মেজর জলিল কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঢাকার পিজি হাসপাতালে তার চিকিৎসা হচ্ছিল। তার দেখাশোনা করতেন করপোরাল আবদুল মজিদ। তিনি একই মামলায় সাজা পেয়েছিলেন। তিনি পুরো মেয়াদ জেল খেটে ইতিমধ্যে মুক্তি পেয়েছেন। একদিন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পিজি হাসপাতালে এলেন চিকিৎসাধীন স্পিকার মির্জা গোলাম হাফিজকে দেখতে। সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান। তিনি শাহ আজিজকে নিয়ে জলিলের কেবিনে গেলেন। তাদের দেখে মজিদ পেছনে ব্যালকনির দিকে সরে গেলেন। জিয়া জলিলকে বললেন, ‘ঘর এত অন্ধকার কেন?’ তিনি নিজেই সুইচ অন করে বাতি জ্বালালেন। জলিল শুয়েছিলেন। বললেন, সারা জীবন তো অন্ধকারেই থাকতে হবে। তিনি তার যাবজ্জীবন
কারাদণ্ডের বিষয়ে ইঙ্গিত করেছিলেন। জিয়া শাহ আজিজকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘ দেখেন দেখেন ও এখনও কেমন রাগী। সব সময় ও এ রকমই ছিল। জলিল হঠাৎ জিয়াকে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘হোয়াই ডিড ইউ হ্যাং তাহের?’ জিয়া কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, ‘আমার ওপর প্রেশার ছিল। আমার কোন চয়েস ছিল না, সবাই এটা চেয়েছিল।’
১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের প্রকাশিতব্য গ্রন্থে এসব কথা বলা হয়েছে। দৈনিক প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় ‘৭ নভেম্বরের সাত-সতেরো’ শিরোনামে বইটির নির্বাচিত অংশ প্রকাশিত হয়েছে। ৭ই নভেম্বরের পরবর্তী সময়ের ঘটনা প্রসঙ্গে এতে আরও বলা হয়েছে, জাসদের নেতা-কর্মীদের পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে। গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য সবাই গা ঢাকা দেন। তবু গ্রেপ্তার এড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। একে একে আখলাকুর রহমান, মোহাম্মদ শাজাহান, আ ফ ম মাহবুবুল হক, মাহমুদুর রহমান মান্না এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার অনেক সংগঠক গ্রেপ্তার হন। পুলিশের একটি দল বাগেরহাট ও পিরোজপুরের মাঝামাঝি একটি অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে মেজর জিয়াউদ্দিনকে ধরে নিয়ে আসে। প্রথমে তাকে খুলনায় নিয়ে যাওয়া হয়। খুলনা শহরে তখন একটা মেলা চলছিল। মেলা প্রাঙ্গণে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল, যাতে সবাই দেখতে পান।
১০ই মে রাজশাহী জেল থেকে প্রেসিডেন্ট সায়েমকে লেখা এক চিঠিতে তাহের ৭ই নভেম্বরের সকালে গৃহীত নীতিমালা মেনে চলার আহবান জানান। তিনি সব রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি এবং ১৯৭৬ সালের অক্টোবরের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানান। জাসদ ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। এই দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহিতা’ ও ‘অরাজকতা’ সৃষ্টির অভিযোগ এনে নির্যাতনের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল। গ্রেপ্তারকৃত ও পলাতক নেতাদের ‘প্রহসনের’ বিচার ও দলকে বেআইনি ঘোষণার আশঙ্কা করা হচ্ছিল।
২১শে জুন সামরিক সরকার জাসদ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ৩৩ জনের বিরুদ্ধে একটি গোপন বিচার-প্রক্রিয়া শুরু করে। এদের মধ্যে ১৬ জন ছিলেন সশস্র বাহিনীতে চাকরিরত। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাদের অভিযুক্ত করা হয়। মামলার শিরোনাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম মেজর জলিল ও অন্যান্য’। অভিযুক্তরা ছিলেন মেজর এম এ জলিল, আ স ম আবদুর রব, লে. কর্নেল আবু তাহের, হাসানুল হক ইনু, আনোয়ার হোসেন, আবু ইউসুফ খান, রবিউল আলম সরদার, সালেহা বেগম, মোহাম্মদ শাজাহান, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখলাকুর রহমান, কে বি এম মাহমুদ, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, আনোয়ার সিদ্দিক, মেজর জিয়াউদ্দিন, নায়েক সুবেদার বজলুর রহমান, হাবিলদার মেজর সুলতান আহমদ, নায়েক সুবেদার আবদুল লতিফ আখন্দ, নায়েক সিদ্দিকুর রহমান, ফ্লাইট সার্জেন্ট কাজী রোকন উদ্দিন, সার্জেন্ট কাজী আবদুল কাদের, সার্জেন্ট সৈয়দ রফিকুল ইসলাম, করপোরাল শামসুল হক, করপোরাল আবদুল মজিদ, হাবিলদার আবদুল হাই মজুমদার, হাবিলদার শামসুদ্দিন, সিরাজুল আলম খান, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, মহিউদ্দিন, হাবিলদার বারেক, নায়েক সুবেদার জালাল এবং করপোরাল আলতাফ হোসেন। অভিযুক্তদের মধ্যে সাতজন ছিলেন ‘পলাতক’। নায়েক আবদুল বারী রাজসাক্ষী হয়েছিলেন। সালেহা বেগম ছিলেন অভিযুক্তদের মধ্যে একমাত্র নারী। তিনি যশোর জেলা ছাত্রলীগের সভানেত্রী ছিলেন। প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা অভিযোগ আনা হয়েছিল।
কর্নেল ডি এস ইউসুফ হায়দারকে চেয়ারম্যান করে পাঁচ সদস্যের একটি সামরিক আদালত গঠন করা হয়। অন্যান্য সদস্যের মধ্যে ছিলেন কমান্ডার সিদ্দিক আহমদ, উইং কমান্ডার মোহাম্মদ আবদুর রশীদ, ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবদুল আলী এবং ম্যাজিস্ট্রেট মো. হাসান মোরশেদ। সরকারপক্ষে কৌঁসুলি ছিলেন ডেপুটি এটর্নি জেনারেল এ টি এম আফজাল, ডেপুটি এটর্নি জেনারেল আবদুল ওহাব এবং পিপি আবদুর রাজ্জাক। অভিযুক্তদের পক্ষে ১৬ জন আইনজীবী ছিলেন। তারা হলেন আতাউর রহমান খান, জুলমত আলী খান, কে জেড আলম, আমিনুল হক, মো. জিনাত আলী, এ কে মুজিবুর রহমান, সিরাজুল হক, মহিউদ্দিন আহমেদ, আবদুর রউফ, কাজী শাহাদাত হোসেন, শরফুদ্দিন চাকলাদার, খাদেমুল ইসলাম, আবদুল হাকিম. শামসুর রহমান, শরফুদ্দিন ভূঁইয়া ও এ টি এম কামরুল ইসলাম।
আদালত বসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। প্রথম দিন রোল কল করা হয়। দু’বার নাম ডাকা সত্ত্বেও সার্জেন্ট রফিকুল ইসলাম সাড়া দেননি। তখন একজন তাকে চিনিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘আমার নাম ঠিকভাবে ডাকা হয়নি বলে আমি জবাব দিইনি।’ চেয়ারম্যান বললেন, আপনার নাম তো সৈয়দ রফিকুল ইসলাম। রফিক জবাবে বলেন, না আমার নাম সৈয়দ রফিকুল ইসলাম বীর প্রতীক। পুরো নাম না বললে আমি জবাব দেবো না। আদালত তার দাবি মেনে নেন। দ্বিতীয় দিনেও গোলমাল হলো। সার্জেন্ট রফিক এফআইআর দেখতে চাইলেন। যখন আদালত থেকে বলা হলো এটা এখন সরবরাহ করা যাবে না তখন সার্জেন্ট রফিক বললেন, তাহলে আমাকে যেতে দিন, আমি আমার সেলে গিয়ে বিশ্রাম নেবো। চেয়ারম্যান রেগে গিয়ে বললেন, শাট আপ অ্যান্ড সিট ডাউন। সার্জেন্ট রফিক চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে জুতা ছুড়ে মারলেন। দেখাদেখি আরও কয়েকজন জুতা ছুড়লেন। রব দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে শ্লোগান দিতে শুরু করলেন। আদালতের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা দৌড়ে পালালেন। ওই দিনের মতো আদালত পণ্ড হয়ে গেল। পরদিন থেকে তাদের আদালত কক্ষে খালি পায়ে হাতকড়া পরিয়ে আনা হলো। এভাবেই চলতে থাকলো আদালতে আসা-যাওয়া। আদালত চলার সময় অভিযুক্তরা এমন ভাব করতেন, যেন তারা কোন জায়গায় বসে আড্ডা দিচ্ছেন। এই ‘অবৈধ আদালতের’ ওপর তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। হয়তো কেউ কারও কোলের ওপর মাথা রেখে শুয়ে থাকেন, কেউ-বা আপন মনে গলা ছেড়ে গান ধরেন: ‘ মা, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে/ তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি।’ ১৫ই জুলাই রায় ঘোষণার কথা ছিল। রায় দেয়া হলো ১৭ই জুলাই। রায় ঘোষণার সময় অভিযুক্তরা সবাই হইচই, চিৎকার করছিলেন। রায়ে তাহের, জলিল ও আবু ইউসুফের ফাঁসির আদেশ হয়। পরে রায় সংশোধন করে জলিল ও ইউসুফকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। আখলাকুর রহমান, মাহমুদুর রহমান মান্না, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, মো. শাজাহান ও কে বি এম মাহমুদসহ ১৫ জনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। ২১শে জুলাই ভোর চারটায় তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তাহের ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, প্রাণবন্ত ও আশাবাদী। রায় ঘোষণার পর থেকে তাকে কখনও মন খারাপ করতে দেখা যায়নি। তিনি যখন ফাঁসির মঞ্চের দিকে হেঁটে যান, তখনও তিনি ছিলেন দৃপ্ত, অবিচল। তাহেরের ফাঁসি নিয়ে বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দল বা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় মাথা ঘামায়নি। দলের তরুণদের কাছে এটা ছিল একটা ভীষণ দুঃখজনক ঘটনা। রায়হান ফেরদৌস মধুর উদ্যোগে একটা কবিতা সংকলন বের হলো। তাহেরকে নিয়ে লিখলেন অনেকেই। তাদের মধ্যে ছিলেন মাশুক চৌধুরী, অসীম সাহা, আবু করিম, মোহন রায়হান প্রমুখ। অসীম সাহার একটা কবিতার কয়েকটা লাইন ছিল এরকম: তাহের তাহের বলে ডাক দিই/ফিরে আসে মৃত্যুহীন লাশ/কার কণ্ঠে বলে ওঠে আকাশ-বাতাস/বিপ্লব বেঁচে থাক তাহের সাবাশ।
কারাদণ্ডের বিষয়ে ইঙ্গিত করেছিলেন। জিয়া শাহ আজিজকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘ দেখেন দেখেন ও এখনও কেমন রাগী। সব সময় ও এ রকমই ছিল। জলিল হঠাৎ জিয়াকে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘হোয়াই ডিড ইউ হ্যাং তাহের?’ জিয়া কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, ‘আমার ওপর প্রেশার ছিল। আমার কোন চয়েস ছিল না, সবাই এটা চেয়েছিল।’
১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের প্রকাশিতব্য গ্রন্থে এসব কথা বলা হয়েছে। দৈনিক প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় ‘৭ নভেম্বরের সাত-সতেরো’ শিরোনামে বইটির নির্বাচিত অংশ প্রকাশিত হয়েছে। ৭ই নভেম্বরের পরবর্তী সময়ের ঘটনা প্রসঙ্গে এতে আরও বলা হয়েছে, জাসদের নেতা-কর্মীদের পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে। গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য সবাই গা ঢাকা দেন। তবু গ্রেপ্তার এড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। একে একে আখলাকুর রহমান, মোহাম্মদ শাজাহান, আ ফ ম মাহবুবুল হক, মাহমুদুর রহমান মান্না এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার অনেক সংগঠক গ্রেপ্তার হন। পুলিশের একটি দল বাগেরহাট ও পিরোজপুরের মাঝামাঝি একটি অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে মেজর জিয়াউদ্দিনকে ধরে নিয়ে আসে। প্রথমে তাকে খুলনায় নিয়ে যাওয়া হয়। খুলনা শহরে তখন একটা মেলা চলছিল। মেলা প্রাঙ্গণে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল, যাতে সবাই দেখতে পান।
১০ই মে রাজশাহী জেল থেকে প্রেসিডেন্ট সায়েমকে লেখা এক চিঠিতে তাহের ৭ই নভেম্বরের সকালে গৃহীত নীতিমালা মেনে চলার আহবান জানান। তিনি সব রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি এবং ১৯৭৬ সালের অক্টোবরের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানান। জাসদ ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। এই দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহিতা’ ও ‘অরাজকতা’ সৃষ্টির অভিযোগ এনে নির্যাতনের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল। গ্রেপ্তারকৃত ও পলাতক নেতাদের ‘প্রহসনের’ বিচার ও দলকে বেআইনি ঘোষণার আশঙ্কা করা হচ্ছিল।
২১শে জুন সামরিক সরকার জাসদ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ৩৩ জনের বিরুদ্ধে একটি গোপন বিচার-প্রক্রিয়া শুরু করে। এদের মধ্যে ১৬ জন ছিলেন সশস্র বাহিনীতে চাকরিরত। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাদের অভিযুক্ত করা হয়। মামলার শিরোনাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম মেজর জলিল ও অন্যান্য’। অভিযুক্তরা ছিলেন মেজর এম এ জলিল, আ স ম আবদুর রব, লে. কর্নেল আবু তাহের, হাসানুল হক ইনু, আনোয়ার হোসেন, আবু ইউসুফ খান, রবিউল আলম সরদার, সালেহা বেগম, মোহাম্মদ শাজাহান, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখলাকুর রহমান, কে বি এম মাহমুদ, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, আনোয়ার সিদ্দিক, মেজর জিয়াউদ্দিন, নায়েক সুবেদার বজলুর রহমান, হাবিলদার মেজর সুলতান আহমদ, নায়েক সুবেদার আবদুল লতিফ আখন্দ, নায়েক সিদ্দিকুর রহমান, ফ্লাইট সার্জেন্ট কাজী রোকন উদ্দিন, সার্জেন্ট কাজী আবদুল কাদের, সার্জেন্ট সৈয়দ রফিকুল ইসলাম, করপোরাল শামসুল হক, করপোরাল আবদুল মজিদ, হাবিলদার আবদুল হাই মজুমদার, হাবিলদার শামসুদ্দিন, সিরাজুল আলম খান, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, মহিউদ্দিন, হাবিলদার বারেক, নায়েক সুবেদার জালাল এবং করপোরাল আলতাফ হোসেন। অভিযুক্তদের মধ্যে সাতজন ছিলেন ‘পলাতক’। নায়েক আবদুল বারী রাজসাক্ষী হয়েছিলেন। সালেহা বেগম ছিলেন অভিযুক্তদের মধ্যে একমাত্র নারী। তিনি যশোর জেলা ছাত্রলীগের সভানেত্রী ছিলেন। প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা অভিযোগ আনা হয়েছিল।
কর্নেল ডি এস ইউসুফ হায়দারকে চেয়ারম্যান করে পাঁচ সদস্যের একটি সামরিক আদালত গঠন করা হয়। অন্যান্য সদস্যের মধ্যে ছিলেন কমান্ডার সিদ্দিক আহমদ, উইং কমান্ডার মোহাম্মদ আবদুর রশীদ, ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবদুল আলী এবং ম্যাজিস্ট্রেট মো. হাসান মোরশেদ। সরকারপক্ষে কৌঁসুলি ছিলেন ডেপুটি এটর্নি জেনারেল এ টি এম আফজাল, ডেপুটি এটর্নি জেনারেল আবদুল ওহাব এবং পিপি আবদুর রাজ্জাক। অভিযুক্তদের পক্ষে ১৬ জন আইনজীবী ছিলেন। তারা হলেন আতাউর রহমান খান, জুলমত আলী খান, কে জেড আলম, আমিনুল হক, মো. জিনাত আলী, এ কে মুজিবুর রহমান, সিরাজুল হক, মহিউদ্দিন আহমেদ, আবদুর রউফ, কাজী শাহাদাত হোসেন, শরফুদ্দিন চাকলাদার, খাদেমুল ইসলাম, আবদুল হাকিম. শামসুর রহমান, শরফুদ্দিন ভূঁইয়া ও এ টি এম কামরুল ইসলাম।
আদালত বসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। প্রথম দিন রোল কল করা হয়। দু’বার নাম ডাকা সত্ত্বেও সার্জেন্ট রফিকুল ইসলাম সাড়া দেননি। তখন একজন তাকে চিনিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘আমার নাম ঠিকভাবে ডাকা হয়নি বলে আমি জবাব দিইনি।’ চেয়ারম্যান বললেন, আপনার নাম তো সৈয়দ রফিকুল ইসলাম। রফিক জবাবে বলেন, না আমার নাম সৈয়দ রফিকুল ইসলাম বীর প্রতীক। পুরো নাম না বললে আমি জবাব দেবো না। আদালত তার দাবি মেনে নেন। দ্বিতীয় দিনেও গোলমাল হলো। সার্জেন্ট রফিক এফআইআর দেখতে চাইলেন। যখন আদালত থেকে বলা হলো এটা এখন সরবরাহ করা যাবে না তখন সার্জেন্ট রফিক বললেন, তাহলে আমাকে যেতে দিন, আমি আমার সেলে গিয়ে বিশ্রাম নেবো। চেয়ারম্যান রেগে গিয়ে বললেন, শাট আপ অ্যান্ড সিট ডাউন। সার্জেন্ট রফিক চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে জুতা ছুড়ে মারলেন। দেখাদেখি আরও কয়েকজন জুতা ছুড়লেন। রব দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে শ্লোগান দিতে শুরু করলেন। আদালতের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা দৌড়ে পালালেন। ওই দিনের মতো আদালত পণ্ড হয়ে গেল। পরদিন থেকে তাদের আদালত কক্ষে খালি পায়ে হাতকড়া পরিয়ে আনা হলো। এভাবেই চলতে থাকলো আদালতে আসা-যাওয়া। আদালত চলার সময় অভিযুক্তরা এমন ভাব করতেন, যেন তারা কোন জায়গায় বসে আড্ডা দিচ্ছেন। এই ‘অবৈধ আদালতের’ ওপর তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। হয়তো কেউ কারও কোলের ওপর মাথা রেখে শুয়ে থাকেন, কেউ-বা আপন মনে গলা ছেড়ে গান ধরেন: ‘ মা, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে/ তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি।’ ১৫ই জুলাই রায় ঘোষণার কথা ছিল। রায় দেয়া হলো ১৭ই জুলাই। রায় ঘোষণার সময় অভিযুক্তরা সবাই হইচই, চিৎকার করছিলেন। রায়ে তাহের, জলিল ও আবু ইউসুফের ফাঁসির আদেশ হয়। পরে রায় সংশোধন করে জলিল ও ইউসুফকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। আখলাকুর রহমান, মাহমুদুর রহমান মান্না, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, মো. শাজাহান ও কে বি এম মাহমুদসহ ১৫ জনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। ২১শে জুলাই ভোর চারটায় তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তাহের ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, প্রাণবন্ত ও আশাবাদী। রায় ঘোষণার পর থেকে তাকে কখনও মন খারাপ করতে দেখা যায়নি। তিনি যখন ফাঁসির মঞ্চের দিকে হেঁটে যান, তখনও তিনি ছিলেন দৃপ্ত, অবিচল। তাহেরের ফাঁসি নিয়ে বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দল বা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় মাথা ঘামায়নি। দলের তরুণদের কাছে এটা ছিল একটা ভীষণ দুঃখজনক ঘটনা। রায়হান ফেরদৌস মধুর উদ্যোগে একটা কবিতা সংকলন বের হলো। তাহেরকে নিয়ে লিখলেন অনেকেই। তাদের মধ্যে ছিলেন মাশুক চৌধুরী, অসীম সাহা, আবু করিম, মোহন রায়হান প্রমুখ। অসীম সাহার একটা কবিতার কয়েকটা লাইন ছিল এরকম: তাহের তাহের বলে ডাক দিই/ফিরে আসে মৃত্যুহীন লাশ/কার কণ্ঠে বলে ওঠে আকাশ-বাতাস/বিপ্লব বেঁচে থাক তাহের সাবাশ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন