ধরে নাও চিরদিনের জন্যই যাচ্ছি : শারমিন আহমদ

বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বিতর্কিত রাজনীতিক চিত্তরঞ্জন সুতার যুদ্ধের প্রারম্ভে কলকাতায় চলে যান। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর মাধ্যম হিসেবে পরিচিত চিত্তরঞ্জন সুতার ও শেখ মনি পরিচালিত যুবদলটি সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় একতার প্রতীক গণপ্রজাতন্ত্রী প্রথম বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ‘র’-এর সহায়তায় এবং বাংলাদেশ সরকারের অজান্তে গড়ে তোলা হয় ‘মুজিব বাহিনী’। মঈদুল হাসান এ সম্পর্কে লেখেন ‘বস্তুত এই বাহিনীর সদস্যভুক্তির জন্য সর্বাধিনায়ক হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার অনুপস্থিতিতে শেখ ফজলুল হক মনির প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করেই শপথনামা পাঠ করা হতো। শেখ মনির দাবি ছিল, একমাত্র তারাই সশস্ত্র বাহিনী গঠনের ব্যাপারে শেখ মুজিব কর্তৃক মনোনীত প্রতিনিধি’। ‘র’-এর চ্যানেল ব্যবহার করে গোপনে যুবদলটিকে সশস্ত্র বাহিনী গঠনের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা হতে বোঝা যায় যে, তিনি পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে সমঝোতার কোন বিকল্প রাস্তা খোলা রাখতে
চেয়েছিলেন। সরকার গঠন হলে তো আর সেই রাস্তা খোলা থাকে না। বিপরীতে আপসহীন ও পূর্ণ স্বাধীনতার প্রশ্নে সুদৃঢ় তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ সরকার গঠন করে স্বাধীনতাকামী জাতির প্রত্যাশা পূর্ণ করেছিলেন। তিনি পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত খোন্দকার মোশ্‌তাকের কনফেডারেশন গঠনের ষড়যন্ত্রও বানচাল করে দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, কোন রাষ্ট্র বা দলের নীতিনির্ধারণ বা কার্য পরিচালনায় অন্য রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপ অশুভ। তাজউদ্দীন আহমদ সে বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে রুখেও দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাযুদ্ধে শারীরিকভাবে উপস্থিত না থাকায় এবং গণতান্ত্রিক নীতি অনুসারে দলকে স্বাধীনতা ঘোষণা, সরকার গঠন, স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা ও তাঁর অবর্তমানে নেতৃত্ব সম্বন্ধে কোন নির্দেশ না দিয়ে যাওয়ায় যে মারাত্মক ফাঁক ও অস্পষ্ট পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তার অশুভ জের চলতে থাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভ ও তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরও। ১৯৭২-এর প্রারম্ভে, বিজিত বাংলাদেশের নতুন লগ্নে, ভবিষ্যতের অশনি সঙ্কেত খুব কম মানুষই সেদিন শুনতে পেয়েছিলেন।
মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জ্যেষ্ঠ কন্যা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শারমিন আহমদের লেখা ‘তাজউদ্দীন আহমদ, নেতা ও পিতা’ শীর্ষক গ্রন্থে এসব কথা বলা হয়েছে। প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্য প্রকাশিত গ্রন্থে শারমিন আহমদ আরও লিখেছেন, ১৯৭৩-এর একটি স্মরণীয় দিন ছিল ১৭ই এপ্রিল। বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আব্বু ও আম্মার সঙ্গে আমরা চার ভাইবোন হেলিকপ্টারযোগে ১৬ই এপ্রিল কুষ্টিয়ায় পৌঁছাই। সেদিন বিকালেই আব্বু কুষ্টিয়ার বাড়াদিতে মহিলা কল্যাণ সমিতির নিজস্ব গৃহের ভিত্তি স্থাপন করেন। মহিলা সমিতিটি তিল তিল করে গড়ে উঠেছিল নিবেদিত সমাজকর্মী এবং মুক্তিযোদ্ধা সেলিনা হামিদ ও তাঁর স্বামী হামিদ সাহেবের অক্লান্ত প্রচেষ্টায়। ১৭ই এপ্রিল আমরা জিপ ও মাইক্রোবাসে করে রওনা দিই ঐতিহাসিক মুজিবনগরের উদ্দেশে। মেহেরপুর থেকে প্রায় ১২ মাইল দূরে ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলায় অবস্থিত ছায়াস্নিগ্ধ ঘন সবুজ আম্রকানন। ওই স্থানটির নামকরণ আব্বু করেছিলেন ‘মুজিবনগর’-বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী। আব্বুর মুখে শোনা সেই মুজিবনগর আমার মানসপটে যেন এক রূপকথার রাজপুরী- যেখানে উদিত হয়েছিল স্বাধীনতার সূর্য। তার দেখা পাবো ভেবে আমার মন আনন্দে বিহ্বল। রিমি ও আমি কিচিরমিচির করে আমাদের আনন্দ প্রকাশ করছি। আমাদের সফরসঙ্গী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সংস্থাপন সচিব নুরুল কাদের খানের হাতে একটি মোটা ইংরেজি বই। সকলের উচ্ছ্বসিত কথাবার্তার মধ্যেও নিবিষ্টভাবে তিনি বই পড়ছেন। দেখে ভাল লাগলো। তাঁর স্ত্রী তারিন কাকির সঙ্গে আমাদের বেশ ভাব হয়ে গেল। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী জাহানারা আমীর (লীলা কাকি)-ও আমাদের সঙ্গে এসেছেন। তাঁরাও গল্প করছেন। স্মৃতিচারণা  করছেন ’৭১-এর। ঘন সবুজ আম্রকাননের অব্যক্ত সম্ভাষণ যেন সাদরে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে আজকের এই বিশেষ দিনটিতে এমনি কথা মনে উদিত হলো মুজিবনগরে পৌঁছে। শত মানুষের সরব উপস্থিতিতে মুখরিত আম্রকাননে মঞ্চ করা হয়েছে। আব্বু ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম (তখন তিনি শিল্পমন্ত্রী) মঞ্চের পাটাতনে পাশাপাশি বসেছেন। সভায় উপস্থিত প্রথম মন্ত্রিসভার প্রায় সকল সদস্য। যাঁর নামে মুজিবনগর সেই মুজিব কাকুই অনুপস্থিত এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সভায়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ঘটনাবলী জানতে চাওয়া সম্বন্ধে তিনি যেমন রহস্যজনকভাবে নীরবতা পালন করেছেন, তেমনই দুঃখজনকভাবে এড়িয়ে গিয়েছেন মুজিবনগরকে। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি কখনওই স্বাধীনতার ওই গৌরবদীপ্ত স্থানটিতে যাননি। যেন তাঁর মনের অভিধানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগরের কোন অস্তিত্বই নেই। ১৯৭৪ সালের ২০শে জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনে আব্বু আড়াই ঘণ্টা এক অসাধারণ বক্তব্য রাখেন। আওয়ামী লীগেরই কোন এক সদস্য বক্তব্যটি টেপ রেকর্ডারে ধারণ করেন। ধারণকৃত সেই টেপ থেকে কপি করার দায়িত্ব আব্বু দিলেন আমার দেড় বছরের ছোট বোন ১২ বছরের রিমিকে। রিমি তার নিজস্ব খালি ক্যাসেট ও আব্বুর দেয়া টেপ রেকর্ডার নিয়ে প্রথমে সার্কিট হাউস রোডের (কাকরাইলের পাশে) আওয়ামী লীগ অফিসে যায়। যিনি টেপ করেছিলেন সেই ভদ্রলোককে রিমি খুঁজে বের করে। তিনি রিমিকে জানান, কে যেন টেপটি নিয়ে গিয়েছে, তাঁর কাছে আর কোন কপি নেই। এরপর রিমি বাসায় ফেরার পর আব্বু কয়েক জায়গায় ফোন করে জানতে পারলেন যে, বাংলাদেশ বেতারও আব্বুর ভাষণটি টেপ করেছে। আব্বুর নির্দেশমতো রিমি এবার গেল বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্রে। তখন বেতার কেন্দ্র ছিল শাহবাগে। সেখানে প্রায় তিন ঘণ্টা বসে আব্বুর পুরো বক্তব্যটি সে টেপে ধারণ করে বাড়ি ফেরে। রিমি আব্বুর বক্তৃতাটা সম্পর্কে আমাদের সঙ্গে বেশ উৎসাহ ভরে আলোচনা করে। এরপর অনুলিখনের দায়িত্বে আব্বু এবার আমাকে জড়ালেন। আজিজ কাকু, তাঁর এক সহকর্মী ও আমি একত্রে শুরু করলাম অনুলিখনের কাজ। আব্বুর ভাষণ আমরা তন্ময় হয়ে শুনছি আর লিখছি। সেই পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার ভাষণ আজও কত অকাট্য সত্য। এক জায়গায় তিনি বলেছেন, ‘সকলেই বলে চোর, চোর, চোর; তবে চুরিটা করে কে? কে তারা? আমি তো এ পর্যন্ত শুনলাম না বিগত দু’বছরে যে, কোন কর্মী এসে খাস করে বলেছে যে, আমার চাচা ওই রিলিফের চাল চুরি করে। এমন তো কেউ বলেনি। ওই পল্টন ময়দানে বক্তৃতা করে দুর্নীতি ধরে ফেলতে হবে আর ধরা পড়লে বাড়িতে এসে বলে তাজউদ্দীন ভাই আমার খালু ধরা পড়েছে, ওরে ছেড়ে দেন। আমি বলি, তুমি না বক্তৃতা করে এলে? তখন সে উত্তর দেয় বক্তৃতা করেছি সংগঠনের জন্য, আমার খালুকে বাঁচান। এই হলো বাংলাদেশের অবস্থা। সামাজিক বয়কটই বা কোথায়? দুর্নীতি যারা করে তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক বয়কট করতে হবে।’ আমাদের কিশোরজীবন ছন্দোময় হয়ে উঠছে সুন্দর সুন্দর অভিজ্ঞতার স্পন্দনে। আর এরই মধ্যে আমরা লক্ষ্য করলাম যে, আব্বু যেন ক্রমেই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছেন। যে স্বপ্ন নিয়ে আব্বু মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন সেই স্বপ্ন যেন ভস্ম হতে শুরু হয়েছে। দলের ভেতরেই শুরু হয়েছে দুর্নীতি এবং সেগুলো প্রশ্রয় পাচ্ছে ব্যাপকভাবে। সরকার সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করলো দুর্নীতি উচ্ছেদের জন্য। আওয়ামী লীগের এক এমপি’র বাসা থেকে রিলিফের জিনিসপত্র সেনাবাহিনী উদ্ধার করলো। ওই এমপি এবং তার মতো দুর্নীতিবাজ অনেকেরই কোন বিচার হলো না। আব্বু ঘটনা জেনে হেয়ার রোডের বাড়ি থেকেই মুজিব কাকুকে ফোন করে বললেন, সেনাবাহিনী যখন দেশের সম্মানিত আইন প্রণয়নকারীর বাসা থেকে রিলিফ চুরির মাল উদ্ধার করে এবং সেই ব্যক্তি অনায়াসে পার পেয়ে যায় তখন সরকারের সম্মান কোথায় থাকে? এর ফলে সরকারের ওপর জনগণের আস্থা তো আর থাকে না! তারপর তিনি বললেন যে, সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহর নির্দেশে সেনাবাহিনী হাতে-নাতে ধরেছে এই দুর্নীতিপরায়ণদের। তারা যখন ছাড়া পেলো, তার অর্থ কি তারা নির্দোষ? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে সম্মানিত এমপিকে হেয় করার জন্য সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া উচিত, কারণ একই সঙ্গে দু’জন তো নির্দোষ হতে পারে না! নিশ্চয়ই একজন দোষী। বাস্তব যখন প্রমাণ করছে যে এমপি দোষী তখন তার এবং তার মতো সকলের দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে। নতুবা আইনের শাসন বলতে দেশে কিছু থাকবে না। মুজিব কাকু বললেন, তিনি ব্যাপারটা সুরাহা করবেন। কিন্তু পরে কিছুই হলো না। আব্বু দুঃখভরে মন্তব্য করলেন, ‘মুজিব ভাই শেষ পর্যন্ত আর্মিকেও ক্ষেপিয়ে দিলেন।’
১৯৭৫ সালে তাজউদ্দীন আহমদের গ্রেপ্তারের পটভূমিতে শারমিন আহমদ লিখেছেন, ২২শে আগস্ট শুক্রবার সকালে আমাদের বাড়ির সামনে পুলিশের দু’টি জিপ এসে থামলো। এক পুলিশ অফিসার এসে আব্বুকে বললেন, ‘স্যার আমাদের সঙ্গে আপনাকে যেতে হবে।’ আব্বুকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে তা তিনি প্রকাশ করলেন না। আব্বু গোসল করে নাশতা খেয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। জিজ্ঞেস করলেন জামা-কাপড় নিতে হবে কিনা। অফিসার বললেন, ‘নিলে ভালো হয়’। আব্বু একটা ছোট সুটকেসে কিছু জামা-কাপড় গুছিয়ে নিলেন। সঙ্গে নিলেন কোরআন শরিফ ও কালো মলাটের ওপর সোনালি বর্ডার দেয়া একটা ডায়েরি, যাতে তিনি লিখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালের কথা ও ভবিষ্যতে বাংলাদেশ কিভাবে চলবে তার নির্দেশনা। আব্বুর ঘরের সামনের বারান্দায় আমরা চার ভাইবোন দাঁড়িয়ে রয়েছি বিদায় দিতে। আব্বু আমাদের সবার মাথায় হাত বুলালেন। আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি মনে হয়, কবে তোমাকে ছাড়বে?’ আব্বু সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই এক হাত নেড়ে বললেন, ্তুঞধশব রঃ ভড়ৎবাবৎ, ধরে নাও চিরদিনের জন্যই যাচ্ছি।’ আমরা দৌড়ে লতাগুল্ম ও ফুলে ছাওয়া দোতলার জলছাদে এসে দাঁড়ালাম। গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় আব্বু গাড়ি বারান্দার ওপরের এই জলছাদে দাঁড়িয়ে বাইরে অপেক্ষমাণ তাঁর ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ীদের উদ্দেশে হাত নাড়তেন। আজ আমরা আব্বুকে বিদায় দিতে তাঁর উদ্দেশে হাত নাড়ছি। আব্বু জিপে উঠতেই রাস্তার উল্টো দিকের মুদি দোকানের সামনে দাঁড়ানো নীল বর্ণের জিনসের ট্রাউজার পরিহিত এক বিদেশী আব্বুর জিপের জানালার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি আব্বুকে কি যেন বললেন, আব্বুও তাঁকে কি যেন উত্তর দিলেন। পুলিশ এবার তাঁকে বাধা দিলো এবং আব্বুকে বহনকারী জিপটি শাঁ করে চোখের আড়াল হয়ে গেল। আমাদের মনে প্রশ্ন ছিল কে এই বিদেশী, তাঁর সঙ্গে আব্বুর কী কথা হয়েছিল? প্রায় এগারো বছর পর আলোড়ন সৃষ্টিকারী ইধহমষধফবংয: ঞযব টহভরহরংযবফ জবাড়ষঁঃরড়হ গ্রন্থের রচয়িতা মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফসুলৎজ সেই প্রশ্নের উত্তর দিলেন। ওয়াশিংটন ডিসি’র উপকণ্ঠে আমাদের ডেমোক্রেসি বুলেভারের বাসায় বেড়াতে এসে জানালেন যে, তিনিই ছিলেন সেই বিদেশী যার সঙ্গে আব্বুর কথা হয়েছিল। লিফসুলৎজ আব্বুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘আপনাকে কি মন্ত্রিসভায় যোগদানের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ?’ ‘আব্বু উত্তর দিয়েছিলেন ‘আমার তা মনে হয় না।’ আব্বু যেন ধরেই নিয়েছিলেন যে, ওই যাওয়াই তাঁর শেষ যাওয়া।
দীর্ঘ এক মাসের বেশি সময়ের পর আম্মা ও আমি বাসার বাইরে যাওয়ার অনুমতি পেলাম। ছোট কাকুসহ আমরা সবাই রওনা দিলাম ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের উদ্দেশে। স্বাধীনতার আগে কতবারই তো নাজিমউদ্দীন রোডে অবস্থিত এই সেন্ট্রাল জেলে আব্বুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। কিন্তু আজ এই স্বাধীন দেশে বিনা অপরাধে আব্বুর বন্দিত্ব মেনে নেয়া সম্ভবপর ছিল না। জেলের ফটক দিয়ে আমরা ঢুকলাম ডান দিকের বড় ওয়েটিংরুমে। আমাদের আসার খবর আব্বুকে দেয়ার জন্য কেউ ভেতরে গেল। আমরা ওয়েটিংরুমের জানালা দিয়ে জেলের ভেতরে তাকালাম। দূরে প্রাচীন গাছপালা ও সবুজ ঘাসের মাঝখানের পথটি দিয়ে আব্বু হেঁটে আসছেন। মুখে স্মিত হাসি। আমরা সবাই ওয়েটিংরুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আব্বুকে অভ্যর্থনা জানালাম। আব্বুর প্রথম কথাই ছিল আমরা কেন এতদিন আব্বুর সঙ্গে দেখা করতে আসিনি। যখন জানলেন আমরা এখনও গৃহবন্দি এবং জেলে সাক্ষাতের জন্য অনুমতিপত্র দেখাবার পরও নিচতলার ডিউটিরত আর্মি বাসার বাইরে আসার অনুমতি দিচ্ছিল না, তখন আব্বু বেশ রেগে গেলেন। আব্বু বললেন, তাঁকে তো বলা হয়েছিল তাঁকে জেলে নিয়ে আসার পরপরই আমাদের বাসা থেকে আর্মির সশস্ত্র পাহারা তুলে নেয়া হয়েছে। আব্বু জেলখানার অফিস থেকে কোথায় যেন ফোন করে অভিযোগ করলেন মিথ্যে কথা বলার জন্য। ফোনে কথা বলার পর আব্বু আমাদের সঙ্গে ওয়েটিং রুমে বসলেন। সেদিন ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর মেয়ে শিরিনও গিয়েছিল তার বাবাকে দেখতে। আমাদের কাছেই মনসুর আলী কাকু তাঁর একমাত্র মেয়ে শিরিনকে ধরে অনেক কাঁদছিলেন। আম্মা ওনাকে সালাম দিতেই তিনি বললেন, ‘ভাবী, আমাদের কি হবে?’ আম্মা সান্ত্বনা দিলেন, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, ভাই।’ আম্মা সান্ত্বনা দিলেও সেই পড়ন্ত বেলার ম্লান আলোয় মনে হলো সব আশার আলোই কেমন নিভু নিভু হয়ে আসছে। আব্বুর চোখের চাহনিও কেমন উদাসীন, অন্যমনস্ক। যেন তিনি কোন দূরের জগতে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। 
এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের দলীয় সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে সমর্থন আদায়ের জন্য  খোন্দকার মোশ্‌তাক ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভবনে এক বিশেষ সভার আয়োজন করে। তার আগেই আমাদের জেলে সাক্ষাৎকারের দিনটিতে আব্বু দৃঢ়ভাবে আমাদের জানিয়ে দিলেন আমরা যতজনকে সম্ভব জানাই তারা যেন ওই সভা বয়কট করে। শামসুল হক সাহেবের (আওয়ামী লীগের এমপি এবং স্থানীয় সরকার ও পাটমন্ত্রী) ছেলে মাসুদ ভাই সেদিন আমাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন, তিনি আব্বুর নির্দেশ পৌঁছাতে বিভিন্ন জায়গায় গেলেন। আবদুল আজিজ ও রিমি গোয়েন্দা পুলিশের নজর এড়িয়ে এমপি হোস্টেলসহ বিভিন্ন স্থানে দলীয় সদস্য ও সমর্থকদের কাছে আব্বুর নির্দেশ পৌঁছে দিলো। তারপরও বঙ্গভবনে সভা ঠিকই অনুষ্ঠিত হয়। ঘটনা জেনে আব্বু খুব ব্যথিত হলেন। পরবর্তী সাক্ষাতের দিন আব্বু আম্মাকে বললেন, ‘আমাদের আর বাঁচিয়ে রাখা হবে না।’ তারপর বললেন, ‘লিলি, আমি জীবনে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করিনি, ১৫ই আগস্টে বাসা থেকে বের না হওয়াই ছিল মারাত্মক ভুল।’ ওই সাক্ষাতের দিনটিতেই আব্বু মুজিব কাকুকে স্বপ্নে দেখার কথা জানালেন। আব্বু যেন জেলখানার ভেতরে বাগানে কাজ করছেন হাতে খুরপি। মুজিব কাকু যেন আব্বুকে বলছেন, ‘তাজউদ্দীন সেই ’৪৪ সাল থেকেই আমরা একসঙ্গে আছি, এখন আর তোমাকে ছাড়া ভাল লাগে না, তুমি চলে আসো আমার কাছে।’ আব্বু বললেন, ‘মুজিব ভাই আমার অনেক কাজ রয়েছে। আমাকে কেন ডাকছেন?’ মুজিব কাকু বললেন, ‘আমাদের আর কোন কাজ নেই। সব কাজ শেষ।’ নভেম্বরের ১ তারিখ, শনিবার। আম্মা একটা দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠলেন। স্বপ্নে দেখেন বাঁশের চারটি তাঁবু পাশাপাশি রাখা। আম্মা জিজ্ঞেস করলেন ‘কাদের এই তাঁবু?’ কে যেন উত্তর দিলো ‘এই তাঁবুগুলো তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান সাহেবদের জন্য।’ স্বপ্নের মধ্যেই আম্মার মনে হলো বাঁশের তাঁবু দেখা তো ভাল না। সেদিনই আইনজীবীদের সঙ্গে নিয়ে আম্মা একাই জেলে গেলেন আব্বুর সঙ্গে দেখা করতে। টিফিন কেরিয়ার ভরে আব্বুর পছন্দের খাবারও রেঁধে নিয়ে গেলেন। আব্বুকে আম্মা কেমন চিন্তামগ্ন দেখতে পেলেন। আব্বু বললেন, ‘লিলি, আজ রাতে ডায়েরির শেষ পাতা লেখা শেষ হবে। সেইসঙ্গে শেষ হবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা।’ খুব সংক্ষেপে প্রয়োজনীয় কথা সেরে আব্বু বললেন, ‘আর বোধহয় বাঁচবো না।’ জেলে আব্বুর সঙ্গে আম্মার সেই শেষ সাক্ষাৎ।
নভেম্বরের চার তারিখ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে খবর এলো আব্বুর বন্ধু ডাক্তার এম. এ করিম-আমাদের করিম কাকু, আম্মার জন্য অপেক্ষা করছেন লালু ফুফুর বাসার সামনে, তাঁর কাছে জরুরি খবর আছে। সংবাদ পাওয়া মাত্রই আমাকে সঙ্গে নিয়ে আম্মা রিকশায় চেপে বসলেন। রিকশা চলছে নিশ্চিন্ত গতিতে। স্বচ্ছ নীল আকাশ থেকে ঝরে-পড়া হৈমন্তী সকালের নরম রোদ আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। আশপাশ দিয়ে হেঁটে চলা স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীদের কলহাস্যে পরিবেশ মুখরিত হয়ে উঠছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দিনটি হয়তো উপভোগ করা যেতো, কিন্তু আজ যেন সবই এলোমেলো। আশপাশের ওই স্বাভাবিক জীবনচারিতাই লাগছে অস্বাভাবিক। যেন আমরা ভিন্ন গ্রহে সহসাই পদার্পণ করেছি। রিকশা থামলো লালু ফুফুর বাসার সামনে। আম্মা ও আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন করিম কাকু। ছোটবেলায় অসুখ-বিসুখ হলে আব্বুর এই রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী, নিঃস্বার্থ সেবক, চিকিৎসক বন্ধু করিম কাকু ছিলেন আমাদের ভরসাস্থল। তাঁর সদাহাস্য চেহারা ও মজার মজার আলাপ শুনে অসুখ অর্ধেক ভাল হয়ে যেত। কিন্তু তাঁর চোখেমুখে আজ স্বজনহারা সন্ধ্যার মতো একরাশ অন্ধকার জমে রয়েছে। তিনি হাউমাউ করে কেঁদে বললেন, ‘ভাবী, তাজউদ্দীন ও তাঁর সহকর্মীদের আর্মিরা মেরে ফেলেছে।’ খবরটি শুনে আম্মা হঠাৎ যেন পাথর হয়ে গেলেন। আম্মার হাত আঁকড়ে ধরে আমি বলে উঠলাম, ‘এ নিশ্চয়ই ভুল সংবাদ।’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন