আত্মীয়তার বন্ধনে রাজনীতি-৪



ভারতীয় উপমহাদেশে আরেকটি প্রভাবশালী উপাধি খান বা খাঁ। মঙ্গোলীয় ও তুর্কি ভাষা থেকে উৎপন্ন এ উপাধির আভিধানিক অর্থ সেনানায়ক, নেতা বা শাসক। মোগল আমলে নজিরবিহীনভাবে বিশিষ্টতা অর্জন করে খান উপাধি। বৃটিশ ও পাকিস্তান আমল পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতেও ব্যাপক প্রভাবশালী কিছু খান পরিবার। বাংলাদেশের রাজনীতি ও ব্যবসায়িক জগতে অন্যতম বিখ্যাত চট্টগ্রামের খান পরিবার। আবুল কাসেম খান (এ কে খান) ছিলেন অবিভক্ত ভারতের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি মেম্বার ও পাকিস্তানের ফেডারেল মিনিস্টার। পরবর্তীকালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বিখ্যাত একে খান গ্রুপ অব কোম্পানি। একে খানের ছেলে প্রয়াত জহিরউদ্দিন খান ছিলেন জিয়া সরকার ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ৫ম সংসদের পরিকল্পনা ও শিল্পমন্ত্রী। একে খানের ভাগনে হলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান। তিনি এরশাদ সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন। জহিরউদ্দিন খান ও মোরশেদ খান আপন মামাতো-ফুফাতো ভাই। মোরশেদ খানের বেয়াই
হলেন আওয়ামী লীগের বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। সালমান এফ রহমানের ছেলে সায়ান রহমানের কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন মোরশেদ খান। আবার এ কে খানের ভাগনি জামাই হলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত সাইফুর রহমান। একে খান পরিবারের আরেক জামাতা বিএনপি নেতা সাবেক সচিব ও মন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেন। এছাড়া খান পরিবারের আরও দুই জামাই হলেন বঙ্গবন্ধু হত্যায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত কর্নেল (অব.) ফারুক ও কর্নেল রশীদ।
পাকিস্তানের স্পিকার ছিলেন মুসলিম লীগের জাঁদরেল নেতা ও বিচারপতি বরিশালের আবদুল জব্বার খান। তার ছেলে রাশেদ খান মেনন ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী। তার আপন বোন হলেন বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী সেলিমা রহমান। জব্বার খানের এক ছেলে প্রয়াত এনায়েতুল্লাহ খান ছিলেন জিয়াউর রহমান সরকারের মন্ত্রী। আরেক ছেলে কবি ও সাবেক সচিব প্রয়াত আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ছিলেন এরশাদ সরকারের কৃষিমন্ত্রী। সেলিমা রহমানের বোন জামাই হলেন বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাস। আবার শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের সঙ্গে আবদুল জব্বার খানের রয়েছে আত্মীয়তা। আবদুল জব্বার খানের শাশুড়ি হলেন শেরেবাংলার আপন ফুফাতো বোন।
উপমহাদেশের বিখ্যাত রাজনীতিক আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তার ছেলে আবু নাসের খান ভাসানী ছিলেন এরশাদ সরকারের মন্ত্রী। মওলানা ভাসানীর মেয়ের জামাই চৌধুরী মোতাহের হোসেন ছিলেন জিয়াউর রহমান সরকারে বিএনপি দলীয় এমপি। এছাড়া, টাঙ্গাইলের খান পরিবারের সন্তান সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক শীর্ষস্থানীয় নেতা প্রয়াত হাবিবুর রহমান খান। তার ছেলে বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী লুৎফর রহমান খান আজাদ। আজাদের চাচা হলেন আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামসুর রহমান খান শাহজাহান। লুৎফর রহমান আজাদের সম্পর্কে চাচাতো ভাই হলেন ঘাটাইলের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি আমানউল্লাহ খান। তার আরেক চাচাতো ভাই আওয়ামী লীগ নেতা ও টাঙ্গাইল পৌর মেয়র মুক্তি। জামালপুরের বিখ্যাত খান পরিবারের সন্তান বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা নজরুল ইসলাম খান। তার চাচাতো ভাই হলেন বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র সাবেক সভাপতি ও বর্তমান উপদেষ্টা মঞ্জুরুল আহসান খান। মঞ্জুরুল আহসান খানের শ্যালক হলেন সিপিবি’র সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। নজরুল ইসলাম খানের সম্পর্কে ভাতিজা হলেন ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন নবী খান সোহেল। অন্য খান পরিবারের মধ্যে গোপালগঞ্জের খান পরিবারের সন্তান হলেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান। তার বড় ভাই আজিজ খান বিখ্যাত ব্যবসায়ী। ফারুক খানের চাচা প্রয়াত অ্যাডভোকেট সালাম খান খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ ছিলেন। ফারুক খানের স্ত্রীর বড় ভাই হলেন সেক্টর কমান্ডার ও বিএনপির সাবেক মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক সম্পাদক প্রয়াত হামিদুল্লাহ খান বীরপ্রতীক। আরেক ভাই আতিকুল্লাহ খান মাসুদ গ্লোব শিল্প গ্রুপের মালিক ও দৈনিক জনকণ্ঠের প্রকাশক। বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার জিয়াউর রহমান খান। তার পিতা আতাউর রহমান খান ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী।
বঙ্গবন্ধু সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন এমআর সিদ্দিকী। তিনি বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এম সাইফুর রহমানের ভায়রা। এম আর সিদ্দিকীর ছেলের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন সাইফুর রহমান। সে হিসেবে সাইফুর রহমান ও এম আর সিদ্দিকী একই সঙ্গে ভায়রা ও বেয়াই। আবার এম আর সিদ্দিকীর চাচাতো ভাই হলেন বিএনপি সরকারের কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক স্পিকার প্রয়াত এলকে সিদ্দিকী। তার ছোট ভাই এওয়াইবি সিদ্দিকী ছিলেন সাবেক আইজিপি। আবার আওয়ামী লীগের এমপি নুরুল ইসলাম বিএসসি ও এম আর সিদ্দিকী সম্পর্কে ভায়রা। বাংলাদেশের আরেক বিখ্যাত সিদ্দিকী পরিবার হচ্ছে টাঙ্গাইলের। মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক এই এমপি বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের সভাপতি। তার বড় ভাই হলেন আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। তার স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী নিজেও একজন সাবেক এমপি। সিদ্দিকী পরিবারের আরও দুই সন্তান আজাদ সিদ্দিকী ও মুরাদ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের রাজনীতি ছেড়ে বর্তমানে কাদের সিদ্দিকীর রাজনৈতিক দলে সক্রিয়। গাজীপুরের বলিয়াদীর জমিদার পরিবারের সন্তান চৌধুরী লাবিব আহমেদ সিদ্দিকী। তার ছেলে চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী ছিলেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী। তানভীর সিদ্দিকীর ছেলে চৌধুরী ইরাদ আহমেদ সিদ্দিকী ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন।
অবিভক্ত বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কিংবদন্তির জনদরদী রাজনীতিক শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। তার ছেলে ফায়জুল হক ছিলেন জিয়া সরকারের বিএনপি দলীয় এমপি। পরে তিনি জাতীয় পার্টির টিকিটে এরশাদ সরকারের ও আওয়ামী লীগের টিকিটে শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। তার বড় ছেলে একে ফাইয়াজুল হক রাজু আওয়ামী লীগ নেতা। তবে তার মেয়ের জামাই আখতারুল আলম ফারুক ময়মনসিংহ জেলা বিএনপি নেতা। শেরেবাংলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা রয়েছে বরিশালের আবদুল জব্বার খানের।
বিএনপির সাবেক মহাসচিব ও সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত কেএম ওবায়দুর রহমান। তার মেয়ে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের সভাপতি ও বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ। শামা ওবায়েদের স্বামীর আপন বড় ভাই হলেন সিরাজগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা শিক্ষাবিদ প্রফেসর মাজহারুল ইসলামের পুত্র চয়ন ইসলাম। আবার ওবায়দুর রহমানের স্ত্রী ড. শাহেদা ওবায়েদ গড়ে তুলেছেন ‘গড়বো বাংলাদেশ’ নামে একটি রাজনৈতিক দল। অন্যদিকে ওবায়দুর রহমানের বড় ভাই খন্দকার হাবিবুর রহমান ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কোষাধ্যক্ষ। তার ছেলে জুয়েল বর্তমানে ঢাকা মহানগর যুবলীগ নেতা।
উৎসঃ   মানবজমিন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন