দুর্ধর্ষ ডন ইমদুকে পাওয়া গেল মন্ত্রীর বাড়িতে
উনিশ শতকে মেরি শেলির উপন্যাস ফ্রাঙ্কেনস্টাইনর নায়ক ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ল্যাবরেটরিতে মানুষরূপী দানব বানিয়েছিলেন। পরে সেই দানবের হাতেই খুন হলেন ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। বাংলাদেশেও অনেক ডনকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এবারের প্রতিবেদন গুচ্ছ সেই ঢাকার ডনদের নিয়েই-
মির্জা মেহেদী তমাল
৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২ সাল। কাক-ভোর থেকেই রাজধানীর মিন্টো রোড মন্ত্রিপাড়ায় বিপুলসংখ্যক সশস্ত্র পুলিশ। মন্ত্রী ও বিচারপতিদের সরকারি বাসভবনের ছাদ, গ্যারেজ, আঙিনায় তাদের অবস্থান। অস্ত্র তাক করে আছেন তারা। তাদের নিশানায় মিন্টো রোডের ৪০ নম্বর বাড়ি। বাড়িটি যুবমন্ত্রী আবুল কাশেমের সরকারি বাসভবন। মন্ত্রীর বাড়ির সীমানাপ্রাচীরেও পুলিশ উঠে ভিতরের দিকে অস্ত্র তাক করে রেখেছে। তারা গুলি চালাতে প্রস্তুত। শুধু নির্দেশের অপেক্ষা। হ্যান্ডমাইকে পুলিশের অনবরত ঘোষণা- ‘পুরো বাড়ি পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। কোনোরকম চালাকি না করে সারেন্ডার করুন, নইলে পুলিশ ভিতরে ঢুকে পড়বে।’ কিন্তু কোনো সাড়া-শব্দ নেই। পুলিশ প্রস্তুতি নিল ভিতরে ঢোকার। এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে মন্ত্রীর বাসভবনে অভিযানের অনুমতি নিল পুলিশ। পুরো ঘটনার নেতৃত্বে
তৎকালীন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার এ এফ এম মাহমুদ আল ফরিদ। সকাল ১০টা থেকে পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তাদের ছোটাছুটি বেড়ে যায়। ওয়াকিটকিও তাদের ভীষণ ব্যস্ত। শীতের সকালেও দরদর করে ঘামছেন কর্মকর্তারা। একজন মন্ত্রীর বাসভবন ঘিরে কয়েকশ পুলিশের এই যুদ্ধংদেহী অবস্থানে গোটা শহরে তখন অজানা আতঙ্ক। মিন্টো রোডে সাধারণের যান চলাচল বন্ধ। আশপাশ এলাকায় উৎসুক জনতার ভিড়। দুপুরে একদল সশস্ত্র পুলিশ মন্ত্রীর বাসভবনের দিকে এগোতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ মন্ত্রীর বাড়ির মূল ফটকের পকেট দরজা খুলে গেল। ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছেন একজন! ধীর পায়ে। চাদর গায়ে, মুখ অর্ধেক ঢাকা। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। সুনসান নীরবতা। পুলিশের অস্ত্রের নল ঘুরে গেল লোকটির দিকে। পায়ে হেঁটে লোকটি পুলিশের একদম কাছাকাছি। পুলিশ সদস্যরা তাকে ঘিরে ফেললেন। লোকটি দুই হাত উঁচু করে দাঁড়ালেন। পুলিশ তাকে জাপটে ধরে। লোকটির দুই হাত পেছন দিকে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে তাদের ভ্যানে তুললেন। পুলিশ কর্মকর্তাদের মুখে তখন হাসি। ভ্যানটি চলতে শুরু করল। পুলিশের গাড়ির বহর ভ্যানকে অনুসরণ করল। উৎসুক জনতার উদ্দেশে হ্যান্ডমাইকে পুলিশ বলে, ‘আমাদের অভিযান শেষ। দেশের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ অপরাধী এখন আমাদের কব্জায়।’ দুর্ধর্ষ সেই লোকটি ২২ খুনসহ অসংখ্য গুম ও ডাকাতি মামলার আসামি এমদাদুল হক ইমদু। ইমদু নামেই যিনি বেশি পরিচিত। বাংলাদেশের ইতিহাসে দুর্ধর্ষ যে কজন অপরাধীর নাম বলা হয়ে থাকে, তাদের অন্যতম এই ইমদু; যার নৃশংসতা মনে পড়লে মানুষ এখনো আঁতকে ওঠে। এই ভয়ঙ্কর অপরাধীকে গ্রেফতার করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তিন দিন ধরে তৎকালীন যুবমন্ত্রী আবুল কাশেমের বাসভবন ঘিরে রাখতে হয়েছিল। সংশ্লিষ্টদের মতে, স্বাধীন বাংলাদেশে ইমদুই একমাত্র সন্ত্রাসী যাকে সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এই ইমদু একসময় ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সেই দানবে পরিণত হয়েছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ ডন। ইমদুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং পুলিশের তৎকালীন কয়েকজন কর্মকর্তার (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) সঙ্গে কথা বলে তার সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের দেওয়া তথ্যে উঠে এসেছে ইমদুর অপরাধ জীবনের নানা চাঞ্চল্যকর ও ভয়ঙ্কর সব কাহিনী। ইমদু এমনই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিলেন, মানুষ তার নাম উচ্চারণ করত সন্ত্রাস, অপহরণ আর হত্যার প্রতীক হিসেবে। যার শুরু কালীগঞ্জ উপজেলার সাতানিপাড়া গ্রামে, আর সমাপ্তি কারাপ্রচীরের আড়ালে ফাঁসির দড়িতে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ সাল। এ পাঁচ বছরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন ইমদু। আন্ডারওয়ার্ল্ড থেকে রাজনীতি অস্থির থাকত তার নামে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ঘুম হারাম করে দেওয়া এই দুর্ধর্ষ অপরাধী দিনদুপুরে মানুষ খুনে ছিলেন পারদর্শী। প্রতিপক্ষ গ্রুপের সদস্যদের হত্যা করে বাঁশে ঝুলিয়ে রাখার মতো রোমহর্ষক ঘটনাও তিনি ঘটিয়েছেন। তার অপরাধের প্রতিবাদকারীদেরও প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করেছেন তিনি। পুলিশও রেহাই পায়নি। হত্যা করে লুটে নিয়েছে অস্ত্র। শিশু ও নারীরাও তার শিকার হয়েছে। কালীগঞ্জের বহু পরিবার নিশ্চিহ্ন করেছেন তিনি। অনেকেই তার ভয়ে ভিটেবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে ছিলেন। পাইকারি হারে খুন করলেও ইমদু নিজে অসংখ্যবার মৃত্যু থেকে রক্ষা পান অলৌকিকভাবে। প্রতিপক্ষরা অ্যাম্বুশ করে গুলি চালিয়েও তাকে হত্যা করতে পারেনি। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার এমন বহু গল্প রয়েছে ইমদুর ঘটনাবহুল অপরাধ জীবনে। এ ছাড়া রাজনৈতিক কারণে অপরাধ করেও পার পেয়ে যেতেন তিনি। একদিকে তিনি খুন করে বেড়াতেন, অন্যদিকে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। সে খবর দেখাত টিভিতে, প্রকাশ পেত পত্রপত্রিকায়। যে কারণে পুলিশও তাকে ঘাঁটাত না। তবে মন্ত্রীর বাসভবন থেকে গ্রেফতারের ঘটনাটি ছিল তার জীবনের শেষ গ্রেফতারের ঘটনা। যতদিন বেঁচে ছিলেন কনডেম সেলের পাথর দেয়ালের মধ্যেই তাকে থাকতে হয়েছে। বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনায় তার মৃত্যুদণ্ড হয়, যা কার্যকর হয় গ্রেফতারের ওই বছরই।
তৎকালীন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার এ এফ এম মাহমুদ আল ফরিদ। সকাল ১০টা থেকে পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তাদের ছোটাছুটি বেড়ে যায়। ওয়াকিটকিও তাদের ভীষণ ব্যস্ত। শীতের সকালেও দরদর করে ঘামছেন কর্মকর্তারা। একজন মন্ত্রীর বাসভবন ঘিরে কয়েকশ পুলিশের এই যুদ্ধংদেহী অবস্থানে গোটা শহরে তখন অজানা আতঙ্ক। মিন্টো রোডে সাধারণের যান চলাচল বন্ধ। আশপাশ এলাকায় উৎসুক জনতার ভিড়। দুপুরে একদল সশস্ত্র পুলিশ মন্ত্রীর বাসভবনের দিকে এগোতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ মন্ত্রীর বাড়ির মূল ফটকের পকেট দরজা খুলে গেল। ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছেন একজন! ধীর পায়ে। চাদর গায়ে, মুখ অর্ধেক ঢাকা। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। সুনসান নীরবতা। পুলিশের অস্ত্রের নল ঘুরে গেল লোকটির দিকে। পায়ে হেঁটে লোকটি পুলিশের একদম কাছাকাছি। পুলিশ সদস্যরা তাকে ঘিরে ফেললেন। লোকটি দুই হাত উঁচু করে দাঁড়ালেন। পুলিশ তাকে জাপটে ধরে। লোকটির দুই হাত পেছন দিকে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে তাদের ভ্যানে তুললেন। পুলিশ কর্মকর্তাদের মুখে তখন হাসি। ভ্যানটি চলতে শুরু করল। পুলিশের গাড়ির বহর ভ্যানকে অনুসরণ করল। উৎসুক জনতার উদ্দেশে হ্যান্ডমাইকে পুলিশ বলে, ‘আমাদের অভিযান শেষ। দেশের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ অপরাধী এখন আমাদের কব্জায়।’ দুর্ধর্ষ সেই লোকটি ২২ খুনসহ অসংখ্য গুম ও ডাকাতি মামলার আসামি এমদাদুল হক ইমদু। ইমদু নামেই যিনি বেশি পরিচিত। বাংলাদেশের ইতিহাসে দুর্ধর্ষ যে কজন অপরাধীর নাম বলা হয়ে থাকে, তাদের অন্যতম এই ইমদু; যার নৃশংসতা মনে পড়লে মানুষ এখনো আঁতকে ওঠে। এই ভয়ঙ্কর অপরাধীকে গ্রেফতার করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তিন দিন ধরে তৎকালীন যুবমন্ত্রী আবুল কাশেমের বাসভবন ঘিরে রাখতে হয়েছিল। সংশ্লিষ্টদের মতে, স্বাধীন বাংলাদেশে ইমদুই একমাত্র সন্ত্রাসী যাকে সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এই ইমদু একসময় ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সেই দানবে পরিণত হয়েছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ ডন। ইমদুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং পুলিশের তৎকালীন কয়েকজন কর্মকর্তার (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) সঙ্গে কথা বলে তার সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের দেওয়া তথ্যে উঠে এসেছে ইমদুর অপরাধ জীবনের নানা চাঞ্চল্যকর ও ভয়ঙ্কর সব কাহিনী। ইমদু এমনই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিলেন, মানুষ তার নাম উচ্চারণ করত সন্ত্রাস, অপহরণ আর হত্যার প্রতীক হিসেবে। যার শুরু কালীগঞ্জ উপজেলার সাতানিপাড়া গ্রামে, আর সমাপ্তি কারাপ্রচীরের আড়ালে ফাঁসির দড়িতে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ সাল। এ পাঁচ বছরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন ইমদু। আন্ডারওয়ার্ল্ড থেকে রাজনীতি অস্থির থাকত তার নামে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ঘুম হারাম করে দেওয়া এই দুর্ধর্ষ অপরাধী দিনদুপুরে মানুষ খুনে ছিলেন পারদর্শী। প্রতিপক্ষ গ্রুপের সদস্যদের হত্যা করে বাঁশে ঝুলিয়ে রাখার মতো রোমহর্ষক ঘটনাও তিনি ঘটিয়েছেন। তার অপরাধের প্রতিবাদকারীদেরও প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করেছেন তিনি। পুলিশও রেহাই পায়নি। হত্যা করে লুটে নিয়েছে অস্ত্র। শিশু ও নারীরাও তার শিকার হয়েছে। কালীগঞ্জের বহু পরিবার নিশ্চিহ্ন করেছেন তিনি। অনেকেই তার ভয়ে ভিটেবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে ছিলেন। পাইকারি হারে খুন করলেও ইমদু নিজে অসংখ্যবার মৃত্যু থেকে রক্ষা পান অলৌকিকভাবে। প্রতিপক্ষরা অ্যাম্বুশ করে গুলি চালিয়েও তাকে হত্যা করতে পারেনি। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার এমন বহু গল্প রয়েছে ইমদুর ঘটনাবহুল অপরাধ জীবনে। এ ছাড়া রাজনৈতিক কারণে অপরাধ করেও পার পেয়ে যেতেন তিনি। একদিকে তিনি খুন করে বেড়াতেন, অন্যদিকে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। সে খবর দেখাত টিভিতে, প্রকাশ পেত পত্রপত্রিকায়। যে কারণে পুলিশও তাকে ঘাঁটাত না। তবে মন্ত্রীর বাসভবন থেকে গ্রেফতারের ঘটনাটি ছিল তার জীবনের শেষ গ্রেফতারের ঘটনা। যতদিন বেঁচে ছিলেন কনডেম সেলের পাথর দেয়ালের মধ্যেই তাকে থাকতে হয়েছে। বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনায় তার মৃত্যুদণ্ড হয়, যা কার্যকর হয় গ্রেফতারের ওই বছরই।
কে এই ইমদু : কালীগঞ্জের সাতানিপাড়া গ্রামের কৃষক আশরাফ আলীর ছেলে এমদাদুল হক ইমদু। সাতানিপাড়া খৈ কোরা হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি লেখাপড়া করেছেন। স্বাধীনতার পর ইমদু জাসদের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কালীগঞ্জের জাসদ নেতা আলী হোসেন তালুকদারের অন্যতম সহযোগী ছিলেন তিনি। রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও তাদের মধ্যে প্রকাশ্য বিরোধ শুরু হয় একটি ডাকাতি করে পাওয়া মাল ভাগবাটোয়ারা নিয়ে। এর জেরে জাসদ সেখানে দুই ভাগ হয়ে পড়ে। কালীগঞ্জের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া রেললাইনের দক্ষিণ পাশের নেতৃত্ব আলী হোসেনের এবং উত্তর পাশ ইমদুর নেতৃত্বে। তাদের দ্বন্দ্ব এতটাই প্রকট আকার ধারণ করে যে, তার শেষ ঘটে খুনাখুনির মধ্য দিয়ে। শুরু হয় উভয় গ্রুপের মধ্যে খুন-পাল্টা খুন।
ভয়ঙ্কর ইমদু : জাসদ থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর ইমদু বিএনপিতে যোগদান করেন। তৎকালীন যুবমন্ত্রী আবুল কাশেমের হাত ধরে তিনি বিএনপিতে যোগদান করেন ১৯৮০ সালে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি দানবে রূপ নেন। শুরু হয় তার ‘জাসদ খতম’ মিশন। জয়দেবপুর উপজেলার খিলগাঁও গ্রামের বাবুল, আবদুল কাদের ভূইয়া, কফিলউদ্দিন সামসুকে নিজ হাতে খুন করেন। এরা প্রত্যেকেই তার একসময়ের সহযোগী ছিলেন। বিএনপিতে যোগদানের আগে ইমদু বেশ কয়েকটি রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড ঘটান। ১৯৭৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইমদু কামারিয়া গ্রামের আজিজকে তার ভাইয়ের সামনে কুপিয়ে হত্যা করেন। আজিজের লাশ মাটিচাপা দিয়ে রাখে ইমদু বাহিনী। ১৯৮০ সালের ৪ এপ্রিল ইমদু মসলিন কটন মিলের শ্রমিক আবদুর রশিদকে পাকড়াও করেন। তিনি ও তার বাহিনী রশিদকে তার বাড়িতে নিয়ে যায় মায়ের সঙ্গে শেষ দেখা করাতে। ইমদু তখন রশিদের মাকে বলেন, ছেলের চেহারাটা দেখে নিন। পরে আর সময় পাবেন না। রশিদকে সেখান থেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। লাশ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৯৮১ সালের ৪ এপ্রিল ইমদু ও তার বাহিনীর হাতে খুন হন জাসদ নেতা আলী হোসেন। ঢাকার তেজগাঁও রেলওয়ে কলোনির বাসার সামনেই আলী হোসেনকে খুন করেন ইমদু। শত শত মানুষের সামনে কুপিয়ে হত্যার পর লাশ রাস্তায় ফেলে রেখে যায় ইমদু বাহিনী। ১৩ এপ্রিল কালীগঞ্জে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হলো। ১১ এপ্রিল কালীগঞ্জের মসলিন কটন মিলের কাছে চলছে মাইকিং। সেখানেও হাজির এই ইমদু ও তার বাহিনী। যারা মাইকিং করছিলেন, তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। তিনজনকে গুলি করে হত্যা করল তারা। একজনের লাশ বাঁশের সঙ্গে বেঁধে কালীগঞ্জে ঘুরে বেড়াল হত্যাকারীরা। এ ঘটনার পর পুরো কালীগঞ্জে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একই বছরে কালীগঞ্জের আবদুল আউয়াল ভূঁইয়ার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে অপহরণ করে ইমদু বাহিনী। তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আউয়ালকে দুই সন্তানসহ হত্যার পরিকল্পনা আঁটে ইমদু। আউয়াল দুই সন্তানকে নিয়ে কালীগঞ্জ থেকে ভিটেবাড়ি ফেলে পালিয়ে গেলেন। ইমদু সেই জমিজিরেত দখল করে নেন। এ রকম বহু মানুষ তিনি খুন করেছেন। পুলিশও নিস্তার পায়নি ইমদুর কাছ থেকে। পুবাইল এলাকায় পুলিশকে হত্যা করে রাইফেল লুট করেন ইমদু।
রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা : ইমদু রাজনৈতিকভাবে কতটা দাপুটে ছিলেন, কয়েকটি ঘটনায় তার প্রমাণ মেলে। পুবাইল স্টেশনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের এক জনসভা ছিল। সেদিন মঞ্চে ছিলেন শুধু রাষ্ট্রপতি এবং ইমদু। সে সভায় বাঘা বাঘা মন্ত্রীদের বসতে হয়েছিল মঞ্চের সামনে, সাধারণের কাতারে। আরও একবার বিএনপির জনসভায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজের গলার মালা খুলে ইমদুকে পরিয়ে দেন। খুনের নেশায় মত্ত ইমদু দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠতে থাকেন। বিএনপি সরকারের ভিত পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল ইমদুর সন্ত্রাসে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর কয়েক দিন আগে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয় ইমদুকে। কিন্তু তখন তিনি যুবমন্ত্রী আবুল কাশেমের ক্যাডার হিসেবেই থেকে যান।
বার বার প্রাণে রক্ষা : নিজের হাতে অনেক খুন করলেও বার বার প্রাণে রক্ষা পান এই ইমদু। ১৯৭৭ সালে আলী হোসেনের দলবল ইমদুর গ্রামের বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় ইমদু পালিয়ে প্রাণরক্ষা করেন। হামলাকারীরা ইমদুকে না পেয়ে তার ছোট ভাইকে হত্যা করে। এর কয়েক দিন পর আবারও হামলা হয় ইমদুর বাড়িতে। সেবার প্রতিপক্ষরা খুব কাছে পেয়ে যায় ইমদুকে। সেবারও বেঁচে গেলেন। কয়েক মাস পর আলী হোসেনের লোকজন টঙ্গী এলাকায় পাকড়াও করে ইমদুকে। তারা স্টেনগান ইমদুর বুকে ঠেকিয়ে ট্রিগারে চাপ দেয়। কিন্তু গুলি বের হয়নি। ওই সুযোগে পালিয়ে গেলেন ইমদু। ১৯৭৯ সালে আলী হোসেনের সঙ্গে আপস আলোচনা করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের দোতলায় ডাকা হয় ইমদুকে। ইমদু কলাভবনের দোতলায় আসেন সেই সন্ধ্যায়। আলোচনার এক পর্যায়ে ইমদুকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। গুলি ইমদুর পায়ে বিদ্ধ হয়। ওই অবস্থায় কলাভবনের দোতলা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে দৌড়ে পালান ইমদু। ফাঁসি : ১৯৮২ সালের ৪ আগস্ট ভোর পৌনে ৪টায় কুখ্যাত খুনি ইমদুর ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। এর আগে বেশ কয়েকটি খুনের বিচারে তার ফাঁসির রায় দেওয়া হয়। অনেক মামলার একটি হলো আবদুল মজিদ হত্যা মামলা। মামলার বিচার হয় ঢাকার ‘ক’ অঞ্চলের ১ নম্বর বিশেষ সামরিক আইন আদালতে। ১২ মে আদালত তার বিরুদ্ধে সর্বসম্মতভাবে ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন