এরশাদ নয়, বিচারপতি সাত্তারের সরকার খালেদা জিয়াকে বাড়ি দিয়েছিল


প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনা গত শনিবার সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া  সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের কাছ থেকে বাড়ি-গাড়িসহ আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন বলে যে অভিযোগ করেছেন, জনমনে তা ব্যাপক ক্ষোভ ও বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তব্য ছিল রবিবার ‘টক অব দ্য
কান্ট্রি’।

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৯০ সালের জানুয়ারির কোনো একদিন গুলিস্তানের এক সমাবেশে খালেদা জিয়া প্রথম বলেছিলেন, তার স্বামীর হত্যাকারী জেনারেল এরশাদ। এরশাদের কাছ থেকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটিও নিলেন তিনি। এখন প্রশ্ন হলো, যাকে তিনি স্বামীর হত্যাকারী বললেন, তার কাছ থেকে গাড়ি, বাড়ি নিলেন কীভাবে?

 শনিবার বিকালে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ সব কথা বলেন।

এ বিষয়ে অতীত রেকর্ডসমুহ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানা যায়, প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাহাদাতের পরে তাঁর পরিবারের ব্যয় নির্বাহের জন্য অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারের মন্ত্রিসভা ১২ জুন ১৯৮১ ও ১৯ মার্চ ১৯৮২ তারিখে খালেদা জিয়া ও তার দুই পুত্রের অনুকুলে বাড়ি, নগদ টাকা এবং আরো কিছু সুযোগ সুবিধা অনুমোদন করে। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রেসিডেন্টের  পক্ষে মিলিটারী এস্টেট অফিসার ৬ নং শহীদ মইনুল রোডের বাড়িটি রেজিষ্টার্ড দলিলের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেন ৮ই জুলাই ১৯৮১। শহীদ জিয়ার পরিবারকে প্রদত্ত সুযোগ সুবিধা নিয়ে ৩০ জুন ১৯৮১ জাতীয় সংসদে একটি বিতর্কও অনুষ্ঠিত হয়। ট্রেজারী বেঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজ এবং বিরোধী দলীয় নেতা আওয়ামীলীগ নেতা আসাদুজ্জামান খান বক্তব্য রাখেন।

এ প্রসঙ্গে একজন সিনিয়র রাজনীতিক বলেন, মুলত শহীদ জিয়ার পরিবারকে এসব সুযোগ  সুবিধা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তৎকালীন সরকার দিয়েছিল। রাষ্ট্রপতি বা কোন ব্যাক্তি বিশেষ এসব অনুদান দেয়নি। মনে রাখা উচিৎ, রাষ্ট্র যদি কাউকে কোনো অনুদান বা সুযোগ-সুবিধা দেয়  সেজন্য কোনো ব্যাক্তি কৃতিত্ব দাবী করতে পারেনা বা দায়ীও হতে পারেনা। পাশাপাশি রাষ্ট্রের কাছ থেকে অনুদান গ্রহণ করা দোষের কিছু নয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদৎ বরণের পর তাঁর অসহায় পরিবারকে যেসব সুযোগ সুবিধা দেয়া হয় তখন ক্ষমতাসীন ছিল অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সরকার। ওই সরকারের সিদ্ধান্তেই এসব অনুদান দেয়া হয়।

তিনি বলেন, আরো একটি বিষয়  লক্ষণীয় যে,  শহীদ জিয়ার পরিবারকে যখন এসব সুযোগ সুবিধা ও অনুদান দেয়া হয়, তখন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বিচারপতি সাত্তার সরকারের অধীনে সেনা বাহিনী প্রধানের পদে চাকরিরত ছিলেন। ঐ অবস্থায় রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষ থেকে কাউকেই কোনো সুযোগ সুবিধা বা অনুদান দেয়ার ক্ষমতা তার ছিল না।

পরের বছর ২৪ মার্চ একটি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিচারপতি সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এরশাদ। নিজে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন এবং বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি করেন ।

এ বিষয়ে তথানুসন্ধনে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা প্রথমে খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা চালান। তার অভিযোগ ছিল, বেগম জিয়া ক্যান্টনমেন্টে থেকে রাজনীতি করেন! আইনানুগভাবে উচ্ছেদের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। পরে ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা ক্যান্টমেন্ট থেকে খালেদা জিয়াকে বের করার জন্য জোরদার চেষ্টা শুরু করেন। এপ্রিল মাসেই খালেদা জিয়াকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেয়া হয় বাড়িটি সেনা আইন লংঘন করে বরাদ্দ দেয়ার অভিযোগ তুলে। পরে আরো ২ দফা নোটিশ দিয়ে উচ্ছেদের চেষ্টা চালায় সরকার। সরকারী নোটিশের প্রতিকারে খালেদা জিয়া উচ্চ আদালতে গেলে আদালত উচ্ছেদের নোটিশের কার্যকারিতা সাময়িকভাবে স্থগিত করেন। পরে সরকারী চেষ্টায় সে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে রিট খারিজ করে দেন বহুল বিতর্কিত বিচারপতি খায়রুল হক। রিভিশনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সরকার জোর করে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা করে, কিন্তু প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক নীরব থাকেন। সে সুযোগে ১৩ নভেম্বর ২০১০ শেখ হাসিনার সরকার অত্যন্ত নির্মমভাবে উচ্ছেদ করে বেগম খালেদা জিয়াকে।

সেনা নিবাসের ৬ নং শহীদ মইনুল রোডের বাড়িটি ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত একটি বাড়ি। ১৯৭২ সালে জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান নিযুক্ত হওয়ার পর ৬ নম্বর শহীদ মইনুল সড়কের এ বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরেও আমৃত্যু সপরিবারে এ বাড়িতেই ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ৩ থেকে ৬ নভেম্বর খালেদ মোশারফের ব্যর্থ অভ্যুত্থানকালে এ বাড়িতেই বন্দী ছিলেন জেনারেল জিয়া। ১৯৮১ সালে শাহদাতের পরে এই বাড়িতেই রাষ্ট্রপতি জিয়ার লাশ আনা হলে স্বামীর কফিন ধরে অজস্র ধারায় কেঁদেছেন খালেদা জিয়া। পরবর্তীতে এ বাড়ি থেকেই ২ ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন, পরিবারে এসেছে ৩ নাতনি। এভাবেই সুখে দুঃখে মইনুল রোডের বাড়িতে ৩৮ বছর পার করেছেন খালেদা জিয়া। অথচ উচ্ছেদ করার পরে শেখ হাসিনার প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে বেগম জিয়া যে বাড়িটিতে ছিলেন সেটি ভাঙা হয়েছে সর্বপ্রথম।

কান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের পরেও এই বিতর্ক শেষ হয়ে যায়নি। কিছুদিন পর পর শেখ হাসিনা এই বাড়ি নিয়ে খালেদা জিয়াকে খোঁচা দেন। অন্যদিকে শেখ হাসিনার সুরে সুর মিলিয়ে জেনারেল এরশাদও সংসদে দাবী করেন, “খালেদা জিয়া রাজনীতি করবেন জানলে মইনুল রোডের বাড়ি আমি দিতাম না!” কিন্তু এরশাদের এই দাবীটি একটি নির্জলা মিথ্যা। কেননা, মইনুল রোডের বাড়িটি বরাদ্দ দিয়েছেন বিচারপতি সাত্তারের সরকার। সেখানে সেনাপ্রধান হিসাবে এরশাদের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না।

‘খালেদা জিয়া তার স্বামীর হত্যাকারী জেনারেল এরশাদের কাছ থেকে বাড়ি ও অন্যান্য সুবিধা নিয়েছেন’ বলে শেখ হাসিনা যে অভিযোগ করে থাকেন, তার কোনো সত্যতা নাই। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শেখ হাসিনা সত্য জেনেও কেবল রাজনৈতিক অসদুদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে কিছু দিন পর পর অহেতুক ভিত্তিহীন বিতর্ক তুলে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন- এ মন্তব্য একজন বেসরকারি কর্মকর্তার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন