বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে যে তিনটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল তা দেশের ১৯৭৫-পরবর্তী সময়কে ভিন্নতর করতে ভূমিকা রেখেছে। এই অভ্যুত্থানসমূহ নিয়ে লেখালেখি এবং আলোচনা হয়েছে, কিন্তু অভ্যুত্থানগুলির বিভিন্ন দিক নিয়ে এখনও অনেক অস্পষ্টতা বিদ্যমান। সেই সময়ের ঘটনাধারা এবং বিভিন্ন ব্যক্তির ভূমিকা নিয়ে যে প্রশ্নসমূহ স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে কখনও তার উত্তর আলোচিত হয়নি, আবার কখনও তা পাওয়া গিয়েছে বিভিন্নভাবে।ফলে সেই ঘটনাগুলি নিয়ে টিকে থাকছে নানা বিতর্ক, অস্পষ্টতাও দূর হচ্ছে না। প্রয়োজন সেই সময়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে নৈর্ব্যক্তিক ও বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ। এই লেখায় সেই সামরিক অভ্যুত্থানগুলির বিভিন্ন দিক তুলে ধরার পাশাপাশি কিছু জরুরি প্রশ্ন বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে, সেই সময়ের ঘটনাধারা সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার জন্য।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকুরীরত ও সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত কিছু অফিসারের নেতৃত্বে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয় দেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের অনেক সদস্যকে। এই হত্যাকাণ্ডের পর দেশের রাজনৈতিক পরিবেশে যেমন পরিবর্তন আসে, তেমনি ভেঙে যায় সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড। নতুন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেওয়া মেজর
এবং ক্যাপ্টেন পদবীর অপেক্ষাকৃত অধস্তন অফিসাররা ভোগ করতে থাকেন বিপুল ক্ষমতা। সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে নতুন প্রধান করা হয় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে।
বোঝা যায়, সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল জিয়ার উপস্থিতি মোশতাক এবং তাকে সমর্থন দেওয়া ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডে জড়িত মেজর-ক্যাপ্টেনদের জন্য স্বস্তিজনক ছিল।
পূর্বের সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেওয়া ফারুক-রশিদ-ডালিম-নূরসহ অন্যান্য জুনিয়র অফিসারদের এবং তাদের অনুগত ইউনিটসমূহের (ট্যাংক ইউনিট বেঙ্গল ল্যান্সারস এবং টু ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট) বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। একইভাবে জেনারেল জিয়াও সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।
এমন অবস্থায় সেনাবাহিনী থেকে এই জুনিয়র অফিসারদের মোকাবেলা করার উদ্যোগ প্রথমবারের মতো গ্রহণ করা হয় ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের আড়াই মাস পর, নভেম্বরের শুরুতে। ৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীর সিজিএস (চিফ অব জেনারেল স্টাফ) ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং ঢাকা সেনানিবাসের ৪৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে ঢাকাস্থ পদাতিক রেজিমেন্টগুলোর মাধ্যমে এবং বিমানবাহিনীর একটি অংশের সক্রিয় সমর্থনে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে অবস্থানরত ফারুক-রশিদ-ডালিম-নূর চক্রের বিরুদ্ধে সামরিক অবস্থান গ্রহণ করা হয়।
৩ নভেম্বর ভোরে খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলের পক্ষ নিয়ে ঢাকার আকাশে এবং বঙ্গভবনের ওপর উড়তে থাকে ট্যাংকবিধ্বংসী রকেট-সজ্জিত মিগ-২১ জঙ্গী বিমান ও এম আই ৮ হেলিকপ্টার। পদাতিক বাহিনী বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের মাধ্যমে শহরের বিভিন্ন স্থানে রোডব্লক স্থাপন করা হয় ট্যাংকের হামলা প্রতিহত করার জন্য।
এই অভ্যুত্থানের শুরুতেই সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দি করা হয়। বঙ্গভবনে অবস্থানরত জুনিয়র অফিসাররা পরাজয় মেনে নেয়, তাদের অনুগত ট্যাংক ও আর্টিলারির ইউনিট দুটি বিমানবাহিনী আর পদাতিক বাহিনীর অবস্থানের সামনে নিষ্ক্রিয় থাকে। কিন্তু মুজিব হত্যায় যুক্ত এই অফিসারদের গ্রেফতার করা হয় না। কর্নেল শাফায়াত জামিলের ভাষ্য অনুযায়ী, একটি সংঘাত এবং রক্তক্ষয় এড়ানোর জন্যই এই অফিসারদের গ্রেফতার না করে দেশত্যাগের সুযোগ দেওয়া হয় এবং ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডে যুক্ত থাকা এই অফিসাররা থাইল্যান্ড চলে যান (জামিল: ১৯৯৮, পৃ-১৩৬)।
কিন্তু তাদের দেশত্যাগের পূর্বেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়। এই রাজনৈতিক নেতারা সবাই ছিলেন মোশতাক-বিরোধী। আর এই সংবাদ খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলরা জানতে পারেন মেজররা দেশত্যাগ করার পর। শহরের বিভিন্ন স্থানে এই মেজরদের মোকাবেলা করার ব্যবস্থা নেওয়া হলেও দেখা যায়, কারাগারে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বন্দিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কার্যকর ব্যবস্থা খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলরা গ্রহণ করেননি। ফলে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর ৪ নভেম্বর ঘটে যায় আরেকটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড।
খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরিয়ে গৃহবন্দি করা হয়, প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ সায়েমকে দেওয়া হয় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব এবং সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পেয়ে নতুন সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন।
এই ঘটনাগুলো ঘটে চললেও এই অভ্যুত্থানের প্রধান ব্যক্তি খালেদ মোশাররফ দেশের মানুষের উদ্দেশ্যে রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমে কোনো বক্তব্য রাখেননি। ফলে দেশের মানুষ এবং বিভিন্ন সেনানিবাসের সাধারণ সৈনিকদের কাছে এই অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তৈরি হয় অস্পষ্ট ধারণা। শাফায়াত জামিল এবং অন্য অফিসারদের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও খালেদ মোশাররফ রেডিও-টেলিভিশনে ভাষণ দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। তাঁর মত ছিল, কেবল নতুন প্রেসিডেন্টই এই দায়িত্বটি পালন করতে পারেন (জামিল, পৃ-১৩৯)।
তাঁর এমন আচরণ স্পষ্ট করে যে, সেনা অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের অভিপ্রায় খালেদ মোশাররফের ছিল না। কিন্তু যখন একটি সেনা অভ্যুত্থানের নেতৃত্বই তিনি দিয়েছিলেন, তখন সেই অভ্যুত্থানের লক্ষ্য সম্পর্কে দেশের মানুষকে অবহিত করার দায়িত্বটিও তাঁরই ছিল।
দেশের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ না করে তাঁর নিশ্চুপ থাকার পুরো সুযোগটি গ্রহণ করে সেনাবাহিনী এবং সেনাবাহিনীর বাইরের খালেদ-বিরোধীরা। খালেদ মোশাররফ ভারত এবং আওয়ামী লীগের স্বার্থ রক্ষার জন্য অভ্যুত্থান করেছেন এমন বক্তব্য রটিয়ে দেওয়া হয় (সাখাওয়াত হোসেন: ২০০৭, পৃ-১০১, পারভেজ: ১৯৯৫, পৃ-১২১)। যদিও খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে সমর্থন যোগানোর কোনো ভারতীয় চেষ্টা কখনও দেখা যায়নি।
খালেদ-বিরোধীদের মধ্যে ছিলেন মোশতাক এবং ফারুক-রশিদ চক্রের সমর্থকরা, সেনাবাহিনীর মধ্যে জেনারেল জিয়ার অনুগত অফিসাররা, রাজনৈতিক দল জাসদের সশস্ত্র সংগঠন গণবাহিনী এবং এই গণবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেনাবাহিনীর ভেতরে কিছু নন-কমিশনড কর্মকর্তা ও সৈনিকদের তৈরি গোপন সংগঠন ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’র সদস্যরা।
জাসদের গণবাহিনীর প্রধান ছিলেন সেনাবাহিনী থেকে ১৯৭২ সালে পদত্যাগ করা মুক্তিযোদ্ধা অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের। একটি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল জাসদের। সেইজন্য শহরভিত্তিক গেরিলা যুদ্ধ সংগঠিত করার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে গড়ে তোলা হয় এই বাহিনী।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই জিয়ার সঙ্গে তাহেরের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। সমাজতন্ত্রের প্রতি জিয়ার কখনও কোনো আগ্রহ দেখা না গেলেও তাহেরের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠতা টিকিয়ে রেখেছেন। একইভাবে জিয়া ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখেছিলেন ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে পরবর্তীতে সর্বহারা পার্টিতে যোগ দেওয়া আরেক মুক্তিযোদ্ধা অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউদ্দিনের সঙ্গেও। আবার দেখা গিয়েছে ফারুক-রশিদের মতো মোশতাক সমর্থিত ডানপন্থী অফিসাররাও জিয়ার প্রতি তাদের আস্থা রেখেছেন।
বোঝা যায়, ডানপন্থী এবং বামপন্থী দুই চিন্তাধারার ব্যক্তিদের সাথেই জিয়া নিজের সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছিলেন।
খালেদ-শাফায়াতের অভ্যুত্থানের পর মোশতাক এবং ফারুক-রশিদ চক্রের ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে গৃহবন্দি জিয়া শরণাপন্ন হন বামপন্থী কর্নেল তাহেরের। বন্দি অবস্থাতেই জিয়া গোপনে তাহেরকে ফোন করে তাকে সাহায্য করার অনুরোধ করেন।
খালেদ-শাফায়াত এবং তাদের সঙ্গের অফিসাররা যখন জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে কেবল ঢাকা সেনানিবাস আর বঙ্গভবনে তাদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন, তাদের বিচ্ছিন্নতা এবং অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে তাদের উৎখাত করার জন্য কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সক্রিয় হয়ে ওঠে গণবাহিনী আর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা। খালেদ-শাফায়াত এবং তাদের অনুসারীরা যেমন জেলহত্যার উদ্যোগ সম্পর্কে আগে জানতে পারেননি, একইভাবে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে জিয়াকে মুক্ত করার জন্য ঢাকা সেনানিবাসে বিভিন্ন সেনাসদস্যদের সংগঠিত হওয়ার বিষয়েও তাঁরা যথেষ্ট সজাগ ছিলেন না (কবির: ১৯৯৭)।
৭ নভেম্বর শুরু হতেই মধ্যরাতে ঢাকা সেনানিবাসে ঘটে যায় আরেকটি অভ্যুত্থান। তাহেরের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা অস্ত্র হাতে শুরু করে সিপাহী-জনতার বিপ্লব। মুক্ত করা হয় জেনারেল জিয়াকে। খালেদ মোশাররফ তার দুই সঙ্গী কর্নেল হুদা আর লেফটেন্যান্ট কর্নেল হায়দারসহ নিহত হন। আহত অবস্থায় শাফায়াত জামিল পালাতে সক্ষম হলেও পরে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।
কর্নেল তাহেরের সক্রিয় সমর্থনে জিয়াকে মুক্ত করা হলেও দ্রুতই তাহেরের গণবাহিনী এবং তাদের অনুসারী সেনাসদস্যদের সঙ্গে সেনাবাহিনী কীভাবে পরিচালিত হবে তা নিয়ে জিয়ার মতভেদ তৈরি হয়। ফলে একে একে গ্রেফতার করা হয় কর্নেল তাহেরসহ জাসদ, গণবাহিনী এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বিভিন্ন সদস্যকে। সামরিক আদালতের রায়ে ১৯৭৬ সালে তাহেরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। জাসদের বিভিন্ন নেতাকে প্রদান করা হয় বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড।
এই তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ঘিরেই কিছু প্রশ্ন উঠে আসে। ৩ নভেম্বর বিমানবাহিনী এবং পদাতিক বাহিনীর মাধ্যমে ফারুক-রশিদদের ট্যাংক আর কামান মোকাবেলার উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হলেও ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর কেন সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ফারুক-রশিদ-ডালিম-নূরদের প্রতিরোধ করা থেকে বিরত থেকেছিলেন? ৩ নভেম্বর পদাতিক রেজিমেন্ট ও বিমানবাহিনীর একটি অংশের সমর্থনে খালেদ-শাফায়াত তাদের অভ্যুত্থান সফল করতে সক্ষম হলেও কেন এই ইউনিটসমূহ তিন দিন পর খালেদ মোশাররফ ও তাঁর সঙ্গের অফিসারদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হল?
একইভাবে প্রশ্ন উঠে আসে, যদি ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের অনুসারী বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে সিপাহী বিপ্লব হয়ে থাকে এবং এই বিপ্লবে বহু সৈনিকের সমর্থন থাকে তাহলে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে জেনারেল জিয়া কাদের সমর্থনে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার দাবিসমূহ অগ্রাহ্য করলেন এবং পরবর্তীতে তাদের নেতা কর্নেল তাহেরকেও বন্দি করে বিচারের সম্মুখীন করলেন?
১৯৭৫-এর আগস্টে ঢাকা সেনানিবাসে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ, উপ-সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান, সিজিএস খালেদ মোশাররফ এবং ৪৬ ব্রিগেড অধিনায়ক শাফায়াত জামিল প্রমুখ সবচেয়ে ক্ষমতাশালী অফিসাররা সবাই ছিলেন সাহসিকতা খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। অথচ তারা সেনাবাহিনীর শীর্ষ পদসমূহে থাকা অবস্থাতেই ঘটে যায় ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডসমূহ এবং এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত অফিসারদের দমন করার জন্য সেনাবাহিনী থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয় না।
উল্লেখ্য, ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সেনা অফিসারও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা (যেমন শরিফুল হক ডালিম, নূর চৌধুরী, আবদুর রশিদ, বজলুল হুদা, শাহরিয়ার রশিদ খান, আজিজ পাশা, রাশেদ চৌধুরী প্রমুখ)। এমন একটি সম্ভাবনার কথা চিন্তা করা যায় যে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই অফিসারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে এই অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন অফিসাররা বিভ্রান্ত ও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব ও তার আত্মীয়দের বাড়িতে হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর ফারুক রহমান ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় সরকার উৎখাতের ব্যাপারে তার এবং সেনাবাহিনীর অন্যান্য কিছু জুনিয়র অফিসারের চিন্তার কথা সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ-প্রধান জেনারেল জিয়ার কাছে প্রকাশ করেন। লক্ষ্যণীয়, ফারুক সেই সময়ের অন্য কোনো উর্ধ্বতন সেনা অফিসারের সঙ্গে এই আলোচনা না করে কেবল জিয়াকে তাদের পরিকল্পনার কথা জানান। সরকার পরিবর্তনের এই পরিকল্পনায় ফারুক জিয়ার সমর্থন এবং নেতৃত্ব চান।
সাংবাদিক অ্যান্টনি ম্যাসকারেনহাসের কাছে পরবর্তীতে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে ফারুক জানান, জিয়া সরাসরি এই পরিকল্পনায় যুক্ত হতে অস্বীকার করেন, কিন্তু তিনি ফারুককে বলেন জুনিয়র অফিসাররা এমন কিছু করতে চাইলে তারা অগ্রসর হতে পারে। ১৯৭৬ সালে লন্ডনে মুজিব হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান করার সময় ম্যাসকারেনহাস জিয়াকে ফারুকের এমন বক্তব্যের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে জিয়া কোনো উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। ফারুকের সঙ্গে তার এমন কথোপকথনের বিষয়টি কিন্তু জিয়া তখন অস্বীকার করেননি (ম্যাসকারেনহাস: ১৯৮৬, পৃ-৫৪)।
এক বিয়ের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফা আর মেজর ডালিমের মাঝে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনার জের ধরে পরবর্তীতে ডালিম আর নূরকে সেনাবাহিনী থেকে অবসর প্রদান করা হয়। ধারণা করা হয়, এই দু’জন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে অবসর দেওয়ায় সেনাবাহিনীতে তাদের ঘনিষ্ঠ অফিসাররা ক্ষুব্ধ হন। রক্ষীবাহিনীর কারণেও সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সরকারের প্রতি এক ধরনের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতীয় প্রশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা প্রশিক্ষিত হতেন, এছাড়া কাউকে গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের বিশেষ ক্ষমতা থাকা প্রভৃতি ব্যাপারে সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যেে এই ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনীর চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে (আলম: ২০১৩, পৃ-৭৯; চৌধুরী: ২০০০, পৃ-৩৮)।
সেই সময় সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা আর পাকিস্তান-প্রত্যাগত অমুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের চাকরিতে দুই বছরের জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হয়; ফলে সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা পাকিস্তান-প্রত্যাগত অফিসারদের চেয়ে অনেকটাই সিনিয়র হয়ে যান। এই কারণে অমুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসাররা ক্ষুব্ধ ছিলেন। কিন্তু রক্ষীবাহিনীর প্রতি মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা সব সেনাসদস্যই ছিলেন সমান বিরূপ (সাখাওয়াত হোসেন: ২০০৭, পৃ-১৭)।
মুক্তিযুদ্ধের পর বিভিন্ন প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারের (যেমন মেজর জলিল, কর্নেল জিয়াউদ্দিন, কর্নেল তাহের) সঙ্গে সরকারের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। এই তিন অফিসারই সেনাবাহিনী ত্যাগ করে সরকারবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ধারণা করা যায়, ক্ষমতাসীন দল এবং ভারতের প্রতি ক্ষোভের কারণে সেই সময় অনেক সেনাসদস্যের মধ্যে আওয়ামী লীগ এবং ভারতের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন অফিসারদের প্রতি সমর্থন যোগানোর প্রবণতা তৈরি হয়।
এই বিভিন্ন পরিস্থিতিসমূহের প্রেক্ষিতেই ব্যাখ্যা করা যায় ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডসমূহ ঘটে যাওয়ার পর সেনাবাহিনী থেকে কোনো সক্রিয় প্রতিরোধ উঠে না আসার বিষয়টিকে।
পরবর্তীতে খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকেও এই অভ্যুত্থানের বিরোধীরা আওয়ামী লীগ ও ভারতের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা চালায়। নিজেদের অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর খালেদ ও তার অনুসারী অফিসাররা সেনানিবাসের বিভিন্ন ইউনিটের সাধারণ সৈনিকদের সঙ্গে যথেষ্ট যোগাযোগ করেননি।
সৈনিকদের সঙ্গে তাদের এই বিচ্ছিন্নতার কারণে যখন ৭ নভেম্বর মধ্যরাতে কর্নেল তাহেরের অনুসারী বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা অফিসার ও জোয়ানদের ভেদাভেদ দূর করে, উপনিবেশী আমলের কাঠামো পাল্টে সেনাবাহিনীকে গরিব শ্রেণির স্বার্থরক্ষার গণবাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবি ও লক্ষ্য নিয়ে তাদের বিপ্লবের সূচনা করেন, তখন বিভিন্ন রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিকরা (যেমন পদাতিক বাহিনী বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা) যারা এই ক’দিন খালেদ-শাফায়াতের নির্দেশ কার্যকর করেছেন, তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। তারা একদিকে যেমন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হননি, অন্যদিকে খালেদ-শাফায়াতের পক্ষে থেকে বিপ্লবী সিপাহীদের প্রতিরোধের চেষ্টাও করেননি।
খালেদের পক্ষের অফিসাররা প্রায় সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু ৭ নভেম্বর তারা তাদের অধীনে থাকা পদাতিক বাহিনীসমূহ নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি। এর আরেকটি অন্যতম কারণ সেই সময় সেনাবাহিনীতে জেনারেল জিয়ার একটি জনপ্রিয়তা ছিল। অন্যান্য আরও কিছু প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা অফিসার যেমন ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী, কর্নেল মইনুল হোসেন চৌধুরী, কর্নেল আমিনুল হক, কর্নেল মোহসীন, মেজর মাহবুব প্রমুখের সমর্থন ছিল জিয়ার প্রতি।
ধারণা করা যায়, অফিসার আর সৈনিকদের মাঝে যথেষ্ট যোগাযোগ না ঘটার কারণে অনেক সাধারণ সৈনিক খালেদ-শাফায়াতের অভ্যুত্থানকে কেবল অফিসারদের স্বার্থে পরিচালিত অভ্যুত্থান হিসেবেই দেখেছিল। পাশাপাশি এই অভ্যুত্থান ভারত ও আওয়ামী লীগের সুবিধার জন্য করা হয়েছে এমন গুজবও সেই সময় হয়তো প্রভাবিত করেছিল অনেক সাধারণ সৈনিককে।
সেনাবাহিনীতে ভারত ও আওয়ামী লীগ বিরোধী যে পরিমণ্ডল তখন বিরাজ করছিল, আর সেই পরিস্থিতিতে জিয়ার যে জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছিল তা ব্যবহার করে নিজেদের বিপ্লব সফল করার চেষ্টা ছিল জাসদ এবং গণবাহিনীর নেতাদের। এজন্যই জিয়াকে মুক্ত করে তার মাধ্যমে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার দাবিসমূহ আদায়ের পরিকল্পনা করা হয়।
গণবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার অনুসারী সদস্যদের সংখ্যা সেনাবাহিনীতে বেশি ছিল না। পদাতিক রেজিমেন্টগুলোতে এই গোপন সংস্থার সদস্য ছিল না বললেই চলে (চৌধুরী: পৃ-৯৬)। গণবাহিনী ৭ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা সেনানিবাসে অভ্যুত্থান শুরু করার দায়িত্ব দিয়েছিল সেনাবাহিনীর নায়েব সুবেদার মাহবুবের ওপর।
মাহবুবের ভাষ্য অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের পর আওয়ামী লীগের শাসনামলে সরকারের সেনাবাহিনী বিরোধী অবস্থান, রক্ষীবাহিনী প্রতিষ্ঠা, সাধারণ মানুষের ওপর সরকারি নির্যাতন এবং সেনাবাহিনীর জেনারেলদের ক্ষমতালিপ্সা দেখে বীতশ্রদ্ধ ও ক্ষুব্ধ হয়ে দেশের সাধারণ মানুষের সম্মান এবং সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য সেনা ও বিমানবাহিনীর কিছু জুনিয়র-কমিশনড অফিসার, নন-কমিশন্ড অফিসার এবং সৈনিকদের সমন্বয়ে ১৯৭৩ সালে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠন করা হয়। নায়েব সুবেদার মাহবুব হন এর সভাপতি।
পরে এই সংস্থার সদস্যরা জাসদ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং জাসদ তাদের গণবাহিনীর প্রধান কর্নেল তাহেরের সঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দেয় (মাহবুবর রহমান: পৃ-১১০-১১৫)। নায়েব সুবেদার মাহবুবের এই ভাষ্য থেকে বোঝা যায়, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন।
৭ নভেম্বর খালেদ-শাফায়াতের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান পরিচালনায় গণবাহিনী কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত সৈনিকদের মধ্যে মুজিব হত্যাকাণ্ডে জড়িত মেজর ফারুক, মেজর রশিদের অধীনস্ত বিভিন্ন মোশতাকপন্থী সৈনিকও অন্তর্ভূক্ত ছিল। এই সৈনিকরা ডানপন্থী মোশতাক ও ফারুক-রশিদের অনুসারী জেনেও জাসদের বামপন্থী বিপ্লবে এদের যুক্ত করা হয় (আনোয়ার হোসেন: ২০১২, পৃ-১০০; পারভেজ: ১৯৯৫, পৃ-১৩৩)।
পরবর্তীতে তাদের বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর গণবাহিনীর নেতারা এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা অনুধাবন করেন যে, মোশতাকপন্থী এই সৈনিকরা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে জিয়াকে মুক্ত করার কাজে অংশ নিয়েছিল এবং কর্নেল তাহেরের চিন্তা অনুযায়ী নতুন কাঠামোর গণমুখী সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠার কোনো আদর্শ এই সৈনিকদের মাঝে ছিল না।
কর্নেল তাহেরের ভাই মুক্তিযোদ্ধা ওয়ারেছাত হোসেন বেলালের মতে, এই রকম একজন সেনাসদস্য ছিল ট্যাংক ইউনিট বেঙ্গল ল্যান্সারসের সুবেদার সারোয়ার যার নেতৃত্বে খালেদের পতনের পর কিলিং স্কোয়াড গঠন করে সামরিক নেতাদের হত্যা করা হয় আর তার দায় চাপানো হয় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের ওপর (পারভেজ: ১৯৯৫, পৃ-১৩৩)।
কিন্তু লক্ষণীয় যে, মেজর ফারুকের ট্যাংক ইউনিটের সদস্যরা মুজিব হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিল জানার পরও কিন্তু ৭ নভেম্বরের বিপ্লব পরিকল্পনায় গণবাহিনী এই ধরনের সদস্যদের ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকেনি। সেই সময় ঢাকা শহরের গণবাহিনীর নেতা কর্নেল তাহেরের ভাই মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন মোশতাক ও ফারুক-রশিদের অনুগত এই সেনাসদস্যদের সম্পর্কে লিখেছেন–
‘‘তিনি (কর্নেল তাহের) জানতেন এরা সৈনিক সংস্থার সদস্য নয় বরং মোশতাকের নেতৃত্বাধীন ডানপন্থী চক্রের প্রতিই তাদের আনুগত্য। কিন্তু একটি সাধারণ গণঅভ্যুত্থানে শামিল হওয়া থেকে তাদের নিবৃত্ত করার বাস্তবতা এবং যুক্তি কোনোটাই তখন খুব একটা ছিল না।” (আনোয়ার হোসেন: ২০১২, পৃ-১০০)।
তাদের এমন যুক্তি যে সম্পূর্ণ ভুল ছিল তা জাসদ নেতারা কেবল বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর বুঝতে পারেন।
মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের ভাষ্য অনুযায়ী আরও জানা যায় যে, ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনায় ছিল অভ্যুত্থান শুরুর পর বাধা প্রদানকারী অফিসারদের গ্রেফতার করে টু ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টে রাখা হবে আর জিয়াকে মুক্ত করে নিয়ে যাওয়া হবে সেনানিবাসের বাইরে, কর্নেল তাহেরের কাছে (আনোয়ার হোসেন: ২০১২, পৃ-৯৪)।
লক্ষ্যণীয়, ফারুকের ট্যাংক ইউনিট আর মেজর রশিদের নেতৃত্বাধীন টু ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের সাহায্যেই ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডসমূহ ঘটানো হয়। ১৫ আগস্টের পর বেঙ্গল ল্যান্সারস আর টু ফিল্ড আর্টিলারি এই দুটি ইউনিট মুজিব হত্যাকাণ্ডে যুক্ত অফিসারদের অনুগত থাকে এবং ট্যাংক ও কামানসহ মোশতাক ও তার ঘনিষ্ঠ অফিসারদের নিরাপত্তা দিতে বঙ্গভবনের পাশে দায়িত্ব পালন করে। কেবলমাত্র খালেদ-শাফায়াতের অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পরই এই ইউনিট দুটি ট্যাংক ও কামানসহ সেনানিবাসে ফেরত আসে।
গণবাহিনীর ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান পরিকল্পনায় টু ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটকে অন্তর্ভূক্ত রাখার বিষয়টি এই অভ্যুত্থানে মোশতাক এবং ফারুক-রশিদপন্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নির্দেশ করে।
জেনারেল জিয়াকে বন্দিদশা থেকে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নাকি টু ফিল্ড আর্টিলারির সদস্য কারা মুক্ত করেছিল তা নিয়ে মতভেদ দেখা যায়। ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার পক্ষে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া হাবিলদার আবদুল হাই মজুমদার লিখেছেন, নায়েব সুবেদার মাহবুবের নেতৃত্বে জিয়াকে মুক্ত করা হয় এবং যখন তাকে কর্নেল তাহেরের নির্দেশমতো সেনানিবাসের বাইরে নিয়ে আসা হচ্ছিল তখন টু ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের অফিসার মেজর মহিউদ্দিন (যিনি যুক্ত ছিলেন ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডে) রাস্তায় জিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। আর তারপরই জিয়া টু ফিল্ড আর্টিলারির অফিসে চলে যান (মজুমদার: ১৯৯৭)।
অথচ নায়েব সুবেদার মাহবুব তার বইয়ে ৭ নভেম্বর সেনানিবাসের অস্ত্রাগার ভেঙে অভ্যুত্থান ঘটানোর বিশদ বর্ণনা দিলেও তার নেতৃত্বে জিয়াকে মুক্ত করা হয়েছিল এবং তারপর তিনি জিয়াকে সেনানিবাসের বাইরে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন সেকথা লেখেননি। তিনি কেবল লিখেছেন, জিয়াকে পরিকল্পনা অনুযায়ী টু ফিল্ড আর্টিলারিতে নিয়ে যাওয়া হয় (মাহবুবর রহমান, পৃ-১২৬)। কিন্তু মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন লিখেছেন, পরিকল্পনা ছিল জিয়াকে সেনানিবাসের বাইরে নিয়ে আসার।
দেখা যাচ্ছে, সৈনিকদের সাথে গণবাহিনীর সভায় যাকে অভ্যুত্থান শুরু করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সভাপতি সেই নায়েব সুবেদার মাহবুব (পরে যখন সামরিক আদালতে কর্নেল তাহেরের বিচার চলছিল তখন মাহবুব রাজসাক্ষী হন) আর গণবাহিনীর নেতা আনোয়ার হোসেন জিয়াকে নিয়ে মূল পরিকল্পনার ব্যাপারে ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। আবার লেফটেন্যান্ট কর্নেল হামিদের বর্ণনা অনুযায়ী টু ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের মেজর মহিউদ্দিন আর সুবেদার মেজর আনিস একদল সৈন্য নিয়ে জিয়াকে মুক্ত করে টু ফিল্ড আর্টিলারির অফিসে নিয়ে আসেন (হামিদ: ১৯৯৬, পৃ-১২৬)।
এই অফিসে যাওয়ার পর একে একে জিয়ার ঘনিষ্ঠ অফিসাররাও উপস্থিত হন। কিছুক্ষণ পর কর্নেল তাহের টু ফিল্ড আর্টিলারির অফিসে আসেন এবং জিয়াকে তাঁর সঙ্গে রেডিও স্টেশনে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলে জিয়া এবং তার সঙ্গের অফিসাররা তাহেরের সেই অনুরোধ অগ্রাহ্য করেন। বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা থেকে জানা যায়, সেই সময় জিয়ার পাশে থাকা ৪ বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রাক্তন কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আমিনুল হক, টু ফিল্ড আর্টিলারির সুবেদার মেজর আনিস কর্নেল তাহেরের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণও করেন (হামিদ: পৃ-১৩৮; চৌধুরী: ৯৩)। অসন্তষ্ট হয়ে তাহের সেখান থেকে চলে যান।
এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, সেনাবাহিনীতে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার প্রভাব ছিল অত্যন্ত সীমিত; কারণ যদি সেনাবাহিনীতে কর্নেল তাহেরের অনুসারী বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বিপুল সমর্থন থাকত তাহলে তাহেরের নির্দেশ জিয়ার পক্ষে অগ্রাহ্য করা সম্ভব হত না। তাহেরের সঙ্গে টু ফিল্ড আর্টিলারি দপ্তরে অসৌজন্যমূলক আচরণ করার সাহসও কারও পক্ষে দেখানো সম্ভব হত না।
৩ নভেম্বরের পর মোশতাকপন্থীদের দিয়ে নয়, বরং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের মাধ্যমে খালেদ-শাফায়াতের বিরুদ্ধে সাধারণ সৈনিকদের একটি অভ্যুত্থান পরিচালনা করা সম্ভব এটি অনুধাবন করেই হয়তো জিয়া তাহেরের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু তাহের সেনাবাহিনীতে যে পরিবর্তন চেয়েছিলেন, তার প্রতি জিয়া ও অধিকাংশ সেনা অফিসারেরই সমর্থন ছিল না।
বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার দাবীর প্রতি জিয়া সাড়া না দেওয়ায় সেনানিবাসের সাধারণ সৈনিকরাও জিয়ার বিরুদ্ধে সেই সময় তীব্র প্রতিবাদ প্রকাশ করেনি। ঢাকাস্থ পদাতিক রেজিমেন্টের সদস্যরা তাহেরের অনুসারী সৈনিকদের সঙ্গে যুক্ত হয়নি। পরে যশোর থেকে দুটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন ঢাকায় এনেও জিয়ার অবস্থান সংহত করা হয়। ধীরে ধীরে জিয়া ঢাকা সেনানিবাসে নিজের ক্ষমতা সংহত করেন।
এই দিকগুলো নির্দেশ করে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের বহু সাধারণ সৈনিকও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এবং গণবাহিনীর পরিকল্পনামতো সেনাবাহিনীর প্রচলিত কাঠামো ভেঙে ফেলার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। ট্যাংক ইউনিট ও টু ফিল্ড আর্টিলারির ফারুক-রশিদের অনুগত সৈনিকরা ৩ নভেম্বরের পর যখন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, তখন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার জিয়াকে মুক্ত করার প্রচেষ্টায় তারা নিজেদের স্বার্থেই যুক্ত হয়ে পড়ে।
কিন্তু মোশতাকপন্থী এই সৈনিকরা নিজেদের ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য খালেদ-বিরোধী অভ্যুত্থানে অংশ নেয়, কর্নেল তাহের বা জাসদের বামপন্থী বক্তব্যের বিষয়ে তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না। গণবাহিনীর নেতারা সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে জিয়ার যে জনপ্রিয়তা ছিল তা কাজে লাগিয়ে নিজেদের অভ্যুত্থান সফল করতে চেয়েছিলেন।
গণবাহিনীর পরিকল্পনায় যে অভ্যুত্থান হয় সেখানে সৈনিকরা তাহেরের পরিবর্তে জিয়ার নামে স্লোগান দেয়। সাধারণ সৈনিকদের কাছে ৭ নভেম্বর তাহের নন, জিয়াই হয়ে যান মূল নেতা। পরবর্তীতে কর্নেল তাহের এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের যখন গ্রেফতার করা হয়, তখনো সাধারণ সৈনিকদের মধ্য থেকে ব্যাপক প্রতিরোধ উঠে আসেনি।
খালেদ মোশাররফের পক্ষে অভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া মেজর নাসির উদ্দিনের ভাষ্য অনুযায়ী, তারা ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের আগে কর্নেল তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন তাহের মোশতাককে অপসারণের ব্যাপারে খালেদ-শাফায়াতের অভ্যুত্থানে জাসদের সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেন (নাসির উদ্দিন: ১৯৯৭, পৃ-১১৫)। পরবর্তীতে ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানে তাহেরের সম্পৃক্ততা দেখা যায় না।
জিয়ার সঙ্গে তাহেরের সখ্যতার কথা জেনে খালেদ-শাফায়াত তাহেরকে আস্থায় নেওয়া থেকে বিরত থেকেছিলেন, নাকি জিয়াকে বন্দি করাতেই তাহের খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে সমর্থন দেননি, এই সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। কিন্তু জিয়ার প্রতি ফারুক-রশিদ চক্রের আস্থার কথা তাহেরের অজানা থাকার কথা নয়। তাহের মোশতাককে সমর্থন করতেন না, কিন্তু সেনাবাহিনীর যেই দুটি ইউনিট ১৫ আগস্টের পর মোশতাক ও ফারুক-রশিদ-ডালিম-নূর চক্রকে সমর্থন যুগিয়েছিল, সেই ইউনিটের সদস্যদের গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিষয়টিতে তাহের এবং গণবাহিনীর নেতারা আপত্তি জানাননি।
বোঝা যায়, সেই সময় খালেদ মোশাররফ বিরোধী যে কোনো পক্ষকে ব্যবহার করেই গণবাহিনী খালেদ-শাফায়াতকে উৎখাত করে নিজেদের অভ্যুত্থান সফল করতে চেয়েছিল। তাদের আস্থা ছিল জিয়ার প্রতি; তারা হয়তো ভেবেছিলেন ফারুক-রশিদের অনুপস্থিতিতে জিয়ার মাধ্যমে ট্যাংক ইউনিট ও টু ফিল্ড আর্টিলারির সেনাদের নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানো সম্ভব হবে।
কিন্তু পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ স্পষ্ট করেছে যে, তাহের ও গণবাহিনী নেতাদের চিন্তা কতটা ভুল ছিল। খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিল তাদের অভ্যুত্থান চলাকালে কাউকে হত্যা করেননি। কিন্তু ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানের পর জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং তার সঙ্গের দুই মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে কারা হত্যা করল সেই ব্যাপারে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না।
জেনারেল খালেদের নির্দেশে ৩ নভেম্বরের পর রংপুর ব্রিগেড থেকে ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ঢাকায় আসে। রংপুর ব্রিগেডের অধিনায়ক কর্নেল নাজমুল হুদা এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল হায়দারকে সঙ্গে নিয়ে ৭ নভেম্বরের পর জেনারেল খালেদ শেরেবাংলা নগরে ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টের দপ্তরে যান। তাদের ধারণা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় খালেদের মাধ্যমে গড়ে ওঠা ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্ট তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
কিন্তু ৭ নভেম্বর সকালে একদল সৈন্য জেনারেল খালেদ আর তার সঙ্গের দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডে ১০ বেঙ্গলের দুজন অফিসার মেজর জলিল আর মেজর আসাদও অংশ নেয় (সাখাওয়াত হোসেন, পৃ-১১১)। জেনারেল জিয়া তখন মুক্ত, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা এবং মোশতাক ও ফারুক-রশিদ পন্থী সেনারা তখন সক্রিয়। কার নির্দেশে খালেদ, হুদা এবং হায়দারকে হত্যা করা হয়েছিল সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা।
ড. নাদির জুনাইদ: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র:
Anthony Mascarenhas, Bangladesh: A Legacy of Blood
(London: Hodder and Stoughton, 1986)
কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব:), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর
(ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৮)
ক্যাপ্টেন হুমায়ুন কবির (অব:), ‘‘৩ নভেম্বর: প্রথম প্রতিরোধ,”
ভোরের কাগজ, ৩ নভেম্বর ১৯৯৭
আনোয়ার উল আলম, রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা (ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন, ২০১৩)
মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব:), এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতার প্রথম দশক
(ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ২০০০)
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব:), বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১
(ঢাকা: পালক পাবলিশার্স, ২০০৭)
আলতাফ পারভেজ (সম্পাদিত), অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ, কর্ণেল তাহের ও জাসদ রাজনীতি
(ঢাকা: পাঠক সমাবেশ, ১৯৯৫)
নায়েব সুবেদার মাহবুবর রহমান, সৈনিকের হাতে কলম (সংলাপ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ফোরাম, জার্মানি কর্তৃক প্রকাশিত; ঢাকা থেকে মুদ্রিত)
ড. মো. আনোয়ার হোসেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানে কর্নেল তাহের
(ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০১২)।
হাবিলদার আবদুল হাই মজুমদার, ”৭ নভেম্বর: এক অভ্যুত্থানকারীর জবানবন্দি,” ভোরের কাগজ, ৬ নভেম্বর ১৯৯৭
লে: কর্নেল (অব:) এম. এ. হামিদ, তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা (ঢাকা: পাতা প্রকাশ, ১৯৯৬)
মেজর নাসির উদ্দিন, গণতন্ত্রের বিপন্নধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৭)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন