তাহেরের জীবন এবং রাজনীতিবিষয়ক একটা বই লেখার সুবাদে তাহের পরিবারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তাদের পরিবারের একজন সদস্য কর্নেল তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহেরের কাছে সংরক্ষিত এই চিঠিটা আমার নজরে আনেন। চিঠিটা ইংরেজিতে লেখা। চিঠির ব্যাখ্যার আগে এর একটা বাংলা অনুবাদ হাজির করছি:
এম এ, তাহের বি উ, লে. কর্নেল (অব.)
ম্যানেজার, সি-ট্রাক ইউনিট
৩০ আর কে দাশ রোড
নেতাইগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা
তারিখ: ১৩ অক্টোবর ১৯৭৩
কর্নেল তাহের এই চিঠি লেখার সময় সেনাবাহিনীর সদস্য নন। এর ঠিক বছর খানেক আগে নীতিগত প্রশ্নে তিনি সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেছেন এবং ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের সি-ট্রাক ইউনিটে। অন্তরালে অবশ্য তখন জাসদ রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় আছেন। এমন একটা পর্যায়ে তিনি ফিলিস্তিন যুদ্ধে সশরীরে যুক্ত হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করছেন। যোদ্ধা হিসেবে তাঁর যোগ্যতা প্রমাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে তিনি তাঁর পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাঁর এতই তীব্র যে তিনি সে সুযোগ যেন কিছুতেই হাত ফসকে না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীকে সচেতন করে দিচ্ছেন যেন তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধিত্ব এই ক্ষেত্রে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
আমরা জানি যে ১১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের যুদ্ধক্ষেত্রে শেলের আঘাতে একটি পা হারিয়েছিলেন। পৃথিবীর সামরিক ইতিহাস সম্পর্কে তাহেরের জানাশোনার পরিধি কতটা ব্যাপক তা বোঝা যায় যখন তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধিতা যে যুদ্ধ পরিচালনায় কোনো বাধা না, সে যুক্তি দেখাতে গিয়ে অনেক সমরনায়কের নাম উল্লেখ করেছেন। তাহের যে সাম ব্রাউনের কথা বলেছেন, তিনি ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সেনাবাহিনীর সেনাকর্তা ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং ব্রিটিশ-আফগান যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে ভিক্টোরিয়া ক্রস পেয়েছিলেন। তাঁর একটা হাত ছিল না। প্রতাপশালী জার্মান জেনারেল স্টফেনবার্গের কথা উল্লেখ করেছেন তাহের, যিনি হিটলারকে হত্যা করে উৎখাত করার পরিকল্পনা করেছিলেন, যাঁকে পরে ফায়ারিং স্কয়াডে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁরও একটা হাত ছিল না। ডগলাস বাডার দুর্ঘটনায় দুটি পা-ই হারিয়েছিলেন, তারপরও তিনি পাইলট হিসেবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় দেন এবং বহু খেতাব পান। তাহের এও স্মরণ করিয়ে দেন যে এমনকি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান মোসে দায়ানও শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। কারণ, তাঁর একটা চোখ ছিল অন্ধ।
কর্নেল তাহের ফিলিস্তিনে যাওয়ার অনুমতি পাননি। ঠিক কোন কারণে তাঁকে ফিলিস্তিন যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি, সেটা আমাদের জানা নেই। তবে বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু তরুণ তখন ফিলিস্তিনে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন। সে সময় ফিলিস্তিন, ভিয়েতনাম, কিউবার মুক্তিসংগ্রাম তৃতীয় বিশ্বের বহু তরুণের কাছে ছিল অনুপ্রেরণার বিষয়। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই তাহের তাঁর সাম্প্রতিক যুদ্ধ অভিজ্ঞতা ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন ধারণা করা যায়।
উল্লেখ্য, তখনকার ফিলিস্তিনের যুদ্ধে আজকের মতো এমন ধর্মীয় লেবাস চড়েনি। লক্ষণীয়, তাহের এই যুদ্ধে যোগ দেওয়ার পেছনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, একটি বিপন্ন জনগোষ্ঠীর মুক্তি এবং ন্যায়বিচারের লক্ষ্যকে। মানুষের মুক্তির সংগ্রামে বরাবর সক্রিয় আগ্রহ ছিল তাহেরের। বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামকে তিনি আন্তর্জাতিক বিপন্ন জনগোষ্ঠীর মুক্তির সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। আজকের বাংলাদেশের তারুণ্য এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে, আজকের ফিলিস্তিনের সংকটও নিয়েছে ভিন্ন রূপ, তবু চার দশক আগে লেখা এই চিঠি সাম্প্রতিক ফিলিস্তিনসংকটের পরিপ্রেক্ষিতে নানা মাত্রার অর্থ নিয়ে উপস্থিত হয় আমাদের সামনে।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
এম এ, তাহের বি উ, লে. কর্নেল (অব.)
ম্যানেজার, সি-ট্রাক ইউনিট
৩০ আর কে দাশ রোড
নেতাইগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা
তারিখ: ১৩ অক্টোবর ১৯৭৩
কর্নেল তাহের এই চিঠি লেখার সময় সেনাবাহিনীর সদস্য নন। এর ঠিক বছর খানেক আগে নীতিগত প্রশ্নে তিনি সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেছেন এবং ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের সি-ট্রাক ইউনিটে। অন্তরালে অবশ্য তখন জাসদ রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় আছেন। এমন একটা পর্যায়ে তিনি ফিলিস্তিন যুদ্ধে সশরীরে যুক্ত হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করছেন। যোদ্ধা হিসেবে তাঁর যোগ্যতা প্রমাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে তিনি তাঁর পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাঁর এতই তীব্র যে তিনি সে সুযোগ যেন কিছুতেই হাত ফসকে না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীকে সচেতন করে দিচ্ছেন যেন তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধিত্ব এই ক্ষেত্রে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
আমরা জানি যে ১১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের যুদ্ধক্ষেত্রে শেলের আঘাতে একটি পা হারিয়েছিলেন। পৃথিবীর সামরিক ইতিহাস সম্পর্কে তাহেরের জানাশোনার পরিধি কতটা ব্যাপক তা বোঝা যায় যখন তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধিতা যে যুদ্ধ পরিচালনায় কোনো বাধা না, সে যুক্তি দেখাতে গিয়ে অনেক সমরনায়কের নাম উল্লেখ করেছেন। তাহের যে সাম ব্রাউনের কথা বলেছেন, তিনি ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সেনাবাহিনীর সেনাকর্তা ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং ব্রিটিশ-আফগান যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে ভিক্টোরিয়া ক্রস পেয়েছিলেন। তাঁর একটা হাত ছিল না। প্রতাপশালী জার্মান জেনারেল স্টফেনবার্গের কথা উল্লেখ করেছেন তাহের, যিনি হিটলারকে হত্যা করে উৎখাত করার পরিকল্পনা করেছিলেন, যাঁকে পরে ফায়ারিং স্কয়াডে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁরও একটা হাত ছিল না। ডগলাস বাডার দুর্ঘটনায় দুটি পা-ই হারিয়েছিলেন, তারপরও তিনি পাইলট হিসেবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় দেন এবং বহু খেতাব পান। তাহের এও স্মরণ করিয়ে দেন যে এমনকি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান মোসে দায়ানও শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। কারণ, তাঁর একটা চোখ ছিল অন্ধ।
কর্নেল তাহের ফিলিস্তিনে যাওয়ার অনুমতি পাননি। ঠিক কোন কারণে তাঁকে ফিলিস্তিন যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি, সেটা আমাদের জানা নেই। তবে বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু তরুণ তখন ফিলিস্তিনে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন। সে সময় ফিলিস্তিন, ভিয়েতনাম, কিউবার মুক্তিসংগ্রাম তৃতীয় বিশ্বের বহু তরুণের কাছে ছিল অনুপ্রেরণার বিষয়। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই তাহের তাঁর সাম্প্রতিক যুদ্ধ অভিজ্ঞতা ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন ধারণা করা যায়।
উল্লেখ্য, তখনকার ফিলিস্তিনের যুদ্ধে আজকের মতো এমন ধর্মীয় লেবাস চড়েনি। লক্ষণীয়, তাহের এই যুদ্ধে যোগ দেওয়ার পেছনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, একটি বিপন্ন জনগোষ্ঠীর মুক্তি এবং ন্যায়বিচারের লক্ষ্যকে। মানুষের মুক্তির সংগ্রামে বরাবর সক্রিয় আগ্রহ ছিল তাহেরের। বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামকে তিনি আন্তর্জাতিক বিপন্ন জনগোষ্ঠীর মুক্তির সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। আজকের বাংলাদেশের তারুণ্য এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে, আজকের ফিলিস্তিনের সংকটও নিয়েছে ভিন্ন রূপ, তবু চার দশক আগে লেখা এই চিঠি সাম্প্রতিক ফিলিস্তিনসংকটের পরিপ্রেক্ষিতে নানা মাত্রার অর্থ নিয়ে উপস্থিত হয় আমাদের সামনে।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন