১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর বরিশাল কালেক্টরেট ভবনের সভা কক্ষে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় হানাদার বাহিনীর পদস্থ অফিসার, জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের অফিসার, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও ঘৃনিত রাজাকার আবদুর রহমান বিশ্বাস, এ্যাডভোকেট আবদুর রব, শাহজাহান চৌধুরী, মাওলানা বশিরউল্লা আতাহারী, এ্যাডভোকেট প্রমথ কুমার সেনগুপ্ত, এডভোকেট আবুল হোসেন সিকদার, এ্যডভোকেট মেনহাজ উদ্দিন আহমেদ খান (নবগ্রাম রোড), সৈয়দ শের আলী (মোক্তার), প্রীন্সিপ্যাল কাজী মোতাহার হোসেন, খলিলুর রহমান (হেড মাষ্টার, নুরিয়া স্কুল). মীর আনোয়ার হোসেন (বড় মিয়া, আলেকান্দা), আমজেদ মৃধা (হাটখোলা), সামসুদ্দিন তালুকদার (হাটখোলা), আব্দুল মজিদ মুন্সি (রব উকিলের মহুরী,
পরবর্তীতে উকিল), স্বরূপ আলী চেয়ারম্যান (বাজার রোড), আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী (নবগ্রাম রোড), আবদুল মজিদ (নাজিরেরপুল), মতিয়ার রহমান তালুকদার, মতি মিয়া (নতুন বাজার), কাঞ্চন গাজী (বৈদ্যপাড়া), এরশাদ আলী (কাউনিয়া), রাজাকার কমান্ডার আব্বাস আলী (বাগেরহাট), আলবদর কমান্ডার আবুল বাসার গং উপস্থিত ছিল।
সামরিক কর্মকর্তারা যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে। সভায় সেনাবাহিনীর বরিশাল ত্যাগ করে ঢাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৮ ডিসেম্বর সকালে মাইকে হঠাৎ করে বরিশালে কারফিউ ঘোষনা করা হলে মানুষ আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়ে। তবে, কারফিউ ঘোষণা হলেও সেনাটহল ছিল না। এমনকি পুলিশ রাজাকারদের দেখা যায়নি।
অন্যান্য দিনগুলোতে সব সময়ের জন্যই রাস্তায় সেনা, পুলিশ এবং রাজাকারদের টহলদারী থাকত। সড়ক পথ চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রেনে চলে যাওয়ার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পালাবার পথ হিসেবে পানি পথকেই বেছে নিয়েছিল। জাহাজ কিউইসহ একাধিক গানবোট, লঞ্চ ও কার্গো বরিশাল ষ্টিমারঘাটে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। গভীর রাতে ওয়াপদা থেকে সেনাবাহিনী, মিলিশিয়া, একাধিক শান্তি কমিটির নেতা কিউই জাহাজে অবস্থান নেয় । কিউই জাহাজ বরিশাল ত্যাগ করে আগের রাত ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে। জাহাজের সামনে ছিল গানবোট ও কার্গো। অপর জাহাজটি বরিশাল ত্যাগ করেছিল সকাল ৪টার পর। এ জাহাজেও পাকসেনা, মিলিশিয়া, শাহজাহান চৌধুরীসহ কয়েকজন রাজাকার ও দালাল ছিল। পাকিস্থানী আর্মি অতি গোপনে বরিশাল ঘাট ত্যাগ করে। এ গোপনীয়তার পরেও পাকিস্থানী বাহিনী নিজেদের রক্ষা করতে পারেনী। ভারতীয় বিমান বাহিনীর হামলায় মুলাদীর কদমতলা নদীতে লঞ্চ, চাঁদপুরের মেঘনা মোহনায় কিউই জাহাজসহ গানবোট ও কার্গো ধ্বংস হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের আরোহীদের সলিল সমাধি হয়।
৭ ডিসেস্বর সন্ধ্যায় সুলতান মাষ্টার তার দলবল নিয়ে নবগ্রাম রোডের চৌমাথা পর্যন্ত পৌছেছিল। ৮ ডিসেম্বর সকালে তিনি মুক্ত বরিশাল শহরে প্রবেশ করে কোতয়ালী থানা দখল করেন। পুলিশ বাহিনী আত্মসমর্পন করে। থানায় উড়িয়ে দেয়া হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এরপর লাকুটিয়া রোডে অবস্থান নেয়া রেজাই সাত্তার ফারুকের নেতৃত্বে শহরে প্রবেশ করে। তারা প্রথমে পাওয়ার হাউস ও পরে শহর হয়ে চরকাউয়া খেয়াঘাটে বরফকলে অবস্থান নেয়। নৌ কমান্ডার আবুল বাসার, অধ্যাপক আবদুস সাত্তার, কোতয়ালী বেইজ কমান্ডার আব্দুল মান্নান গৌরনদীর বেইজ কমান্ডার নিজাম উদ্দিন হাওলাদার যার যার নিজ বাহিনী নিয়ে বরিশাল শহরে প্রবেশ করেন । বাবুগঞ্জের বেইজ কমান্ডার আব্দুল মজিদ খান দুপুরের পরে বরিশাল টেক্সাটাইল মিলে ক্যাম্প গঠন করেন। কুদ্দুস মোল্লা তার দল নিয়ে বরিশালে ঢুকে জেলখানার দায়িত্বভার গ্রহন করেন। কারাগারে আটক থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি মুক্ত করে দেন। সাব সেক্টর কমান্ডার শাহজাহান ওমর ছিলেন বাকেরগঞ্জে। ৯ ডিসেম্বর বিকেলে আহত অবস্থায় নৌকাযোগে পোর্ট রোড হাজী আদম আলী ঘাটে নেমে অবস্থান নেন সার্কিট হাউজে। এদিকে যে সব রাজাকার আলবদর পালিয়ে যেতে পারেনি তারা আশ্রয় নিল পাকসেনাদের ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে পরিচিত ওয়াপদায়। বরিশালের আশে-পাশে থাকা পাক সেনারা ওয়াপদা এলাকায় আশ্রয় নেয় এবং বাংকারে ঢুকে অস্ত্র তাক করে ঘোষনা করল নুরুল ইসলাম মনজুর ছাড়া আর কারও কাছে তারা আত্মসমর্পন করবে না।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নুরুল ইসলাম মনজুর এবং তাঁর সাথে থাকা সীমান্তের ওপারে ভারতীয় ভূমিতে অবস্থিত শ্মরনার্থী শিবির ও ৯ম সেক্টরের সদর দপ্তরের আশে-পাশে নিরাপদে আস্রয় গ্রহণকারী কতিপয় সুবিধাবাদী ব্যক্তিসহ খুলনা অঞ্চলের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ এর নেতৃত্বে সুন্দরবন অঞ্চল হয়ে নৌপথে তিনশতাধীক মুক্তিযোদ্ধা ৩টি লঞ্চ ও ৩৫ টি নৌকা বহর নিয়ে বরিশাল পৌছেন ১৭ ডিসেম্বর। ঐদিনই বিকেলে ওয়াপদায় অবস্থানকারী রাজাকার, আলবদরা ও পাক সেনারা সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ এর কাছে আত্মসমর্পন করেছে। এরপর, শিকারপুরে ফেরীঘাটে অবস্থানরত অবশিষ্ট বর্বর পাক সৈন্যরা ক্যাপ্টেন কাহারের নেতৃত্বে ১৯ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ এর কাছে আত্মসমর্পণ করে । পরাজিত পাকিস্তানি সৈন্যদের বরিশাল সদর রোড থেকে হাটিয়ে ওয়াপদায় নিয়ে যাওয়া হয়। গৌরনদী কলেজ ক্যাম্পে আটকে পড়া দেড়শ পাকিস্তানী দখলদার সৈন্য ২২ ডিসেম্বর মুজিবাহিনী ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তাদেরকেও বন্দী করে বরিশাল ওয়াপদা ঘাঁটিতে নিয়ে আসা হয়। শেষ হয় বরিশাল থেকে পাকিস্থানী দখলদারিত্ব। এভাবেই মুক্ত হয়েছিল ০৯ মাসের অবরুদ্ধ বরিশাল।
সূত্রঃ রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতাপ্রাপ্ত যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল হোসেন ফোরকা্ন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন