ইতিহাসের দায় : মুশফিকুল ফজল আনসারী


স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে অন্তত পক্ষে মত প্রকাশের সামান্যতম স্বাধীনতা ভোগ করাটাও এখন কষ্টসাধ্য। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার এসকল শব্দ এখন অভিধানেই শোভা পাচ্ছে।  অথচ এসবের জন্য কতই না সংগ্রাম আর আত্মত্যাগ। দেশের মা, মাটি আর মানুষের সে স্বাধীনতা সংগ্রামের আছে গৌরবময় ইতিহাস। কিন্তু স্বাধীনতার সুদীর্ঘ সময় পরও একটি পক্ষ চাইছে তরুণ প্রজন্মকে তাদের দাসত্বের সীমানা দেখিয়ে আটকে রাখতে। কিন্তু ইতিহাসের
পরিণতি অপ্রিয় সত্যের মতো বারবার স্পষ্ট হয়ে থাকে। ইতিহাস কেউ দখলের দুঃসাহস করতে পারে, তবে তাতে তার ইচ্ছের জায়গাটা দখল করে নিতে পারে না। 

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস খুব বেশী দূরের নয়। তবে দুঃখজনক হলেও নিকট অতীতের এ ইতিহাস নিয়ে জাতির যতটুকু উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দেখা পাবার কথা ছিলো তা হয়নি। সবচাইতে  পরিতাপের বিষয় যাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা আর শ্রম-ঘামে দেশ স্বাধীন হলো, তাদের অবজ্ঞা আর অস্বীকারের এক হীন প্রতিযোগিতায় কোমর বেঁধে নেমেছে একটি পক্ষ। আর তার সাম্প্রতিক প্রমাণ বাংলাদেশের কোটি মানুষের প্রিয় নেতা বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্প্রতি তথ্য, প্রমাণ, যুক্তি ও ইতিহাস নির্ভর বক্তব্যে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের বিরুপ, অশোভন, অশ্রাব্য প্রতিক্রিয়া। 

দেশের রাজনীতিতে প্রবলভাবে উচ্চারিত একটি নাম তারেক রহমান। স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মতো যিনি মিশে গেছেন দেশের তৃণমূলসহ প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। গত ২৫ মার্চ লন্ডনে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে যুক্তরাজ্য বিএনপি আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে তারেক রহমানের দেয়া বক্তব্য ছিলো ইতিহাসের প্রতিধ্বনি, পুনঃশব্দায়ন। 

তারেক রহমান বলেন, ‘শহীদ জিয়া ৭ কোটি মানুষের মনের কথা বুঝতে পেরে তখনকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতার পর স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি কারো পাঠানো নয়, বরং নিজের হাতে ড্রাফট করে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’

অনুষ্ঠানে তিনি তার বক্তব্যের স্বপক্ষে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের দেয়া বক্তব্য, তাদের প্রকাশিত বই ও সাক্ষাৎকার, দেশের বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য, পত্রিকার প্রতিবেদন, বিদেশী সাংবাদিকদের ইন্টারভিউ, ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের রেকর্ড, ভারত রক্ষক সাইটের রেকর্ড প্রদর্শন করেন। 

ইতিহাসের দায়কে গ্রাহ্য করে তারেক রহমান ইতিহাস নির্ভর তত্ত্ব-উপাত্ত্বের দ্বারস্ত হয়েছেন। আর এ  দায় দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের। সুচিন্তক তারেক রহমান তার সঠিক দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু তার এ বক্তব্যে অনেকটা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠার মতো আক্রোশে ফেটে পড়েছে শাসক দল আওয়ামী লীগ।

যুক্তির বিপক্ষে যেখানে যুক্তিই বাস্তবিক উদাহরণ। সেখানে আওয়ামী লীগের শীর্ষ ও মাঝারি নেতারা তারেক রহমানের বক্তব্যের বিরোধীতা করেছেন অত্যন্ত অযৌক্তিক, অসংযত ও অশোভন বক্তব্যের ভিতর দিয়ে। এ যেনো অনেকটা যুক্তিতে না পারিলে শক্তিতে দেখে নেবো, সে প্রবাদের বাস্তবায়ন। 

তারেক রহমানের বক্তব্যে তীর্যক সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে যারা মিথ্যাচার করছে তারাই প্রথম রাষ্ট্রপতি নিয়ে নতুন ফর্মুলা দিচ্ছে। ঘোষক ফর্মুলা পাল্টে এখন রাষ্ট্রপতি বানিয়ে ফেলেছে। কিছু অর্বাচীন উদ্দেশ্যমূলকভাবে কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার পর দলটির সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য তোফায়েল আহমদ তার সমালোচনায় অবিচার করলেন তার নিজের রাজনৈতিক জীবনের উপর। অত্যন্ত অসংযত ভাষায় সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আরে আহাম্মক, লেখাপড়া জানে না।  ... বেয়াদবির একটা সীমা আছে। স্যার স্যার করে মুখে লালা বের করে ফেলত। বঙ্গবন্ধু দেশে এসেছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে।’
 
দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘এসব অর্বাচীন ইতোমধ্যে ইতিহাস বিকৃতকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের কথা এবং কাজের মধ্যে কোনো  মিল নেই। রাজনীতির মাঠে পরাজিত হয়ে এখন তারা হতাশা থেকে এসব প্রলাপ করছে।’

আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক বলেন, এ ধরনের বক্তব্য ইগনোর (এড়ানো) করা ছাড়া কোন অভিব্যক্তি আমার নেই। এ ধরনের কথা যারা বলতে পারে তাদের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করা উচিৎ।

তারেক রহমানের বক্তব্যে সরকার দলীয়দের যুক্তি ও তথ্য প্রমাণছাড়া এ ধরনের গালাগাল নির্ভর সমালোচনা ভিন্ন মতের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অসংযতা রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বই প্রমাণ করে। ইতিহাস নিয়ে তারেক রহমানের দাবি যদি অসত্যই হয়ে থাকে তাহলে আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকদের উচিত ছিলো তার বক্তব্যে উপস্থাপন করা প্রমাণ ও যুক্তিসমূহের জবাবে তাদের অবস্থানের প্রমাণ তোলে ধরা। তারেক রহমান তার বক্তব্যের স্বপক্ষে যাদের বক্তব্য উদৃত করেছেন তাদের কেউ কেউ এখনও শাসক দলের মন্ত্রী অথবা ঘনিষ্ট বলে পরিচিত। তাদের কাউকেই এ বিষয়ে মুখ খুলতে দেখা গেলনা। তা না করে অন্যরা  যে ভাষায় কথা বলেছেন, সেটা তাদের আচরণের পুরনো ভাঙ্গা রেকর্ডের আওয়াজ ছাড়াতো আর কিছুই নয়। 

তারেক রহমান ইতিহাসের গভীরে প্রবেশ করে একটি গবেষণাধর্মী বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তিনি পৃথিবীর এমন এক দেশে তার বক্তব্য দিয়েছেন, যেখানে প্রতিটি মানুষের মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা বিরাজিত। গণতন্ত্রের তীর্থ বলে খ্যাত গ্রেট বৃটেনে। দেশের বাইরে থাকলেও তার অনূভবে, অস্তিত্বে আর দুচোখ জুড়ে কেবল বাংলাদেশ। 

যদি পরিবারের কথা বলা হয়, তবে বলতে হবে সাত কোটি বাংলাদেশিকে স্বাধীনতার ঘোষণায় উজ্জিবীত করে যিনি নিজেও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন যুদ্ধের সম্মুখ সমরে, সেই স্বাধীনতার ঘোষকের গর্বিত উত্তরাধিকার তারেক রহমান। প্রতিবেশী দেশে প্রবাস যাপন না করে বুলেট আর মৃত্যুকে সঙ্গী করে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সেনাপতি জিয়াউর রহমানের যোগ্য পুত্র ইতিহাসের সত্যের প্রতিধ্বনি করেছেন। যে মাটি মানুষের রাষ্ট্রনায়ক কেবল স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য লড়েননি, লড়েছেন একটি সম্ভাবনাময় আগামীর বাংলাদেশ গড়তে। জীবনের শেষ মুহূর্তে তার নিজের প্রিয় সম্পদ আপন প্রাণকেও দেশের জন্য বিলিয়ে গেছেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আর দেশের মুক্তির জন্য। সে নামটিকেই ইতিহাস থেকে জোর করে মুছে দিতে চাচ্ছে একটি পক্ষ। জাতিকে সে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করতে আর ইতিহাসের প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরতেই দেশের এক ক্রান্তিকালে সোচ্চার কন্ঠে  ইতিহাসের আশ্রয় নিয়েছেন তারেক রহমান। কেবল শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা নয় সন্তান হিসাবেও পিতার প্রতি কর্তব্য পালনে ও নির্জলা অসত্যের বিরুদ্ধে ইতিহাস নির্ভর জবাব দেয়াটা যোগ্য পুত্রের দায়িত্বও বটে।

তারেক রহমান বলেছেন, ‘ইতিহাসের আলোকে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বলা হয়েছে জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং স্বাধীনতার ঘোষক।’ 

তিনি বলেন, ‘৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা হলে ১৭ই এপ্রিল কেন মুজিবনগর সরকার গঠিত হলো,  কেন ৮ই মার্চ বাংলাদেশে স্বাধীন সরকার গঠন হলো না, চট্টগ্রামে ২শ’ মাইল দুরে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠাতে পারলে কেন তার বাড়ি থেকে ৬/৭ মাইল দূরে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে খবর পাঠাতে পারলেন না। এসব কোন প্রশ্নের উত্তর শেখ হাসিনাসহ তার দলের  নেতৃবৃন্দ না দিয়ে অগণতান্ত্রিক ভাষায় নানা কথা বলছেন। এটাই প্রমাণ করে আমরা যা বলেছি তা-ই ঠিক, জিয়াই বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও স্বাধীনতার ঘোষক।’

বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, “অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত তার লেখা ‘বাংলাদেশ : ইর্মাজেন্সী অব এ নেশন’ বইয়ের ১৪৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘মেজর জিয়াউর রহমান ওয়াজ দ্যা ফাস্ট এনাউন্স দ্যা ইন্ডিপেন্ডডেন্স অব বাংলাদেশ’ এবং একই বইয়ের ২২৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘দ্যা নেঙট ইভিনিং  মেজর জিয়া এনাউন্স দ্যা ফরমিটিকা অব এ প্রবিনশিয়াল গর্ভমেন্ট...’। শেখ মুজিব সরকারের তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল শফি উল্লাহ (অব.) তার লেখা ‘বাংলাদেশ এট ওয়ার’ বইয়ের ৪৪ নম্বর পৃষ্ঠায় জিয়াউর রহমানকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের ‘প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার কথা’ স্বীকার করেছেন।”

তারেক রহমান বলেন, গত ২৫ই মার্চ যুক্তরাজ্যে স্বাধীনতা দিবসের আলোচনায় তিনি জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে যে ঐতিহাসিক দলিল ও প্রমাণ দিয়ে কিছু প্রশ্ন উপস্থাপন করেছিলেন তার উত্তরে আওয়ামী লীগ কিছুই বলতে পারেনি।

গত ৯ এপ্রিল সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের বিরূপ সমালোচনার জবাবে লন্ডনের ওয়েস্ট মিনিস্টার হলের সমাবেশে ঘোষণাপত্রের একটি বক্তব্য তুলে ধরে তারেক রহমান বলেন, “সেখানে লেখা রয়েছে, ‘এতদ্বারা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকিবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি থাকিবেন’। কিন্তু ৭২ সালের ১০ জানুয়ারী স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে শেখ মুজিব ১২ জানুয়ারী কিভাবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন? তখনওতো সংবিধান প্রণীত হয়নি।”

ইতিহাস নিয়ে কূটতর্ক ও বিতর্কের সূচনা আওয়ামী লীগের হাতেই হয়েছে। তারেক রহমান নিজের মনগড়া কোন বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি। তিনি কেবল সেসময়কার কিছু কঠিন সত্য তুলে ধরেছেন। তিনি শেখ হাসিনার বক্তব্যের ভাষ্যমতো নতুন কোন ফর্মূলাও দাঁড় করাননি আবার তোফায়েল আহমদের মতো, না জেনে বা সত্যকে এড়িয়ে নিজের বক্তব্য সবার সামনে তোলে ধরেননি। বাস্তব সত্য হচ্ছে আওয়ামী লীগে এখন যারা নাক সিটকিয়ে কথা বলছেন, সেই দলে তাদের অবস্থানই অস্পষ্ট। এইতো ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠনের সময় মন্ত্রীত্ব পাননি দলটির নেতা তোফায়েল আহমদ। তার স্ব-বিরোধী অবস্থানের কারণেই নিজ সভানেত্রীর কাছে স্থান পাননি। আর নিজের মন্ত্রীত্ব ও গুরুত্ব হারানোর বেদনা তখন কেঁদে কেঁদে মিডিয়াকে জানান দিয়েছেন তোফায়েল। এরকম আরো অনেকেইতো রয়েছেন, যাদের কথা বললে কলেবর আরো বড় হয়ে যাবে। তারা যুক্তি, প্রমাণে পরাস্ত হয়ে কেবলি গলাবাজি করে বেড়াচ্ছেন।

ঘটে যাওয়া ঘটনাই নিজস্ব ক্ষমতাবলে জায়গা করে নেয় তার কাঙ্খিত স্থানে। আর তাই ইতিহাস। ইতিহাস চলে তার নিজস্ব নিয়মে। চাইলেই এর গতিপথ পরিবর্তন করা যায় না।  যা ঘটেছে তাই বলতে হবে, আর অপ্রিয় হলেও তাই মেনে নিতে হবে এটা ইতিহাসের দাবি। তারেক রহমানের তার দায় থেকে ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাই জাতির কাছে তুলে ধরেছেন। কেউ মানুক আর না মানুক ইতিহাস সবসময় স্পষ্ট অক্ষরে তার নিজের কথা বলে যাবে।


লেখক: সাংবাদিক 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন