খন্দকারের জন্ম ১ জানুয়ারি, ১৯৩০ সালে। মুক্তিবাহিনীর উপ-অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৫২ সালে পাকিস্তান এয়ারফোর্সে কমিশন লাভ করেন তিনি। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন উইং কমান্ডার। প্রবাসী সরকার তাকে গ্র“প ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি দেয়। পরে তিনি বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। মুক্তিবাহিনীর উপ-অধিনায়ক হিসেবে তার কাজ, ডিসেম্বরের চূড়ান্ত
যুদ্ধ ও আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান নিয়ে তিনি কথা বলেছিলেন সমকাল-এর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন মাহবুব মোর্শেদ। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি সমকাল-এর সৌজন্যে প্রকাশ করা হলো।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড গঠিত হওয়ার পর মুক্তিবাহিনী ও এর নেতৃত্বের কর্মতৎপরতায় কি পরিবর্তন এসেছিল?
এ কে খন্দকার: যৌথ বাহিনী বলতে বোঝায় দুটি বাহিনীর এক হয়ে যুদ্ধ করা। সত্য কথা বললে, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই এটা চলছিল। আমরা যুদ্ধ করছিলাম আর ভারতীয় বাহিনী আমাদের সাহায্য করছিল। এই প্রক্রিয়াটা চলছিল সমানভাবে। পরে দুই সরকারের মধ্যে আলোচনা করে যৌথ বাহিনী গঠন করা হয়। মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনী মিলে যৌথ বাহিনী গঠন করে। যৌথ বাহিনী সক্রিয় হওয়ার পর আমরা একসঙ্গে যুদ্ধ করতে আরম্ভ করলাম। অনেক জায়গায় তারা আমাদের সাপোর্ট দিতে আরম্ভ করল। কোনো কোনো জায়গায় তারা এবং কোনো কোনো জায়গায় আমরাও নতুনভাবে আক্রমণ করতে আরম্ভ করলাম। এভাবে ৪ ডিসেম্বর থেকে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হলো। একটি কথা বলে রাখা দরকার, এই অভিযান শুরু হওয়ার অনেক আগেই যুদ্ধ করার মতো মানসিক এবং শারীরিক সামর্থ্য পাকিস্তানের ছিল না। কারণ, মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে তারা এমনভাবে পর্যুদস্ত হয়েছিল যে, যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটা ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতা। তাছাড়া তাদের যুদ্ধ করার ক্ষমতা খুব বেশিদিন ছিল না। ভারত মিত্রবাহিনী হিসেবে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেওয়ার ফলে যুদ্ধের গতিটা অনেক বেড়ে গেল। ৩ ডিসেম্বর শেষ রাতে যে যুদ্ধ আরম্ভ হয়, তাতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীই প্রথম আক্রমণ করে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী বাংলাদেশের ভেতরে পাকিস্তানি টার্গেটে প্রথম আক্রমণ করে। তারা নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে এবং ফিউয়েল ডাম্পে আক্রমণ করে দুটিকে এমনভাবে ধ্বংস করে যে, পাকিস্তানি বাহিনীর যেখানে-সেখানে যাওয়া-আসার ক্ষমতা কমে যায়। তাদের তেল সরবরাহ ধ্বংস হয়ে যাবে এটা তারা চিন্তা করতে পারেনি। ৩ তারিখ শেষ রাতে যুদ্ধ শুরু হওয়ার ৪, ৫, ৬ তারিখের মধ্যেই যশোরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের পতন হলো। ওদিকে ঠাকুরগাঁও স্বাধীন হয়ে গেছে। ৭ তারিখেই পাকিস্তানিরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে প্রথম জানাল, যুদ্ধ থামিয়ে আলোচনা করতে হবে। ইয়াহিয়া তাদের কথায় পাত্তা দিলেন না। তাদের ধারণা ছিল, উত্তর থেকে চীন এবং দক্ষিণ থেকে আমেরিকা উভয়েই তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে এবং শেষ পর্যন্ত যৌথ বাহিনীকে পরাজিত করবে। কিন্তু চীনা কর্তৃপক্ষ তাদেরকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিল, তাদের সমর্থন করলেও যুদ্ধে জড়াতে তারা রাজি নয়। আর এদিকে ৯ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে বঙ্গোপসাগরের দিকে আসা শুরু করল। এ নিয়ে যে আমাদের চিন্তা ছিল না তা নয়। আমাদের চিন্তা ছিল তারা যদি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, তাহলে এটি একটি বড় যুদ্ধে পরিণত হবে। তখন পাকিস্তান ছিল আনন্দে উৎফুল্ল। তাদের মনোভাবটা ছিল এমনথ এই বুঝি যুদ্ধ শেষ হলো। যুদ্ধ শেষে তারাই জিতবে। কিন্তু সপ্তম নৌবহর যখন ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছেছে, তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের কিছু সাবমেরিন এবং যুদ্ধজাহাজ ভারত সাগরে উপস্থিত হয়। সুতরাং সপ্তম নৌবহরের পক্ষেও কিন্তু বাংলাদেশে যুদ্ধে নেমে পড়া সহজ ছিল না এবং শেষ পর্যন্ত তারা বঙ্গোপসাগরে আসেনি। যৌথ বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর এই যে যুদ্ধ চলল, সত্যিকার অর্থেই এটি ছিল একটি অসম যুদ্ধ। কারণ আগেই বললাম, পাকিস্তানিদের যুদ্ধ করার মতো শক্তি ছিল না। না মানসিক, না শারীরিকভাবে।
প্রশ্ন: লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেএফআর জ্যাকব তার বই ‘স্যারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’য় দাবি করেছেন, পাকিস্তানি ফরমেশন ও ক্যান্টনমেন্ট এড়িয়ে সরাসরি ঢাকায় আসার আইডিয়াটা তার ছিল। মানেকশ তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন।
এ কে খন্দকার: এ সম্পর্কে তাদের মধ্যে কী আলাপ হয়েছিল কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে মতদ্বৈধতা তৈরি হয়েছিল বলা কঠিন। তবে জ্যাকব এটাকে সমর্থন করতেন যে, পাকিস্তানিদের সামরিক অবস্থানগুলো এড়িয়ে যাওয়া। তিনি নিজেও তখন এটি বলেছেন। শক্ত ঘাঁটিগুলোতে সম্মুখ সমরে লিপ্ত না হয়ে তাদের এড়িয়ে যেতে পারাটাই ভালো হবে, এটা তিনি বলেছিলেন।
প্রশ্ন: আপনারা এই পরিকল্পনা জানতেন এবং সমর্থন করতেন?
এ কে খন্দকার: আমরা তো যৌথ বাহিনীতে ছিলাম। ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দফতরথ ফোর্ট উইলিয়ামসে গিয়ে আমি তো তাদের সঙ্গে আলোচনা করতাম।
প্রশ্ন: সেখানে কী ধরনের আলোচনা হতো?
এ কে খন্দকার: যুদ্ধকৌশল নিয়ে আলোচনা হতো। কোন কোন টার্গেটে আক্রমণ চালানো হবে সেসবও আলোচনা হতো। কীভাবে যুদ্ধ চালানো হচ্ছে সে আলোচনাও হতো। সুতরাং আমার পক্ষে জানাটা অনেক সহজ ছিল।
প্রশ্ন: ওই সভায় মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে আর কে কে থাকতেন?
এ কে খন্দকার: আমি একাই থাকতাম। সে সময় জেনারেল এমএজি ওসমানী অতটা ইনভলভ ছিলেন না।
প্রশ্ন: জেনারেল এমএজি ওসমানীর সঙ্গে তখন আপনার আলোচনা হতো?
এ কে খন্দকার: হতো না। তিনি তখন একটু নিশ্চুপ ছিলেন। আর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমি ব্যস্ত থাকতাম।
প্রশ্ন: সামরিক যেসব সিদ্ধান্ত আপনারা গ্রহণ করতেন সেগুলো জানার জন্য তাজউদ্দীন আহমদ আগ্রহী ছিলেন?
এ কে খন্দকার: হ্যাঁ। এসব জানার জন্য তিনি খুব আগ্রহী ছিলেন। তিনি আমার কাছে শুনতেন, যুদ্ধ কেমনভাবে চলছে, কতদিন লাগবে, আমরা জয়লাভ করব কি-নাথ এরকম অনেক প্রশ্ন তিনি আমাকে করতেন। আমি পরিষ্কারভাবে তাকে বলতাম, স্যার আমরা জিতবই। জয়ের ব্যাপারে আমার মনে কোনোরকম সন্দেহ ছিল না।
প্রশ্ন: আপনার কি মনে হতো যুদ্ধ ৯ মাসে শেষ হবে?
এ কে খন্দকার: আমি মে মাসে এই কথাটা আমার বন্ধুদের বলতাম যে, ডিসেম্বর মাসে আমরা দেশে ফিরে যাব। কারণ, আমি ভাবতাম এক কোটি শরণার্থীকে খুব বেশিদিন রাখা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, ডিসেম্বর মাস হবে শীতের মাস। তখন চীন আসতে পারবে না। কারণ, বরফ পড়বে। পাকিস্তানিরা পশ্চিম সীমান্ত থেকে এসে এখানে যুদ্ধ করতে পারবে না। অথচ ভারতে সমস্ত সুবিধা থাকবে। সে জন্য ভারত মিত্র হিসেবে আমাদের সঙ্গে যখন যোগ দেবে তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা শারীরিক এবং মানসিকভাবে এত বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়বে যে, তাদের পক্ষে যুদ্ধ বেশিদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। তাই এ যুদ্ধে জয়লাভ করে ডিসেম্বরেই আমরা দেশে ফিরে যাব।
প্রশ্ন: আত্মসমর্পণের সময় আপনি রেসকোর্সে উপস্থিত ছিলেন। আপনি কখন জানলেন যে, ১৬ তারিখ আপনাকে ঢাকায় আসতে হবে?
এ কে খন্দকার: ১৬ তারিখ সকালে আমি একটা কাজে বের হই। সকাল ১০টার দিকে ফিরে এসে দেখি সবাই আমাকে খুঁজছে। জানতে পারলাম, বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা জেনারেল এমএজি ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু তারা তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হননি। জেনারেল এমএজি ওসমানী তখন সিলেট চলে গিয়েছিলেন। তিনি কোথায় আছেন সেটা কেউ জানত না। তখন মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নেয়, রেসকোর্স ময়দানে যে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হবে, সেখানে বাংলাদেশ বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করব আমি। আমাকে তখনি বলা হলো, তুমি এখনি চলে যাও। দমদম এয়ারপোর্টে তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন ভারতীয় প্রতিনিধিরা।
প্রশ্ন: কোথায় এসে আপনি এটা শুনলেন?
এ কে খন্দকার: কলকাতার থিয়েটার রোডের অফিসে। সেখানেই আমাদের হেডকোয়ার্টার ছিল।
প্রশ্ন: আপনার সঙ্গে তখন কেউ ছিল?
এ কে খন্দকার: আমার সঙ্গে ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজা ও শিশু।
প্রশ্ন: কীভাবে আপনারা দমদম পৌঁছলেন?
এ কে খন্দকার: তৎক্ষণাৎ একটা জিপে চড়ে আমরা দমদমে পৌঁছলাম। গিয়ে দেখি, একটা উড়োজাহাজ প্রস্তুত হয়ে আছে। অনেক সিনিয়র অফিসার ভেতরে অপেক্ষা করছেন। আমি উড়োজাহাজে উঠতে যাব এমন সময় দেখি আরেকটি জিপ খুব দ্রুতবেগে জাহাজের দিকে এগিয়ে আসছে। দেখতে পেলাম সেই জিপে জেনারেল অরোরা এবং তার স্ত্রীও আসছেন। তারা যখন জিপ থেকে নামলেন, তখন আমি জাহাজে ওঠার সিঁড়ি থেকে একটু পিছিয়ে গেলাম। কারণ, তিনি ছিলেন আমার থেকে অনেক সিনিয়র একজন অফিসার। অথচ তিনি এসে আমার ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, না না। তুমিই আগে যাবে। কারণ, তুমি মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার। আমি তোমাকে পেছন থেকে অনুসরণ করব। তার এই ভদ্রতাটুকু আমার চিরদিন মনে থাকবে। এই সম্মান মুক্তিবাহিনীর। তারা স্বীকারও করেছেন, মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীকে কীভাবে পর্যুদস্ত করেছে। তারা সবাই বলেছেন, যুদ্ধটা এত তাড়াতাড়ি শেষ হওয়ার একটাই কারণ, মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীকে একেবারেই কোণঠাসা করে ফেলেছিল।
প্রশ্ন: তারপর?
এ কে খন্দকার: এরপর আমরা উড়োজাহাজে করে আগরতলা গেলাম। ঢাকার ওপর দিয়েই আমরা গেলাম।
প্রশ্ন: ঢাকায় সরাসরি নামলেন না কেন?
এ কে খন্দকার: ঢাকার রানওয়ে তখন এত বিধ্বস্ত ছিল যে নামা যেত না। আগরতলায় গিয়ে দেখি ৭-৮টি হেলিকপ্টার দাঁড় করানো। হেলিকপ্টারে আমরা ঢাকা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছলাম। বিমানবন্দরে এসে দেখি জেনারেল নিয়াজি, জ্যাকবসহ অন্য জেনারেলরা আমাদের রিসিভ করার জন্য অপেক্ষা করছেন। তারপর জিপে করে আমরা সোজা চলে গেলাম রমনা ময়দানে।
প্রশ্ন: রমনা ময়দানে যাওয়ার পথে কী দেখলেন?
এ কে খন্দকার: দেখলাম, হাজার হাজার মানুষ রাস্তার দু’পাশে অপেক্ষা করছে।
প্রশ্ন: ততক্ষণে কি আত্মসমর্পণ হওয়ার খবরটি ছড়িয়ে পড়েছে?
এ কে খন্দকার: হ্যাঁ। কিছু একটা হচ্ছে এ ধরনের একটি খবর ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছিল। মানুষের মধ্যে ছিল উৎফুল্ল একটা ভাব।
প্রশ্ন: রমনা ময়দানে পৌঁছে?
এ কে খন্দকার: সেখানে পৌঁছে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হলো। অনুষ্ঠানটি ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। দুটি চেয়ার ও একটা টেবিল পাতা ছিল। জেনারেল অরোরা এবং জেনারেল নিয়াজি দু’জনেই স্বাক্ষর করলেন। তারপর জেনারেল নিয়াজি এবং অন্য পাকিস্তানি অফিসারদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হলো। কারণ, সে সময় তাদের জীবন ছিল একেবারেই অনিরাপদ। চারদিকে জনগণ চিৎকার করছিল। এতদিন তারা যে অত্যাচার বাঙালিদের ওপর করেছে তাদের সেই শাস্তি দাবি করছিল তারা। কিন্তু সেটা তখন সম্ভব ছিল না। আত্মসমর্পণ করার পর আমাদের দায়িত্ব ছিল তাদের রক্ষা করা। কোনো ক্ষতি হতে না দেওয়া।
প্রশ্ন: এরপর তাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হলো?
এ কে খন্দকার: এরপর ক্যান্টনমেন্টে যেখানে তাদের থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল, সেখানে তাদের নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা সবাই আবার বিমানবন্দরে চলে গেলাম।
প্রশ্ন: সেদিনের বিশেষ কোনো কথা মনে পড়ে?
এ কে খন্দকার: আমার মনে পড়ে, সেদিন অনেক মানুষ আমাকে আলিঙ্গন করেছে। কত মানুষ যে আমার সঙ্গে আলিঙ্গন করেছে তার হিসাব নেই। আলিঙ্গন করে তারা বলেছে, আজ থেকে আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারব।
প্রশ্ন: তখন আপনার অনুভূতি কেমন ছিল?
এ কে খন্দকার: আমি আল্লাহর কাছে হাজার শুকর করলাম। আমি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা দিতে পেরেছি এটিই ছিল আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।
প্রশ্ন: এয়ারপোর্ট থেকে আপনারা কোথায় গেলেন?
এ কে খন্দকার: এয়ারপোর্ট থেকে আমরা আবার গেলাম আগরতলায়। আগরতলা থেকে ওই প্লেনে চড়ে আবার এলাম কলকাতায়।
প্রশ্ন: স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার প্রক্রিয়া কী ছিল?
এ কে খন্দকার: আমার ইচ্ছা ছিল পরদিনই চলে আসার। তখন ওসমানী সাহেব আমাকে আসতে দিলেন না। তিনি বললেন, না ওখানে এখনও বিপদ রয়েছে। আগে সবকিছু ঠিক হোক তারপর যাব। কিন্তু ওখানে থাকতে আমার ভালো লাগছিল না। ১৮-১৯ তারিখে তাজউদ্দীন সাহেবকে বলে আমি একাই চলে এলাম। এসে যারা ছিল তাদের সবাইকে একত্র করে পরদিন সকাল থেকেই আমি কাজ শুরু করলাম, যাতে বিমান বাহিনী পুনরায় দাঁড়াতে পারে। তখন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর যেসব বিমান ছিল পাকিস্তানিরা গুলি করে সেসব বিমান নষ্ট করে রেখে গিয়েছিল, যাতে আমরা সেগুলো ব্যবহার করতে না পারি। কিন্তু আমরা টেকনিশিয়ানদের মাধ্যমে অন্য বিমানের ছোট ছোট যন্ত্রাংশ খুলে যে বিমানটি সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটি ঠিক করলাম। সেটিতে আমি এবং অন্য একজন ফ্লাই করলাম। তারপর ধীরে ধীরে এয়ারফোর্স গড়ে উঠল।
প্রশ্ন: আপনি অফিস নিয়েছিলেন কোথায়?
এ কে খন্দকার: আমার অফিস ছিল ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেই ১০ ফুট বাই ১০ ফুটের ছোট্ট একটি ঘর। এটি ছিল মাটির নিচে।
প্রশ্ন: ১৬ ডিসেম্বর কতদিন পর ঢাকা ফিরেছিলেন?
এ কে খন্দকার: আমি ঢাকা ছেড়ে ছিলাম ১০ মে। এর আগে আরও দু’বার আমি যাওয়ার চেষ্টা করি। প্রথমবার এপ্রিল মাসের ১-২ তারিখে। কিন্তু গফরগাঁওয়ে পৌঁছে আমরা দেখি যে নদীতে পানি নেই। লঞ্চ আর সামনের দিকে যাচ্ছে না। আমাদের ফিরে আসতে হলো। দ্বিতীয়বার এপ্রিলের ১৭-১৮ তারিখে আবার আরিচা দিয়ে রাজশাহী হয়ে পার হওয়ার চেষ্টা করলাম। আরিচা পৌঁছে আমরা দেখলাম, আরিচা পাকিস্তানি সৈন্যে বোঝাই। দেখলাম, ওখান দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ফিরে এলাম। ফিরে এসে চিন্তা করলাম, এতগুলো বাঙালি পাইলট যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত। আমি একা চলে যাচ্ছি কেন? পাইলটরা যুদ্ধ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত কি-না তা আমি জানতাম না। তখন আমি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজার মারফত উইং কমান্ডার বাশারের কাছে খবর পাঠালাম। জুনিয়র অফিসারদের কাছে জানতে চাইলাম, বিদ্রোহ করে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত কি-না। তখন এয়ারফোর্স থেকে বিদ্রোহ করে বের হয়ে যুদ্ধে যাওয়া খুব বড় একটা সিদ্ধান্তের ব্যাপার ছিল। বাশার এবং রেজা জুনিয়র অফিসারদের কাছে জানতে পেল তারা সবাই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। তখন একজনকে আমরা পাঠালাম কোন রাস্তা নিরাপদ তা যাচাই করার জন্য। দু’দিন পর সে ফিরে এসে আমাদের জানাল। তখন আমরা দুটি গ্র“পে বিভক্ত হলাম। এটা এ জন্য যে, এক গ্র“প ধরা পড়লেও অন্য গ্র“প যাতে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে। এরপর ১০ মে পুরো গ্র“প মিলে আমরা রওনা হলাম। সৌভাগ্যবশত আমরা দু’দলই আগরতলায় গিয়ে পৌঁছলাম।
প্রশ্ন: আপনি বললেন, ৩ ডিসেম্বর প্রথম যে বিমান আক্রমণ হয়েছিল ঢাকার ওপর তা আমাদের বিমান বাহিনী করেছিল। এটা ঠিক কোন সময়ে?
এ কে খন্দকার: এটা হয়েছিল ৩ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ২টা ৩০ মিনিটে কিংবা ৩টার দিকে। এখানে একটি বিষয় আমি গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করতে চাই তা হলো, আমাদের পাইলটরা রাতেই ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করে এসে আক্রমণ করেছিল। ওপর দিয়ে ফ্লাই করে এসে আক্রমণ করলে রাডারে ধরা পড়ার ভয় ছিল। তাই তারা গাছের ওপর দিয়ে এসে আক্রমণ করেছিল। অন্ধকার রাতে গাছের ওপর দিয়ে আসা যে কত বিপজ্জনক তা একমাত্র পাইলটরাই বুঝবে। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে তারা আক্রমণ করেছিল।
প্রশ্ন: বিমান তো দিয়েছিল ভারত?
এ কে খন্দকার: হ্যাঁ। নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে একটি পরিত্যক্ত এয়ারফিল্ড ছিল। ওই এয়ারফিল্ডে গিয়ে আমরা প্রশিক্ষণ আরম্ভ করলাম। আমি গিয়ে ওদের সঙ্গে ফ্লাইও করতাম। তারা কেমন করছে, টার্গেটে ঠিকমতো অ্যাটাক হচ্ছে কি-না, তাদের কোনো অসুবিধা আছে কি-না এসব পর্যবেক্ষণ করতাম। সে সময় ছিল খুব বৃষ্টি। আমরা সবাই ডিমাপুরে একত্র হই ২৮ সেপ্টেম্বর। সেদিন থেকেই বাংলাদেশ এয়ারফোর্র্সের জন্ম। সেখানে আমাদের আধুনিক কোনো যন্ত্রপাতি ছিল না। আমরা শুধু ম্যাপ এবং টাইমিংয়ের ওপর নির্ভর করে ফ্লাই করতাম। আমাদের তো তখন টার্গেট নির্ধারণ করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে আমরা কীভাবে টার্গেট নির্ধারণ করব? তখন পাহাড়ের ওপর উঠে আমরা একটা সাদা প্যারাসুট ফেলে দিলাম। যাতে ওই সাদা চিহ্ন দেখে আমরা আক্রমণ করতে পারি। আমরা যখন আক্রমণ করতাম তখন সাদা প্যারাসুটটাকে মনে হতো ছোট্ট একটা বিন্দু। ওই বিন্দু দেখে আমরা আক্রমণ করতাম। ওখানে চারদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়। গাছপালা চারদিকে প্রচুর। কেউ যদি প্লেন থেকে পড়ে যেত তাকে আর উদ্ধার করা যেত না। আগেই বলেছি, সে সময় প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। গাছের ওপরে ছিল মেঘ। মেঘ এবং গাছের মাঝখানে ফ্লাই করে পাইলটদের ট্রেনিং নিতে হয়েছে। তাদের মধ্যে গভীর দেশপ্রেম না থাকলে এটা করা সম্ভব হতো না। পাইলটদের মধ্যে ছিলেন এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ, স্কোয়াড্রন লিডার বদরুল, পিআইএর ক্যাপ্টেন আকরাম, ক্যাপ্টেন সাহাব প্রমুখ। এরা ৩ ডিসেম্বরের আক্রমণে ফ্লাই করেছিলেন।
সমকাল
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন