তাহেরের সঙ্গে জিয়া কোথাও যেতে চাননি

‘তাহের জিয়াকে বেতারকেন্দ্রে নিয়ে আসতে এবং তাকে দিয়ে একটি ভাষণ দেয়াতে চেয়েছিলেন। জিয়া তাহেরের সঙ্গে কোথাও যেতে চাননি। কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা পরামর্শ দেন, সেনাপ্রধানের বেতারকেন্দ্রে যাওয়ার কী দরকার? ভাষণ তো এখানেই রেকর্ড করা যায়? শেষ পর্যন্ত জিয়ার ভাষণ সেনানিবাসেই রেকর্ড করা হয়। ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় এই ভাষণ প্রচার করা হয়।’ 
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের প্রকাশিতব্য গ্রন্থে এসব কথা বলা হয়েছে। দৈনিক প্রথম আলোর ঈদ

সংখ্যায় ‘৭ নভেম্বরের সাত-সতেরো’ শিরোনামে বইটির অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছে।
জিয়ার ভাষণ:
‘প্রিয় দেশবাসী,
আসসালামু আলাইকুম।
আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলছি। বর্তমান পরিস্থিতি বাংলাদেশের জনগণ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ আনসার এবং অন্যদের অনুরোধে আমাকে সাময়িকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ও সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়েছে। এ দায়িত্ব ইনশাআল্লাহ আমি সুষ্ঠুভাবে পালন করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আপনারা সবাই শান্তিপূর্ণভাবে যথাস্থানে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করুন। দেশের সর্বস্থানে- অফিস-আদালত, যানবাহন, বিমানবন্দর, নৌবন্দর ও কলকারখানা পূর্ণভাবে চালু থাকবে। আল্লাহ আমাদের সকলের সহায় হোন। খোদা হাফেজ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
জিয়ার এই ভাষণে কোথাও জাসদ, গণবাহিনী বা তাহেরের উল্লেখ নেই। সকালেই ‘সিপাহি বিপ্লবের’ ঘণ্টা বেজে গিয়েছিল। এই ভাষণ ‘বিপ্লবের’ কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিল।”
‘উল্লেখ্য, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের কুশীলবদের অনেকেই যে যেখানে পারেন, গা ঢাকা দেয়ার চেষ্টা করেন। অনেকেই গ্রেফতার হন। শাফায়াত জামিল পালিয়ে যাওয়ার সময় আহত হন এবং পরে নারায়ণগঞ্জ থানায় আত্মসমর্পণ করেন। তাকে ঢাকায় এনে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিত্সার ব্যবস্থা করা হয়।
৭ নভেম্বর ভোরে খালেদ মোশাররফ তার দুই সহযোগী কর্নেল হায়দার ও কর্নেল হুদাকে নিয়ে শেরেবাংলা নগরে সেনাবাহিনীর একটি ইউনিটে যান। সেখানেই তাদের হত্যা করা হয়। তাদের কার নির্দেশে হত্যা করা হয়েছিল, তা আজও অজানা। কেউ বলেন তাহের, কেউ বলেন জিয়া।
কয়েক মাস পর ঢাকার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে মেজর হাফিজের সঙ্গে আ কা ফজলুল হকের দেখা হয়। হাফিজ তখন সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত। মোহামেডান ক্লাবের ফুটবল টিমের তিনি অধিনায়ক ছিলেন। তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, জিয়াকে গৃহবন্দি রাখার পরিকল্পনাটি ছিল হাফিজের। আবার হাফিজের কারণেই জিয়া কিলড হননি। এতে মনে হতে পারে, জিয়াকে আটক রাখার ব্যাপারটা ছিল সাজানো।
অভ্যুত্থানকারীরা জিয়াকে তার বাসভবনে অন্তরীণ করার সময় ড্রইংরুমের টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার শয়নকক্ষের টেলিফোন লাইনটি সচল ছিল। এই টেলিফোনের মাধ্যমেই জিয়া তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন।
৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারীদের মধ্যে খালেদ, হায়দার ও হুদা ছাড়া আর কেউ নিহত হননি। তাদের বিরুদ্ধে জিয়া প্রকাশ্যে কখনো কিছু বলেছেন বলে জানা যায় না। তবে ‘বিশ্বাসঘাতক খালেদ মোশাররফচক্রের’ বিরুদ্ধে বিষোদগার করে সেনানিবাসে প্রচারপত্র দিয়েছিল সৈনিক সংস্থা।
৮ নভেম্বর জাসদের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম চত্বরে একটা সমাবেশের চেষ্টা করা হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেখানে আক্রমণ চালিয়ে সমবেত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেন। তাদের গুলিতে আ ফ ম মাহবুবুল হক আহত হন।
৮ নভেম্বর রাতে রাজশাহী কারাগার থেকে জাসদের সভাপতি মেজর জলিল সাধারণ সম্পাদক আসম আবদুর রব ছাড়া পান। পরদিন তারা ঢাকায় আসেন। এর আগে ৭ নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার একটি দল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক খুলে দিলে জাসদের নেতা এম এ আউয়াল, মোহাম্মদ শাজাহান ও মির্জা সুলতান রাজা বেরিয়ে আসেন। তারা সবাই তখন হতবিহ্বল।
৮ নভেম্বর চিত্রপট একটু বদলে যায়। রাষ্ট্রপতি সায়েম নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং তিন বাহিনীর প্রধানদের উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা দেন। এর সঙ্গে আরও অনেকগুলো আদেশ জারি করা হয় এবং ‘এই ফরমান ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট তারিখের ফরমানের অংশবিশেষ বলে গণ্য হবে’ বলে উল্লেখ করা হয়।
তাহেরের অনুরাগী মেজর জিয়াউদ্দিন ছিলেন সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার মেজর। ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানের সময় তিনি দাফতরিক কাজে খুলনায় ছিলেন। ঢাকায় এসে তিনি সব জানতে পারেন এবং বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ৮ নভেম্বর রাতে সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে পিরোজপুরের দিকে রওনা হন। লঞ্চে অনেক আনসার ছিলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় ৯ নম্বর সেক্টরে তার সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করেছেন। পিরোজপুরে তিনি আরও কিছু লোককে সংগঠিত করার নির্দেশ দিয়ে লঞ্চটা নিয়ে সুন্দরবনের উদ্দেশে যাত্রা করেন। প্রথমেই তিনি শরণখোলা থানা দখলে নিয়ে নেন এবং ওই এলাকাকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করে ‘বিপ্লবের ঘাঁটি’ বানান।
তাহেরের সঙ্গে জিয়ার যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে আসে এবং ১২ নভেম্বর থেকে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। মেজর জলিল ও আ স ম আবদুর রবের একটি বক্তব্য লিফলেট হিসেবে ছেপে বিলি করা হয়। বক্তব্যে বলা হয়:
... এ মাসের (নভেম্বর) প্রথম দিকে, বিশেষ করে ৩ তারিখে, বিশ্বাসঘাতক ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ভারত, রাশিয়া ও আমেরিকার প্ররোচণায় তারা দেশ ও জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বকে চিরতরে বিলুপ্ত করার চরম আঘাত হানার প্রস্তুতি নিয়েছিল। এ ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের পূর্ব মুহূর্তেই বাংলার বিপ্লবী সিপাহিরা, বিপ্লবী গণবাহিনী ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুবক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবীসহ সব দেশপ্রেমিক নাগরিকের সমর্থন ও সক্রিয় সহায়তায় আঘাত হানল শত্রুর দুর্গে। মুক্ত করল মৃত্যুর কবল থেকে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে, মুক্ত করল আমাদেরকে। ...কিন্তু ভুললে চলবে না যে আমাদের এ বিজয় অত্যন্ত সাময়িক। ... আমরা দেখতে পাচ্ছি যে দেশীয় শোষক ও সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদের দালালেরা তাদের প্রভুদের ইঙ্গিতে নতুন পোশাক পরে আবার জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। এদের সমূলে উত্খাত না করা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।...
জলিল ও রব বাকশালকে বাদ দিয়ে সব প্রকাশ্য ও গোপন রাজনৈতিক দল নিয়ে একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার’ গঠন এবং অবিলম্বে সামরিক আইন বাতিলের দাবি জানান। অন্যান্য দাবির মধ্যে ছিল সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা; ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দূতাবাস সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া, জাতিসংঘের কাছে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে নালিশ জানানো; সব রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি ও সকল প্রকার গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করা ইত্যাদি।
জাসদের নেতাদের একটা গোপন সভা ১৭ নভেম্বর রায়েরবাজারে একটা কাঠের আড়তে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় তারা বলেন, ‘জিয়া বিট্রে করেছে।; জলিল বলেন, ‘ভয়ের কোনো কারণ নাই। বঙ্গভবনের সামনে যেসব ট্যাংক আছে, ওরা আমার সঙ্গে কথা বলে গেছে।’
নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে শাজাহান সিরাজের শ্বশুরবাড়িতে জলিলের সঙ্গে সাংবাদিক আমানউল্লাহ দেখা করতে যান। আমানউল্লাহর বর্ণনামতে: জলিলকে খুব অস্থির মনে হচ্ছিল। জিয়া সম্পর্কে ক্ষোভের সঙ্গে বলল, ‘দ্যাট বাস্টার্ড হ্যাজ বিট্রেইড, বেজন্মাটা বেইমানি করেছে।’
ইতিমধ্যে সৈনিকেরা বেশিরভাগই সেনানিবাসে ফিরে গেছেন। তাহের বিভিন্ন সেনানিবাসে তার অনুগত লোকদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। ২৩ নভেম্বর এলিফ্যান্ট রোডে শাজাহান সিরাজের শ্বশুরবাড়ি থেকে জলিল ও রবকে পুলিশ গ্রেফতার করে। একই দিন আবু ইউসুফ খান ও ইনু গ্রেফতার হন। ২৪ নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কয়েকজনকে নিয়ে তাহের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক শিক্ষক ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের লেকচারার মোস্তফা সরোয়ার বাদলের বাসায় সভা করার সময় নিরাপত্তা বাহিনী তাদের ঘিরে ফেলে। তাহের কয়েকজন সহযোগীসহ গ্রেফতার হন।’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন