনপত্রে সই করতে হবে। কতৃপক্ষ যাকে বিপজ্জনক মনে করেন সদস্যপদ দেবেন না, কিন্তু বাংলাদেশে বাস করে চাকুরি-বাকরি, ব্যাবসা-বানিজ্য করে বেঁচে-বর্তে থাকতে চাইলে জাতীয়দলের সদস্যপদের আবেদনপত্রে সই করতেই হবে। সর্বত্র বাকশালে যোগদান করার একটা হিড়িক পড়ে গেল। শেখ মুজিবুর রহমান যেদিন আনুস্ঠানিকভাবে বাকশালের কেন্দ্রীয় দফতর উদ্বোধন করতে এলেন তাঁকে স্বাগত সম্ভাষন জ্জাপনের উদ্দেশ্যে গোটা দেশের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, শ্রমিক, কৃষক সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে হাজির থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেদিন ছিল মুষলধারে বৃষ্টি। অবিরাম ধারাস্রোতে প্লাবিত হয়ে ভেজা কাকের মত সুদীর্ঘ মানুষের সারি কিভাবে রাস্তায় তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন, যাঁরা এ দৃশ্য দেখেছেন ভুলবেন না। মহিলাদের গাত্রবস্ত্র ভিজে শরীরের সংগে একশা হয়ে গিয়েছিল। এই সুবিশাল জনারন্যে আমাদের দেশের নারীকুলকে লজ্জা-শরম জলান্জলি দিয়ে সশংকিতচিত্তে তাঁর আগমনের প্রতীক্ষা করতে হচ্ছিল।
নাগরিক জীবনের সর্বত্র একটা আতন্কের কৃষছায়া প্রসারিত করে আসছিল। এ ধরনের চিন্তা, বুদ্ধি এবং সাহসরোধী পরিবেশে যেখানে মানুষের বিচার-বুদ্ধি কাজ করে না, বেঁচে থাকা বলতে শুধু বোঝায় কোন রকমে পশু অস্তিত্বের সংরক্ষণ। নৈতিক সাহস, মানবিক মুল্যবোধ ইত্যাকার সুসভ্য জীবনের বোধগুলো বাংলাদেশে সর্বপ্রকারের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। সবখানে আতন্ক, উদ্বেগ। এ তো গেল একদিকের চিত্র। অন্যদিকে গ্রাম-বাংলার মানুষদের অবস্থা দুর্দশার শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দাম প্রতিদিন হু হু করে বাড়ছে। দেশে অভাব, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ক্ষুধার তাড়নায় মা সন্তান বিক্রি করছে। স্বামী স্ত্রীকে পরিত্যাগ করছে। বিনা কাফনে লাশ কবরে নামছে। সৎকারবিহীন অবস্থায় লাশ শৃগাল-কুকুরের আাহার্য হওয়ার জন্য পথে পথে পড়ে থাকছে। চারদিকে জ্বলন্ত বিভীষিকা, চারদিকে হা-অন্ন, হা-অন্ন রব। এই অন্নহীন বস্ত্রহীন মানুষের দংগল একমুঠো ভাত, এক ফোটা ফেনের আশায় ঢাকা শহরে এসে শহরের ফুটপাতে চিৎ হয়ে মরে থাকছে।
একদিকে উদ্ধত উলংগ স্বৈরাচার, অন্যদিকে নির্মম দারিদ্র, বুভুক্ষা এই দুইয়ের মাঝখানে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে অতি কষ্টে, অতি সন্তর্পনে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হচ্ছিল। অর্থনৈতিক অন্তর্দাহের আঁচ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতেও লেগেছে। অনেকগুলো পরিবার মাছ-মাংস স্পর্শ করা বাদ দিতে বাধ্য হয়েছে। কোনো কোনো পরিবারের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যারা দু'বেলা ভাত খেত দু'বেলা আাটা খেয়ে জীবন কাটাচ্ছে। আবার অনেক পরিবারের দু'বেলা আটাও জোটে না।
অথচ শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন ক্ষমতার সংগে যাঁরা যুক্ত তাঁদের সুযোগ-সুবিধের অন্ত নেই। তাঁদের হাতে টাকা, ক্ষমতা সবকিছু যেন স্বাভাবিক নিয়মে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। আইন তাঁদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধির সহায়, সরকারি আমলারা আ্জ্গাবহ মাত্র, সামাজিক সুনীতি, ন্যায়-অন্যায়, নিয়ম-কানুন কোন কিছুর পরোয়া না-করলেও তাঁদের চলে। উনিশ শ' একাত্তুর সালের যুদ্ধের পর থেকে এই শ্রেণীটি বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক নৈরাজ্যের থেকে প্রাণরস সংগ্রহ করে ডাঁটো হয়ে মাথা তুলছিল। ঢাকা শহরের প্রশস্ত রাজপথ থেকে শুরু করে সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিস্ঠান, ব্যাবসায়ীর আড়ত, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, রেডিও-টেলিভিশন, লেখক-সাহিত্যিকদের আড্ডা, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মন্দির এমনকি দূর-দুরান্তের পল্লীগ্রামের মহল্লায় মহল্লায় এই হঠাৎ জন্মানো নব্যনবাবদের সীমাহীন প্রতিপত্তি। এদের অনুমোদন ছাড়া মরণোম্মুখ রোগী এক ফোটা ওষুধ পেত না, শীতার্ত উলংগ অসহায় মানুষের পরনে রিলিফের একখানি বস্ত্র উঠত না, এক সের রেশনের চাল কি আটা বিলি হতে পারত না। বিধ্ধস্ত বাংলাদেশের জনগনের সাহায্যার্থে যে দেশ থেকেই সাহায্য আসুক না কেন এই শ্রণীটির দুষ্ট ক্ষুধার চাহিদা মিটাতে সবকিছু শেষ হয়ে যেত। এদের অনুমোদন ছাড়া কোন অফিসে একজন সামান্য পিয়নের নিয়োগপত্র পাওয়ার সম্ভাবণা ছিল না, যোগ্যতা যাই হোক না কেন। রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো যেত না। ছাত্রকে স্কুলে। বেবাক দেশের দশদিকে এরা ছড়িয়েছিল। আমলাদের মধ্যে, নিম্নশ্রেণীদের মধ্যে, শিক্ষকদের মধ্যে, গায়ক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে, কৃষক-শ্রমিকদের মধ্যে অন্তরীক্ষে অবস্থান করে একজন মাত্র মানুষ সবকিছুর সুতো ধরে রয়েছেন তিনি বাংলাদেশের রাস্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান।
স্বাধীনতার তিন বছর সময়ের মধ্যে সার্বিক পরিস্থিতি এরকম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে বাংলাদেশ এবং শেখ মুজিব এ দুটো শব্দ পরস্পরের পরিপুরক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শেখ মুজিব যদি বলতেন আমিই হলাম গিয়ে বাংলাদেশ, তাহলে তিনি এতটুকুও মিথ্যে বলতেন না। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর দেশে ফিরে ক্ষমতার সিংহাসনে অধিষ্টিত হয়ে একে একে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর গলা টিপে ধরেছিলেন। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে তিনি নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছেন। তাদের ঘরবাড়ি ভূ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছেন, পরিবার-পরিজনের ওপর সীমাহীন অত্যাচার চালিয়েছেন। তাদের কাউকে গ্রেফতার করে কারাগারের উদরে নিক্ষেপ করেছেন। দেদার নেতা এবং কর্মী হত্যা করেছে রক্ষীবাহিনী। বাংলাদেশের গ্রামে-গন্জে বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী দমন করার নামে সরল মানুষদের পাখির মত গুলি করে, গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। শেখ মুজিব বিরোধী কোন কিছুর আভাস পাওয়ামাত্রই রক্ষীবাহিনী আগ্নেয়াস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে ছুটে গেছে। সবকিছু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে, ভেংগে-চুড়ে তছনছ লন্ড-ভন্ড করে দিয়েছে। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতা তিরিশ বছর বয়স্ক সিরাজ সিকদারকে নৃশংসভাবে হত্যা করিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান পরিষদ কক্ষে উল্লসিত উদ্ঘোষনায় ফেটে পড়ে বলেছিলেন, এখন কোথায় সিরাজ সিকদার? গ্রফতার, নির্যাতন এসব শেখ মুজিব প্রশাসনের একটা অ্ত্যন্ত উল্লেখযোগ্য দিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আবদুল মতিন, আলাউদ্দিন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি মেজর জলিল, সম্পাদক আ.স.ম. আবদুর রব সহ অসংখ্য নেতা এবং কর্মী, জাতীয় লীগের অলি আহাদ অনেককেই তিনি কারাগারে প্রেরণ করেছিলেন। বিপ্লবী মতাদর্শী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের কথা বাদ দিয়েও তিনি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিকবোধ আস্থাশীল রাজনৈতিক দলগুলোর উপস্থিতিও বরদাশত করতে পারতেন না।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফেরার পর তিনি দেশের বিপর্যস্ত অবস্থার উন্নয়ন সাধনের জন্য সময়ে অসময়ে হুন্কার দেয়া ছাড়া কোনো বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ করেননি। পক্ষকান্তরে তার বিরোধীদের সমুলে বিনাশ করার এক সর্বনেশে খেলায় মেতে উঠেছেন। এমনকি সে বিরোধিতা নিজের দলের লোক থেকে এলেও এবং একান্ত ন্যায়সংগত হলেও তিনি সহ্য করেননি। দৃশ্যত বিরোধীদলবিহীন খোলা ময়দানের তিন তিনটি দলের সর্বময় কর্তা হওয়া স্বত্তেও তিনি নিশ্চিত বোধ করতে পারছিলেন না। তিনটি দলকে এক করে একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করে সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করে রাখার জন্য রাতারাতি প্রধানমন্ত্রী থেকে রাস্ট্রপতি হয়ে বসলেন। সংবিধান বাতিল ঘোষনা করলেন। জাতীয় পরিষদের সদস্যদের সংগে বয়-বেয়ারাদের মত আচরন করলেন। উদারনৈতিক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ দলের পাটাতনে দাঁড়িয়েই একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরিসরে নিজেকে বাঙালি জাতির সংগ্রামী প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করে নিতে পেরেছিলেন এবং বাঙালি জাতির মুক্তি-সংগ্রামের নায়করুপে সারাবিশ্বে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। তিন বছর যেতে না যেতেই আওয়ামী লীগ দলটির অস্তিত্ব বিলীন করে দিলেন। উনিশ শ' উনসত্তর সালের পর থেকে এ পর্যন্ত তাঁকে ভাগ্যদেবতা অযাচিতভাবে কৃপা করে আসছে। উনিশ শ' উনসত্তর সালে আইয়ুব বিরোধী অভ্যূথ্থানের ফলে আইয়ুব খানকে আগরতলা ষড়যণ্ত্র মামলে উঠিয়ে নিতে হয়। কারাগার থেকে তিনি বেরিয়ে আসেন বাঙালি জাতীর জনক এবং অদ্বিতীয় নেতা হিসেবে। তাঁর প্রতি জনগনের আস্থা ভালবাসা তাঁর মস্তকে হিমালয় পর্বতের চুড়োর মত উত্তুংগ মহিমায় বিভুষিত করেছে। গোটা জাতি তাঁর পেছনে। এর পূর্বে কোন বাঙালি নায়কের পেছনে মানুষ অকৃত্ত্রিম আস্থা এবং স্বত:স্ফুর্ট ভালাবাসা এমন করে বিলিয়ে দেয়নি। তার আগেও এরকমটি ঘটেছে বারবার। যে-কোন বড় ধরনের রাজনৈতিক বিপ্লব, উপবিপ্লব শুরু হওয়ার পূর্বে শেখ মুজিব কোন যাদুমন্ত্র বলে কারাগারে ঢুকে পড়েছেন। ঘটনার নিয়মে ঘটনাটি ঘটে যাবার পর বিজয়ী বীরের মত শেখ সাহেব দৃপ্ত পদক্ষেপে প্রকাশ্য সূর্যালোকে বেরিয়ে এসে নেতার আসনটিতে বিনাদ্বিধায় বসে পড়েছেন। শেখ মুজিবকেই ঘটনাটির নায়ক বলে লোকে বিনাদ্বিধায় মেনে নিয়েছেন। তাঁর নিজের দলের মধ্যেও এ নিয়ে বোধকরি কোন প্রশ্ন কখনো উঠেনি। উনিশ শ' একাত্তর সালের পঁচিশে মার্চ তারিখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে আপন বাসভবন থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং উনিশ শ' বাহাত্তর সালের দশই জানুয়ারি তারিখে বাংলাদেশে এসে এমন একটি আসন পেয়ে গেলেন, বাঙালি জাতির ইতিহাসে কোন মানুষ সে রকম মর্যাদা, ভালোবাসা এবং একছ্ত্র ক্ষমতার আসনে উপনিবেশ করতে পারেনি। তাঁর তেজ, বীর্য এবং বাক্যের মন্ত্রশক্তিতে বিস্ময়াবিশ্ট দেশবাসী বহুকাল পূর্বেই তাঁকে বংগবন্ধু এবং বাঙালি জাতির পিতা ইত্যাদি দুর্লভ সম্মানে ভূষিত করেছিলেন। শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার আসনে তো তিনি রাজচক্রবর্তী হিসেবে বহুকাল পূর্বে থেকেই আসীন ছিলেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে বাঙালি হ্রদয়ের সিংহাসনের রাজা বাস্তবের সিংহাসনে আরোহন করলেন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি তাঁর দু:শাসনে যতই বিপর্যয়ের শেষ সীমানায় নেমে আসুক-না কেন, বন্যা, মহামারী, চোরাচালানী, ছিনতাইকারী, টাউট, স্বজনতোষনকারীরা বাংলাদেশে যে অবর্ননীয় দু:খ-দুর্দশারই সৃষ্টি করুক-না কেন তাঁর গোচরেই সবকিছু ঘটে আসছিল। যৌবনবতী মেয়ে মানুষ তার প্রেমিককে যে রকম বিশ্বাস করে এবং ভালবাসে, বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে সেই অকৃত্তিম অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে উৎসারিত বিশ্বাস এবং ভালাবাসা দিয়েছিল। তিনি এলেন, প্রধাণমন্ত্রী হলেন। নতুন সংবিধান রচনা করলেন, নির্বাচন ডাকলেন এবং নির্বাচিত হওয়ার পর বছর না ঘুরে না-আসতেই প্রধাণমন্ত্রীর পদ তাঁর হল না। তাঁরই নির্দেশে রচিত সংবিধানের বিধানগুলো আঁটোসাটো জামার মত ক্রমাগত তাঁর বিরক্তি উৎপাদন করছিল। তাই তিনি নিজ হাতে গড়া অনুশাসনের নিগড় ছিন্ন করে ফেললেন। সংবিধান বাতিল ঘোষনা করলেন। যে সংসদীয় গনতন্ররে বাঁধানো সড়ক বেয়ে আকাশস্পর্শী উচ্চকাঙখার নির্দেশে একটি সবল, স্বাস্থ্য এবং দরাজ কন্ঠস্বর মাত্র সম্বল করে এতদুর উর্ধ্বে আরোহন করেছেন সেই সংসদীয় গণতণ্ত্র শেখ মুজিবের হাতেই জখম হয়ে হয়ে লাশটি তাঁরই হাতে কবরস্থ হওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিল। অবিলম্বে তিনি তাঁর কর্তব্যকর্ম সমাপন করলেন। সংসদীয় গনতণ্ত্রের লাশটি কবর দিলেন। একদলীয় সরকারের রা্স্ট্টপতি হিসেবে নতুন পরিচয়ে তিনি নিজেকে পরিচিত করলেন। শেখ মুজিব যা করেন সব নিঁখুত। ইতিহাসের সংগোপন আকান্খা তাঁর প্রতি কর্মে অভিব্যক্তি লাভ করে। এ হচ্চে তাঁর পরিষদের ধারণা। কথাটি তিনিও আপনদল এবং বন্ধুদলের মানুষদের কাছ থেকে এতবেশি শুনেছেন যে নিজেও প্রায় অতিমানব বলে বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন। তিনিও মনে করতে আরম্ভ করলেন, যা কিছু হও বলবেন, অমনি হয়ে যাবে। এ যেন শেক্সপীয়রের নাটকের নায়ক জুলিয়াস সিজার। আকাশের জ্যোতিস্কমন্ডল বারেবারে শুভ-সংকেত বয়ে নিয়ে আসে।
শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রে সীজারের বীরত্ব এবং গুনাগুন বর্তমান ছিল কিনা বিচার করবেন আগামীদিনের এৈতিহাসিক। তবে একথা সত্য যে, পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশ বাংলাদেশে তিনি যা পয়েছেন, যা আদায় করেছেন, অনুরুপ ভাগ্য কোন রোমান সীজারের কোনদিন হয়নি।
সব শক্তিদর্পী মানুষের যেমন হয়ে থাকে তেমনি শেখ মুজিবর রহমানের মনে কিছু নিরীহ বস্তু না পাওয়ার ক্ষোভ বারবার তাঁর অন্তর্লোককে পীড়ন করেছে। শক্তিদর্পী মানুষেরাও চায় মানুষ তাদের ভালাবাসুক বন্ধুর মত, আবার যমের মত ভয় করুক। আকাশের দেবতাকে যে রকম ভীতিমিশ্রিত ভালবাসা দিয়ে বিচার করে, শেখ মুজিবুর রহমানের মনেও অবিকল সে রকম একটি বাসনার উদয় হয়েছিল।
তিনি বিলক্ষন জানতেন, পান্ডিত্যাভিমানী শিক্ষিত সমাজের মানুষ তাঁকে অন্তর থেকে অবজ্গা করেন। এই শ্রেণীটির চরিত্রের খাঁজগুলো সম্বন্ধে পুরোপুরি অবহিত ছিলেন। উনিশ শ' উনসত্তর সালের পূর্ব পর্যন্ত এই শ্রেনীর লোকেরা তাঁকে বাগাড়ম্বর সর্বস্ব অমার্জিত হামবগ ছাড়া কিছু মনে করতেন না, তা তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। বিভিন্ন বিবৃতি, বক্তৃতা, ঘরোয়া বৈঠক এবং আলাপ-আলোচনায় এঁদের প্রতি প্রচ্ছন্ন ঘৃণা এবং বিরক্তি তিনি কুন্ঠাহীনভাবে ব্যক্ত করেছেন। তা সত্তে্ও উচ্চশিক্ষিত আমলা, লেখক-সাহিত্যিক এবং শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষক এবং সম্ভ্রন্ত সমাজের একাংশ তাঁকে বংগবন্ধু বলে যে সম্বোধন কেন করতেন শেখ মুজিব তা বুঝতেন এবং তা তাঁর ক্ষমতার স্বাভাবিক প্রাপ্য হিসাবেই গ্রহণ করতেন। তাছাড়া বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবি বলে কথিত শ্রেণীটির হীনমন্যতাবোধ এবং চারিত্রিক দাসত্ব অনেকটা প্রবাদের সামিল। যে-কোন নতুন শাসক এলেই সকলে মিলে তাঁর গুণপনা বাখান করা এখানকার বহুদিনের একটা প্রচলিত প্রথা। কচিত কদাচিত ব্যতিক্রমী কন্ঠ শোনা যায়। এর কারণ নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সমাজ শরীরের মধ্যে সংগুপ্ত আছে।
শক্তিদর্পী মানুষেরাও যে শেষ পর্যন্ত একেকটা দিকে কাঙাল থেকে যান শেখ মুজিবের মধ্যেও তার পরিচয় পাওয়া যায়। যে বস্তুটি সহজভাবে পাওয়া যায় না তাকে ভেঙে ফেলার জন্য এঁদের অনেক সময় নিয়মমত খাওয়া-শোয়ার ব্যাঘাত ঘটতে থাকে। তাঁর আসন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমনের ঘটনাটিকেও এ পর্যায়ে ফেলা যায়। যদিও তিনি দেশের একচ্ছত্র অধিপতি তথাপি তাঁর কানের কাছে অনেক উচ্চকন্ঠ চিৎকার করেছে, বাচাল ও অর্বাচীনেরা অনেক বৃথা লিখেছে, কিন্তু পন্ডিতরা বরাবর নিশ্চুপ থেকেছেন। এই অর্থবোধক নিশ্চয়তা তাঁর বুকে শেলের মত বেজেছে। সেজন্যই তাঁর অত ঘটা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা। যে লোকেরা সহজভাবে তাঁকে স্বীকার করে নেয়নি, তাঁদেরকে তাঁর মহিমা বুঝিয়ে দেয়ার জন্যই বিশ্ববিদ্যলয়ে আসছেন। নইলে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে শেখ মুজিব সকাল-সন্ধে ভাঙা কাপে চা খেয়েছেন, সেখানে আাসার জন্য সাড়ে সাত লক্ষ টাকা ব্যয় করার কি প্রয়োজন থাকতে পারে? বিশষত বাংলাদেশের মত দেশে যেখানে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠেও এক-তৃতীয়াংশ ছাত্রের পয়সার অভাবে সকাল বেলার টিফিন জোটে না।
তাছাড়া আরেকটি কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা তাঁর জন্য অণিবার্য হয়ে পড়েছিল। যতই তিনি জনগনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন ততই তাঁর চরিত্রের স্বৈরাচারী লক্ষণসমুহ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল। ক্ষমতার নির্মম একাকীত্ব তাঁকে নিশ্চয়ই বুঝিয়ে দিয়েছিল যে গণতণ্রের ধারাস্রোতে বাহিত হয়ে তিনি এসেছিলেন, তাতে তাঁর পুনরায় অবগাহন করার কোন উপায় নেই। কেননা এই তিন বছরে শরীর অনেক ভারী হয়ে গিয়েছে এবং সাঁতারও প্রাঅয় ভুলে গিয়েছেন। যদি তাঁকে একজন মানুষ হিসেবেই বেঁচে থাকতে হবে - জনতাই তাঁর শাসনের বিষয়বস্তু। তিনি রাজা এঁরা প্রজা। এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি মনে মনে সাংঘাতিক রকম অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন। সংবিধান, জাতীয় পরিষদ, পরিষদের সদস্য, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতি বলতেন, তিনি জনগনকে ভালবাসেন এটা তাঁর দীর্ঘদিনের অভ্যাস আর জনগন তাঁকে দেখতে ভিড় করতেন, তাঁর বক্তৃতা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, তাঁর কথায় হাত উঠাতেন এটা জনগনের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা শুনে এবং কথায় কথায় হাত উঠিয়ে অভ্যস্ত। আসলে জনগন অনেকদিন থেকেই তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। কারণ বাংলাদেশের যে দুর্দশা বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি ধরে নিয়েও বলা যায় তার আশি ভাগই মানুষের সৃষ্টি এবং তাঁর জন্য মুখ্যত দায়ী তাঁর পরিচালিত তৎকালীন সরকার। গ্রামের সরল মানুষকে, অনাহারক্লিষ্টা বিধবাকে আমি নিজের কানে তাদের তাবৎ অভাব অভিযোগের জন্য দায়ী করে অভিস্পাতের বাণী উচ্চারণ করতে শুনেছি। তিনি যে ধীরে ধীরে স্বখাত সলিলে ডুবে যাচ্ছেন খুবই টের পাচ্ছিলেন। জনগনের রুদ্ররোষ কি বস্তু উপলব্ধি করতে সময় লাগেনি। এই জনগনই আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করিয়ে শেখ মুজিবকে আইুয়ব খানের কারাগার থেকে মুক্তমানব হিসেবে প্রসন্ন দিবালোকে বের করে এনেছে। উনিশ শ' একাত্তর সালের মার্চ মাসের দিনগুলোতে জনগনের সংগবদ্ধ শক্তির গভীরতা, তীব্রতা কতদূর হতে পারে, বাঁধভাঙা বন্যার স্রোতের মত রাস্ট্রীয় এবং সামাজিক জীবনে কি অঘটন ঘটিয়ে তুলতে পারে সে জ্গান তিনি হাতে কলমেই লাভ করেছেন। তাই তিনি ক্রমাগতভাবে জনগনের ক্ষোভ আক্রোশ প্রকাশ করার পন্থা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমুহের মুখে বালির বাঁধ রচনা করে যাচ্ছিলেন। তাই তিনি তিনদল ভেঙে একদল করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী থেকে সরাসরি একনায়ক সেজে বসেছেন।
তিনদিন ভেঙে একদল করার পর তাঁর হাতে প্রভুত ক্ষমতা সন্চিত হয়েছিল বটে, কিন্তু তিনি রাজনৈতিকভাবে সম্পুর্ণ গরঠিকানার মানুষ হয়ে পড়েছিলেন। সম্মিলিতভাবে তিনি তিনদলেরই কর্তা, কিন্তু আসলে কোন দলেরই কেউ নন। এই ঠিকানাহীনতা তাঁকে একনায়কতন্রের দিকে আরো জোরে ঠেলে দিচ্ছিল। জনগন মন অধিনায়ক নেতার পক্ষে একনায়ক পরিচয়ের পথে রাজার পরিচয় আরো প্রীতিপদ এবং সম্মানের। বিশেষত তিনি দেশ এবং বিদেশের সামনে প্রমাণ যখন করতে পেরেছেন, তিনি চাননি তবু জনগন তাঁকে রাজার আসনে বসিয়েছে। এই রাজকীয় পরিচয়টা দেশের মানুষের মনে ভালভাবে দাগ কাটে মত বসিয়ে দেয়ার জন্য তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করে যাচ্ছেন। একদলীয় শাসন কায়েম করেছেন, জাঁকালো রাস্ট্রপতি হয়ে বসেছেন, উপবেশনের সুবিধার জন্য দিনাজপুরের মহারাজার সিংহাসনটা আনিয়ে নিয়েছেন। ব্রিটিশ আমলের ঘূণে ধরা প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করেছেন। পূর্বের জেলা এবং বিভাগগুলোর সীমানা চিহ্ণ মুছে দিয়ে গোটা দেশেকে একষট্টিটি নতুন প্রশাসনিক এলাকা তথা জেলায় বিভক্ত করে, প্রতি জেলার জন্য একজন করে গভর্ণরও দান মনোনয়ন দান করেছেন। জেলা প্রশাসনের সংগে সরাসরি কেন্দ্রীয় শাসনের সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। গভর্ণররা যাতে সর্বেসর্বা হয়ে বসতে না পারে সেজন্য বৈরী গ্রুপ থেকে একেকজন বাকশাল সাধারন সম্পাদককে মনোনয়ন দান করা হয়েছে। শাসনব্যবসথাকে নতুনভাবে ঢালাই করার নামে আইয়ুবের মত শেখ মুজিবও তাঁর সিংহাসনে থাকার পথটি পাকাপোক্ত করেছেন। আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের মৌলিক বস্তুটির সংগে জনগনের চাক্ষুষ পরিচয় ঘটেছে। মুজিবের মৌলিক বস্তুটিরও প্রয়োজনীয়তা কতদুর ছিল আগামীদিনের প্রশাসনবিদরা বিচার-বিবেচনা করে দেখবেন। আমার বক্তব্য হল, আইয়ুব সরকার এবং মুজিব সরকা নিজেদের ক্ষমতায় অটুট থাকবার জন্য উদ্ভাবিত পথটিকেই শাসনতান্রিক বিপ্লব বলে আখ্যা দিয়েছেন। জেলাসমুহের গভর্নর এবং বাকশালের সাধারন সম্পাদক নিযুক্ত করার ব্যাপারেও শেখ সাহেব রাজকীয় বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশের শাসক নেতৃশ্রনীতে যত ধরনের চাপ প্রয়োগক্ষম গ্রুপ রয়েছে, সব গ্রুপ থেকে প্রতিনিধি গ্রহন করেছেন - রাজনৈতিক দল ও ন্যাপ থেকে, আমলাদের থেকে, আইনজীবী শ্রেণী থেকে, সেনাবাহিনী থেকে, আনুপাতিকহারে গভর্নর ও সম্পাদক নিয়েগ করার পেছনরে কারণ ছিল সার্বিকভাবে গোটা শাসক নেতৃশ্রণীটার কাছে তাঁর শাসনটা গ্রহণযোগ্য করে তোলা।
ব্যবহারিক দিক দিয়েও তিনি রাজার মতই আচরন করে যাচ্ছিলেন। তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দের কেউ তাঁর সামনে টু-শব্দটি উচ্চারণ করতে সাহস পেতেন না। তাঁকে বুদ্ধি পরামর্শ দিতে পারে মত কেউ ছিলেন না। তিনি যদি কখনো মন্ত্রিসভার সদস্যদের ডাকার প্রয়োজন মনে করতেন, ডাকতেন। এ কারণে যে তাঁর নিজস্ব পরিবারটিকে কেন্দ্র করে একটি রাজপরিবারের ছবি ক্রমশ লক্ষ্যগোচর হয়ে উঠেছিল। তাঁর ছেলে, তাঁর ভাগ্নে, ভগ্নিপতি, ভাই সকলে সত্যি সত্যি দুধের সরের মত বাংলাদেশের শাসকশ্রণীর পুরোভাগে ভেসে উঠেছিলেন। বাকি ছিল রাজমুকুটটা মস্তকে ধারণ করা এবং রাজউত্তরীয়খানি অঙে চড়িয়ে দেয়া। এই জন্যই তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। নেপোলিয়নের মত বিশ্ববিখ্যাত বীরযোদ্ধাও হাতে প্রভুত ক্ষমতা থাকা স্বত্তেও রাজমুকুটটি নিজে নিজে পরে বসেননি। রোম থেকে পোপকে আসতে হয়েছিল। এই সমস্ত শক্তিধর মানুষেরা শক্তি দিয়ে সব কাজ করো আনলেও শেষের কাজটি করাবার জন্য এমন কাউকে খোঁজ করে আনেন, যাঁর প্রতি মানবসাধারণের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা রয়েছে এবং যা এৈতিহ্যসম্মত।
নেপোলিয়নের যুগ গেছে, পোপের যুগ গেছে। কিন্তু মানুষের অন্তরের আগুন সে রকম আছে। উচ্চাকাঙ্খা উদ্ধত হয়ে এখনো আকাশ ফুঁড়ে ফেলতে চায়। তাই শেখ মুজিবুর রহমান আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন। একক হাতে বেবাক ক্ষমতা তুলে নেয়ার স্বপক্ষে সাসস্বত সমাজের রায় গ্রহণ করবেন। তাছাড়া আরেকটি গোপন অভিলাষ তাঁর মনের কোনে থাকাও বিচিত্র কি। উচ্চশক্ষাভিমানী পন্ডিতম্মন্য লোকেরা যাঁদের তিনি মনে মনে অপরিসীম তাচ্ছিল্য করেন, তাঁরা সকলে একযোগে এসে তাঁর বিরাটত্ব ও মহত্তের সামনে দন্ডবত হবেন। একজন শিক্ষকও যাতে অনুপস্থিত না-থাকতে পারেন এবং একজনও যাতে অর্থহীন নীরিহ একগুঁয়েমীকে আশ্রয় করে কাগুজে বীর হিসেবে পরিচিত না-হতে পারেন আগেভাগে সে ব্যবস্থা করা হয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ সরকারসমর্থক ছাত্রদের যাবতীয় দুর্নীতির আখড়াতে পরিনত হয়েছিল। পাকিস্তানি শাসনামলে সামরিক সরকারের আরোপিত হাজারো বাধা-বিঘ্ন অগ্রাহ্য করে বাঙালি মনীষা পাথরের ভেতর দিয়ে পথ কেটে একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের পানে অগ্রসর হচ্ছিল। কি সংস্কৃতি চর্চায়, কি রাজনৈতিক চেতনার বিকাশে, কি মননশীলতার লাবণ্য সন্চারে পাকিস্তান আমলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে ভুমিকা পালন করেছে তা বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবে। বাংলাভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ, বাংলার জাতীয় জাগরনের প্রথম আন্দোলন, উনিশ শ' উনসত্তরের আইয়ুব বিরোধী বিক্ষোভ, একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধ এ সকল জাতীয় জীবনে অপরিসীম প্রভাববিস্তারী ঘটনাগুলো ঘটিয়ে তোলার উদ্যোগপর্বে নেতৃত্বদান করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। উন্নয়নশীল দেশসমুহের রাজনীতিতে ছাত্ররা অনিবার্যভাবে কোন্ ভুমিকা পালন করে থাকেন শেখ মুজিব তা জানতেন। তিনি নিজেও এরকম ছাত্র আন্দোলনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তাই তাঁকে শুরু থেকেই ছাত্রদের কঠোর নিয়ন্ত্রনে রাখার বিষয়টি অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে ভাবতে হয়েছে।
তিনি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করার কিছুদিন পরই দেখেছেন যে, যে ছা্ত্রপ্রতিষ্ঠানটির পেশল সমর্থন তাঁর একমাত্র রাজনৈতিক মুলধন ছিল সেই ছাত্রলীগকে চোখের সামনে দু'টুকরো হয়ে যেতে, তাঁর ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়া, ছাত্রলীগের অপরাংশের সক্রিয় সহযোগিতার ওপর নির্ভর করে অপর একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেখে তাঁকে নিশ্চয়ই হতবাক করে থাকবে। উনিশ শ' তিয়াত্তর সালের পয়লা জানুয়ারির ঘটনা। ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিবাদ করে বাংলাদেশের ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যকেন্দ্রের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করলে পুলিশ বিক্ষোভকারী ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষন করে। ফলে একজন ছাত্র ঘটনাস্থলে নিহত হয়, কয়েকজন মারাত্বকভাবে আহত হয়। তার প্রতিবাদে ছাত্র ইউনিয়ন সমস্ত ঢাকা শহরে প্রতিবাদ সভা এবং মিছিলের আয়োজন করে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যাকারী আখ্যায় ভুষিত করে। সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চালিত 'ন্যাপ' এবং 'বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি'র সমর্থক ইউনিয়নের দখলে ছিল। তাঁর এই গুলিবর্ষনের প্রতিবাদস্বরুপ বিক্ষুদ্ধ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা ছাত্রসংসদের খাতায় যে পৃষ্ঠাটিতে শেখ মুজিবুর রহমান কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের আজীবন সদস্য হিসেবে সাক্ষর করেছিলেন সেই পৃষ্ঠাটিকে ছিড়েঁ ফেলে। অথচ এই ছাত্র ইউনিয়নই পদে পদে শেখ মুজিবুর রহমানকে তাদের মূল রাজনৈতিক দলদু'টোর মত অন্ধভাবে সমর্থনদান করে যাচ্ছিল। নিজের সমর্থক ছাত্ররা যখন এ অভাবনীয় কান্ড ঘটিয়ে তুলতে পারে, বিরোধীদলীয় ছাত্ররা যে প্রতিবাদে কতদূর মারমুখী হতে পারে, একটি সম্যক ধারণা তাঁর হয়েছিল। তাঈ শক্তহাতে বিশ্ববিদ্যালয়সমুহ বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় এবং ছাত্রসমাজকে নিয়ন্ত্রনে রাখার সিদ্ধান্ত্ব তিনি গ্রহণ করেছিলেন।
উনিশ শ' বাহাত্তর সালের পর থেকে প্রকৃত প্রস্তাবে চার পাঁচজন ছা্ত্রই স্টেনগান হাতে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ চালাত। উপাচার্যবৃন্দ এই অস্ত্রধারী ছা্ত্রদের কথাতে উঠতেন, বসতেন। স্বাধীনতার পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্তির দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল, কিন্তু স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যলয়ের বেবাক পরিবেশটাকেই কলুষিত করে তোলা হল। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন চিন্তা, কল্পনা, নিরপেক্ষ গবেষনার পথ একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। সরকার সমর্থক ছা্ত্ররা প্রকাশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করত। দরকারবোধে তারা এগুলো ব্যবহার করতে কোন রকম কুন্ঠা বা সংকোচবোধ করত না। বর্তমানে ঢাকা জেলার জেলা জজের কোর্টে একটি লোমহর্ষক হত্যামামলার বিচার চলছে। সরকার সমর্থক দু'দল ছা্ত্রের মধ্যে মতামতের গরমিল হওয়ায় অবাধে রাতের বেলা অগ্নেয়াস্ত্র ব্যাবহার করে সাতজন সতীর্থকে হত্যা করেছে। আজ থেকে প্রায় একবছর পূর্বে হাজী মুহম্মদ মহসীন ছাত্রাবাসের টিভি কক্ষের সামনেই এই শোকাবহ ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়। সরকারসমর্থক ছাত্ররাই যখন মতামতের গড়মিলের জন্য স্বদলীয় ছাত্রের হাতে এভাবে বেঘোরে প্রাণ হারাতে পারে, সাধারণ ছাত্র এবং শিক্ষকদের অবস্থা কি হতে পারে সহজেই অনুমান করা যায়। সরকারসমর্থক ছাত্রের মত শিক্ষকদেরও একটি বিশেষ অসুবিধা হবার কথা নয়।
উনিশ শ' বাহাত্তর সালের পর থেকে প্রকৃত প্রস্তাবে চার পাঁচজন ছা্ত্রই স্টেনগান হাতে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ চালাত। উপাচার্যবৃন্দ এই অস্ত্রধারী ছা্ত্রদের কথাতে উঠতেন, বসতেন। স্বাধীনতার পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্তির দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল, কিন্তু স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যলয়ের বেবাক পরিবেশটাকেই কলুষিত করে তোলা হল। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন চিন্তা, কল্পনা, নিরপেক্ষ গবেষনার পথ একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। সরকার সমর্থক ছা্ত্ররা প্রকাশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করত। দরকারবোধে তারা এগুলো ব্যবহার করতে কোন রকম কুন্ঠা বা সংকোচবোধ করত না। বর্তমানে ঢাকা জেলার জেলা জজের কোর্টে একটি লোমহর্ষক হত্যামামলার বিচার চলছে। সরকার সমর্থক দু'দল ছা্ত্রের মধ্যে মতামতের গরমিল হওয়ায় অবাধে রাতের বেলা অগ্নেয়াস্ত্র ব্যাবহার করে সাতজন সতীর্থকে হত্যা করেছে। আজ থেকে প্রায় একবছর পূর্বে হাজী মুহম্মদ মহসীন ছাত্রাবাসের টিভি কক্ষের সামনেই এই শোকাবহ ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়। সরকারসমর্থক ছাত্ররাই যখন মতামতের গড়মিলের জন্য স্বদলীয় ছাত্রের হাতে এভাবে বেঘোরে প্রাণ হারাতে পারে, সাধারণ ছাত্র এবং শিক্ষকদের অবস্থা কি হতে পারে সহজেই অনুমান করা যায়। সরকারসমর্থক ছাত্রের মত শিক্ষকদেরও একটি বিশেষ অসুবিধা হবার কথা নয়। এঁদের অনেকে পুর্ব থেকে ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর সেবা করি আসছেন। সুতরাং এই নতুন শাসনামলেও তাঁরা বস্তু-সম্পদের দিক দিয়ে কিন্চিত লাভবান হওয়ার সাধনা করে যাচ্ছিলেন এবং নানাভাবে সরকারসমর্থক ছাত্ররা সক্রিয় সহায়তা দান করে যা্চ্ছিলেন। আর সরকার নিজস্ব প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে অপর কোন মতামত এবং প্রতিষ্ঠান যাতে মাথা তুলতে না-পারে সেজন্য সম্ভাব্য সকল উপায়ে চেষ্টা করে আসছিল। বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি মতামতের লালনক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলতে যেয়ে এমন একটা অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হল, যার সংগে অধিকাংশ শিক্ষক এবং ছাত্র মিলিয়ে নিতে পারলেন না। শেখ মুজিবুর রহমানের রাস্ট্রনৈতিক চিন্তা এবং রাস্ট্রশাসন পদ্ধতিকে মুজিববাদ আখ্যা দিয়ে, তার প্রচার, প্রসার এবং বাস্তবায়নের জন্য সরকারসমর্থক ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়সমুহে এমন একটা সুসংগঠিত অভিযান পরিচালনা করলেন, কোন স্বাধীনচেতা, ন্যায়বান ছাত্র কিংবা শিক্ষক তার সংগে অন্তরের সামান্য সংযোগও অনুভব করতে পারলেন না। এই না-পারার কারণেই সৎ এবং ন্যায়পরায়ন শিক্ষকরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। তাঁরা অপরিসীম মানসিক উৎকন্ঠা নিয়ে শন্কা, ত্রাস এবং ভীতির মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হলেন। অতি শিগ্গির গোটা দেশের তাবত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই মুজিববাদী ছাত্রদের এবং তাঁদের পেছন বুদ্ধি-পরামর্শ যোগানো শিক্ষকদের প্রভাব ঘুর্ণিহাওয়ার মত অপ্রতিরোধ্য বেগে ছড়িয়ে পড়ল।
যে সমস্ত শিক্ষক চরিত্র এবং বিদ্যাবত্তার জন্য ছাত্রদের মধ্যে শ্রদ্ধা এবং সম্মানের আসনে অধিষ্টিত ছিলেন মুশকিল হল তাঁদেরই। তাঁরা তাঁদের পরিবারবর্গ নিয়ে নিতান্ত ভয়ে ভয়েই দিবস রজনী অতিবাহিত করতেন। যে-কোন সময়, যে কোন বিবাদ এসে ঘাড়ে আশ্রয় করতে পারে। সে সময় আমি নিজে বিশ্ববিদ্যালয় কম্পাউন্ডে বাস করেছি। এই সন্ত্রাসজনক পরিস্থিতির ভয়াবহতা কিছু কিছু অনুভব করেছি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার দু'বছর পরেও দেখেছি শিক্ষকরা ফ্ল্যাটে বাইরের দিক থেকে তালা লাগিয়ে রাখতেন। কোন অচেনা লোক খোঁজ-খবর করতে গেলে বাড়ির লোকেরা জবাব দিতেন, তিনি বাসায় নেই।
যে মুষ্টিমেয় ছাত্রদল বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকিছু শক্তহাতে নিয়ন্ত্রন করত সংখ্যায় ছিল তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনরত মোট ছাত্রছাত্রীর এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র। সরকারি পুলিশ সব সময়ে তাদের সাহায্যে মোতায়েন থাকত। ছাত্রাবাসের ভোজনক্ষে খাওয়ার জন্য তাদের কোনো অর্থ দিতে হত না। অধিকন্তু মন্বন্তরের সময় ছা্ত্রাবাসের প্রভোস্ট এবং হাউজ টিউটররে সংগে মিলেমিশে রেশনে পাওয়া চাল, ডাল কালোবাজারে বেচে দিয়ে প্রচুর অর্থ আত্নস্যাত করার সুযোগ তারা পেত। তাছাড়াও সরকারদলীয় লোকদের মধ্যে ব্যাবসা-বাণিজ্য, চাকুরি-বাকরি বন্টন করার বরাদ্দ সুযোগগুলো তো ছিলই।
বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজের ছাত্রসংসদসমূহের নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করত, ভীতি এবং ত্রাসসৃষ্টি করে ছাত্র সাধারণের কাছ থেকে ভোট আদায়ের চেষ্টা করত। তারপরেও যখন দেখা যেত নির্বাচনে তারা শতকরা বিশটি ভোটও লাভ করতে পারেনি এবং পরাজয় অবধারিত, রাতের বেলা আলো নিভিয়ে ভোটের বা্ক্সগুলো লুট করে নিয়ে যেত। তাদের অনুমোদন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছাত্রভর্তি হতে পারত না, ছাত্রাবাসসমূহে থাকবার জায়গা পেত না। শিক্ষকদের নিয়োগ বরখাস্ত অনেকটা তাদের খেয়াল-খুশির উপর নির্ভরশীল ছিল।
শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর একদলীয় শাসন চালু করে দেশে যে নতুন শাসনতান্রিক পদ্ধতি চালু করার কথা ঘোষনা করেছিলেন, তাতে বিশ্ববিদ্যলয়গুলোকেও ক্ষমতার অংশভোগী করে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক শ' পনেরজন সদস্যের মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, জাহান্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যত্রয় এবং বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালিকা ও বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষাকে স্থান দিয়েছিলেন। জাতীয়দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের স্থান দিয়ে সরাসরি বিধিবদ্ধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে সরকারি নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসার আয়োজন সম্পুর্ণ করলেন। অর্থাৎ এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ঘোরপ্যাচ ব্যাতিরেকে প্রত্যক্ষভাবে সরকারি শাসন বলবত করা হবে। পূর্বেকার সরকারসমূহ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃত্ব করতেন বটে, কিন্তু সে পন্থাটি ছিল সম্পুর্ণ স্বাধীন, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। সরকার প্রশাসন কিংবা পরিচালনায় প্রকাশ্যত কোন হস্তক্ষেপ করতেন না। শেখ মুজিবই প্রথম যিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্ষমতার অংশীদার করলেন। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আলাদা অস্তিত্ব, আলাদা আইন-কানুন এগুলোকে তিনি ক্রমে ক্রমে ভেঙে নতুন করে সাজিয়ে, তার মধ্যে সরকারি বিরোধীতার বীজকে উপরে ফেলতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, যে আধুনিক শিক্ষাভিমানী পন্ডিত সমাজ তাঁকে অবগ্জ্জা করেন, তাঁদের অন্তরলালিত অহন্কার চূর্ণ করতে পারবেন। নতুন পদ্ধতিটা এমনভাবে রচনা করা হয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পন্ডিতদেরও তাঁর আাওতার বাইরে থাকার উপায় নেই এবং শেখ মুজিবুর রহমানরে সিংহাসনের পেছনে না দাঁড়িয়ে তাঁদের গত্যান্তর থাকবে না। তৃতী্য়ত, বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের হাতের মুঠোতে পুরে তিনি দেশের মানুষ এবং বিশ্ববাসীর সামনে প্রমাণ করত পারবেন যে তিনি মন্দ অর্থে একনায়ক নন। দেশের কৃষকসমাজ থেকে শুরু করে সারস্বত্ব সমাজ পর্যন্ত তাঁকে এত অনুরোধ উপরোধ করেছেন যে, বাধ্য হয়েই তিনি দেশের কল্যান চান এবং বাংলার মানুষকে ভালবাসেন। সমস্ত দেশের মানুষের সমবেত প্রার্থনা তিনি অগ্রাহ্য করতে পারেনণি।
তাঁর দিক থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ভূল চিন্তা করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্ষমতার অংশ দেয়ার সংগে সংগেই এক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রবীণ উপাচার্য এক পত্রিকার প্রতিনিধির সংগে সাক্ষাতকারে বলেই বসলেন যে শেখ মুজিবুর রহমানের মত এমন একজন বলিষ্ঠ নেতা হাজার বছরে জন্মগ্রহন করেননি। শেখ মুজিবুর রহমান যে বলিষ্ঠ নেতা সে বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি তা প্রকাশ করার জন্য এই সময়কে বেছে নিয়েছিলেন কেন তা অনেকের কাছেই খুব তাৎপর্যপূর্ণবহ মনে হয়েছে। বাস্তবেও তিনি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের নিয়ে কর্মচারীদের কেন্দ্রীয়দলে যোগদানের আবেদনপত্রসহ তাঁদের নিয়ে রাস্ট্রপতির সংগে দেখা করে আসলেন। সেই ছবি কাগজে ফলাও করে প্রকাশিত হল।
এই উপাচার্য ভদ্রলোককে দেশের মানুষ আত্নমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে জানতেন। অতটুকু দাস্যতা তাঁর কাছ থেকে কেউ প্রত্যাশা করেননি। তাঁর এ ধরনের কার্যকলাপের দু'রকম প্রতিক্রিয়া হল। তাঁর মত লোকের পক্ষে তথাকথিত জাতীয়দলের এ ধরনের কান্ডজ্গ্জানহীন তোষামোদ দেখে জ্ঞানীগুণী সমাজের একাংশ চিন্তিত হয়ে উঠলেন, আরেক অংশের প্রতিরোধ ক্ষমতাও দুর্বল হয়ে এল। অন্যদিকে রাস্ট্রপতির সংগে তাঁর দহরম মহরম অন্যান্য উপাচার্য এবং সরকারসমর্থক শিক্ষা-সংস্কৃতির সংগে সংযুক্ত নেতৃ্শ্রনীর মনে ঈর্ষার উদ্রেক করেছিল তাতে সন্দেহ নেই। তিনি যদি রাস্ট্রপতির সংগে অতবেশী মাখামাখি করার সুযোগ আদায় করে ফেলেন, অন্যান্যদের সুযোগ-সুবিধে মাঠে মারা যাবার সম্ভাবনা। তাই অন্যান্যরাও উঠে পড়ে লাগলেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক আবুল ফজল ছাড়া আর সকল উপাচার্যই নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী এবং শিক্ষকদের জাতীয়দলে যোগ দেয়ার জন্য ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছিলেন। এ ব্যাপারে সরকার সমর্থক ছাত্রদল উপাচার্যদের সহায়তা দিয়ে আসছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জাতীয়দলে যোগদান করার জন্য যে জয়ভীতি এবং নানামুখী চাপরে সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তা আমি খুব কাছে থেকে নিজের চোখে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি। প্রতিটি অধ্যক্ষ বিভাগীয় শিক্ষকদের মধ্যে আবেদনপত্র বিলি করেছিলেন এবং সরকারি প্ররোচনায় তরুণতর শিক্ষকদের সই করতে অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য করেছিলেন। অনেক শিক্ষকই স্বত:প্রবৃত্ত হয়ে সই করতে চাননি। কিন্তু হুমকি, ভীতি এবং চাপের মুখে তাঁদের বেশীরভাগই আত্নসমর্পন করতে বাধ্য হলেন। যে সকল শিক্ষক সই করেননি, তাঁদের নাম বাকশাল কেন্দ্রীয় অফিসে পাঠিয়ে দেয়া হল। সরকারসমর্থক ছাত্রদল এই বিদ্রোহী শিক্ষকদের দেশদ্রোহী হিসেবে খুব শিগ্গির ধরে নেয়া হবে বলে হুমকি দিয়ে গুজব ছড়াতে শুরু করল। এই জোর-জুলুম, ভয়-ভীতি, সন্ত্রাসের মধ্যে চৌদ্দই আগস্ট সন্ধ্যাবেলা দেখা গেল মাত্র পনেরজন শিক্ষক জাতীয়দলে সদস্যপদের আবেদন করে সই করেননি। বাকি সকল শিক্ষকদের সই সম্বলিত আবেদনপত্র সংগৃহীত হয়ে গেছে। আগামীকাল যখন রাস্ট্রপতি আসবেন, তখন প্রায় হাজারখানেক শিক্ষকের আবেদনপত্র তাঁর সকাশে দাখেল করা হবে। তিনি শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভাষন দেবেন এবং তাঁদের কাছে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি একনিষ্ঠ সমর্থনের প্রতিশ্রুতি চাইবেন এবং শিক্ষকরাও হাত তুলে তিনি যা বলবেন তার প্রতি সমর্থন জানাতে বাধ্যা হবেন। এই পর্যন্ত সকলে তাই করছেন।
বাংলাদেশের আগ্নেয়আত্নার জ্বালামুখ বলে কথিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় চিন্তা, ভাবনা, বুদ্ধি এবং মননশীলতার নেতৃত্বদানকারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোন শক্তিধর মানুষকে যা দেয়নি শেখ মুজিবুর রহমানকে সেই অকুন্ঠ আনুগত্য স্বেচ্ছায় প্রদান করবে। গোটা দেশের মানুষ অবাক বিস্ময়ে এই দৃশ্য দেখার জন্য বেদনাহত চিত্তে প্রতীক্ষা করছিল। রাস্ট্রপতির বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন উপলক্ষে জাতীয় দৈনিকগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করছিল। রেডিও ঘনঘন সংবাদ দিচ্ছিল। টেলিভিষনে উপাচার্যের বিশেষ সাক্ষ্যাৎকার দেখানো হচ্ছিল। এ উপলক্ষে কি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়কে কিভাবে সাজানো গোছানো হয়েছে আনুপূর্বিক সমস্ত বিবরণ রেডিও, টেলিভিষন প্রচার করছিল। এই দিনটিকে ভাবগম্ভীর, পবিত্র এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণরুপে দেশের মানুষরে দৃষ্টিতে চিত্রিত করার জন্য পূর্ণপ্রয়াস গ্রহণ করা হয়েছিল। সরকারি প্রচারণার ধরণটা এমন ছিল যে-কোন রকমের বাধ্যবাধকতা ছাড়া স্বত:স্ফুর্তভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে এই এৈতিহাসিক সংবর্ধনা প্রদাণ করছে। পূর্বের একনায়করা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে যে রকম ছা্ত্রদের পূণ্জীভূত ক্ষোভ, আক্রোশ কোন না কোনো পথে ফেটে পড়ে, খুন, জখম, রক্তারক্তি কান্ড অবধারিত ঘটে যেত এবার সে সবের কোন লক্ষণ নেই। তিনি তো আর ওৌপনিবেশিক শাসনকর্তা নন, তিনি স্বয়ং বাঙালি জাতির পিতা। সুতরাং তিনি বিশ্ববিদ্যলয়ে আগমন করছেন, তার জন্য কেন বিক্ষোভ এবং অশান্তি হবে। বরন্চ এই মহানায়ককে আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা তাঁদের মধ্যে পাবেন এ আনন্দে সকলে বিভোর হয়ে আছেন। আগামীকাল উনিশ শ'পচাঁত্তর সালের পনেরই আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের একটি স্মরণী্য় দিন হয়ে বিরাজ করবে।
চোদ্দই আগস্ট সন্ধের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। শুনলাম কার্জন হলে এবং লাইব্রেরিতে বোমা ফুটেছে। পরিবেশটা থমথমে হয়ে এসেছে। উৎসবমুখর পরিবেশ হঠাৎ যেন কেমন থিতিয়ে এসেছে। মিনিটে মিনিটে পুলিশের গাড়ি টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। সকলের চোখেমুখে আশংকা। ছাত্রদের সিংহভাগ যাঁরা এই সুবিশাল এলাহিকান্ডের নীরব নিরুপায় দর্শক ছিলেন, তাদের মনের গতিটা অনুসরন করতে চেষ্টা করলাম। তাঁদের চোখমুখ দেখে মনে হল এ রকম একটা অভাবনীয় কান্ড ঘটায় সকলে যেন মনের গভীরে খুশি হয়েছে। হাতে পায়ে শেকল, শেকলের পর শেকল পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বারুদ এবং আগুনের ভাষায় শেষ পর্যন্ত আসন্ন মূহূর্তটিতেই কথা কয়েছে। অর্থাৎ কোন স্বেচ্ছাচারীকেই এই পবিত্র বিদ্যাপীঠ কোনদিন অতীতে বরন করেনি এবং ভবিষ্যতেও বরণ করতে প্রস্তুত নয়।
কথাগুলো ভেবে নিয়েছিলাম আমি। মনের ভেতর একটা ভয়ার্ত আশংকাও দুলে উঠেছিল। দুয়েকটা বোমা ফুটেছে এই ভয়ে শেখ মুজিবুর রহমান আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা স্থগিত রাখবেন তিনি তেমন মানুষ নন। তুনি নিশ্চিতভাবেই আসবেনই। অপার শক্তিবলে মুখরা নগরীর স্পর্ধিত জিহ্বা যিনি স্তব্ধ করে দিয়েছেন, দুয়েকা বোমা ফুটলে কি তিনি সেই ভয়ে ঘরের কোনে চুপটি করে ভেজাবেড়ালের মত বসে থাকবেন? তাঁর প্রতি সবচেয়ে বিরুপ শ্রেণীটি আগামীকাল সকালে সদলবলে নতমস্তকে বসে থাকবেন? নাটকের এই রোমান্চকর দৃশ্যে তিনি কি করে অনুপস্থিত থাকতে পারেন? হয়ত আরো বোমা ফুটবে। পুলিশ ছাত্রাবাসসমুহের কক্ষে কক্ষে খানাতল্লাসী চালাবে, সন্দেহজনক কিছু ছাত্রদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। কিন্তু তাঁর আসা বন্ধ হবে না।
রাতে হেটে ফিরছিলাম সাতাশ নম্বর সড়কের দিকে। মনে মনে এসব কথা তোলপাড় করছিল ভয়ংকরভাবে। শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘবাহু প্রসারিত করে সমস্ত দেশটাকে কঠিণ আলিংগনে আবদ্ধ করছেন, যা কিছু বাধা দিচ্ছে, প্রতিবাদ করছে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোন কথা নেই, কোনো বাধা নেই। বাংলাদেশের কন্ঠ একটি, সেটি শেখ মুজিবুর রহমানের ---- মানুষ ওই একজন, তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। ভয়ে দুরুদুরু করছিল বুক। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পনেরজন সই করেননি, তাঁদের অনেকেই আমার চেনাজানা বন্ধু-বান্ধব। তাঁদের অবস্থার কথা চিন্তা করছিলাম। তাঁদের কি হবে? তাঁদের কি চাকরি চলে যাবে? তাঁরা কি খাবেন? এই বাজারে বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে কিভাবে জীবনধারন করবেণ? তাঁদের কি পুলিশে তুলে নিয়ে যাবে? কি হতে পারে এই রাজদ্রোহিতার পুরষ্কার?
ভয়ন্কর চাপ অনুভব করছিলাম। একা একা হাঁটছিলাম। ভয়ানক একা বোধ করছিলাম। চারপাশের লোকজনের কারো সংগে আমার সম্পর্ক নেই, যেন কোনকালে ছিলও না। একা একা আমি যেন সুড়ংগ পথে বিচরন করছি। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল আমি ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আমি দেখে আসছি, কিভাবে আমার লালিত মূল্যবোধগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। লোভীর লোভ, প্রবলের অন্যায়কে এমনভাবে রুপ ধরে জেগে উঠতে আমি কোনোদিন দেখিনি। এত অশ্রুতে ভেজা, এতা গাঢ়রক্তে রন্জিত আমাদের স্বাধীনতা আমাদেরকে এমনভাবে প্রতারিত করছে প্রতিদিন, সে কথা কার কাছে যেয়ে বোঝাই। যাদেরকে মনের কথা ব্যক্ত করতে যাব, তাঁদের অবস্থাও আমার মত। এ কেমন স্বাধীনতা, যে স্বাধীনতা আমাদের গোটা জাতীটাকে সম্পূর্ন ভিখিরীতে পরিণত করে? এমন স্বাধীনতা যে স্বাধীনতায় আমরা একটা কথাও বলতে পারব না। চোখের সামনে সত্য মিথ্যের আকার নিচ্ছে। জলজ্যান্ত মিথ্যে নধর তাজা সত্যি হিসেবে এসে প্রতিদিন হাজির হচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের গোটা জাতিটাকে নিয়ে কি করতে চান? তাঁর কথায় কথায় উঠে বসে এ জাতির তো আর কোনোকিছুই অবশিষ্ট নেই। এত অ্ত্যাচার দেখেছি, এত জমাট দু:খ দেখেছি, এত কাপুরুষতা দেখেছি এ জাতি আর মানুষের পর্যায়ে নেই। ক্রমশ পশুর নিচে চলে যাচ্ছি আমরা। দুর্নীতির জাতীয়করন করে সমাজজীবনের প্রতিটি স্তর তিনি বিষিয়ে তুলেছেন। এই জাতীর যা কিছু গভীর, যা কিছু পবিত্র, উজ্জ্বল এবং গরীয়ান বিগত তিন বছরে সমস্ত কিছু কলুষিত করে ফেলতে পেরেছেন।
তাঁর বাহিনী অশ্বমেধ যগ্জ্জের মত যদিকেই গেছে সবকিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে ফেলেছে। শেষমেষ ছিল আমাদের একটা বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা ভাবতে শিখেছি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ই স্বাধীনতা, শান্তি, কল্যাণ, প্রগতি, সাম্য এবং হরিৎবরণ আশা-আকাঙ্খার লালনক্ষেত্র। এইখানে এই বিশ্ববি্দ্যালয়ে এমন এক শন্কাহীন স্বাধীনতা নিবাস করেন, বিরাজ করেন এমন এক সুস্থশালীনতা আমাদের জ্ঞানদায়িনী মা বিশ্ববিদ্যায়ের অঙে অঙে এমন এক প্রসন্ন পবিত্রতার স্রোত প্রবাহিত হয়, কোন রাজন্য, কোন সমরনায়ক, কোন শক্তিদর্শী মানুষ কোনদিন তা স্থুল হস্তের অবলেপে কলন্কিত করতে পারেনি। আকাশের মত উদার, বাতাসের মত নির্ভর, অনির্বার ঝর্নার উৎসের মত স্বচ্ছ এবং সুনির্মল স্বত:স্ফুর্ত স্বাধীনতা এইখানে প্রতিদিন, প্রতিদিন বসন্তের নতুন মুকুলের আবেগে অন্কুরিত হয়।এই অন্কুঠিত স্বাধীনতার পরশমনির ছোঁয়ায় প্রতিটি আপদকালে এই জাতি বারেবারে নবীন হয়ে ওঠে। এর প্রতিষ্ঠাকালের পর থেকে আমাদের জন্মভুমির ওপর দিয়ে কতই না ঝড় বয়ে গেছে। কতবার ঘোড়ার খুরে, বন্দুকের আওয়াজে কেঁপে উঠেছে আকাশ, গর্বিত মিলিটারির বুটের সদম্ভ পদবিক্ষেপে চমকে উঠেছে রাত্রির হৃদয়। কত শাসক এল, কত মানুষ প্রাণ দিল। আমাদের এই ধৈর্যশীলা জ্ঞানদায়িনী মা সংহত মর্যাদার শক্তি, সাহস, বলবীর্য সবকিছু ফুরিয়ে যাবার পরেও শিখিয়েছে কি করে প্রতীক্ষা করতে হয়। নীরব ভাষায় মৌন আকাশের কানে কানে বারেবারে জানতে চেয়ে গেছে শক্তি, ক্ষমতা, দম্ভ এসবের পরিণতি কোথায়? ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অতন্রপ্রহরীর দল, তারা কোথায়? কোথায় মি. জিন্না, কোথায় নাজিমুদ্দিন, কোথায় নুরুল আমিন? জেনারেল আইয়ুব খান, আবদুল মোনেম খান, ইয়াহিয়া খান এই সমস্ত শক্তিদর্পী মানুষেরা আজ কোথায়? তাঁরা যে আতন্ক, যে ঘৃণা, যে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে এ দেশের জনপদবাসীর জীবনধারায় ঘুর্ণিঝড়ের সুচনা করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কি আপন সন্তানদের তার আর্তি থেকে বেরিয়ে আসার প্রেরনা দেয়নি?
20-09-1975
আহমদ ছফা
মুজিবের শাসন: একজন লেখকের অনুভব - আহমদ ছফা
চোদ্দই আগস্টের রাতে আমি নতুন ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার সাতাশ
নম্বর সড়কের একটি হোস্টেলে এক বন্ধুর সংগে ঘুমাতে গিয়েছিলাম। সাতাশ নম্বর আর বত্রিশ নম্বর সড়কের ব্যবধান বড় জোড় তিন থেকে চার'শ গজ। এই বত্রিশ নম্বরেই দারাপুত্র পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন বাংলাদেশের রাস্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান।
আনুমানিক রাত এগারোটা হবে হয়ত। বত্রিশ নম্বর পেরোবার সময় খাকি পোষাক পরা আট দশজন পুলিশ দেখলাম। কয়েকজন অফিসার, বাকিরা সেপাই। বন্দুক উঁচিয়ে রাস্ট্রপতির বাসভবনের সামনের সড়কের মুখে পাহারারত।
এই পথে বেশ ক'দিন থেকে যাওয়া আশা করছি। প্রায়ই দেখতাম ঘুণটি ঘরে দু'জন থেকে তিনজন সেপাই দাঁড়িয়ে। কোন অফিসার দেখেছি মনে পড়ে না। আজ পাহারাদারদের দল ভারি দেখেও মনে কোন ভাবান্তর আসেনি।
আগামিকাল পনেরোই আগস্ট বেলা দশটার দিকে রাস্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এককালের বাংলাদেশের আগ্নেয়আত্মার জ্বালামুখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানিত অতিথি হিসেবে আগমন করছেন। হয়ত সেজন্য এই অধিকসংখ্যক সেপাই-সান্ত্রীর আনাগোনা। এখন পর্যন্ত সবকিছু পুর্ব-নির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুসারে ঘটে আসছে। কোথাও কোনো ঝঞ্জাট ঘটেনি।
শেখ মুজিবুর রহমানের আগমনোপলোক্ষে বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে ছড়ানো-ছিটানো বিশ্ববিদ্যালয়ে চলেছে সাজানো গোছানোর পালা। রাস্তার এবড়ো-থেবড়ো গর্তগুলোতে সুরকি পড়েছে। রোলার ঘুরছে, পীচের আস্তরণ বসেছে। গত এক পক্সকাল ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে, কলভবনে, বাণিজ্যভবনে, বিজ্জানভবনে জোর মেরামতির কাজ চলছে। অনেকদিন অনাদরে মৃত জন্তুর কন্কালের মত দাঁড়িয়ে থাকা ন্যাড়ামুড়ো দেয়ালগুলো চুণ, সুরকির প্রসাধন স্পর্শে হেসে উঠেছে। সমস্ত এলাকাটায় একটা সাজ সাজ রব, তাড়াহুড়ো ব্যস্ততা এসব তো আছেই।
রাতের আঁধারে শক্তহাতে আলকাতরা দিয়ে দাবড়া করে লেখা শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারকে চ্যালেন্জ করা দেয়াল লিখনসমূহ নবীন চুনের প্রলেপের তলায় ঢাকা পড়েছে। সুন্দরীর ললাটের সিন্দুর বিন্দুর মত বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সুউচ্চ শুভ্র প্রাচীরের কপোলদেশে শিল্পীর নিপুণ তুলিতে লেখা সুন্দর সুন্দর লিখনমালা দৃস্টিকে দূর থেকে টেনে নিয়ে যা্য়। শেখ মুজিব বন্গবন্ধু, বাঙালি জাতির ত্রানকর্তা, সমাজতান্রিক সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের মহানায়ক, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার লৌহমানব ইত্যাদি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন, তাই বিশ্ববিদ্যালয় নানান রঙের চিত্রলেখায় সেজে সুন্দর হয়ে উঠেছে। চারদিকে একটা উৎসবের হাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়াঢাকা কালো কালো সাপের শরীরের মত চেকন বাঁকা রাস্তাগুলোর মোড়ে মোড়ে উল্লসিত অভিনন্দন বুকে ধারন করে রাতারাতি ঝাঁক বেঁধে দাঁড়িয়ে গেছে নানান রঙের প্ল্যাকার্ড। তোরণরাজি মাথা তুলেছে। সর্বত্র একটা উৎকন্ঠার ভাব। আগামীকাল কাঁটায় কাঁটায় বেলা দশটায় তিনি আসছেন।
প্রায় এক পক্ষকাল ধরে দিনে রাতে কাজ চলছে। উপাচার্যের আহার নেই, নিদ্রা নেই। সাড়ে সাত লক্ষ টাকা নগদে বলিয়ে দিয়েও মনে মনে তিনি সস্তিবোধ করতে পারছেন না। দৈবাৎ যদি কোন ত্রুটি থেকে যায়, আর সেখানেই যদি মহামানবের দৃস্টি আটকে যায়, তিনি মুখ দেখাবেন কেমন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাস্ট্রপতির এটা প্রথম আনুষ্ঠানিক আগমন। তিনি শুধু রাস্ট্রপতি নন, বাঙালি জাতির পিতা, মুক্তিদাতা, বাংলার হাটের মানুষ, ঘাটের মানুষ, মাঠের মানুষের বন্ধু বন্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সরকার সমর্থক ছাত্রদলটির হোমরা-চোমরা কর্মীদেরও বেশ ব্যস্তদিন কাটছে। তারা দিবসে কাজের তদারক করে, রজনীতে পাহারায় থাকে। বাংলাদেশে দুস্ট লোকের অভাব নেই। রাস্ট্রপতির আগমনের সন্গে সম্পুর্ণ সংগতিহীন অলুক্ষণে কোন দেয়াল লিখন লিখে যেতে পারে, অনেক অর্থব্যয়ের শ্রমের শিল্পকর্মগুলোর অংগহানি ঘটাতে পারে, সুন্দর চিত্রলেখাসমুহের লাবণ্যহানি করতে পারে, এরকম কিছু ঘটা অস্বাভাবিক নয়। তাই আগেভাগেই এই শতর্কতামুলক ব্যবস্থা।
পুরো দায়িত্বটা রাস্ট্রপতির জ্যেস্ঠপুত্র শেখ কামাল গ্রহণ করেছেন। তিনি তাঁর দীর্ঘ দেহ এবং বাহু বিশিস্ট বন্ধুদের নিয়ে অবিরাম চরকার মত ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের গোঁড়া সমর্থক ছাত্র এবং শিক্ষকদের মনোভংগিটা এরকম যে, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে চরণ ফেলামত্রই বাংলাদেশে একটি অভিনব যুগের অভ্যুদয় ঘটবে।
শেখ মুজিবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ে আগমটা ছিল কৌশলগত দিক দিয়ে তাঁর নতুন শাসনতান্ত্রিক বিধি চালু করার পথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। উনিশ শ' পচাঁত্তর সাল শুরুর দিকে তিনি বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক কার্যকলাপ একেবারে নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছেন। বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের বেশকিছুকে জেলে ভরেছেন। তাঁর একনায়কত্বের প্রতিস্পর্ধী তরুণ বয়স্ক রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মীদের খুশীমাফিক হত্যা করেছেন এবং সে কথা বলে প্রকাশ্যে গর্ববোধ করতেও তাঁকে দেখা গেছে।
প্রধানমন্রির স্থলে সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন রাস্ট্রপতি হয়ে বসেছেন। তাঁর নিজের দল আওয়ামী লীগ অন্য দুটো সমর্থক দল বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চালিত ন্যাশনাল আওয়মী পার্টির কেউ কোনো ওজর আপত্তি উত্থাপন করেননি। বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার সংগে জড়িত এই তিনটি দলের প্রত্যেকটিরই টিকে থাকার জন্য শেখ মুজিবের ছত্রছায়ায় দাঁড়ানোর ছিল একেবারে অপরিহার্য। মুজিব থাকলে তাঁরা সবাই আছেন, তিনি নেই তো কেউ নেই। তাই তাঁদের কারো পক্ষে এই জননন্দিত অধিনায়কের কোনো সিদ্ধান্তকে দলীয় কিংবা আন্ত:দলীয় শৃংখলা প্রয়োগ করে রাশ টেনে ধরা অসম্ভব ছিল।
প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়েই তিনি তাঁর প্রতি সমর্থনবিমুখ পত্র-পত্রিকাসমুহের মুখ প্রায় বন্ধ করে নিয়ে আসছিলেন। বিরোধী পত্রিকাগুলোতে সরকারি বিজ্গ্জাপন বন্ধ করে দিয়ে, সাংবাদিকদের গ্রফতার করে, সম্পাদকদের জেলে পুরে, ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করে ইত্যাদি নানা ছলছুতোর সাহায্যে অনেকগুলো দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং পাক্ষিক পত্রিকার প্রকাশ সাফল্যজনকভাবে বন্ধ করে দিতে পেরেছিলেন। এই চরম মার হজম করেও যে গুটিকয়েক পত্রিকা প্রাণ নিয়ে কোনোরকমে বেঁচেছিল, সগুলোর বিরুদ্ধে কোন রকমের অভিযোগহীনতাকেই অভিযোগ হিসেবে দাঁড় করিয়ে সরকারি ক্ষমতা প্রয়োগ করে বন্ধ করে দিলেন।
তারপরে বাংলাদেশে শেখ মুজিবের বিরোধী কোন দলের মালিকানাধীন কোন পত্রিকা ছিলনা। ব্যক্তি মালিকানাধীন পত্রপত্রিকার সংখ্যাও ছিল একেবারে অল্প। শেখ সাহেবের নিজের দল আওয়ামী লীগ এবং তাঁর সমর্থক দুটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি ও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চালিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এই তিনটি রাজনৈতিক দলকে তিনি অংগুলি হেলনে সামনে পেছনে ডাইনে বাঁয়ে যেদিকে ইচ্ছে পরিচালনা করতেন। এই দলগুলোর ঘোষিত রাজনৈতিক দর্শন যা-ই হোক না কেন, কার্যত তাঁরা শেখ মুজিবুর রহমানের সব রকম নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। অংগদলসমুহের পরামর্শে নাকি নিজের বিবেচনা অনুসারে তা বলা খুব মুশকিল। তিনি সরকারি দলটি এবং সরকারের অন্ধ সমর্থক দল দুটোকে ভেংগে একটি মাত্র জাতীয় দল গঠন করার সিদ্ধান্ত ঘোষনা করলেন। আর নতুন জাতীয় দলের নামকরন করলেন, "বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ" সংক্ষেপে বাকশাল। বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষনার পরে তখন পর্যন্ত যে কয়টি ব্যক্তি বা দলীয় মালিকানাধীন পত্রিকা বাংলাদেশ সরকারের সংগে আপোস রফা করে বেঁচেছিল, সগুলোকে পুরোপুরি সরকারি আওতায় নিয়ে আসার জন্য তিনি সুদীর্ঘ বাহু প্রসারিত করলেন।
বাংলাদেশে ব্যাক্তি বা দলীয় মালিকানাধীন দৈনিক, সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকার সংখ্যা ছিল একেবারে স্বল্প। অনেকগুলোই সরকারি কোপানলে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে। আইয়ুব আমলে প্রত্যক্ষভাবে সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকার সংখ্যা ছিল মাত্র দুটি। একটি বাংলা, অন্যটি ইংরেজি। বাংলা পত্রিকাটির নাম ছিল "দৈনিক পাকিস্তান"। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর "দৈনিক বাংলা" নামে আত্মপ্রকাশ করে। ইংরেজি পত্রিকাটির নাম ছিল "মর্নিং নিউজ"। এ দুটি পত্রিকা ছাড়া স্বাধীনতার পর সরকারের প্রত্যক্ষ এখতিয়ারে আরো তিনটি পত্রিকা চলে আসে। তার দুটি দৈনিকের মধ্যে একটি বাংলা এবং একটি সাপ্তাহিক চলচ্চিত্র পত্রিকা। ইংরেজি দৈনিকটির পাকিস্তান নাম ছিল, "পাকিস্তান অবজারভার"। স্বাধীনতার পর "বাংলাদেশ অবজারভার" নাম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলা কাগজটি আগে থেকেই "দৈনিক পূর্বদেশ" নামেই পরিচিত ছিল এবং চলচ্চিত্র পত্রিকাটির নাম ছিল "চিত্রালী"। এই পত্রিকা তিনটির মালিক জনাব হামিদুল হক চৌধুরী যিনি ন'মাসের স্বাধীনতা যু্দ্ধের সময়ে দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যদের কার্যকলাপ সমর্থন করেছেন এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্থনের পূ্র্বে পাকিস্তানে আশ্রয়গ্রহন করেছিলেন। তাই পরিত্যাক্ত সম্পত্তি হিসেবে পত্রিকা তিনটির প্রকাশনার দায়িত্ব সরাসরি সরকারকেই গ্রহণ করতে হয়েছিল।
শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে বাংলাদেশ যুব আওয়ামী লীগ প্রসিডিয়ামের সভাপতি কেন্দ্রীয় বাকশালের অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা এবং রাস্ট্রপতির বুদ্ধিবিবেচনার একমাত্র ভরসা বলে কথিত জনাব শেখ ফজলুল হক মনি স্বাধীনতার পরে একেবারে শূন্যাবস্থা থেকেই তিন তিনটি পত্রিকার জন্মদান করেছিলেন। একটি ছিল বাংলাদেশের বিচারে ইর্ষাযোগ্য মানের অধিকারী ইংরেজি দৈনিক, নাম "বাংলাদেশ টাইমস", বাংলা দৈনিকটির নাম "বাংলার বাণী" এবং চলচ্চিত্র পত্রিকাটির "সিনেমা" নামে পরিচিত ছিল। স্বাধীনতার পূর্বে তিনি স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় সাব এডিটরের কাজ করতেন। শেখ মুজিবুর রহমানের তিন বছরের শাসনকালে জনাব শেখ ফজলুল হক মনির মত অনেকেই এরকম সামান্য অবস্থা থেকে অকল্পনীয় অর্থ-সম্পদের মালিক হতে পেরেছেন। অবশ্য তাদের বেশিরভাগেরই রাজনৈতিক উচ্চাকাংখা ছিলা না বলে টাকা-পয়সাকে এমন সুন্দর লাভজনকভাবে বিনিয়োগ করতে পারেননি। ওপরে বর্ণিত তিনটি বাংলা এবং তিনটি দৈনিকের প্রত্যেকটিই সরকার সমর্থন করে যেত। এই সমর্থন অনেক সময় এতো দাসোচিত এবং অমার্জিত রুপ গ্রহণ করত যে, রুচিবান মানুষদের পিড়িত না করে ছাড়ত না। এই সকল পত্রিকার সম্পাদক এবং সাংবাদিকেরা সরকারের সুনজরে পড়ার জন্য তোষামোদ এবং তোয়াজে কে কার চাইতে অধিকদুর যেতে পারেন সেজন্য রীতিমত প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতেন। যদিও সেসব লেখা পাঠ করে বিবমিষা ছাড়া নিরপেক্ষ পাঠকের মনে আর কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারত না।
রাজধানী ঢাকা থেকে তখন প্রকাশিত উল্লিখিত ছয়টি দৈনিক পত্রিকা ছাড়া আরো কয়েকটি পত্রিকা তখোনো ছিল। তার মধ্যে জনপ্রিয়তায় যেটি সবগুলোকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, সে পত্রিকার নাম "দৈনিক ইত্তেফাক"। এই পত্রিকাটির সংগে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নানা উত্থান-পতন ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। আওয়ামী লীগের প্রথম সভাপতি মওলানা ভাসানী এই কাগজটির প্রতিষ্ঠাতা হলেও প্রখ্যাত সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন ওরফে মানিক মিয়া ছিলেন পত্রিকাটির মালিক এবং সম্পাদক। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রাতিম্বিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী তফাজ্জল হোসেন সাহেব নিজেও ছিলেন একজন আওয়ামী লীগার, শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ঘনিষ্ঠ সহচর এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর পরামর্শ-বুদ্ধি-বিবেচনা আওয়ামী লীগ মহলে অপরিসীম মর্যাদা এবং গুরুত্বসহকারে গৃহীত হত। জন্মের শুরু থেকেই এই পত্রিকাটি আওয়ামী লীগকে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন দান করে আসছিল। উনিশ শ' পয়ষট্টি সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবিকে তৎকলীন পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় করার পেছনে শেখ মুজিবুর রহমান যে ভুমিকা পালন করেছিলেন, "ইত্তেফাক" পত্রিকা এবং সম্পাদক তফাজ্জল হোসেনের অনন্য সাংবাদিকতার প্রতিভা তাঁর চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেননি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন আন্দোলনের প্রতি জোরাল সমর্থন প্রকাশ করার অভিযোগে আই্য়ুব খান সরকারের গভর্নর মোনেম খান পত্রিকাটির প্রকাশ বন্দ্ধ করেছিলেন এবং ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিলেন। উনিশ শ' উনসত্তর সালের আইয়ুব বিরোধী অভ্যুত্থানের সময়ে প্রবল জনমতের চাপে সাময়িক সরকারকে বাধ্য হয়ে এই পত্রিকাটির ওপর থেকে নিষিধাগ্জা প্রত্যহার করে নিতে হয়। "ইত্তেফাক" যেসব সময়ে আওয়ামী লীগকে অকুন্ঠ সমর্থন করে আসছিল ইত্তেফাকের ভুমিকাটি অতটা মর্যাদাবিবর্জিত ছিলনা। এই কাগজে মাঝে মাঝে গণতান্রিক মূল্যবোধের প্রশ্নটি তুলে ধরার চেষ্টা করত। ব্যক্তিস্বাধীনতা, আইনের শাসন, নাগরিক অধিকার ইত্যাদির সপক্ষে কখনো-সখনো, দু'চার কথা নরমে-গরমে সাহস করে লিখে বসত। "ইত্তেফাক" ছাড়া অপর প্রাচীন দৈনিক পত্রিকাটির নাম "আজাদ"। পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা, মুসলিম লীগের পুরোধা, কৃতবিদ্য পন্ডিত এবং এক সময়ের বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের নাম করা সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক মওলানা আকরম খাঁ ছিলেন এই প্রাচীনতম পত্রিকাটির প্রতিস্ঠাতা সরকার ঘেঁষা। বাংলাভাষা আন্দোলন ছাড়া তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং কেন্দ্রের মধ্যে স্বার্থ-সংস্লিষ্ট ব্যাপারে যখনই বিরোধ উপস্হিত হত সব সময়েই কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থন করত। মওলানা আকরম খাঁ যতদিন বেঁচে ছিলেন এই সুচিহ্নিত ভুমিকা "আজাদ" পত্রিকা অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করেছে। মাওলানা সাহেবের মৃত্যুর পর আজাদের প্রাক্তন ভুমিকার অনেক পরিবর্তন ঘটলেও পত্রিকা হিসেবে পূর্বের জনপ্রিয়তা হারিয়ে বসেছিল। পরিচালনার ত্রুটিই সম্ভবত এর মুখ্য কারণ। স্বাধীন বাংলাদেশে কোন রকমের ধারদেনা করে আজাদ পত্রিকার দিন চলছিল। সরকারের বিরোধিতা করার তো প্রশ্নই ওঠেনা। মাঝখানে একবার সরকার পত্রিকাটিকে নিয়েও গিয়েছিলেন।
মোজাফফর আহমদের বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পত্রিকাটির নাম "সংবাদ"। এই কাগজে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছাড়াও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি সমর্থন জ্জাপন করত। এই দুটি দলই যৌথভাবে ভারত থেকে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে কিম্বা বলা যায় তারও আগে থেকে অধিকাংশ বিষয়ে আওয়ামী লীগকে ছায়ার মত অনুসরন করে আসছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এই পার্থক্য কমতে কমতে একেবারে শুন্যের কোটায় এসে ঠেকেছিল। অধিকন্তু তিনদল মিলেমিশে একদল সৃষ্টির পরে একদলীয় সরকার পদ্ধতির মুখ্য নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের যাবতীয় কার্যকালাপের প্রতি সমর্থন যোগানো পত্রিকাটির একটি নৈতিক কর্তব্যও হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই পত্রিকাটিতেও সরকারি কার্যকলাপের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত হত। স্বাধীনতার পর "জনপদ" নামে আরেকটি বাংলা দৈনিক ঢাকা থেকে আত্মপ্রকাশ করে। আওয়ামী লীগের এককালীন সভাপতি এবং পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভার সদস্য জনাব কামরুজ্জামান ছিলেন পত্রিকাটির নেপথ্য মালিক। এটিও ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক পত্রিকা। "দি পিপল" নামে একটি দৈনিক ইংরেজি পত্রিকা স্বাধীনতা সংগ্রামের কিছুকাল পূর্বে জন্মলাভ করেছিল। জনৈক উঠতি বাঙালী ধনী ছিলেন পত্রিকাটির স্বত্তাধিকারী। উনিশ শ' একাত্তর সালের মার্চর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আগুন লাগিয়ে কাগজটি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতে গাণ্দ্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠানের অর্থানুকুল্যে কাগজটির পুন:প্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশে পুনরায় কাগজটির প্রকাশ ঘটার পর থেকে সব সরকারকেই সমর্থন দান করেছিল। উনিশ শ' একাত্তর সালের পয়লা জানুয়ারি একবার মাত্র সরকারি গুলিবর্ষন করার প্রতিবাদ করে গরম খবর পরিবেশন করেছিল বলে প্রচন্ড হুমকির মুখে ভাল ছেলের মত সুর পাল্টাতে বাধ্য হয়।
উনিশ শ' পচাত্তর সালের শুরুর দিকে বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক কার্যকলাপ একেবারে পুরোপুরি বন্দ্ধ ঘোষনার পরে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সমর্থক পত্রিকা গণকন্ঠের প্রকাশ রুদ্ধ, সম্পাদক দেশের খ্যাতনামা কবি জনাব আল মাহমুদ কারারুদ্ধ এবং ছাপাখানায় তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। এর পূর্বেও "গণকন্ঠ" পত্রিকাটি বন্দ্ধ করার জন্য সরকার নানাধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। পত্রিকাটিতে সরকারি বিজ্জাপন দেয়া হত না, দুয়েকবার ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়েছে। আইনের ফ্যাঁকড়া তুলে মুদ্রণ এবং প্রকাশের পথে কৃত্তিম সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। মাঝখানে একবার বন্দ্ধও করে দেয়া হয়েছিল। সাংবাদিকদের সমবেত দাবির মুখে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ বন্ধ ঘোষনার সাথে সাথে প্রকাশ রহিত হয়ে গেল। গণকন্ঠের পিছু পিছু সরকার বিরোধী দলীয় ইংরেজি "সাপ্তাহিক ওয়েভ" এবং "হলিডে" কিছুদিন পর্যন্ত টিকে থাকে পরেছিল। পরে দুটোকেই বন্ধ করে দেয়া হয় এবং আপত্তিজনক সংবাদ পরিবেশনের দায়ে "হলিডে" সম্পাদক জনাব এনায়েতুল্লাহ খানকে জেলখানায় প্রেরণ করা হয়। জনাব আলী আশরাফ সম্পাদিত বাংলা "সাপ্তাহিক অভিমত" - এরও একই পরিণতি ঘটে।
বিরোধীদল তো ছিলই না। বিরোধীদলীয় পত্রপত্রিকাগুলোকেও নির্মমভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সরকার সমর্থক পত্রিকাসমুহ এবং সরকারের অন্য দুটো অংগদলের মুখপত্রগুলো প্রতিটি স্বৈরাচারী পদক্ষেপকে একেবারে নির্লজ্জভাবে অভিনন্দিত করে যাচ্ছিল। তথাপি শেখ মুজিবুর রহমান একদলীয় শাসন কায়েম করার প্রাক্কালে বাংলাদেশে পত্র-পত্রিকার সংখ্যা একেবারে কমিয়ে এনে গণমতের বাহনগুলোর কর্তৃত্ব নির্ভরযোগ্য হস্তে অর্পণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র চারটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হবে ঠিক হল। দুটি বাংলা এবন দুটি ইংরেজি এবং এটাও ঠিক হল যে বাদ বাকি পত্রিকাসমুহ বন্ধ করে দেয়া হবে। "ইত্তেফাক" কাগজটিকে পুরোপুরিভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসা হল। "ইত্তেফাক" ছাড়া অপর যে বাংলা কাগজটি বেঁচে থাকবে সেটির নাম "দৈনিক বাংলা"। ইংরেজি কাগজ দুটির নাম "বাংলাদেশ অবজারভার" এবং "বাংলাদেশ টাইমস"। এসব পত্রিকাগুলো একেবারে সরকারি পত্রিকা এবং সাংবাদিকেরা সরকারি কর্মচারীরুপে চিহ্নিত হবেন বলে ঘোষনা দেয়া হল।
একসংগে অনেকগুলো পত্রপত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে গোটা দেশের সাংবাদিকবৃন্দ এক ভয়াবহ সংকটে নিপতিত হন। এই নির্মম অর্তসংকটের দিনে সাংবাদিকেরা সবান্ধবে বেকার হয়ে পড়ার ফলে তাঁদের সামনে বেঁচে থাকার দ্বিতীয় কোন পন্থা উম্মুক্ত রইল না। যে চারটি পত্রিকা প্রকাশিত হবার সিদ্ধান্ত পাকাপাকি হয়ে গেছে, সেগুলোতে কোনো রকমে স্থান করে নেয়ার জন্য প্রতিটি সাংবাদিকই মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। এই ধরনের পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের কাছ থেকে এর চেয়ে ভিন্ন কোন আচরন আশাও করা বোধহয় সম্ভব ছিলনা। অবশ্য শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার তাঁদের কর্মসংস্থান করে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতিও দান করেছিলেন এবং সরকার থেকে তাঁরা অল্প-স্বল্প মাইনেও পাচ্ছিলেন। এই অনিশ্চিত শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে সাংবাদিকদের মাথায় যে চিন্তাটা প্রথমে এসেছিল তাতে বাহ্যত দাসোচিত আত্মসমর্পন এবং সুবিধাবাদি চরিত্রের পরিচয় স্পষ্টতভাবে ফুটে উঠলেও বাংলাদেশের পরিস্থিতির বিচারে তাই-ই ছিল একান্ত বাস্তব এবং যুক্তিসংগত। প্রতিটি আলাদা আলাদা পত্রিকার সাংবাদিকেরা ভাবলেন তারা আগেভাগে যদি সরকারি দলে যোগ দেয়ার আবেদনপত্রে সই দিয়ে বসেন, সরকার অনুকম্পা করে তাঁদের কথাটি বিবেচনা করে দেখবেন। এই ধরনের মনোভাবের বশবর্তী হয়ে যাবার বেশ কয়েকদিন পূর্বে "দৈনিক পূর্বদেশ" পত্রিকার সাংবাদিকবৃন্দ সদলবলে বাকশালের কেন্দ্রীয় দফতরে গমন করে সই করা আবেদনপত্রসমুহ জমা দিয়ে এসে মনে করলেন, যা্ক্ নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। এই ঘটনার পর থেকে অন্যান্য চালু এবং বাতিল পত্রিকার কর্রমরত সাংবাদিকদেরও বোধদয় ঘটল। তাঁরা ভাবলেন, পূর্বদেশের সাংবাদিকদের মত তাঁরাও যেয়ে যদি বাকশালের সদস্যপদের আবেদনপত্রে সই না করেন, তাহলে তাদের চাকুরি হবে না এবং চালু পত্রিকায় কর্মরত থাকলে চাকুরিটি টিকবে না। সরকারি পত্রিকায় সরকারিদলের লোকদের কাজ পাবার নৈতিক দাবীই সবচেয়ে বেশী। তারপর থেকে সাংবাদিকেরা দিগ্বিদিক জ্ঙান হারিয়ে দল বেঁধে নিয়মিত বাকশাল অফিসে ধাওয়া করতে থাকলেন। প্রতিটি পত্রিকার সরকারসমর্থক সাংবাদিকেরা উদ্যোগী হয়ে সহযোগী এবং কলাকুশলীদের টেনে নিয়ে জাতীয় দলের অফিসে হাজিরা দিতে আরম্ভ করলেন। রাস্ট্রের তৃতীয় স্তম্ভ বলে কথিত সংবাদপত্রের কারিগরদের একাংশ পেশাগত মর্যাদা, স্বাধীনতাস্পৃহা, সত্য এবং ন্যায় - সাংবাদিকতাবৃত্তির সংগে সংস্লিষ্ট ইত্যাদি মহত অনুষংগসমুহ বাদ দিয়ে যে নাটকের অবতারনা করেছিলেন বাংলাদেশের সমাজে অনতিবিলম্বে তার প্রভাব অনুভুত হতে শুরু করে। অবশ্য সাংবাদিক মাত্রেই যে বাকশালে যোগ দেয়ার জন্য লালায়িত ছিলেন তেমন কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। চাপের মুখে বাকশাল সদস্যপদের আবেদনপত্রে সই করে একজন সাংবাদিককে আমি সত্যি সত্যি নিজের চোখে কাঁদতে দেখেছি। বেশ ক'জন সাংবাদিক ভয়ভীতি অগ্রা হ্য করে শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকতার আদর্শ এবং নীতিতে অটল ছিলেন। "ইত্তেফাক" পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব আসাফউদ্দৌলা রেজা আবেদনপত্রে সই করেননি। এই অভিযোগে সরকারি ব্যবস্থাপনায় "ইত্তেফাক" প্রকাশ পাওয়ার সময় তাঁর চাকরি চলে যায়।
বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সভাপতি ঘোষনা করেছিলেন যে আমলা, কর্মরত সাংবাদিক, স্বায়ত্বশাসিত এবং আধা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানসমুহের কর্মচারীবৃন্দ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক যে কেউ বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সদস্যপদের জন্য আবেদন করতে পারবেন। অবশ্য কাকে সদস্যপদ দেয়া হবে, কাকে হবে না সটি সম্পুর্নভাবে কর্তৃপক্ষের বিবেচনার বিষয়।
যে কেউ ইচ্ছে করলে সরকারি দলে যোগদান করতে পারবে, এটা ছিল সরকারি ঘোষনা। আসলে যোগ না দিলে কারো নিস্তার পাবার উপায় ছিলনা। ভেতরে ভেতরে সমস্ত সরকারি বেসরকারি দফতর স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পত্রিকার সাংবাদিক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক এবং বুদ্ধিজীবীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছিলেন যে, সবাইকে জাতীয়দলে যোগ দেয়ার আবেদনপত্রে সই করতে হবে। কতৃপক্ষ যাকে বিপজ্জনক মনে করেন সদস্যপদ দেবেন না, কিন্তু বাংলাদেশে বাস করে চাকুরি-বাকরি, ব্যাবসা-বানিজ্য করে বেঁচে-বর্তে থাকতে চাইলে জাতীয়দলের সদস্যপদের আবেদনপত্রে সই করতেই হবে। সর্বত্র বাকশালে যোগদান করার একটা হিড়িক পড়ে গেল। শেখ মুজিবুর রহমান যেদিন আনুস্ঠানিকভাবে বাকশালের কেন্দ্রীয় দফতর উদ্বোধন করতে এলেন তাঁকে স্বাগত সম্ভাষন জ্জাপনের উদ্দেশ্যে গোটা দেশের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, শ্রমিক, কৃষক সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে হাজির থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেদিন ছিল মুষলধারে বৃষ্টি। অবিরাম ধারাস্রোতে প্লাবিত হয়ে ভেজা কাকের মত সুদীর্ঘ মানুষের সারি কিভাবে রাস্তায় তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন, যাঁরা এ দৃশ্য দেখেছেন ভুলবেন না। মহিলাদের গাত্রবস্ত্র ভিজে শরীরের সংগে একশা হয়ে গিয়েছিল। এই সুবিশাল জনারন্যে আমাদের দেশের নারীকুলকে লজ্জা-শরম জলান্জলি দিয়ে সশংকিতচিত্তে তাঁর আগমনের প্রতীক্ষা করতে হচ্ছিল।
নাগরিক জীবনের সর্বত্র একটা আতন্কের কৃষছায়া প্রসারিত করে আসছিল। এ ধরনের চিন্তা, বুদ্ধি এবং সাহসরোধী পরিবেশে যেখানে মানুষের বিচার-বুদ্ধি কাজ করে না, বেঁচে থাকা বলতে শুধু বোঝায় কোন রকমে পশু অস্তিত্বের সংরক্ষণ। নৈতিক সাহস, মানবিক মুল্যবোধ ইত্যাকার সুসভ্য জীবনের বোধগুলো বাংলাদেশে সর্বপ্রকারের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। সবখানে আতন্ক, উদ্বেগ। এ তো গেল একদিকের চিত্র। অন্যদিকে গ্রাম-বাংলার মানুষদের অবস্থা দুর্দশার শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দাম প্রতিদিন হু হু করে বাড়ছে। দেশে অভাব, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ক্ষুধার তাড়নায় মা সন্তান বিক্রি করছে। স্বামী স্ত্রীকে পরিত্যাগ করছে। বিনা কাফনে লাশ কবরে নামছে। সৎকারবিহীন অবস্থায় লাশ শৃগাল-কুকুরের আাহার্য হওয়ার জন্য পথে পথে পড়ে থাকছে। চারদিকে জ্বলন্ত বিভীষিকা, চারদিকে হা-অন্ন, হা-অন্ন রব। এই অন্নহীন বস্ত্রহীন মানুষের দংগল একমুঠো ভাত, এক ফোটা ফেনের আশায় ঢাকা শহরে এসে শহরের ফুটপাতে চিৎ হয়ে মরে থাকছে।
একদিকে উদ্ধত উলংগ স্বৈরাচার, অন্যদিকে নির্মম দারিদ্র, বুভুক্ষা এই দুইয়ের মাঝখানে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে অতি কষ্টে, অতি সন্তর্পনে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হচ্ছিল। অর্থনৈতিক অন্তর্দাহের আঁচ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতেও লেগেছে। অনেকগুলো পরিবার মাছ-মাংস স্পর্শ করা বাদ দিতে বাধ্য হয়েছে। কোনো কোনো পরিবারের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যারা দু'বেলা ভাত খেত দু'বেলা আাটা খেয়ে জীবন কাটাচ্ছে। আবার অনেক পরিবারের দু'বেলা আটাও জোটে না।
অথচ শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন ক্ষমতার সংগে যাঁরা যুক্ত তাঁদের সুযোগ-সুবিধের অন্ত নেই। তাঁদের হাতে টাকা, ক্ষমতা সবকিছু যেন স্বাভাবিক নিয়মে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। আইন তাঁদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধির সহায়, সরকারি আমলারা আ্জ্গাবহ মাত্র, সামাজিক সুনীতি, ন্যায়-অন্যায়, নিয়ম-কানুন কোন কিছুর পরোয়া না-করলেও তাঁদের চলে। উনিশ শ' একাত্তুর সালের যুদ্ধের পর থেকে এই শ্রেণীটি বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক নৈরাজ্যের থেকে প্রাণরস সংগ্রহ করে ডাঁটো হয়ে মাথা তুলছিল। ঢাকা শহরের প্রশস্ত রাজপথ থেকে শুরু করে সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিস্ঠান, ব্যাবসায়ীর আড়ত, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, রেডিও-টেলিভিশন, লেখক-সাহিত্যিকদের আড্ডা, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মন্দির এমনকি দূর-দুরান্তের পল্লীগ্রামের মহল্লায় মহল্লায় এই হঠাৎ জন্মানো নব্যনবাবদের সীমাহীন প্রতিপত্তি। এদের অনুমোদন ছাড়া মরণোম্মুখ রোগী এক ফোটা ওষুধ পেত না, শীতার্ত উলংগ অসহায় মানুষের পরনে রিলিফের একখানি বস্ত্র উঠত না, এক সের রেশনের চাল কি আটা বিলি হতে পারত না। বিধ্ধস্ত বাংলাদেশের জনগনের সাহায্যার্থে যে দেশ থেকেই সাহায্য আসুক না কেন এই শ্রণীটির দুষ্ট ক্ষুধার চাহিদা মিটাতে সবকিছু শেষ হয়ে যেত। এদের অনুমোদন ছাড়া কোন অফিসে একজন সামান্য পিয়নের নিয়োগপত্র পাওয়ার সম্ভাবণা ছিল না, যোগ্যতা যাই হোক না কেন। রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো যেত না। ছাত্রকে স্কুলে। বেবাক দেশের দশদিকে এরা ছড়িয়েছিল। আমলাদের মধ্যে, নিম্নশ্রেণীদের মধ্যে, শিক্ষকদের মধ্যে, গায়ক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে, কৃষক-শ্রমিকদের মধ্যে অন্তরীক্ষে অবস্থান করে একজন মাত্র মানুষ সবকিছুর সুতো ধরে রয়েছেন তিনি বাংলাদেশের রাস্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান।
স্বাধীনতার তিন বছর সময়ের মধ্যে সার্বিক পরিস্থিতি এরকম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে বাংলাদেশ এবং শেখ মুজিব এ দুটো শব্দ পরস্পরের পরিপুরক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শেখ মুজিব যদি বলতেন আমিই হলাম গিয়ে বাংলাদেশ, তাহলে তিনি এতটুকুও মিথ্যে বলতেন না। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর দেশে ফিরে ক্ষমতার সিংহাসনে অধিষ্টিত হয়ে একে একে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর গলা টিপে ধরেছিলেন। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে তিনি নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছেন। তাদের ঘরবাড়ি ভূ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছেন, পরিবার-পরিজনের ওপর সীমাহীন অত্যাচার চালিয়েছেন। তাদের কাউকে গ্রেফতার করে কারাগারের উদরে নিক্ষেপ করেছেন। দেদার নেতা এবং কর্মী হত্যা করেছে রক্ষীবাহিনী। বাংলাদেশের গ্রামে-গন্জে বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী দমন করার নামে সরল মানুষদের পাখির মত গুলি করে, গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। শেখ মুজিব বিরোধী কোন কিছুর আভাস পাওয়ামাত্রই রক্ষীবাহিনী আগ্নেয়াস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে ছুটে গেছে। সবকিছু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে, ভেংগে-চুড়ে তছনছ লন্ড-ভন্ড করে দিয়েছে। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতা তিরিশ বছর বয়স্ক সিরাজ সিকদারকে নৃশংসভাবে হত্যা করিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান পরিষদ কক্ষে উল্লসিত উদ্ঘোষনায় ফেটে পড়ে বলেছিলেন, এখন কোথায় সিরাজ সিকদার? গ্রফতার, নির্যাতন এসব শেখ মুজিব প্রশাসনের একটা অ্ত্যন্ত উল্লেখযোগ্য দিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আবদুল মতিন, আলাউদ্দিন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি মেজর জলিল, সম্পাদক আ.স.ম. আবদুর রব সহ অসংখ্য নেতা এবং কর্মী, জাতীয় লীগের অলি আহাদ অনেককেই তিনি কারাগারে প্রেরণ করেছিলেন। বিপ্লবী মতাদর্শী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের কথা বাদ দিয়েও তিনি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিকবোধ আস্থাশীল রাজনৈতিক দলগুলোর উপস্থিতিও বরদাশত করতে পারতেন না।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফেরার পর তিনি দেশের বিপর্যস্ত অবস্থার উন্নয়ন সাধনের জন্য সময়ে অসময়ে হুন্কার দেয়া ছাড়া কোনো বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ করেননি। পক্ষকান্তরে তার বিরোধীদের সমুলে বিনাশ করার এক সর্বনেশে খেলায় মেতে উঠেছেন। এমনকি সে বিরোধিতা নিজের দলের লোক থেকে এলেও এবং একান্ত ন্যায়সংগত হলেও তিনি সহ্য করেননি। দৃশ্যত বিরোধীদলবিহীন খোলা ময়দানের তিন তিনটি দলের সর্বময় কর্তা হওয়া স্বত্তেও তিনি নিশ্চিত বোধ করতে পারছিলেন না। তিনটি দলকে এক করে একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করে সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করে রাখার জন্য রাতারাতি প্রধানমন্ত্রী থেকে রাস্ট্রপতি হয়ে বসলেন। সংবিধান বাতিল ঘোষনা করলেন। জাতীয় পরিষদের সদস্যদের সংগে বয়-বেয়ারাদের মত আচরন করলেন। উদারনৈতিক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ দলের পাটাতনে দাঁড়িয়েই একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরিসরে নিজেকে বাঙালি জাতির সংগ্রামী প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করে নিতে পেরেছিলেন এবং বাঙালি জাতির মুক্তি-সংগ্রামের নায়করুপে সারাবিশ্বে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। তিন বছর যেতে না যেতেই আওয়ামী লীগ দলটির অস্তিত্ব বিলীন করে দিলেন। উনিশ শ' উনসত্তর সালের পর থেকে এ পর্যন্ত তাঁকে ভাগ্যদেবতা অযাচিতভাবে কৃপা করে আসছে। উনিশ শ' উনসত্তর সালে আইয়ুব বিরোধী অভ্যূথ্থানের ফলে আইয়ুব খানকে আগরতলা ষড়যণ্ত্র মামলে উঠিয়ে নিতে হয়। কারাগার থেকে তিনি বেরিয়ে আসেন বাঙালি জাতীর জনক এবং অদ্বিতীয় নেতা হিসেবে। তাঁর প্রতি জনগনের আস্থা ভালবাসা তাঁর মস্তকে হিমালয় পর্বতের চুড়োর মত উত্তুংগ মহিমায় বিভুষিত করেছে। গোটা জাতি তাঁর পেছনে। এর পূর্বে কোন বাঙালি নায়কের পেছনে মানুষ অকৃত্ত্রিম আস্থা এবং স্বত:স্ফুর্ট ভালাবাসা এমন করে বিলিয়ে দেয়নি। তার আগেও এরকমটি ঘটেছে বারবার। যে-কোন বড় ধরনের রাজনৈতিক বিপ্লব, উপবিপ্লব শুরু হওয়ার পূর্বে শেখ মুজিব কোন যাদুমন্ত্র বলে কারাগারে ঢুকে পড়েছেন। ঘটনার নিয়মে ঘটনাটি ঘটে যাবার পর বিজয়ী বীরের মত শেখ সাহেব দৃপ্ত পদক্ষেপে প্রকাশ্য সূর্যালোকে বেরিয়ে এসে নেতার আসনটিতে বিনাদ্বিধায় বসে পড়েছেন। শেখ মুজিবকেই ঘটনাটির নায়ক বলে লোকে বিনাদ্বিধায় মেনে নিয়েছেন। তাঁর নিজের দলের মধ্যেও এ নিয়ে বোধকরি কোন প্রশ্ন কখনো উঠেনি। উনিশ শ' একাত্তর সালের পঁচিশে মার্চ তারিখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে আপন বাসভবন থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং উনিশ শ' বাহাত্তর সালের দশই জানুয়ারি তারিখে বাংলাদেশে এসে এমন একটি আসন পেয়ে গেলেন, বাঙালি জাতির ইতিহাসে কোন মানুষ সে রকম মর্যাদা, ভালোবাসা এবং একছ্ত্র ক্ষমতার আসনে উপনিবেশ করতে পারেনি। তাঁর তেজ, বীর্য এবং বাক্যের মন্ত্রশক্তিতে বিস্ময়াবিশ্ট দেশবাসী বহুকাল পূর্বেই তাঁকে বংগবন্ধু এবং বাঙালি জাতির পিতা ইত্যাদি দুর্লভ সম্মানে ভূষিত করেছিলেন। শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার আসনে তো তিনি রাজচক্রবর্তী হিসেবে বহুকাল পূর্বে থেকেই আসীন ছিলেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে বাঙালি হ্রদয়ের সিংহাসনের রাজা বাস্তবের সিংহাসনে আরোহন করলেন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি তাঁর দু:শাসনে যতই বিপর্যয়ের শেষ সীমানায় নেমে আসুক-না কেন, বন্যা, মহামারী, চোরাচালানী, ছিনতাইকারী, টাউট, স্বজনতোষনকারীরা বাংলাদেশে যে অবর্ননীয় দু:খ-দুর্দশারই সৃষ্টি করুক-না কেন তাঁর গোচরেই সবকিছু ঘটে আসছিল। যৌবনবতী মেয়ে মানুষ তার প্রেমিককে যে রকম বিশ্বাস করে এবং ভালবাসে, বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে সেই অকৃত্তিম অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে উৎসারিত বিশ্বাস এবং ভালাবাসা দিয়েছিল। তিনি এলেন, প্রধাণমন্ত্রী হলেন। নতুন সংবিধান রচনা করলেন, নির্বাচন ডাকলেন এবং নির্বাচিত হওয়ার পর বছর না ঘুরে না-আসতেই প্রধাণমন্ত্রীর পদ তাঁর হল না। তাঁরই নির্দেশে রচিত সংবিধানের বিধানগুলো আঁটোসাটো জামার মত ক্রমাগত তাঁর বিরক্তি উৎপাদন করছিল। তাই তিনি নিজ হাতে গড়া অনুশাসনের নিগড় ছিন্ন করে ফেললেন। সংবিধান বাতিল ঘোষনা করলেন। যে সংসদীয় গনতন্ররে বাঁধানো সড়ক বেয়ে আকাশস্পর্শী উচ্চকাঙখার নির্দেশে একটি সবল, স্বাস্থ্য এবং দরাজ কন্ঠস্বর মাত্র সম্বল করে এতদুর উর্ধ্বে আরোহন করেছেন সেই সংসদীয় গণতণ্ত্র শেখ মুজিবের হাতেই জখম হয়ে হয়ে লাশটি তাঁরই হাতে কবরস্থ হওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিল। অবিলম্বে তিনি তাঁর কর্তব্যকর্ম সমাপন করলেন। সংসদীয় গনতণ্ত্রের লাশটি কবর দিলেন। একদলীয় সরকারের রা্স্ট্টপতি হিসেবে নতুন পরিচয়ে তিনি নিজেকে পরিচিত করলেন। শেখ মুজিব যা করেন সব নিঁখুত। ইতিহাসের সংগোপন আকান্খা তাঁর প্রতি কর্মে অভিব্যক্তি লাভ করে। এ হচ্চে তাঁর পরিষদের ধারণা। কথাটি তিনিও আপনদল এবং বন্ধুদলের মানুষদের কাছ থেকে এতবেশি শুনেছেন যে নিজেও প্রায় অতিমানব বলে বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন। তিনিও মনে করতে আরম্ভ করলেন, যা কিছু হও বলবেন, অমনি হয়ে যাবে। এ যেন শেক্সপীয়রের নাটকের নায়ক জুলিয়াস সিজার। আকাশের জ্যোতিস্কমন্ডল বারেবারে শুভ-সংকেত বয়ে নিয়ে আসে।
শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রে সীজারের বীরত্ব এবং গুনাগুন বর্তমান ছিল কিনা বিচার করবেন আগামীদিনের এৈতিহাসিক। তবে একথা সত্য যে, পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশ বাংলাদেশে তিনি যা পয়েছেন, যা আদায় করেছেন, অনুরুপ ভাগ্য কোন রোমান সীজারের কোনদিন হয়নি।
সব শক্তিদর্পী মানুষের যেমন হয়ে থাকে তেমনি শেখ মুজিবর রহমানের মনে কিছু নিরীহ বস্তু না পাওয়ার ক্ষোভ বারবার তাঁর অন্তর্লোককে পীড়ন করেছে। শক্তিদর্পী মানুষেরাও চায় মানুষ তাদের ভালাবাসুক বন্ধুর মত, আবার যমের মত ভয় করুক। আকাশের দেবতাকে যে রকম ভীতিমিশ্রিত ভালবাসা দিয়ে বিচার করে, শেখ মুজিবুর রহমানের মনেও অবিকল সে রকম একটি বাসনার উদয় হয়েছিল।
তিনি বিলক্ষন জানতেন, পান্ডিত্যাভিমানী শিক্ষিত সমাজের মানুষ তাঁকে অন্তর থেকে অবজ্গা করেন। এই শ্রেণীটির চরিত্রের খাঁজগুলো সম্বন্ধে পুরোপুরি অবহিত ছিলেন। উনিশ শ' উনসত্তর সালের পূর্ব পর্যন্ত এই শ্রেনীর লোকেরা তাঁকে বাগাড়ম্বর সর্বস্ব অমার্জিত হামবগ ছাড়া কিছু মনে করতেন না, তা তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। বিভিন্ন বিবৃতি, বক্তৃতা, ঘরোয়া বৈঠক এবং আলাপ-আলোচনায় এঁদের প্রতি প্রচ্ছন্ন ঘৃণা এবং বিরক্তি তিনি কুন্ঠাহীনভাবে ব্যক্ত করেছেন। তা সত্তে্ও উচ্চশিক্ষিত আমলা, লেখক-সাহিত্যিক এবং শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষক এবং সম্ভ্রন্ত সমাজের একাংশ তাঁকে বংগবন্ধু বলে যে সম্বোধন কেন করতেন শেখ মুজিব তা বুঝতেন এবং তা তাঁর ক্ষমতার স্বাভাবিক প্রাপ্য হিসাবেই গ্রহণ করতেন। তাছাড়া বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবি বলে কথিত শ্রেণীটির হীনমন্যতাবোধ এবং চারিত্রিক দাসত্ব অনেকটা প্রবাদের সামিল। যে-কোন নতুন শাসক এলেই সকলে মিলে তাঁর গুণপনা বাখান করা এখানকার বহুদিনের একটা প্রচলিত প্রথা। কচিত কদাচিত ব্যতিক্রমী কন্ঠ শোনা যায়। এর কারণ নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সমাজ শরীরের মধ্যে সংগুপ্ত আছে।
শক্তিদর্পী মানুষেরাও যে শেষ পর্যন্ত একেকটা দিকে কাঙাল থেকে যান শেখ মুজিবের মধ্যেও তার পরিচয় পাওয়া যায়। যে বস্তুটি সহজভাবে পাওয়া যায় না তাকে ভেঙে ফেলার জন্য এঁদের অনেক সময় নিয়মমত খাওয়া-শোয়ার ব্যাঘাত ঘটতে থাকে। তাঁর আসন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমনের ঘটনাটিকেও এ পর্যায়ে ফেলা যায়। যদিও তিনি দেশের একচ্ছত্র অধিপতি তথাপি তাঁর কানের কাছে অনেক উচ্চকন্ঠ চিৎকার করেছে, বাচাল ও অর্বাচীনেরা অনেক বৃথা লিখেছে, কিন্তু পন্ডিতরা বরাবর নিশ্চুপ থেকেছেন। এই অর্থবোধক নিশ্চয়তা তাঁর বুকে শেলের মত বেজেছে। সেজন্যই তাঁর অত ঘটা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা। যে লোকেরা সহজভাবে তাঁকে স্বীকার করে নেয়নি, তাঁদেরকে তাঁর মহিমা বুঝিয়ে দেয়ার জন্যই বিশ্ববিদ্যলয়ে আসছেন। নইলে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে শেখ মুজিব সকাল-সন্ধে ভাঙা কাপে চা খেয়েছেন, সেখানে আাসার জন্য সাড়ে সাত লক্ষ টাকা ব্যয় করার কি প্রয়োজন থাকতে পারে? বিশষত বাংলাদেশের মত দেশে যেখানে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠেও এক-তৃতীয়াংশ ছাত্রের পয়সার অভাবে সকাল বেলার টিফিন জোটে না।
তাছাড়া আরেকটি কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা তাঁর জন্য অণিবার্য হয়ে পড়েছিল। যতই তিনি জনগনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন ততই তাঁর চরিত্রের স্বৈরাচারী লক্ষণসমুহ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল। ক্ষমতার নির্মম একাকীত্ব তাঁকে নিশ্চয়ই বুঝিয়ে দিয়েছিল যে গণতণ্রের ধারাস্রোতে বাহিত হয়ে তিনি এসেছিলেন, তাতে তাঁর পুনরায় অবগাহন করার কোন উপায় নেই। কেননা এই তিন বছরে শরীর অনেক ভারী হয়ে গিয়েছে এবং সাঁতারও প্রাঅয় ভুলে গিয়েছেন। যদি তাঁকে একজন মানুষ হিসেবেই বেঁচে থাকতে হবে - জনতাই তাঁর শাসনের বিষয়বস্তু। তিনি রাজা এঁরা প্রজা। এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি মনে মনে সাংঘাতিক রকম অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন। সংবিধান, জাতীয় পরিষদ, পরিষদের সদস্য, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতি বলতেন, তিনি জনগনকে ভালবাসেন এটা তাঁর দীর্ঘদিনের অভ্যাস আর জনগন তাঁকে দেখতে ভিড় করতেন, তাঁর বক্তৃতা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, তাঁর কথায় হাত উঠাতেন এটা জনগনের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা শুনে এবং কথায় কথায় হাত উঠিয়ে অভ্যস্ত। আসলে জনগন অনেকদিন থেকেই তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। কারণ বাংলাদেশের যে দুর্দশা বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি ধরে নিয়েও বলা যায় তার আশি ভাগই মানুষের সৃষ্টি এবং তাঁর জন্য মুখ্যত দায়ী তাঁর পরিচালিত তৎকালীন সরকার। গ্রামের সরল মানুষকে, অনাহারক্লিষ্টা বিধবাকে আমি নিজের কানে তাদের তাবৎ অভাব অভিযোগের জন্য দায়ী করে অভিস্পাতের বাণী উচ্চারণ করতে শুনেছি। তিনি যে ধীরে ধীরে স্বখাত সলিলে ডুবে যাচ্ছেন খুবই টের পাচ্ছিলেন। জনগনের রুদ্ররোষ কি বস্তু উপলব্ধি করতে সময় লাগেনি। এই জনগনই আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করিয়ে শেখ মুজিবকে আইুয়ব খানের কারাগার থেকে মুক্তমানব হিসেবে প্রসন্ন দিবালোকে বের করে এনেছে। উনিশ শ' একাত্তর সালের মার্চ মাসের দিনগুলোতে জনগনের সংগবদ্ধ শক্তির গভীরতা, তীব্রতা কতদূর হতে পারে, বাঁধভাঙা বন্যার স্রোতের মত রাস্ট্রীয় এবং সামাজিক জীবনে কি অঘটন ঘটিয়ে তুলতে পারে সে জ্গান তিনি হাতে কলমেই লাভ করেছেন। তাই তিনি ক্রমাগতভাবে জনগনের ক্ষোভ আক্রোশ প্রকাশ করার পন্থা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমুহের মুখে বালির বাঁধ রচনা করে যাচ্ছিলেন। তাই তিনি তিনদল ভেঙে একদল করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী থেকে সরাসরি একনায়ক সেজে বসেছেন।
তিনদিন ভেঙে একদল করার পর তাঁর হাতে প্রভুত ক্ষমতা সন্চিত হয়েছিল বটে, কিন্তু তিনি রাজনৈতিকভাবে সম্পুর্ণ গরঠিকানার মানুষ হয়ে পড়েছিলেন। সম্মিলিতভাবে তিনি তিনদলেরই কর্তা, কিন্তু আসলে কোন দলেরই কেউ নন। এই ঠিকানাহীনতা তাঁকে একনায়কতন্রের দিকে আরো জোরে ঠেলে দিচ্ছিল। জনগন মন অধিনায়ক নেতার পক্ষে একনায়ক পরিচয়ের পথে রাজার পরিচয় আরো প্রীতিপদ এবং সম্মানের। বিশেষত তিনি দেশ এবং বিদেশের সামনে প্রমাণ যখন করতে পেরেছেন, তিনি চাননি তবু জনগন তাঁকে রাজার আসনে বসিয়েছে। এই রাজকীয় পরিচয়টা দেশের মানুষের মনে ভালভাবে দাগ কাটে মত বসিয়ে দেয়ার জন্য তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করে যাচ্ছেন। একদলীয় শাসন কায়েম করেছেন, জাঁকালো রাস্ট্রপতি হয়ে বসেছেন, উপবেশনের সুবিধার জন্য দিনাজপুরের মহারাজার সিংহাসনটা আনিয়ে নিয়েছেন। ব্রিটিশ আমলের ঘূণে ধরা প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করেছেন। পূর্বের জেলা এবং বিভাগগুলোর সীমানা চিহ্ণ মুছে দিয়ে গোটা দেশেকে একষট্টিটি নতুন প্রশাসনিক এলাকা তথা জেলায় বিভক্ত করে, প্রতি জেলার জন্য একজন করে গভর্ণরও দান মনোনয়ন দান করেছেন। জেলা প্রশাসনের সংগে সরাসরি কেন্দ্রীয় শাসনের সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। গভর্ণররা যাতে সর্বেসর্বা হয়ে বসতে না পারে সেজন্য বৈরী গ্রুপ থেকে একেকজন বাকশাল সাধারন সম্পাদককে মনোনয়ন দান করা হয়েছে। শাসনব্যবসথাকে নতুনভাবে ঢালাই করার নামে আইয়ুবের মত শেখ মুজিবও তাঁর সিংহাসনে থাকার পথটি পাকাপোক্ত করেছেন। আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের মৌলিক বস্তুটির সংগে জনগনের চাক্ষুষ পরিচয় ঘটেছে। মুজিবের মৌলিক বস্তুটিরও প্রয়োজনীয়তা কতদুর ছিল আগামীদিনের প্রশাসনবিদরা বিচার-বিবেচনা করে দেখবেন। আমার বক্তব্য হল, আইয়ুব সরকার এবং মুজিব সরকা নিজেদের ক্ষমতায় অটুট থাকবার জন্য উদ্ভাবিত পথটিকেই শাসনতান্রিক বিপ্লব বলে আখ্যা দিয়েছেন। জেলাসমুহের গভর্নর এবং বাকশালের সাধারন সম্পাদক নিযুক্ত করার ব্যাপারেও শেখ সাহেব রাজকীয় বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশের শাসক নেতৃশ্রনীতে যত ধরনের চাপ প্রয়োগক্ষম গ্রুপ রয়েছে, সব গ্রুপ থেকে প্রতিনিধি গ্রহন করেছেন - রাজনৈতিক দল ও ন্যাপ থেকে, আমলাদের থেকে, আইনজীবী শ্রেণী থেকে, সেনাবাহিনী থেকে, আনুপাতিকহারে গভর্নর ও সম্পাদক নিয়েগ করার পেছনরে কারণ ছিল সার্বিকভাবে গোটা শাসক নেতৃশ্রণীটার কাছে তাঁর শাসনটা গ্রহণযোগ্য করে তোলা।
ব্যবহারিক দিক দিয়েও তিনি রাজার মতই আচরন করে যাচ্ছিলেন। তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দের কেউ তাঁর সামনে টু-শব্দটি উচ্চারণ করতে সাহস পেতেন না। তাঁকে বুদ্ধি পরামর্শ দিতে পারে মত কেউ ছিলেন না। তিনি যদি কখনো মন্ত্রিসভার সদস্যদের ডাকার প্রয়োজন মনে করতেন, ডাকতেন। এ কারণে যে তাঁর নিজস্ব পরিবারটিকে কেন্দ্র করে একটি রাজপরিবারের ছবি ক্রমশ লক্ষ্যগোচর হয়ে উঠেছিল। তাঁর ছেলে, তাঁর ভাগ্নে, ভগ্নিপতি, ভাই সকলে সত্যি সত্যি দুধের সরের মত বাংলাদেশের শাসকশ্রণীর পুরোভাগে ভেসে উঠেছিলেন। বাকি ছিল রাজমুকুটটা মস্তকে ধারণ করা এবং রাজউত্তরীয়খানি অঙে চড়িয়ে দেয়া। এই জন্যই তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। নেপোলিয়নের মত বিশ্ববিখ্যাত বীরযোদ্ধাও হাতে প্রভুত ক্ষমতা থাকা স্বত্তেও রাজমুকুটটি নিজে নিজে পরে বসেননি। রোম থেকে পোপকে আসতে হয়েছিল। এই সমস্ত শক্তিধর মানুষেরা শক্তি দিয়ে সব কাজ করো আনলেও শেষের কাজটি করাবার জন্য এমন কাউকে খোঁজ করে আনেন, যাঁর প্রতি মানবসাধারণের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা রয়েছে এবং যা এৈতিহ্যসম্মত।
নেপোলিয়নের যুগ গেছে, পোপের যুগ গেছে। কিন্তু মানুষের অন্তরের আগুন সে রকম আছে। উচ্চাকাঙ্খা উদ্ধত হয়ে এখনো আকাশ ফুঁড়ে ফেলতে চায়। তাই শেখ মুজিবুর রহমান আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন। একক হাতে বেবাক ক্ষমতা তুলে নেয়ার স্বপক্ষে সাসস্বত সমাজের রায় গ্রহণ করবেন। তাছাড়া আরেকটি গোপন অভিলাষ তাঁর মনের কোনে থাকাও বিচিত্র কি। উচ্চশক্ষাভিমানী পন্ডিতম্মন্য লোকেরা যাঁদের তিনি মনে মনে অপরিসীম তাচ্ছিল্য করেন, তাঁরা সকলে একযোগে এসে তাঁর বিরাটত্ব ও মহত্তের সামনে দন্ডবত হবেন। একজন শিক্ষকও যাতে অনুপস্থিত না-থাকতে পারেন এবং একজনও যাতে অর্থহীন নীরিহ একগুঁয়েমীকে আশ্রয় করে কাগুজে বীর হিসেবে পরিচিত না-হতে পারেন আগেভাগে সে ব্যবস্থা করা হয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ সরকারসমর্থক ছাত্রদের যাবতীয় দুর্নীতির আখড়াতে পরিনত হয়েছিল। পাকিস্তানি শাসনামলে সামরিক সরকারের আরোপিত হাজারো বাধা-বিঘ্ন অগ্রাহ্য করে বাঙালি মনীষা পাথরের ভেতর দিয়ে পথ কেটে একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের পানে অগ্রসর হচ্ছিল। কি সংস্কৃতি চর্চায়, কি রাজনৈতিক চেতনার বিকাশে, কি মননশীলতার লাবণ্য সন্চারে পাকিস্তান আমলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে ভুমিকা পালন করেছে তা বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবে। বাংলাভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ, বাংলার জাতীয় জাগরনের প্রথম আন্দোলন, উনিশ শ' উনসত্তরের আইয়ুব বিরোধী বিক্ষোভ, একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধ এ সকল জাতীয় জীবনে অপরিসীম প্রভাববিস্তারী ঘটনাগুলো ঘটিয়ে তোলার উদ্যোগপর্বে নেতৃত্বদান করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। উন্নয়নশীল দেশসমুহের রাজনীতিতে ছাত্ররা অনিবার্যভাবে কোন্ ভুমিকা পালন করে থাকেন শেখ মুজিব তা জানতেন। তিনি নিজেও এরকম ছাত্র আন্দোলনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তাই তাঁকে শুরু থেকেই ছাত্রদের কঠোর নিয়ন্ত্রনে রাখার বিষয়টি অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে ভাবতে হয়েছে।
তিনি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করার কিছুদিন পরই দেখেছেন যে, যে ছা্ত্রপ্রতিষ্ঠানটির পেশল সমর্থন তাঁর একমাত্র রাজনৈতিক মুলধন ছিল সেই ছাত্রলীগকে চোখের সামনে দু'টুকরো হয়ে যেতে, তাঁর ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়া, ছাত্রলীগের অপরাংশের সক্রিয় সহযোগিতার ওপর নির্ভর করে অপর একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেখে তাঁকে নিশ্চয়ই হতবাক করে থাকবে। উনিশ শ' তিয়াত্তর সালের পয়লা জানুয়ারির ঘটনা। ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিবাদ করে বাংলাদেশের ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যকেন্দ্রের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করলে পুলিশ বিক্ষোভকারী ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষন করে। ফলে একজন ছাত্র ঘটনাস্থলে নিহত হয়, কয়েকজন মারাত্বকভাবে আহত হয়। তার প্রতিবাদে ছাত্র ইউনিয়ন সমস্ত ঢাকা শহরে প্রতিবাদ সভা এবং মিছিলের আয়োজন করে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যাকারী আখ্যায় ভুষিত করে। সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চালিত 'ন্যাপ' এবং 'বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি'র সমর্থক ইউনিয়নের দখলে ছিল। তাঁর এই গুলিবর্ষনের প্রতিবাদস্বরুপ বিক্ষুদ্ধ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা ছাত্রসংসদের খাতায় যে পৃষ্ঠাটিতে শেখ মুজিবুর রহমান কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের আজীবন সদস্য হিসেবে সাক্ষর করেছিলেন সেই পৃষ্ঠাটিকে ছিড়েঁ ফেলে। অথচ এই ছাত্র ইউনিয়নই পদে পদে শেখ মুজিবুর রহমানকে তাদের মূল রাজনৈতিক দলদু'টোর মত অন্ধভাবে সমর্থনদান করে যাচ্ছিল। নিজের সমর্থক ছাত্ররা যখন এ অভাবনীয় কান্ড ঘটিয়ে তুলতে পারে, বিরোধীদলীয় ছাত্ররা যে প্রতিবাদে কতদূর মারমুখী হতে পারে, একটি সম্যক ধারণা তাঁর হয়েছিল। তাঈ শক্তহাতে বিশ্ববিদ্যালয়সমুহ বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় এবং ছাত্রসমাজকে নিয়ন্ত্রনে রাখার সিদ্ধান্ত্ব তিনি গ্রহণ করেছিলেন।
উনিশ শ' বাহাত্তর সালের পর থেকে প্রকৃত প্রস্তাবে চার পাঁচজন ছা্ত্রই স্টেনগান হাতে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ চালাত। উপাচার্যবৃন্দ এই অস্ত্রধারী ছা্ত্রদের কথাতে উঠতেন, বসতেন। স্বাধীনতার পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্তির দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল, কিন্তু স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যলয়ের বেবাক পরিবেশটাকেই কলুষিত করে তোলা হল। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন চিন্তা, কল্পনা, নিরপেক্ষ গবেষনার পথ একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। সরকার সমর্থক ছা্ত্ররা প্রকাশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করত। দরকারবোধে তারা এগুলো ব্যবহার করতে কোন রকম কুন্ঠা বা সংকোচবোধ করত না। বর্তমানে ঢাকা জেলার জেলা জজের কোর্টে একটি লোমহর্ষক হত্যামামলার বিচার চলছে। সরকার সমর্থক দু'দল ছা্ত্রের মধ্যে মতামতের গরমিল হওয়ায় অবাধে রাতের বেলা অগ্নেয়াস্ত্র ব্যাবহার করে সাতজন সতীর্থকে হত্যা করেছে। আজ থেকে প্রায় একবছর পূর্বে হাজী মুহম্মদ মহসীন ছাত্রাবাসের টিভি কক্ষের সামনেই এই শোকাবহ ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়। সরকারসমর্থক ছাত্ররাই যখন মতামতের গড়মিলের জন্য স্বদলীয় ছাত্রের হাতে এভাবে বেঘোরে প্রাণ হারাতে পারে, সাধারণ ছাত্র এবং শিক্ষকদের অবস্থা কি হতে পারে সহজেই অনুমান করা যায়। সরকারসমর্থক ছাত্রের মত শিক্ষকদেরও একটি বিশেষ অসুবিধা হবার কথা নয়।
উনিশ শ' বাহাত্তর সালের পর থেকে প্রকৃত প্রস্তাবে চার পাঁচজন ছা্ত্রই স্টেনগান হাতে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ চালাত। উপাচার্যবৃন্দ এই অস্ত্রধারী ছা্ত্রদের কথাতে উঠতেন, বসতেন। স্বাধীনতার পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্তির দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল, কিন্তু স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যলয়ের বেবাক পরিবেশটাকেই কলুষিত করে তোলা হল। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন চিন্তা, কল্পনা, নিরপেক্ষ গবেষনার পথ একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। সরকার সমর্থক ছা্ত্ররা প্রকাশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করত। দরকারবোধে তারা এগুলো ব্যবহার করতে কোন রকম কুন্ঠা বা সংকোচবোধ করত না। বর্তমানে ঢাকা জেলার জেলা জজের কোর্টে একটি লোমহর্ষক হত্যামামলার বিচার চলছে। সরকার সমর্থক দু'দল ছা্ত্রের মধ্যে মতামতের গরমিল হওয়ায় অবাধে রাতের বেলা অগ্নেয়াস্ত্র ব্যাবহার করে সাতজন সতীর্থকে হত্যা করেছে। আজ থেকে প্রায় একবছর পূর্বে হাজী মুহম্মদ মহসীন ছাত্রাবাসের টিভি কক্ষের সামনেই এই শোকাবহ ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়। সরকারসমর্থক ছাত্ররাই যখন মতামতের গড়মিলের জন্য স্বদলীয় ছাত্রের হাতে এভাবে বেঘোরে প্রাণ হারাতে পারে, সাধারণ ছাত্র এবং শিক্ষকদের অবস্থা কি হতে পারে সহজেই অনুমান করা যায়। সরকারসমর্থক ছাত্রের মত শিক্ষকদেরও একটি বিশেষ অসুবিধা হবার কথা নয়। এঁদের অনেকে পুর্ব থেকে ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর সেবা করি আসছেন। সুতরাং এই নতুন শাসনামলেও তাঁরা বস্তু-সম্পদের দিক দিয়ে কিন্চিত লাভবান হওয়ার সাধনা করে যাচ্ছিলেন এবং নানাভাবে সরকারসমর্থক ছাত্ররা সক্রিয় সহায়তা দান করে যা্চ্ছিলেন। আর সরকার নিজস্ব প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে অপর কোন মতামত এবং প্রতিষ্ঠান যাতে মাথা তুলতে না-পারে সেজন্য সম্ভাব্য সকল উপায়ে চেষ্টা করে আসছিল। বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি মতামতের লালনক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলতে যেয়ে এমন একটা অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হল, যার সংগে অধিকাংশ শিক্ষক এবং ছাত্র মিলিয়ে নিতে পারলেন না। শেখ মুজিবুর রহমানের রাস্ট্রনৈতিক চিন্তা এবং রাস্ট্রশাসন পদ্ধতিকে মুজিববাদ আখ্যা দিয়ে, তার প্রচার, প্রসার এবং বাস্তবায়নের জন্য সরকারসমর্থক ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়সমুহে এমন একটা সুসংগঠিত অভিযান পরিচালনা করলেন, কোন স্বাধীনচেতা, ন্যায়বান ছাত্র কিংবা শিক্ষক তার সংগে অন্তরের সামান্য সংযোগও অনুভব করতে পারলেন না। এই না-পারার কারণেই সৎ এবং ন্যায়পরায়ন শিক্ষকরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। তাঁরা অপরিসীম মানসিক উৎকন্ঠা নিয়ে শন্কা, ত্রাস এবং ভীতির মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হলেন। অতি শিগ্গির গোটা দেশের তাবত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই মুজিববাদী ছাত্রদের এবং তাঁদের পেছন বুদ্ধি-পরামর্শ যোগানো শিক্ষকদের প্রভাব ঘুর্ণিহাওয়ার মত অপ্রতিরোধ্য বেগে ছড়িয়ে পড়ল।
যে সমস্ত শিক্ষক চরিত্র এবং বিদ্যাবত্তার জন্য ছাত্রদের মধ্যে শ্রদ্ধা এবং সম্মানের আসনে অধিষ্টিত ছিলেন মুশকিল হল তাঁদেরই। তাঁরা তাঁদের পরিবারবর্গ নিয়ে নিতান্ত ভয়ে ভয়েই দিবস রজনী অতিবাহিত করতেন। যে-কোন সময়, যে কোন বিবাদ এসে ঘাড়ে আশ্রয় করতে পারে। সে সময় আমি নিজে বিশ্ববিদ্যালয় কম্পাউন্ডে বাস করেছি। এই সন্ত্রাসজনক পরিস্থিতির ভয়াবহতা কিছু কিছু অনুভব করেছি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার দু'বছর পরেও দেখেছি শিক্ষকরা ফ্ল্যাটে বাইরের দিক থেকে তালা লাগিয়ে রাখতেন। কোন অচেনা লোক খোঁজ-খবর করতে গেলে বাড়ির লোকেরা জবাব দিতেন, তিনি বাসায় নেই।
যে মুষ্টিমেয় ছাত্রদল বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকিছু শক্তহাতে নিয়ন্ত্রন করত সংখ্যায় ছিল তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনরত মোট ছাত্রছাত্রীর এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র। সরকারি পুলিশ সব সময়ে তাদের সাহায্যে মোতায়েন থাকত। ছাত্রাবাসের ভোজনক্ষে খাওয়ার জন্য তাদের কোনো অর্থ দিতে হত না। অধিকন্তু মন্বন্তরের সময় ছা্ত্রাবাসের প্রভোস্ট এবং হাউজ টিউটররে সংগে মিলেমিশে রেশনে পাওয়া চাল, ডাল কালোবাজারে বেচে দিয়ে প্রচুর অর্থ আত্নস্যাত করার সুযোগ তারা পেত। তাছাড়াও সরকারদলীয় লোকদের মধ্যে ব্যাবসা-বাণিজ্য, চাকুরি-বাকরি বন্টন করার বরাদ্দ সুযোগগুলো তো ছিলই।
বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজের ছাত্রসংসদসমূহের নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করত, ভীতি এবং ত্রাসসৃষ্টি করে ছাত্র সাধারণের কাছ থেকে ভোট আদায়ের চেষ্টা করত। তারপরেও যখন দেখা যেত নির্বাচনে তারা শতকরা বিশটি ভোটও লাভ করতে পারেনি এবং পরাজয় অবধারিত, রাতের বেলা আলো নিভিয়ে ভোটের বা্ক্সগুলো লুট করে নিয়ে যেত। তাদের অনুমোদন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছাত্রভর্তি হতে পারত না, ছাত্রাবাসসমূহে থাকবার জায়গা পেত না। শিক্ষকদের নিয়োগ বরখাস্ত অনেকটা তাদের খেয়াল-খুশির উপর নির্ভরশীল ছিল।
শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর একদলীয় শাসন চালু করে দেশে যে নতুন শাসনতান্রিক পদ্ধতি চালু করার কথা ঘোষনা করেছিলেন, তাতে বিশ্ববিদ্যলয়গুলোকেও ক্ষমতার অংশভোগী করে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক শ' পনেরজন সদস্যের মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, জাহান্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যত্রয় এবং বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালিকা ও বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষাকে স্থান দিয়েছিলেন। জাতীয়দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের স্থান দিয়ে সরাসরি বিধিবদ্ধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে সরকারি নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসার আয়োজন সম্পুর্ণ করলেন। অর্থাৎ এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ঘোরপ্যাচ ব্যাতিরেকে প্রত্যক্ষভাবে সরকারি শাসন বলবত করা হবে। পূর্বেকার সরকারসমূহ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃত্ব করতেন বটে, কিন্তু সে পন্থাটি ছিল সম্পুর্ণ স্বাধীন, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। সরকার প্রশাসন কিংবা পরিচালনায় প্রকাশ্যত কোন হস্তক্ষেপ করতেন না। শেখ মুজিবই প্রথম যিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্ষমতার অংশীদার করলেন। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আলাদা অস্তিত্ব, আলাদা আইন-কানুন এগুলোকে তিনি ক্রমে ক্রমে ভেঙে নতুন করে সাজিয়ে, তার মধ্যে সরকারি বিরোধীতার বীজকে উপরে ফেলতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, যে আধুনিক শিক্ষাভিমানী পন্ডিত সমাজ তাঁকে অবগ্জ্জা করেন, তাঁদের অন্তরলালিত অহন্কার চূর্ণ করতে পারবেন। নতুন পদ্ধতিটা এমনভাবে রচনা করা হয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পন্ডিতদেরও তাঁর আাওতার বাইরে থাকার উপায় নেই এবং শেখ মুজিবুর রহমানরে সিংহাসনের পেছনে না দাঁড়িয়ে তাঁদের গত্যান্তর থাকবে না। তৃতী্য়ত, বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের হাতের মুঠোতে পুরে তিনি দেশের মানুষ এবং বিশ্ববাসীর সামনে প্রমাণ করত পারবেন যে তিনি মন্দ অর্থে একনায়ক নন। দেশের কৃষকসমাজ থেকে শুরু করে সারস্বত্ব সমাজ পর্যন্ত তাঁকে এত অনুরোধ উপরোধ করেছেন যে, বাধ্য হয়েই তিনি দেশের কল্যান চান এবং বাংলার মানুষকে ভালবাসেন। সমস্ত দেশের মানুষের সমবেত প্রার্থনা তিনি অগ্রাহ্য করতে পারেনণি।
তাঁর দিক থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ভূল চিন্তা করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্ষমতার অংশ দেয়ার সংগে সংগেই এক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রবীণ উপাচার্য এক পত্রিকার প্রতিনিধির সংগে সাক্ষাতকারে বলেই বসলেন যে শেখ মুজিবুর রহমানের মত এমন একজন বলিষ্ঠ নেতা হাজার বছরে জন্মগ্রহন করেননি। শেখ মুজিবুর রহমান যে বলিষ্ঠ নেতা সে বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি তা প্রকাশ করার জন্য এই সময়কে বেছে নিয়েছিলেন কেন তা অনেকের কাছেই খুব তাৎপর্যপূর্ণবহ মনে হয়েছে। বাস্তবেও তিনি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের নিয়ে কর্মচারীদের কেন্দ্রীয়দলে যোগদানের আবেদনপত্রসহ তাঁদের নিয়ে রাস্ট্রপতির সংগে দেখা করে আসলেন। সেই ছবি কাগজে ফলাও করে প্রকাশিত হল।
এই উপাচার্য ভদ্রলোককে দেশের মানুষ আত্নমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে জানতেন। অতটুকু দাস্যতা তাঁর কাছ থেকে কেউ প্রত্যাশা করেননি। তাঁর এ ধরনের কার্যকলাপের দু'রকম প্রতিক্রিয়া হল। তাঁর মত লোকের পক্ষে তথাকথিত জাতীয়দলের এ ধরনের কান্ডজ্গ্জানহীন তোষামোদ দেখে জ্ঞানীগুণী সমাজের একাংশ চিন্তিত হয়ে উঠলেন, আরেক অংশের প্রতিরোধ ক্ষমতাও দুর্বল হয়ে এল। অন্যদিকে রাস্ট্রপতির সংগে তাঁর দহরম মহরম অন্যান্য উপাচার্য এবং সরকারসমর্থক শিক্ষা-সংস্কৃতির সংগে সংযুক্ত নেতৃ্শ্রনীর মনে ঈর্ষার উদ্রেক করেছিল তাতে সন্দেহ নেই। তিনি যদি রাস্ট্রপতির সংগে অতবেশী মাখামাখি করার সুযোগ আদায় করে ফেলেন, অন্যান্যদের সুযোগ-সুবিধে মাঠে মারা যাবার সম্ভাবনা। তাই অন্যান্যরাও উঠে পড়ে লাগলেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক আবুল ফজল ছাড়া আর সকল উপাচার্যই নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী এবং শিক্ষকদের জাতীয়দলে যোগ দেয়ার জন্য ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছিলেন। এ ব্যাপারে সরকার সমর্থক ছাত্রদল উপাচার্যদের সহায়তা দিয়ে আসছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জাতীয়দলে যোগদান করার জন্য যে জয়ভীতি এবং নানামুখী চাপরে সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তা আমি খুব কাছে থেকে নিজের চোখে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি। প্রতিটি অধ্যক্ষ বিভাগীয় শিক্ষকদের মধ্যে আবেদনপত্র বিলি করেছিলেন এবং সরকারি প্ররোচনায় তরুণতর শিক্ষকদের সই করতে অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য করেছিলেন। অনেক শিক্ষকই স্বত:প্রবৃত্ত হয়ে সই করতে চাননি। কিন্তু হুমকি, ভীতি এবং চাপের মুখে তাঁদের বেশীরভাগই আত্নসমর্পন করতে বাধ্য হলেন। যে সকল শিক্ষক সই করেননি, তাঁদের নাম বাকশাল কেন্দ্রীয় অফিসে পাঠিয়ে দেয়া হল। সরকারসমর্থক ছাত্রদল এই বিদ্রোহী শিক্ষকদের দেশদ্রোহী হিসেবে খুব শিগ্গির ধরে নেয়া হবে বলে হুমকি দিয়ে গুজব ছড়াতে শুরু করল। এই জোর-জুলুম, ভয়-ভীতি, সন্ত্রাসের মধ্যে চৌদ্দই আগস্ট সন্ধ্যাবেলা দেখা গেল মাত্র পনেরজন শিক্ষক জাতীয়দলে সদস্যপদের আবেদন করে সই করেননি। বাকি সকল শিক্ষকদের সই সম্বলিত আবেদনপত্র সংগৃহীত হয়ে গেছে। আগামীকাল যখন রাস্ট্রপতি আসবেন, তখন প্রায় হাজারখানেক শিক্ষকের আবেদনপত্র তাঁর সকাশে দাখেল করা হবে। তিনি শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভাষন দেবেন এবং তাঁদের কাছে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি একনিষ্ঠ সমর্থনের প্রতিশ্রুতি চাইবেন এবং শিক্ষকরাও হাত তুলে তিনি যা বলবেন তার প্রতি সমর্থন জানাতে বাধ্যা হবেন। এই পর্যন্ত সকলে তাই করছেন।
বাংলাদেশের আগ্নেয়আত্নার জ্বালামুখ বলে কথিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় চিন্তা, ভাবনা, বুদ্ধি এবং মননশীলতার নেতৃত্বদানকারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোন শক্তিধর মানুষকে যা দেয়নি শেখ মুজিবুর রহমানকে সেই অকুন্ঠ আনুগত্য স্বেচ্ছায় প্রদান করবে। গোটা দেশের মানুষ অবাক বিস্ময়ে এই দৃশ্য দেখার জন্য বেদনাহত চিত্তে প্রতীক্ষা করছিল। রাস্ট্রপতির বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন উপলক্ষে জাতীয় দৈনিকগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করছিল। রেডিও ঘনঘন সংবাদ দিচ্ছিল। টেলিভিষনে উপাচার্যের বিশেষ সাক্ষ্যাৎকার দেখানো হচ্ছিল। এ উপলক্ষে কি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়কে কিভাবে সাজানো গোছানো হয়েছে আনুপূর্বিক সমস্ত বিবরণ রেডিও, টেলিভিষন প্রচার করছিল। এই দিনটিকে ভাবগম্ভীর, পবিত্র এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণরুপে দেশের মানুষরে দৃষ্টিতে চিত্রিত করার জন্য পূর্ণপ্রয়াস গ্রহণ করা হয়েছিল। সরকারি প্রচারণার ধরণটা এমন ছিল যে-কোন রকমের বাধ্যবাধকতা ছাড়া স্বত:স্ফুর্তভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে এই এৈতিহাসিক সংবর্ধনা প্রদাণ করছে। পূর্বের একনায়করা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে যে রকম ছা্ত্রদের পূণ্জীভূত ক্ষোভ, আক্রোশ কোন না কোনো পথে ফেটে পড়ে, খুন, জখম, রক্তারক্তি কান্ড অবধারিত ঘটে যেত এবার সে সবের কোন লক্ষণ নেই। তিনি তো আর ওৌপনিবেশিক শাসনকর্তা নন, তিনি স্বয়ং বাঙালি জাতির পিতা। সুতরাং তিনি বিশ্ববিদ্যলয়ে আগমন করছেন, তার জন্য কেন বিক্ষোভ এবং অশান্তি হবে। বরন্চ এই মহানায়ককে আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা তাঁদের মধ্যে পাবেন এ আনন্দে সকলে বিভোর হয়ে আছেন। আগামীকাল উনিশ শ'পচাঁত্তর সালের পনেরই আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের একটি স্মরণী্য় দিন হয়ে বিরাজ করবে।
চোদ্দই আগস্ট সন্ধের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। শুনলাম কার্জন হলে এবং লাইব্রেরিতে বোমা ফুটেছে। পরিবেশটা থমথমে হয়ে এসেছে। উৎসবমুখর পরিবেশ হঠাৎ যেন কেমন থিতিয়ে এসেছে। মিনিটে মিনিটে পুলিশের গাড়ি টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। সকলের চোখেমুখে আশংকা। ছাত্রদের সিংহভাগ যাঁরা এই সুবিশাল এলাহিকান্ডের নীরব নিরুপায় দর্শক ছিলেন, তাদের মনের গতিটা অনুসরন করতে চেষ্টা করলাম। তাঁদের চোখমুখ দেখে মনে হল এ রকম একটা অভাবনীয় কান্ড ঘটায় সকলে যেন মনের গভীরে খুশি হয়েছে। হাতে পায়ে শেকল, শেকলের পর শেকল পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বারুদ এবং আগুনের ভাষায় শেষ পর্যন্ত আসন্ন মূহূর্তটিতেই কথা কয়েছে। অর্থাৎ কোন স্বেচ্ছাচারীকেই এই পবিত্র বিদ্যাপীঠ কোনদিন অতীতে বরন করেনি এবং ভবিষ্যতেও বরণ করতে প্রস্তুত নয়।
কথাগুলো ভেবে নিয়েছিলাম আমি। মনের ভেতর একটা ভয়ার্ত আশংকাও দুলে উঠেছিল। দুয়েকটা বোমা ফুটেছে এই ভয়ে শেখ মুজিবুর রহমান আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা স্থগিত রাখবেন তিনি তেমন মানুষ নন। তুনি নিশ্চিতভাবেই আসবেনই। অপার শক্তিবলে মুখরা নগরীর স্পর্ধিত জিহ্বা যিনি স্তব্ধ করে দিয়েছেন, দুয়েকা বোমা ফুটলে কি তিনি সেই ভয়ে ঘরের কোনে চুপটি করে ভেজাবেড়ালের মত বসে থাকবেন? তাঁর প্রতি সবচেয়ে বিরুপ শ্রেণীটি আগামীকাল সকালে সদলবলে নতমস্তকে বসে থাকবেন? নাটকের এই রোমান্চকর দৃশ্যে তিনি কি করে অনুপস্থিত থাকতে পারেন? হয়ত আরো বোমা ফুটবে। পুলিশ ছাত্রাবাসসমুহের কক্ষে কক্ষে খানাতল্লাসী চালাবে, সন্দেহজনক কিছু ছাত্রদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। কিন্তু তাঁর আসা বন্ধ হবে না।
রাতে হেটে ফিরছিলাম সাতাশ নম্বর সড়কের দিকে। মনে মনে এসব কথা তোলপাড় করছিল ভয়ংকরভাবে। শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘবাহু প্রসারিত করে সমস্ত দেশটাকে কঠিণ আলিংগনে আবদ্ধ করছেন, যা কিছু বাধা দিচ্ছে, প্রতিবাদ করছে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোন কথা নেই, কোনো বাধা নেই। বাংলাদেশের কন্ঠ একটি, সেটি শেখ মুজিবুর রহমানের ---- মানুষ ওই একজন, তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। ভয়ে দুরুদুরু করছিল বুক। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পনেরজন সই করেননি, তাঁদের অনেকেই আমার চেনাজানা বন্ধু-বান্ধব। তাঁদের অবস্থার কথা চিন্তা করছিলাম। তাঁদের কি হবে? তাঁদের কি চাকরি চলে যাবে? তাঁরা কি খাবেন? এই বাজারে বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে কিভাবে জীবনধারন করবেণ? তাঁদের কি পুলিশে তুলে নিয়ে যাবে? কি হতে পারে এই রাজদ্রোহিতার পুরষ্কার?
ভয়ন্কর চাপ অনুভব করছিলাম। একা একা হাঁটছিলাম। ভয়ানক একা বোধ করছিলাম। চারপাশের লোকজনের কারো সংগে আমার সম্পর্ক নেই, যেন কোনকালে ছিলও না। একা একা আমি যেন সুড়ংগ পথে বিচরন করছি। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল আমি ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আমি দেখে আসছি, কিভাবে আমার লালিত মূল্যবোধগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। লোভীর লোভ, প্রবলের অন্যায়কে এমনভাবে রুপ ধরে জেগে উঠতে আমি কোনোদিন দেখিনি। এত অশ্রুতে ভেজা, এতা গাঢ়রক্তে রন্জিত আমাদের স্বাধীনতা আমাদেরকে এমনভাবে প্রতারিত করছে প্রতিদিন, সে কথা কার কাছে যেয়ে বোঝাই। যাদেরকে মনের কথা ব্যক্ত করতে যাব, তাঁদের অবস্থাও আমার মত। এ কেমন স্বাধীনতা, যে স্বাধীনতা আমাদের গোটা জাতীটাকে সম্পূর্ন ভিখিরীতে পরিণত করে? এমন স্বাধীনতা যে স্বাধীনতায় আমরা একটা কথাও বলতে পারব না। চোখের সামনে সত্য মিথ্যের আকার নিচ্ছে। জলজ্যান্ত মিথ্যে নধর তাজা সত্যি হিসেবে এসে প্রতিদিন হাজির হচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের গোটা জাতিটাকে নিয়ে কি করতে চান? তাঁর কথায় কথায় উঠে বসে এ জাতির তো আর কোনোকিছুই অবশিষ্ট নেই। এত অ্ত্যাচার দেখেছি, এত জমাট দু:খ দেখেছি, এত কাপুরুষতা দেখেছি এ জাতি আর মানুষের পর্যায়ে নেই। ক্রমশ পশুর নিচে চলে যাচ্ছি আমরা। দুর্নীতির জাতীয়করন করে সমাজজীবনের প্রতিটি স্তর তিনি বিষিয়ে তুলেছেন। এই জাতীর যা কিছু গভীর, যা কিছু পবিত্র, উজ্জ্বল এবং গরীয়ান বিগত তিন বছরে সমস্ত কিছু কলুষিত করে ফেলতে পেরেছেন।
তাঁর বাহিনী অশ্বমেধ যগ্জ্জের মত যদিকেই গেছে সবকিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে ফেলেছে। শেষমেষ ছিল আমাদের একটা বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা ভাবতে শিখেছি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ই স্বাধীনতা, শান্তি, কল্যাণ, প্রগতি, সাম্য এবং হরিৎবরণ আশা-আকাঙ্খার লালনক্ষেত্র। এইখানে এই বিশ্ববি্দ্যালয়ে এমন এক শন্কাহীন স্বাধীনতা নিবাস করেন, বিরাজ করেন এমন এক সুস্থশালীনতা আমাদের জ্ঞানদায়িনী মা বিশ্ববিদ্যায়ের অঙে অঙে এমন এক প্রসন্ন পবিত্রতার স্রোত প্রবাহিত হয়, কোন রাজন্য, কোন সমরনায়ক, কোন শক্তিদর্শী মানুষ কোনদিন তা স্থুল হস্তের অবলেপে কলন্কিত করতে পারেনি। আকাশের মত উদার, বাতাসের মত নির্ভর, অনির্বার ঝর্নার উৎসের মত স্বচ্ছ এবং সুনির্মল স্বত:স্ফুর্ত স্বাধীনতা এইখানে প্রতিদিন, প্রতিদিন বসন্তের নতুন মুকুলের আবেগে অন্কুরিত হয়।এই অন্কুঠিত স্বাধীনতার পরশমনির ছোঁয়ায় প্রতিটি আপদকালে এই জাতি বারেবারে নবীন হয়ে ওঠে। এর প্রতিষ্ঠাকালের পর থেকে আমাদের জন্মভুমির ওপর দিয়ে কতই না ঝড় বয়ে গেছে। কতবার ঘোড়ার খুরে, বন্দুকের আওয়াজে কেঁপে উঠেছে আকাশ, গর্বিত মিলিটারির বুটের সদম্ভ পদবিক্ষেপে চমকে উঠেছে রাত্রির হৃদয়। কত শাসক এল, কত মানুষ প্রাণ দিল। আমাদের এই ধৈর্যশীলা জ্ঞানদায়িনী মা সংহত মর্যাদার শক্তি, সাহস, বলবীর্য সবকিছু ফুরিয়ে যাবার পরেও শিখিয়েছে কি করে প্রতীক্ষা করতে হয়। নীরব ভাষায় মৌন আকাশের কানে কানে বারেবারে জানতে চেয়ে গেছে শক্তি, ক্ষমতা, দম্ভ এসবের পরিণতি কোথায়? ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অতন্রপ্রহরীর দল, তারা কোথায়? কোথায় মি. জিন্না, কোথায় নাজিমুদ্দিন, কোথায় নুরুল আমিন? জেনারেল আইয়ুব খান, আবদুল মোনেম খান, ইয়াহিয়া খান এই সমস্ত শক্তিদর্পী মানুষেরা আজ কোথায়? তাঁরা যে আতন্ক, যে ঘৃণা, যে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে এ দেশের জনপদবাসীর জীবনধারায় ঘুর্ণিঝড়ের সুচনা করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কি আপন সন্তানদের তার আর্তি থেকে বেরিয়ে আসার প্রেরনা দেয়নি?
20-09-1975
আহমদ ছফা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন