
বিপ্লবী গণবাহিনীর ঢাকা নগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা বেশ তৎপর হয়ে ওঠে। শেখ মুজিবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন উপলক্ষে একটা শক্তির মহড়া দেওয়ার চিন্তা করা হয়। কিন্তু তেমন কোনো বিক্ষোভ বা মিছিলের পরিকল্পনা করা যায়নি।
চুয়াত্তরের নভেম্বরে বোমা বানাতে গিয়ে তরুণ জাসদ নেতা ও প্রকৌশল
বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের লেকচারার নিখিল রঞ্জন সাহা নিহত হন।তাঁর নামে ওই বোমার নামকরণ হয় ‘নিখিল’।নিখিলের প্রস্তুতপ্রণালি ছিল স্থূল। ঢাকা নগর গণবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেন ‘নিখিল’ ইমপ্রুভাইজ করেন।আনোয়ার হলেন গণবাহিনীর ফিল্ড কমান্ডার লে. কর্নেল (অব.) আবু তাহেরের ছোট ভাই, তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে লেকচারার হিসেবে কর্মরত। রসায়ন তিনি ভালো বোঝেন। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের আগমন যাতে নির্বিঘ্ন না হয়, সে জন্য তাঁর নির্দেশে গণবাহিনীর সদস্যরা ১৪ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে তিনটি ‘নিখিল’ ফোটায়। একটি বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের কাছে, একটি সায়েন্স অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ের চত্বরে এবং তৃতীয়টি কার্জন হলের সামনে। এর ফলে কিছু হুড়োহুড়ি এবং হইচই হয়। তবে তা ছিল ক্ষণস্থায়ী।
১৫ আগস্ট ভোরবেলা ঢাকা শহরের অনেক অধিবাসীর ঘুম ভাঙে গোলাগুলির আওয়াজে। দিনটি ছিল ৩০ শ্রাবণ, শুক্রবার। রেডিওতে ঘোষণা শোনা যাচ্ছিল: আমি মেজর ডালিম বলছি। স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে উৎখাত করা হয়েছে। সারা বিশ্বে কারফিউ জারি করা হয়েছে। উত্তেজনার বশে ডালিম সারা বিশ্বে কারফিউ জারি করে দিলেন। তিনি ঘোষণা শেষ করলেন ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়ে। ঢাকা বেতারে ‘জিন্দাবাদ’ শোনা গেল প্রায় ৪৪ মাস পরে।
ধীরে ধীরে ১৫ আগস্টের ঘটনার বিবরণ প্রকাশ হতে থাকল। জানা গেল, সেনাবাহিনীর একদল জুনিয়র অফিসার এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন। তাঁদের নেতা মেজর ফারুক রহমান ও মেজর খন্দকার আবদুর রশিদ। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন আরও কয়েকজন মেজর, ক্যাপ্টেন, লেফটেন্যান্ট ও জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার। তাঁদের অনেকেই সেনাবাহিনী থেকে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বরখাস্ত হয়েছিলেন। এই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা। পরে তাঁকে মেজর পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। হুদা ১৯৬৫-৬৭ সালে ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। তখন তিনি ছাত্রলীগ করতেন। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। ছাত্র থাকাকালীন তিনি সেনাবাহিনীর ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। তাঁর কলেজজীবনের অন্তরঙ্গ বন্ধুদের একজন ছিলেন আবদুল বাতেন চৌধুরী। বাতেন জাসদের ঢাকা নগর পার্টি ফোরামের অন্যতম সদস্য। তিনি মুহসীন হলের ৩-এ নম্বর কক্ষে থাকতেন। হুদা বাতেনের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। বাতেন স্কুলজীবন থেকেই ছাত্রলীগের সদস্য এবং ১৯৭২-৭৩ সালে এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তাঁর স্মৃতিচারণা থেকে এখানে উদ্ধৃত করা হলো:
১৩ আগস্ট বিকেল তিনটায় সেনা গোয়েন্দা দপ্তরের (ডিএমআই) ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা অসামরিক পোশাকে মুহসীন হলে আমার
কক্ষে এল। সে ঢাকা শহরের দায়িত্বে ছিল। আমরা সূর্য সেন হলের ক্যানটিনে গিয়ে চা খেলাম এবং তারপর রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে একটা গাছের নিচে ঘাসের ওপর বসলাম। তারপর শুরু হলো কথাবার্তা।
হুদা: তোরা যেভাবে চেষ্টা করছিস, তাতে কিছু হবে না। লেট আস ইউনাইট অ্যান্ড গিভ হিম এ ব্লো।
বাতেন: ইউনাইট হতে পারি, কিন্তু ব্লো দিতে পারব না। আমরা বিপ্লবে বিশ্বাস করি। তুমি যা বলছ, সে পথ আমাদের নয়।
এভাবে কিছুক্ষণ কথা বলার পর সন্ধ্যা হয়ে এল।তাঁরা দুজন বলাকা বিল্ডিংয়ের দোতলার একটা চায়নিজ রেস্তোরাঁয় খাবার খেলেন। হুদা চলে যাওয়ার সময় বাতেনকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘কাল-পরশু দুদিন হলে না থাকাই ভালো। বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। নানা ধরনের চাপ থাকবে। রাতে বাইরে থাকিস।’ হুদা বাতেনকে যোগাযোগের জন্য একটা টেলিফোন নম্বর দিলেন।
বাতেন সে রাতে মুহসীন হলেই ছিলেন।১৪ আগস্ট তিনি আজিমপুর কলোনিতে তাঁর বোনের বাসায় যান এবং সেখানেই রাত কাটান।
১৫ আগস্ট সকালে ঘুম ভাঙতেই রেডিওতে তিনি অভ্যুত্থানের সংবাদ পান। তিনি হেঁটে হেঁটে নিউমার্কেট-নীলক্ষেতের মোড়ে বিউটি রেস্টুরেন্টে যান এবং সেখানে নাশতা করেন। তারপর মুহসীন হলের দিকে রওনা হতেই দেখলেন বেশ কয়েকজন ছাত্র ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। তারা অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত।বাতেন এদের মধ্যে ফকির গোলেদার রহমানকে দেখলেন। গোলেদার মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র এবং সরকার-সমর্থিত ছাত্রলীগের একজন নেতা গোছের ছিলেন।তাঁর পরনে লুঙ্গি এবং গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। গোলেদার বললেন, তিনি হলের গ্রিলবিহীন জানালা দিয়ে হল অফিসের একতলার ছাদে লাফিয়ে নেমেছেন এবং এখন যতদূর সম্ভব চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। বাতেনকে তিনি বললেন, ‘আমারে মাপ কইরা দিস।’
বাতেন মুহসীন হলে তাঁর কক্ষে গেলেন।তিনি ঘরে জাহাঙ্গীর ও রুবেলকে পেলেন।ওঁরা ওই কক্ষেই থাকতেন। জাহাঙ্গীর গণবাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। বাতেন বললেন, ‘তোরা আমার বোনের বাসায় চলে যা।’ তিনি নিজেই তাঁদের আজিমপুরে বোনের বাসায় নিয়ে এলেন।
বেলা ১১টার দিকে বজলুল হুদা বাতেনের বোনের বাসায় এসে হাজির হলেন।তিনি বাতেনকে নিয়ে বেরোলেন। তিনি নিজেই একটা জিপ চালাচ্ছিলেন। জিপের পেছনে একটা পিকআপে কয়েকজন সিপাহি।হুদা বললেন, ‘জাসদের সাপোর্ট দরকার, এটার ব্যবস্থা করো।’ বাতেন বললেন, ‘জাসদ সাপোর্ট দেবে না। জাতীয় ঐক্যের চেষ্টা করো। তাজউদ্দীনকে আনো, রাজ্জাককে আনো।’
হুদা বাতেনকে নিয়ে গণভবনের পেছনে একটা সেনা ক্যাম্পে গেলেন। সেখানে একটা ক্যানটিনে তাঁরা পরোটা-মাংস খেলেন। তারপর বাতেনকে আসাদগেটের কাছে নামিয়ে দিয়ে তাজউদ্দীনের বাসার দিকে রওনা হলেন। হুদা পরে তাজউদ্দীনের বাসায় তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বাতেনকে বলেছিলেন। তাজউদ্দীনকে হুদা সরকার গঠনের অনুরোধ জানালে তাজউদ্দীন জবাবে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে আমি প্রধানমন্ত্রী-প্রেসিডেন্ট হতে চাই না।’
বাতেনকে হুদা মুজিব হত্যার বিবরণ দিয়েছিলেন। তাঁর ভাষ্যমতে, ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবের বাড়িতে ওরা আক্রমণ চালায় মেজর (অব.) নূর চৌধুরীর নেতৃত্বে। গোলাগুলির শব্দ শুনে শেখ কামাল বেরিয়ে আসেন। একতলা থেকে তিনি প্রথমে গুলি ছোড়েন। হুদা তৎক্ষণাৎ কামালকে গুলি করে হত্যা করেন। গোলাগুলির শব্দ শুনে শেখ মুজিব ওপর থেকে চিৎকার করে তাঁদের গোলাগুলি থামাতে বলেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের কোনো কিছু বলার থাকলে ওপরে এসে আমাকে বলো।’ হুদারা তখন দোতলায় ওঠেন। শেখ মুজিবকে দেখে হুদা স্যালুট দেন। রাষ্ট্রপতিকে সামনাসামনি দেখে ভয়ে এবং উত্তেজনায় তাঁর পা কাঁপছিল। সাহস সঞ্চয় করে হুদা বলেন, ‘আমরা আপনাকে নিতে এসেছি। আমাদের সঙ্গে আপনাকে যেতে হবে।’ শেখ মুজিব ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘কোথায় যাব? কেন যাব? না, আমি যাব না।’
হুদা সাহস সঞ্চয় করে বলেন, ‘আপনাকে যেতেই হবে।’ তিনি শেখ মুজিবের গলার কাছে রিভলবারের নল ঠেকালেন। শেখ মুজিব বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি একটু চেঞ্জ করে আসি।’ তাঁর পরনে লুঙ্গি, হুদা সময় নষ্ট করতে রাজি ছিলেন না। বললেন, ‘এ পোশাকেও আপনি বঙ্গবন্ধু, চেঞ্জ করলেও বঙ্গবন্ধুই থাকবেন। পোশাক বদলানোর দরকার নেই।’ মুজিব তাঁদের সঙ্গে যেতে রাজি হলেন। বললেন, ‘দাঁড়াও, আমার পাইপ আর তামাক নিয়ে আসি।’ এই বলে তিনি তাঁর ঘরে গেলেন এবং পাইপ নিয়ে বেরিয়ে এলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছালে পেছন থেকে একজন একটা গামছা বের করে মুজিবের চোখ বাঁধতে যান। মুজিব হাত দিয়ে এক ঝটকায় তাঁকে সরিয়ে দেন। হাতের আঘাত থেকে বাঁচতে হুদা হাঁটু মুড়ে বসে পড়েন। তখন পেছন থেকে একজন মুজিবের ওপর ব্রাশফায়ার করেন। মুজিব ঘটনাস্থলেই নিহত হন। অন্যরা এ সময় দোতলায় গিয়ে বাড়ির সবাইকে হত্যা করেন। ‘অপারেশন’ শেষ করে ফেরার সময় হুদা কামালের টয়োটা গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে আসেন এবং সেনানিবাসে তাঁর মেসের সামনে রেখে দেন।
বাতেন হুদাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তাঁকে তোমরা কোথায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলে?’ হুদা বলেছিলেন, ‘রেডিও স্টেশনে। সেখানে তাঁকে অ্যানাউন্সমেন্ট দিতে হতো, ‘বাকশাল বাতিল করা হয়েছে, খন্দকার মোশতাককে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’ হুদা আরও বলেছিলেন, ‘আমি জানতাম না, তাঁকে মেরে ফেলার কোনো পরিকল্পনা ছিল। আমার অ্যাসাইনমেন্ট ছিল, তাঁকে ধরে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যাওয়া।’ বাতেন জানতে চেয়েছিলেন, ‘তোমরা তো তাঁকে পেয়েছিলেই, অন্যদের মারতে গেলে কেন?’ হুদা জবাব দিল, ‘শেখ মুজিবকে মেরে ফেলার পর আমরা আর কোনো সাক্ষী রাখতে চাইনি।’
প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিতব্য বই জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি থেকে নেওয়া অংশবিশেষ।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন