তারেক রহমানকে নির্যাতন প্রসঙ্গে দুই জেনারেলের বাকযুদ্ধ


moyeenগত ১২ জুন, ২০১৪ আমেরিকায় বহুল প্রচারিত বাংলা সাপ্তাহিক ‘ঠিকানায়’ দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ১/১১-এর কারিগর সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন আহমেদ বলেছেন, ‘তারেক রহমানকে নির্যাতন করেছেন এক লেফটেন্যান্ট কর্নেল। তারেক রহমানকে ধরে আনা হয়েছে এটা আমাকে জানানো হয়নি। পরে যখন জানতে পারলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাকে আনার পর টর্চার করা হয়েছে-এমন একটা খবর আমার কাছে এলো। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ডেকে পাঠালাম, কেন তাকে মারা হয়েছে তা জানার জন্য। তিনি তাকে (তারেক রহমান) মারা হয়নি বলে জানালেন। এও বললেন যে, তিনি ভালো আছেন। টিভিতে
দেখা গেল তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। এর কারণ জানতে চাইলে আমাকে জানানো হলো-তিনি নাকি বগুড়ায় একবার সিঁড়ি থেকে পড়ে ব্যথা পান। এজন্য তার পায়ে ও কোমরে ব্যথা হয়েছে। এখন ব্যথা বেড়েছে তাই খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। তাকে নির্যাতন করা হয়েছে এটা আমি যখন শুনলাম তখন ওই অফিসারকে বদলি করে দিলাম অন্যত্র। আমি নাকি তারেক রহমানকে মারতে বলেছি। তা কখনো হয়? এটা অসম্ভব। কারণ তাকে যিনি নির্যাতন করেছেন বলে পরে জানা েেগছ তিনি ছিলেন একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। আপনি বলুন, একজন জেনারেল কি কখনো একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেলকে কোনো নির্দেশনা দেন? আমি বললে কি তাকে মারার জন্য লেফটেন্যান্ট কর্নেলকে বলতাম। আমি তো বললে ডিজি-ডিজিএফআইকে বলতাম। তাকে জিজ্ঞেস করুন, তিনিই বলুন আমি তাকে ডেকে বলেছি কি না তারেক রহমানকে নির্যাতন করার জন্য। তা তিনি বলতে পারবেন না।’ (সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৮ জুন ২০১৪)।

জেনারেল (অব.) মঈনের উপরোক্ত বক্তব্য থেকে এটি পরিষ্কার যে, তারেক রহমানকে গ্রেফতার (তার ভাষায় ‘ধরে আনা’) করা হয়েছে তার অজান্তে এবং এমনকি তারেক রহমানের ওপর যে নির্মম অমানবিক শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে সে বিষয়েও তিনি জানতেন না। পরে অবশ্য নির্যাতনের বিষয়টি নিশ্চিত হবার পর নির্যাতনকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেলকে অন্যত্র বদলি করেন তিনি। জেনারেল (অব.) মঈনের উপরোক্ত বক্তব্যসমূহ বিশ্লেষণ করার পূর্বে দেখা যাক তার সংক্ষিপ্ত কর্মপরিচিতি। এ বিষয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট মোবায়েদুর রহমানের ভাষ্য, “জেনারেল মঈন আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তিনি পর্দার অন্তরাল থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং মার্কিনি পুতুল বিশ্বব্যাংকের সাবেক অফিসার ফখরুদ্দীন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টা পদে বসান। এই কাজ তিনি করেন বন্দুকের জোরে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নাম দিয়ে এই অপকর্মটি তিনি করেন। ৩ মাসের মধ্যে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন দেয়ার কথা। সেখানে তিনি তার শাসন দুই বছর প্রলম্বিত করেন। যখন তার শাসন দুই বছর পুরো হতে যাচ্ছিল তখন তিনি পর্দার অন্তরালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটি গোপন সমঝোতায় উপনীত হন। সমঝোতার মূল পয়েন্ট ছিল, আওয়ামী লীগকে ‘ফেভার’ (ভধাড়ঁৎ) করে তাদের ক্ষমতায় আসার রাস্তা পাকা করে দেবেন। বিনিময়ে তাদের দুই বছরের অপকর্মকে বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হবে না এবং তার মিলিটারি জান্তা যাতে নিরাপদে দেশ ত্যাগ করতে পারে (ংধভব বীরঃ) সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে আওয়ামী লীগ। সেই মোতাবেকই কাজ হয় এবং ১/১১-এর সমস্ত নায়করা নিরাপদে দেশত্যাগ করেন। ১/১১-এর দ্বিতীয় নায়ক জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী অস্ট্রেলিয়ায় রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন। তাকে ৪ বার একই জায়গায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে এক্সটেনশন দেয়া হয়। জেনারেল মঈন সপরিবারে চলে যান আমেরিকায় তার পুত্রের কাছে। বিগত ৫ বছর ধরে তিনি সেখানেই আছেন। আমেরিকা যাওয়ার কিছুদিন পর তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। সেখানেই তিনি চিকিৎসা নেন। এখন তিনি সুস্থ হয়েছেন।” (সূত্র : মোবায়েদুর রহমান, ২০১৪; জেনারেল মঈনের বিশেষ ইন্টারভিউ একটি নির্মোহ পোস্টমর্টেম, দৈনিক ইনকিলাব, ২৪ জুন ২০১৪) এছাড়া জেনারেল মঈন ১/১১-এর মাধ্যমে শহীদ জিয়ার পরিবার এবং জিয়ার প্রতিষ্ঠিত বিএনপি তথা জাতীয়তাবাদী মূল্যবোধের রাজনীতি বাংলাদেশের মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করতে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, তা হলো, দুর্নীতির অভিযোগে তারেক রহমানকে গ্রেফতার বিষয়ে জেনারেল মঈন পরোক্ষভাবে সেই সময় দুর্নীতি দমনের জন্য গঠিত কমিটিকেই দায়ী করেন যার দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) এম. এ. মতিন বীরপ্রতীক। মজার বিষয় হলো, জেনারেল মঈনের সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর গত ২৬ জুন ২০১৪ তারিখের দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় “সত্যকে বিকৃত করে প্রকাশ করার প্রবণতা জেনারেল মঈনের আছে” শীর্ষক একটি নিবন্ধে মেজর জেনারেল (অব.) এমএ মতিন বীরপ্রতীক তারেক রহমানকে গ্রেফতার ও তাকে নির্যাতনের দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করে লিখেছেন, “একদিন সকালে পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানতে পারলাম যে, তারেক রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে এবং তৎপ্রেক্ষিতে তিনি মেরুদ-ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। সংবাদটি আমাকে খুবই মর্মাহত করে তোলে। সেদিন দুপুরের পর ঢাকা সেনানিবাসে ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’র মিটিং ছিল। উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক, এসিসির নিয়োজিত আইনজীবীগণ, এসিসির পরিচালক (আইন), ডিজিএফআইর একজন পরিচালক এবং অপরাপর সকল সদস্য। সেদিনকার পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তারেক রহমানকে নির্যাতনের সংবাদটির প্রতি আমি সভায় উপস্থিত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করি এবং সেখানে উপস্থিত ডিজিএফআইয়ের পরিচালকের কাছ থেকে কে বা কারা তারেক রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদকালীন নির্যাতন করেছে আমি তা জানতে চাই। ডিজিএফআইর পরিচালক তা সরাসরি অস্বীকার করেন। আমি তখন রাগতস্বরে বলি, তারেক রহমান একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে, তার শরীরে হাত দেয়ার সাহস কে দেখিয়েছে আমাকে তার নাম বলতে হবে, আমি তার হাত ভেঙে দেব। আমি আরও বলি, এমন একটি গর্হিত কাজ যে বা যারাই করে থাকুক, তাদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে কারো গায়ে হাত দেয়া অন্যায়। আমি ডিজিএফআইর পরিচালককে জিজ্ঞাসাবাদের নামে এ ধরনের নির্যাতন অনতিবিলম্বে বন্ধ করার জন্য বলি। সেদিনকার মিটিংয়ের এসব আলোচনা ও কথাবার্তা তৎকালীন ডিজি, ডিজিএফআই মেজর জেনারেল মোহাম্মদের কানে পৌঁছায়। তিনি পরদিন সচিবালয়ে আমার অফিসে আসেন এবং আমাকে জানান, ডিজিএফআইর লোকজন তারেক রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কিন্তু তাকে প্রহার করা হয়নি। তিনি আরও জানান, তারেক রহমানের মেরুদ-ের ব্যথা যা পত্রিকায় বলা হয়েছে, তা অনেক পুরনো এবং তিনি ক’বছর পূর্বে চিকিৎসার জন্য জার্মানি গিয়েছিলেন। বিষয়টি আমাকে পীড়া দিতে থাকে। এর পরদিনই বেইলি রোডস্থ আমার বাসায় বসে খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীমকে বিষয়টি অবহিত করি। তিনিও আমাকে জানালেন যে, তারেক রহমানকে ভীষণভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। আমি তাকে জানালাম, ডিজি, ডিজিএফআই মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আমাকে জানিয়েছেন, তারেক রহমানের মেরুদ-ের এ ব্যথা নাকি অনেক পুরনো এবং তিনি চিকিৎসার জন্যে একবার জার্মানিও গিয়েছিলেন। জবাবে শামীম আমাকে জানালেন, তারেক রহমানের মেরুদ-ে কোনো ব্যথা পূর্বে কখনো ছিল না এবং তিনি ইতিপূর্বে কখনো জার্মানি যাননি। এরপর আমি বিষয়টি জেনারেল মঈনের গোচরে আনয়ন করি এবং এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তাকে অনুরোধ জানাই” (সূত্র : মেজর জেনারেল এমএ মতিন, বীরপ্রতীক (অব.) ২০১৪, ‘সত্যকে বিকৃত করে প্রকাশ করার প্রবণতা জেনারেল মঈনের আছে’, দৈনিক ইনকিলাব, ২৬ জুন ২০১৪)।
এটি আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, ১/১১-এর সেনা সমর্থিত সরকার সারাদেশে আতংক ও ভীতির সৃষ্টি করেছিল। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, কর্মকর্তা-কর্মচারি, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ সারাক্ষণ থাকত গ্রেফতার ও নির্যাতন আতঙ্কে। সারাদেশ কম্পমান ছিল তাদের দাপটে। নিশ্চিহ্ন হতে চলেছিল শহীদ জিয়ার আদর্শ জাতীয়তাবাদী শক্তি। আর ওই সরকারের পিছনের চালিকা শক্তি হিসেবে তৎকালীন জেনারেল মঈন, মেজর জেনারেল মতিন, জেনারেল মাসুদ, ব্রিগেডিয়ার বারীর নাম ছিল সকলের মুখে মুখে। আর সামনে ছিলেন সুন্দর সুবোধ বালক হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ। দুই নেত্রী (বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা)সহ তারেক রহমানকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের নামে তারেক রহমানের উপর নির্যাতন নিয়ে ওই সময়ের দুই প্রতাপশালী সাবেক সেনা কর্মকর্তা জেনারেল (অব.) মঈন ও মেজর জেনারেল (অব.) মতিন আজ মুখোমুখি কাগুজে বাকযুদ্ধে। তারা দুজনই দেশবাসীকে বুঝানোর চেষ্টা করছেন যে, তারেক রহমানের গ্রেফতার ও তার উপর নির্যাতনের ব্যাপারে দুজনই কিছুই জানেন না। কিন্তু দেশবাসীর কাছে আজ যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে তাহলো, যদি তাদের দুজনই এ ব্যাপারে কিছুই না জানেন তাহলে কার নির্দেশে তারেক রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং কার নির্দেশে তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হলো? অবশ্যই নির্যাতনকারী একজন সেনা কর্মকর্তা এবং তিনি নিশ্চয়ই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই কিংবা সম্মতিতেই তারেক রহমানের ওপর নির্যাতন করেছেন। এ কথা মনে করার কোনো কারণ নেই, কোনো অশরীরি আত্মা অর্থাৎ ভূত-পেতিœ তারেক রহমানকে নির্যাতন করেছে। এ ব্যাপারে যে যাই বলুন না কেন-তারেক রহমানকে গ্রেফতার ও নির্যাতনের বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ, জেনারেল মঈন, মেজর জেনারেল মতিন; জেনারেল মাসুদ, তৎকালীন ডিজিএফআই প্রধান এবং ব্রিগেডিয়ার বারী অবশ্যই জানেন। তাদের অজান্তে কিংবা তাদের বিনা অনুমতিতে তারেক রহমানের মতো একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার ও নির্যাতন করার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এটি অবাস্তব ও অসম্ভব। এটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, জেনারেল (অব.) মঈন এবং মেজর জেনারেল (অব.) মতিন দুজনই এখন সত্য কথা বলছেন না। একজন আরেকজনকে দোষারোপ করে নিজে সম্পূর্ণ নির্দোষ- “ধোয়া তুলসি পাতা” সাজার চেষ্টা করছেন। দেশবাসী আজ জেনারেল মঈনের কাছে জানতে চায় কে সেই লেফটেন্যান্ট কর্নেল যিনি আপনাদের নির্দেশ ছাড়া তারেক রহমানের ওপর নির্মম শারীরিক নির্যাতন করেছেন? কার হুকুমে কোন কর্মকর্তা তারেক রহমানকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করেছেন? তারেক রহমানের ওপর নির্মম নির্যাতনের শাস্তি কি সংশ্লিষ্ট লেফটেন্যান্ট কর্নেলকে শুধুই অন্যত্র বদলি? এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, আইন অনুযায়ী গ্রেফতারকৃত কোনো ব্যক্তিকে শারীরিক বা মানসিকভাবে নির্যাতন করা যায় না। এটি নাগরিকের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী-যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাছাড়া তারেক রহমান একজন চোর-ডাকাত বা দাগি আসামি কিংবা একজন সাধারণ ব্যক্তিত্ব নন। তিনি একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ এবং বাংলাদেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের তৎকালীন সিনিয়র মহাসচিব (বিএনপির দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি)। পারিবারিক পরিচয়ে তারেক রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক, মহান মুক্তিযোদ্ধা-সেক্টর কমান্ডার, সাবেক সেনাপ্রধান, সর্বোপরি সাবেক রাষ্ট্রপতি ও সফল রাষ্ট্রনায়ক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং বিএনপির চেয়ারপারসন ও তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র। এছাড়া তিনি ব্যক্তি ও রাজনীতিক হিসেবে জননন্দিত এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কান্ডারি। মেজর জেনারেল (অব.) মতিন তাঁর নিবন্ধে লিখেছেন, “আমি তখন রাগ করে বলি, তারেক রহমান একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে, তার শরীরে হাত দেয়ার সাহস কে দেখিয়েছে আমাকে তার নাম বলতে হবে, আমি তার হাত ভেঙে দেব। আমি আরও বলি, এমন একটি গর্হিত কাজ যে বা যারাই করে থাকুক, তাদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে কারো গায়ে হাত দেয়া অন্যায়। আমি ডিজিএফআই’র পরিচালককে জিজ্ঞাসাবাদের নামে এ ধরনের নির্যাতন অনতিবিলম্বে বন্ধ করার জন্য বলি।” জেনারেল মতিন যদি সত্যি সত্যি ওই দিন ওই কথাগুলো বলে থাকেন তাহলে তিনি যথার্থই বলেছেন এবং এজন্য তিনি ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার। কিন্তু তার কাছে আজ আমাদের প্রশ্ন ও যা জানতে ইচ্ছে করে তা হলো, ‘পরে যখন জানতে পারলেন তারেক রহমানকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করে তার মেরুদ-ের হাড় ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে তখন কি সেই নির্যাতনকারীকে শনাক্ত করে (জেনারেল মঈনের মতে এক লেফটেন্যান্ট কর্নেল) সামরিক বিধান অনুযায়ী সংবিধান লক্সঘনকারী হিসেবে আপনি শাস্তি দিতে পেরেছিলেন? পেরেছিলেন সেই নির্যাতনকারীর হাত ভেঙে দিতে-যা আপনি চেয়েছিলেন?’ নিশ্চয়ই না। নির্যাতনকারীর পরিচয় ঠিকই পেয়েছিলেন, কিন্তু শাস্তি দিতে পারেননি বা দেননি। আর তাছাড়া এতদিন কেন নির্যাতনের বিষয়টি স্বীকার করেননি? কেনই বা নির্যাতনকারীর পরিচয় প্রকাশ করেননি? তাহলে আজ কেন তারেক রহমানের গ্রেফতার ও তার উপর চালানো নির্যাতনের দায় আপনারা নিজেরা না নিয়ে উল্টো একে অপরের ঘাড়ে চাপাচ্ছেন? আপনারা কেউ এর দায় এড়াতে পারেন না। ১/১১-এর ওই আজব অদ্ভুত সরকারের একজন উপদেষ্টা কিংবা নেপথ্যের নায়ক সেনাপ্রধান হিসেবে এর দায় সম্পূর্ণভাবে আপনাদের প্রত্যেকের ওপর বর্তায় এবং এজন্য ভবিষ্যতে বিচারের কাঠগড়ায় হয়তো আপনাদের দাঁড়াতে হতে পারে।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হলো জেনারেল মঈন এবং মেজর জেনারেল মতিন-উভয়ের বক্তব্য থেকে দেখা যায় যে, তাদের উভয়কে দেয়া তৎকালীন ডিজিএফআইর বক্তব্য হলো, তারেক রহমানকে নির্যাতন করা হয়নি। তারেক রহমানের মেরুদ-ের ওই ব্যথা তার পূর্বের দুর্ঘটনার ব্যথা। শুধুই তর্কের খাতিরেও যদি ডিজিএফআইর বক্তব্য সত্য বলে মেনে নেয়া হয় যে, তারেক রহমানকে নির্যাতন করা হয়নি, তাহলে তারেক রহমানের মেরুদ-ের হাড় ভেঙে গেল কি করে? এমনি এমনিই কি মেরুদ-ের হাড় ভেঙে গিয়ে তারেক রহমান পঙ্গু হবার শামিল হয়েছিলেন? তাই যদি হবে তাহলে আদালতের নির্দেশক্রমে ২৯ জানুয়ারি ২০০৮ তারেক রহমানকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে একটি মেডিকেল বোর্ড পরীক্ষা করে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তির সুপারিশ কেন করে? কেনইবা ডিজিএফআই’র প্রবল চাপ উপেক্ষা করে দেশের শীর্ষ চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড তারেক রহমানকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর সুপারিশ করে? উল্লেখ্য, মেডিকেল বোর্ড দেখতে পায়, নির্যাতনে তারেক রহমানের মেরুদ-ের ৬ ও ৭ নম্বর হাড় ভেঙে গেছে। মেরুদ-ের ৩৩টি হাড়ের দূরত্ব কমে গেছে। চোখে এবং হৃদযন্ত্রে নানা সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া তারেক রহমান তার উপর বর্বর নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক শওকত মাহমুদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “২০০৭-এর ৩১ ডিসেম্বর রিমান্ডে থাকাকালে আমার ওপর নানা রকমের দৈহিক নির্যাতন করা হয়। এর মধ্যে একটি ছিল অনেক উপর থেকে বারবার ফেলে দেয়া। অসহ্য যন্ত্রণায় আমি কুঁকড়ে উঠেছি। কিন্তু ওইসব অফিসারদের বিন্দুমাত্র দয়া-মায়া হয়নি। ওদের দায়িত্ব ছিল আমাকে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলা।” একজন রাজনীতিকের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে, গ্রেফতার চলতে পারে। কিন্তু নির্যাতন করার, শরীরের অঙ্গ বিকল করার, মানবাধিকার প“লিত করার অধিকার সভ্য দেশে কোথাও আছে? এছাড়া শারীরিক নির্যাতনে মৃতপ্রায় তারেক রহমান আদালতে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে বলেন, “জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে চোখ বেঁধে আমাকে নিগৃহীত করা হয়েছে। আমি একজন রাজনীতিবিদ। কোনো সন্ত্রাসী নই। এর আগে আদালত নির্দেশ দিলেও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। রিমান্ডে আবার নির্যাতন হলে আমি বাঁচব না।” যাই হোক, তারেক রহমানের ওপর যে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে এটি সত্য এবং এটি জেনারেল মঈন তার সাক্ষাৎকারে স্বীকারও করেছেন এবং এজন্য একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেলকে দায়ী করেছেন যাকে শাস্তি হিসেবে তিনি অন্যত্র বদলিও করেন। জেনারেল মঈনের বক্তব্যে এটি প্রমাণিত হয় যে, তারেক রহমানের ওপর নির্যাতন অস্বীকার করে তৎকালীন ডিজিএফআই’র দেয়া বক্তব্য সম্পূর্ণ মিথ্যা।
পরিশেষে যে কথাটি না বললেই নয় তাহলো, জেনারেল (অব.) মঈন উ আহমেদ এবং মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন তাদের বক্তব্যে যতই অস্বীকার করুন না কেন, দেশবাসী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, তাদের অজান্তে তারেক রহমানকে গ্রেফতার এবং শারীরিকভাবে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়নি। সবকিছুই করা হয়েছে তাদের জ্ঞাতসারে এবং রীতিমতো তাদের নির্দেশে কিংবা পরামর্শে। এটিই সত্য বলে বিশ্বাস করে দেশবাসী। তারেক রহমান আজ বিদেশে চিকিৎসাধীন। কবে দেশে ফিরতে পারবেন তা ভবিষ্যৎই বলতে পারে। তারেক রহমানের ওপর রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্মম নির্যাতনের দায় কোনক্রমেই তৎকালীন সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল (অব.) মঈন, উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) মতিন এবং সর্বোপরি প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ এড়াতে পারেন না। এর জন্য একদিন তাদের হয়তো বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে। সেদিন হয়তো একমাত্র বেগম খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানের ‘ক্ষমা’ই তাদেরকে রক্ষা করতে পারে। কিন্তু বেগম জিয়া কিংবা তারেক রহমান ক্ষমা করলেও কি তারা নিজেদের বিবেকের আদালতের শাস্তি থেকে মুক্তি পাবেন? না, পাবেন না। বরং বিবেকের যন্ত্রণা তাদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কুড়ে কুড়ে খাবে। জনমনে ঘৃণার পাত্র হয়ে থাকবেন তারা সকলেই।

লেখক : প্রফেসর, ইন্সটিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস ও সাবেক প্রো-ভিসি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন