৮ ডিসেম্বর বরিশাল মুক্ত দিবস ! বরিশালে অবস্থানকারী পাকিস্তান আর্মির সদস্য ও মিলিশিয়ারা তখনও অস্ত্র সমাপর্ণ করে নাই। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে খুনি পাকিস্তানী আর্মিরা বরিশাল শহরে অপারেশনে বের না হলেও ওয়াপদা ক্যাম্পের আশে পাশে কেউ গেলেই তাকে গুলি করতো, তাদের গুলিতে সেই সময়ে বহু আহতও হয়েছিলেন। তাছাড়া তখনও বরিশাল শহরের প্রধান
প্রবেশমুখ শিকারপুরে ক্যাপ্টেন কাহারের নেতৃত্বে পাকিস্তান আর্মির শক্তিশালী একটি দলের ঘাঁটি ছিল। তারপরও ৮ ডিসেম্বর বরিশাল মুক্ত দিবস কেন হল তা বোধগম্য নয়। যদিও বিষয়টি নিয়ে বরিশাল নগরীর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া রয়েছে, তথাপি এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতেও তাঁরা বিব্রত বোধ করেন। ফলে যা চলছে তাই তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বলে যাচ্ছেন! অবশ্য সবাই না, চুপ থাকছেন অনেকেই! কেননা, তাদের সময়ে তাঁরা তাদের যুদ্ধটা ভাল মতোই করেছেন, নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেই করেছেন, তবে জীবন সায়াহ্নে এসে তাঁদের পক্ষে আর বাড়তি কোন চাপ নেয়া যৌক্তিক কারণেই সম্ভব নয়। এবার আসুন আমরা সেই সময়ের বরিশালের ঘটনাচক্রে দৃষ্টিপাত করি, তৎকালীন বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা লাভ করার চেষ্টা করি।
১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর বরিশালের তৎকালীন কালেক্টরেট ভবনের সভাকক্ষে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তারা, তৎকালীন জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও ঘৃনিত রাজাকার আবদুর রহমান বিশ্বাস, এ্যাডভোকেট আবদুর রব, শাহজাহান চৌধুরী, মাওলানা বশিরউল্লা আতাহারী, এ্যাডভোকেট প্রমথ কুমার সেনগুপ্ত, এডভোকেট আবুল হোসেন সিকদার, এ্যডভোকেট মেনহাজ উদ্দিন আহমেদ খান (নবগ্রাম রোড), সৈয়দ শের আলী (মোক্তার), প্রীন্সিপ্যাল কাজী মোতাহার হোসেন, খলিলুর রহমান (হেড মাষ্টার, নুরিয়া স্কুল). মীর আনোয়ার হোসেন (বড় মিয়া, আলেকান্দা), আমজেদ মৃধা (হাটখোলা), সামসুদ্দিন তালুকদার (হাটখোলা), আব্দুল মজিদ মুন্সি (রব উকিলের মহুরী, পরবর্তীতে উকিল), শ্বরূপ আলী চেয়ারম্যান (বাজার রোড), আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী (নবগ্রাম রোড), আবদুল মজিদ (নাজিরেরপুল), মতিয়ার রহমান তালুকদার, মতি মিয়া (নতুন বাজার), কাঞ্চন গাজী (বৈদ্যপাড়া), এরশাদ আলী (কাউনিয়া), রাজাকার কমান্ডার আব্বাস আলী (বাগেরহাট), আলবদর কমান্ডার আবুল বাসার গং উপস্থিত ছিল। পাকিস্তানী সামরিক কর্মকর্তারা যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে। সেই সভায় পাকি সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তাসহ অধিকাংশের বরিশাল ত্যাগ করে ঢাকায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সেই ৮ ডিসেম্বর সকালে মাইকে হঠাৎ করে বরিশালে কারফিউ ঘোষনা করা হলে শহরের মানুষ আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়ে। তবে, কারফিউ ঘোষণা হলেও পাকিস্তানী সেনা টহল ছিল না। এমনকি স্থানীয় পুলিশ, স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধী ও রাজাকারদেরও দেখা যায়নি। যদিও অন্যান্য দিনগুলোতে সব সময়ের জন্যই রাস্তায় সেনা, পুলিশ এবং সশস্ত্র রাজাকারদের টহলদারী থাকত। বরিশালগামী মহাসড়ক গুলো চারদিক থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রনে চলে যাওয়ায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দালালরা পালাবার পথ হিসেবে জলপথকেই বেছে নিয়েছিল সেইদিন। জাহাজ ‘কিউই’ সহ একাধিক গানবোট, লঞ্চ ও কার্গো বরিশাল ষ্টিমারঘাটে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। গভীর রাতে ওয়াপদা থেকে সেনাবাহিনী, মিলিশিয়া, বরিশাল শান্তি কমিটির একাধিক নেতা ‘কিউই’ জাহাজে অবস্থান নিয়েছিল। ‘কিউই’ জাহাজ বরিশাল ত্যাগ করে আগের রাত আনুমানিক ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে। জাহাজের সামনে ছিল গানবোট ও কার্গো। অপর একটি জাহাজ বরিশাল ত্যাগ করেছিল আনুমানিক সকাল ৪টার পর। এ জাহাজেও পাকিস্তানী সেনা, মিলিশিয়া, শান্তি কমিটির অন্যতম প্রভাবশালী নেতা শাহজাহান চৌধুরীসহ কয়েকজন রাজাকার ও দালাল ছিল। সেদিন পাকিস্থান আর্মি ও তাদের এদেশীয় দোসররা অতি গোপনে বরিশাল ঘাট ত্যাগ করলেও শেষপর্যন্ত নিজেদের রক্ষা করতে পারে নাই। মিত্র বাহিনীর বিমান হামলায় মুলাদীর কদমতলা নদীতে লঞ্চ, চাঁদপুরের মেঘনা মোহনায় ‘কিউই’ জাহাজসহ গানবোট ও কার্গো ধ্বংস হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের আরোহীদের সলিল সমাধি ঘটে।
৭ ডিসেস্বর সন্ধ্যায় বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলতান মাষ্টার ও তার দলের বীর মুক্তিযোদ্ধারা নবগ্রাম রোডের চৌমাথা পর্যন্ত এসে পৌঁছেছিলেন। পরদিন ৮ ডিসেম্বর সকালে তাঁরা বরিশাল শহরে প্রবেশ করেন। কোন ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই কোতয়ালী থানা দখল করেন। থানায় উপস্থিত পাকিস্তান পুলিশ বাহিনীর কতিপয় সদস্য আত্মসমর্পন করে। থানায় উড়িয়ে দেয়া হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এরপর লাকুটিয়া রোডে অবস্থান নেয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাই সাত্তার ফারুকের নেতৃত্বে বরিশাল শহরে প্রবেশ করে। তারা প্রথমে পাওয়ার হাউস ও পরে শহর হয়ে চরকাউয়া খেয়াঘাটে বরফকলে অবস্থান নেয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌ কমান্ডার আবুল বাসার, বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আবদুস সাত্তার, কোতয়ালী বেইজ কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান গৌরনদীর বেইজ কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নিজাম উদ্দিন হাওলাদার যার যার বাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে বরিশাল শহরে প্রবেশ করেন। বাবুগঞ্জের বেইজ কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ খান দুপুরের পরে বরিশাল টেক্সাটাইল মিলে ক্যাম্প স্থাপন করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা কুদ্দুস মোল্লা তার দল নিয়ে বরিশালে ঢুকেই জেলখানার দায়িত্বভার গ্রহন করেন। কারাগারে আটক থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি মুক্ত করে দেন। সাব সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান ওমর ছিলেন বাকেরগঞ্জে। ৯ ডিসেম্বর বিকেলে আহত অবস্থায় নৌকাযোগে পোর্ট রোডের হাজী আদম আলী ঘাটে নেমে অবস্থান নেন বরিশাল সার্কিট হাউজে।
এদিকে যে সব মিলিশিয়া, সশস্ত্র রাজাকার আলবদর পালিয়ে যেতে পারেনি তারা আশ্রয় নিয়েছিল পাকিস্তান সেনাদের ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে পরিচিত ওয়াপদায়। এছাড়াও বরিশাল শহরের প্রধান প্রবেশমুখ শিকারপুরে ক্যাপ্টেন কাহারের নেতৃত্বে পাকিস্তান আর্মির শক্তিশালী একটি দলের ঘাঁটি ছিল।
মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক নুরুল ইসলাম মনজুর এবং তাঁর সাথে থাকা সীমান্তের ওপারে ভারতীয় ভূমিতে অবস্থিত শরনার্থী শিবির ও নবম সেক্টরের সদর দপ্তরের আশে-পাশে নিরাপদে আশ্রয় গ্রহণকারী কতিপয় সুবিধাবাদী ব্যক্তিসহ খুলনা অঞ্চলের সাব-সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ এর নেতৃত্বে সুন্দরবন অঞ্চল হয়ে নৌপথে তিন শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা ১টি লঞ্চ ও ৩০টি নৌকার বহর নিয়ে বরিশাল এসে পৌঁছেছিলেন। লঞ্চটির নাম ছিল ‘বিউটি অব খুলনা’। যদিও নবম সেক্টরের আরও দুইটি লঞ্চ ছিল যার কোন হদিস পাওয়া যায় নাই।
মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক নুরুল ইসলাম মনজুরের উপস্থিতিতে ওয়াপদায় অবস্থানকারী রাজাকার, স্বাধীনতা বিরোধী ও পাকিস্তানী সেনা ও মিলিশিয়ারা সাব-সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ এর নিকট আত্মসমর্পন করে। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ ও নুরুল ইসলাম মনজুর একটি মটর সাইকেলে শিকারপুরে পাকিস্তানী বাহিনীর ক্যাম্পে যান। সেখানে তারা কয়েক ঘন্টা আলোচনার পর পাকিস্তানী সেনাদের আত্মসমর্পণে রাজী করান। তবে পাকিস্তানী সেনারা কিছু শর্ত দিয়েছিল। শিকারপুর থেকে বরিশাল নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পাকিস্তানী সেনাদের বাসে করে নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে তাদের হাটিয়ে বরিশাল শহরের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয় ওয়াপদা ক্যাম্পে। একটি খোলা জিপে বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানী সেনাদের অগ্রভাগে ছিলেন। তখনও পাকিস্তানী সেনাদের প্রত্যেকের কাছে ২টা করে গুলিসহ অস্ত্র ছিল। একাত্তরে একমাত্র বরিশালেই দখলদার হানাদার বাহিনী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্নসমর্পন করেছিল, অন্যান্য সব স্থানে তারা মিত্র বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। সেদিন বরিশালে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল, সে এক ঐতিহাসিক মুর্হূত! ৯ মাস গনহত্যা চালানো পাকিস্তানী সেনারা অবনত মস্তকে হেটে যাচ্ছিল আর বরিশালবাসী রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে ফুলেল বিজয় উল্লাস করছিল, শ্লোগান দিচ্ছিল জয়বাংলা! জয়বাংলা! পাকিস্তানী সেনাদের পায়ে হাটিয়ে ওয়াপদা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে জেনেভা কনভেনশনের শর্ত অনুযায়ী ‘ফল ইন’ করানো হয়, তাদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে বন্দি করা হয়। এরপর মিত্র বাহিনীর জাহাজ বরিশালে এলে তাদের নিকট পাকিস্তানী সেনাদের হস্তান্তর করা হয়। আর এভাবেই পুরোপুরি মুক্ত হয়েছিল নয় মাসের অবরুদ্ধ বরিশাল।
বি.দ্র: বিউটি অব খুলনা বরিশালে পৌঁছানোর তারিখ এবং শিকারপুরের পাকিস্তানী সেনাদের আত্নসমর্পনের তারিখ নিয়ে বরিশালের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মতভেদ থাকায় কোন তারিখ উল্লেখ করা হয় নাই।
সূত্রঃ একাত্তরের শহীদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন