নীরব ঘাতক তারেক
ল্যাবরেটরিতে মানুষরূপী দানব বানিয়েছিলেন ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। পরে সেই দানবের হাতেই খুন হতে হয় তাকে। বাংলাদেশেও অনেক ডনকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
২৯ জুলাই, ২০১৩। রাত সাড়ে ১২টা। রাজধানীর গুলশান শপার্স ওয়ার্ল্ডের উল্টো দিকের রাস্তার পাশে একটি গাড়ি এসে থামে। গাড়ি থেকে কালো পাঞ্জাবি পরা একজন নেমে রাস্তা পার হচ্ছেন। হঠাৎ সেখানে একটি মোটরসাইকেল এসে থামল। মোটরসাইকেল থেকে নেমে দ্রুত এগিয়ে আসছেন এক যুবক। পাঞ্জাবি-পাজামা পরা যুবকটির মাথায় টুপি। বাম হাতে ধরা মোবাইল ফোনে কথা বলে যাচ্ছেন। ডান হাতে তার পিস্তল। যুবকটি গাড়ি থেকে নামা লোকটির সামনে এসেই মাথায় গুলি চালান। গুলিবিদ্ধ লোকটি রাস্তায় পড়ে গিয়ে আবার ওঠার চেষ্টা করেন। ঘাতক যুবকটি ফোনে কথা বলেই যাচ্ছেন, পাশাপাশি গুলিও করছেন। খুব কাছ থেকে ছয়-সাতটি গুলি চালান যুবকটি। এরপর অপেক্ষমাণ
রাজধানীতে নীরবে ২৫ থেকে ৩০টি খুন করেছেন। মিল্কী হত্যাকাণ্ডটি সিসিটিভিতে ধারণ করায় তারেক ধরা খেয়ে যান। এর আগে পুলিশ প্রশাসনের কাছেও তার ব্যাপারে এমন ভয়ঙ্কর তথ্য ছিল না। মিল্কী খুনের পর তারেক গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ধরা পড়েন উত্তরার একটি ক্লিনিক থেকে। এরপরই খিলক্ষেত এলাকায় র্যাবের ওপর হামলা চালিয়ে তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে তার সহযোগীরা। গুলিবিনিময়ের একপর্যায়ে নিহত হন পেশাদার এই কিলার তারেক। পুলিশ, গোয়েন্দা ও তারেকের একসময়ের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এমন বেশ কয়েকজনের বক্তব্যে তারেকের ভয়ঙ্কর সব অপরাধের চিত্র ফুটে উঠে। সূত্রগুলো জানায়, কালা জাহাঙ্গীর, বিকাশ, ডাকাত শহীদ এবং সুইডেন আসলামসহ অনেকের কাজ (কন্ট্রাক্ট কিলিং) করে দিতেন এই তারেক। ওর অস্ত্রভাণ্ডারে ছিল অত্যাধুনিক বিদেশি অস্ত্র। পুরান ঢাকার শাহাদাত কমিশনার, মতিঝিলের দর্পণ, শাহজাহানপুরের রাজীব, পুরান ঢাকার আইনজীবী হাবিব মণ্ডল, ধানমন্ডিতে ফরিদপুরের আওয়ামী লীগ নেতা লিয়াকত হোসেন, আগারগাঁওয়ে এসআই হুমায়ুন কবির, ছাত্রলীগ নেতা তপন ও আঁখি, জাতীয় পার্টির কমিশনার খালেদ ইমাম, মোহাম্মদপুরে শোভনের শ্যালক এবং সায়েদাবাদে এক শিল্পপতিসহ অনেককেই তিনি নিজ হাতে খুন করেছেন। তারেকের বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি অন্য কাউকে দিয়ে খুন করাতেন না। নিজেই খুনের কাজটি নিপুণ হাতে করতেন। তারেকের গ্রামের বাড়ি সিলেটের হবিগঞ্জে। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। বাবা আবদুল হাই। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে। তারেকের শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও রাজনৈতিক জীবন খুব কাছ থেকে দেখা এমন কয়েকজন নেতা-কর্মী বলেন, নব্বইয়ের দশকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়েই তারেকের রাজনৈতিক পথচলা শুরু। সে সময় ওই নেতার পক্ষে ছিলেন রিয়াজুল। ওই সময় পুরো মতিঝিল এলাকার অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন ইখতিয়ার, জিসানসহ আরও কয়েকজন। ইখতিয়ার ও জিসান ছিলেন মতিঝিলের এক ওয়ার্ড কমিশনারের সহযোগী। তাদের কারণে তারেক, রিয়াজুল শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত ও নিগৃহীত হতেন। রাজনৈতিকভাবেও তারা পিছিয়ে ছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ নির্যাতন ও নিগ্রহ থেকে বাঁচতে তারেক আশ্রয় নেন মিরপুরের তৎকালীন শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীরের কাছে। সেই সূত্রে তারেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে ভারতে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদত, তাজসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে। তারেকের কাজই ছিল এ তিন সন্ত্রাসীর বিরোধীদের চিহ্নিত করে হত্যা করা। ২০০১ সালের দিকে তারেক মিরপুরের গুদারাঘাটের বাসিন্দা সন্ত্রাসী টিপুকে এলিফ্যান্ট রোডে একটি রেস্তোরাঁয় গুলি করে হত্যা করেন। মূলত ওটাই ছিল নিজ হাতে তার জীবনের প্রথম কাউকে খুন করা। এরপর একে একে খুন করে গেছেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই সাইলেন্ট কিলার তারেক। নাম প্রকাশ না করে মতিঝিলের এজিবি কলোনির একজন রাজনৈতিক নেতা বলেন, এভাবে খুন করতে করতে পারদর্শী ও ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিল তারেক। অন্যদিকে মতিঝিল এলাকার অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণকারী ইখতিয়ার, জিসানসহ কয়েকজন দুই পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার আসামি হন। তারা দেশের বাইরে পালিয়ে যান। আর বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাইরে চলে যান ইখতিয়ার ও জিসানের আশ্রয়দানকারী ওই ওয়ার্ড কমিশনার। এ সুযোগে তারেক মতিঝিলের অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। জড়িয়ে পড়েন একের পর এক হত্যাকাণ্ডে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন