৩.
বিশেষ অভিযান
যেসব নায়েক ও সুবেদারের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, ক্যাপ্টেন এমদাদ ১ জুন ১৯৮১ তাঁদের জড়ো করেছিলেন। তাঁদের বলা হয়, তাঁরা একটি ‘বিশেষ অভিযান’-এ অংশ নিতে যাচ্ছেন। সংবাদপত্রের তথ্য অনুসারে, ক্যাপ্টেন এমদাদ
চট্টগ্রামে এসব ঘটনাপ্রবাহের সময় একজন কর্তব্যরত সক্রিয় কর্মকর্তা ছিলেন। সিআইডির কাছে দেওয়া পাঁচজন সাধারণ সৈনিকের সাক্ষ্য ও হলফনামা থেকে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
আমরা এই সৈনিকদের নাম প্রকাশ করছি না, কারণ তাঁদের পরিচয় গোপন রাখার বিষয়টি আমরা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করি। জেনারেল এরশাদ ও তাঁর সহযোগীদের কাছে তাঁদের নাম সুপরিচিত, তা জানা সত্ত্বেও এ সাবধানতা আমরা অবলম্বন করছি। তাঁদের নাম রটিয়ে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব নয়। যাঁদের নাম আমরা প্রকাশ করেছি, তাঁদের তুলনায় এ সৈনিকদের সামাজিক অবস্থান দুর্বল হওয়ায় তাঁদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
এ সতর্কতার আরও একটি কারণ আছে। এসব সাক্ষ্য ও ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের জবানবন্দি থেকে দেখা যায় যে
ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের একটি ‘মিথ্যা আখ্যান’ ছিল। একটা ভিত্তিহীন গল্পের মাধ্যমে এই সৈনিকদের মঞ্জুর হত্যা-মামলায় জড়ানো হয়। এভাবে সরাসরি জড়িত ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের দিক থেকে সবার দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে আনা হয়। এসব সাক্ষ্য যথার্থ হলে এটা পরিষ্কার যে এই সুবেদার ও নায়েকদের সুপরিকল্পিতভাবে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে, যাতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরে তাঁদের ওপর মঞ্জুর হত্যার দায় চাপিয়ে দিতে পারেন।
সুবেদার-১ তাঁর সাক্ষ্যে বলেছেন, ‘ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) এমদাদ সাহেব আমাদের সর্ট আউট করেন এবং বলেন, বিশেষ একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের নির্দেশ ওপর থেকে এসেছে যে মেজর জেনারেল মঞ্জুর হাটহাজারী থানা পুলিশের হেফাজতে আছেন। সেখান থেকে তাঁকে আনতে হবে। আনার পথে রাস্তায় অথবা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে কোথাও সুবিধামতো জায়গায় তাঁকে শেষ করে ফেলতে হবে।’
হাবিলদার-১ সিআইডিকে বলেছেন, ‘ক্যাপ্টেন এমদাদ আমাদের বলেন, মেজর জেনারেল মঞ্জুর ও তাঁর সঙ্গীয় অন্যান্যরা হাটহাজারী থানায় পুলিশের নিকট আছেন। তাঁদের আনতে হবে এবং আনার পথে মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে সুবিধামতো জায়গায় মেরে ফেলতে হবে। এটা ওপরের নির্দেশ। আমাদের কিছু করার নাই।’
সুবেদার-২ তাঁর সাক্ষ্যে বলেছেন, ‘ক্যাপ্টেন এমদাদ (হামিদ কোম্পানির কোম্পানি কমান্ডার) আমাদের উদ্দেশে ব্রিফিং দেন। তিনি বলেন যে মেজর জেনারেল মঞ্জুর, তাঁর পরিবারবর্গ, অন্যরাসহ পুলিশের কাছে ধরা পড়েছেন, তাঁরা হাটহাজারী থানায় আছেন। সেখান থেকে তাঁদের নিয়ে আসতে হবে। ওপরের নির্দেশ, আনার পথে জেনারেল মঞ্জুরকে সুবিধামতো জায়গায় হত্যা করতে হবে।’
‘সুবিধামতো জায়গায়’ শব্দবন্ধটি প্রায় সব সাক্ষ্যেই পাওয়া যায়। নায়েক-১ বলেন, ‘ক্যাপ্টেন এমদাদের ব্রিফিং অনুসারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ অনুযায়ী, থানা থেকে সেনানিবাসে নিয়ে আসার সময় কোনো সুবিধামতো জায়গায় ও সময়ে মঞ্জুর সাহেবকে খুন করতে হবে।’
হাবিলদার-১-এর ভাষ্যমতে, যে জায়গাটা শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে সুবিধাজনক বলে মনে হলো, সেটি হচ্ছে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে, ফায়ারিং রেঞ্জের কাছাকাছি একটি স্থান: ‘সেখানে গাড়ি থেকে মঞ্জুর সাহেবকে নামিয়ে হাঁটিয়ে উত্তর দিকে আনুমানিক ৩০০ গজ দূরে এবং পরে সেখানে বাঁ দিকে কিছু দূরে পাহাড়ের কাছে আমরা নিয়ে যাই। সেখানে যাওয়ার পর এমদাদ সাহেব জেনারেলের সঙ্গে আস্তে আস্তে কথা বলেন। পরে তিনি আমাকে জেনারেলকে গুলি করতে পারব কি না, জিজ্ঞাসা করেন। আমি বলি, আমার দ্বারা সম্ভব হবে না। পরে নায়েক-২-কে জিজ্ঞাসা করেন। তিনিও রাজি হননি। পরে হাবিলদার মালেককে জিজ্ঞাসা করলে তিনি গুলি করতে রাজি হন। ক্যাপ্টেন এমদাদ সাহেবের নির্দেশে হাবিলদার মালেক জেনারেল মঞ্জুরের মাথায় চায়নিজ রাইফেল দিয়ে গুলি করেন। জেনারেল মঞ্জুর মাটিতে পড়ে যান।’
হাবিলদার-১ এরপর কী দেখেছেন তা-ও বর্ণনা করছেন, ‘আমরা যেখানে গাড়ি দাঁড়ানো ছিল সেখানে চলে আসি। তখন ওই গাড়ির
পাশে আরেকটি জিপ দাঁড়ানো দেখি। সেখান থেকে দুজন অফিসার এগিয়ে আসেন। তাঁদের একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামস (শামসুর রহমান) এবং অন্যজন মেজর কামাল (মোস্তফা কামালউদ্দিন ভূঁইয়া)। কাজ সেরেছে কি না, তাঁরা জিজ্ঞাসা করেন। তখন এমদাদ সাহেব কাজ হয়েছে বলে জানান। এরপর তাঁরা জেনারেল মঞ্জুরের লাশ দেখার জন্য...ক্যাপ্টেন এমদাদকে...নিয়ে যেতে চান।’
সুবেদার-১ যা দেখেছেন তার বর্ণনা এ রকম: ‘আমাদের গাড়ির কাছে এলে দেখি, গাড়ির কাছে আরেকটি জিপগাড়ি দাঁড়ানো। জিপগাড়ির কাছে দাঁড়ানো একজন জিজ্ঞাসা করেন, এমদাদ নাকি? তখন ক্যাপ্টেন এমদাদ তাঁর পরিচয় দেন। তখন জিজ্ঞাসা করেন, তোমাদের খবর কী? কাজ হয়েছে কি না? তখন দেখি তাঁদের একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসুর রহমান শামস এবং অন্যজন মেজর মোস্তফা কামালউদ্দিন ভূঁইয়া (বর্তমানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল)। তখন তাঁরা বলেন, চলো, দেখে আসি। তখন এমদাদ সাহেবসহ দুজন রওনা হন। আমরা বলি, স্যার, আপনি একা যাবেন না। আমরাও সঙ্গে যাব। তখন আমরা সবাই একসঙ্গে...মঞ্জুরকে যেখানে মারা হয়েছে সেখানে যাই। যাওয়ার পর লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামস জেনারেল মঞ্জুরের শরীর হাতিয়ে দেখেন এবং মরে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হন।’ সুবেদার-১ সময়টাও উল্লেখ করেছেন, ‘হাবিলদার মালেক তাঁর হাতে থাকা চায়নিজ রাইফেল দিয়ে জেনারেলের মাথায় গুলি করেন। তখন রাত আনুমানিক ১১ থেকে সাড়ে ১১টা হবে।’
হাবিলদার-১ বর্ণনা করেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামস মঞ্জুরের লাশ পরীক্ষা করার পর কীভাবে সৈনিকেরা সেটি সিএমএইচে নিয়ে যান। হাবিলদার-১ বলেন: এরপর ‘মর্গে লাশ পৌঁছিয়ে আমরা গাড়ি নিয়ে ইবিআরসিতে (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টার) চলে যাই। হাতিয়ার জমা দিয়ে ব্যারাকে চলে যাই।’ এভাবেই সে রাতের রক্তাক্ত ‘দায়িত্বের’ অবসান ঘটে।
জেনারেল এরশাদ বছরের পর বছর ধরে বলে আসছেন মঞ্জুর ‘ক্ষুব্ধ’ ও ‘উত্তেজিত’ সেনাদের হাতে মারা পড়েছেন। এ ব্যাপারে সুবেদার-২ যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক, বিশেষ করে এ অপরাধটিকে বিবেচনার মধ্যে নিলে। সুবেদার-২ বলেন, ‘ক্যান্টনমেন্ট ঢুকে ইবিআরসি পর্যন্ত আসার পথে রাস্তায় বা আশপাশে কোনো উচ্ছৃঙ্খল বা উত্তেজিত সৈনিক দেখিনি। পরদিন ২ জুন ১৯৮১ তারিখ সকালে রেডিওতে শুনতে পাই যে মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকেরা ছিনিয়ে নিয়ে মেরে ফেলেছেন।’
সুবেদার-২ ও তাঁর অন্য সহকর্মীরা যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তা সত্য হলে কাজটা খুব সন্তর্পণে ঘটেছে; আর কোনো উত্তেজনাও সেখানে ছিল না। তাঁরা ‘ক্ষুব্ধ’ বা ‘অনিয়ন্ত্রিত’ কোনোটাই ছিলেন না। তাঁদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে তাঁরা ‘ওপরের নির্দেশ’ অনুযায়ী কাজ করছিলেন। নায়েক-১-এর ভাষ্য অনুযায়ী, তাঁদের আর ‘কিছু করার’ ছিল না।
একজন সেনা কর্মকর্তা তাঁদের হেফাজতে থাকা অবস্থায় কোনো সৈনিক যে তাঁকে হত্যা করার অবৈধ নির্দেশ পালন করলেন, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। হেফাজতে থাকা অবস্থায় কোনো সেনা কর্মকর্তা, সৈনিক বা বেসামরিক লোককে হত্যা করা স্রেফ খুনের পর্যায়ে পড়ে। এটা অপরাধ। যদিও তা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়।
যে বিষয়টির দিকে নজর দেওয়া দরকার সেটি হচ্ছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁদের অধীনের সৈনিকদের সঙ্গে বেশ সতর্কভাবে যোগাযোগ করছিলেন। হাবিলদার-১ স্পষ্টভাবেই বলেছেন, ক্যাপ্টেন এমদাদ তাঁদের এই ‘বিশেষ অভিযান’-এর অন্তিম পর্যায়টুকু যখন তাঁকে ও নায়েক-২-কে সম্পন্ন করতে বলেন, তখন তাঁরা মঞ্জুরকে হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানান। হাবিলদার-১ বলেন, নায়েক মালেক নামে এক সৈনিক ক্যাপ্টেন এমদাদের নির্দেশ পালন করেন, অর্থাৎ কি না, মঞ্জুরকে গুলি করে হত্যা করেন।
সৈনিকেরা যে বিবরণ দিয়েছেন তা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা যেমন: লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামস, মেজর কামাল, ক্যাপ্টেন এমদাদ ফায়ারিং রেঞ্জের কাছাকাছি ছিলেন, কিন্তু এই ‘দায়িত্ব’টি সম্পন্ন করার দায় তাঁরা কেউই নিজের কাঁধে না নিয়ে নায়েক, সুবেদার বা হাবিলদারদের তা করতে বলেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামস, মেজর কামাল, ক্যাপ্টেন এমদাদ তাঁরা কেন নিজেরাই এগিয়ে এসে মঞ্জুরকে গুলি করে হত্যার ‘দায়িত্ব’টা না সেরে সাধারণ একজন সৈনিককে দিয়ে তা করালেন? পক্ষান্তরে, সাধারণ কোনো সৈনিকের হাতে মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হলো কি না, তাঁরা ছায়ার ছায়ায় থেকে সে তথ্য নিশ্চিত করলেন। এটা তাঁরা কেন করলেন? একজন সাধারণ সৈনিককে দিয়ে মঞ্জুরকে হত্যা করানোটা কেন এত জরুরি ছিল?
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, মঞ্জুর-হত্যার দায় একদল সাধারণ সৈনিকের ওপর চাপানোটা ‘পরিকল্পনার’ অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। যেমন: ধরা যাক, অপরাধস্থলে কোনো সেনা কর্মকর্তার আঙুলের ছাপ থাকা চলবে না। পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠলে একদল সাধারণ সৈনিকের কাঁধে দোষ চাপিয়ে একটি বিশ্বাসযোগ্য গল্প ফাঁদা যাবে।
পরিস্থিতি সে রকম হলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পক্ষে এ হত্যার দায় একদল ‘ক্ষুব্ধ’ ও ‘নিয়ন্ত্রণহীন’ সৈনিকদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকবে। ক্যাপ্টেন, মেজর, লেফটেন্যান্ট কর্নেলদের কথার চেয়ে কিছু নায়েক, সুবেদার ও হাবিলদারের কথা কি মানুষ বেশি বিশ্বাস করবে? আর প্রয়োজন হলে ‘দ্রুত’ কোর্ট মার্শালের আয়োজন করে তীব্র নির্যাতনের মাধ্যমে কয়েকজনের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করে নেওয়া যাবে, একদল মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া যাবে। সমীকরণটা কী অসম্ভব? ঘটনার এক মাস পর ১৩ জন তরুণ সেনা কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ঠিক এই কায়দাতেই ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এমনকি মিলিটারি কোড অব জাস্টিসে আসামির জন্য যেসব সুরক্ষার ব্যবস্থা আছে, সেগুলোও তাতে অবলীলায় লঙ্ঘন করা হয়।
বাস্তবে ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা’ ‘অনিয়ন্ত্রিত সেনাদের’ হাতে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার কাহিনি-সংবলিত তথ্যবিজ্ঞপ্তি ফাঁদছিলেন বলে মনে হয়। সেনাবাহিনীর তৎকালীন অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর ভাষ্য অনুযায়ী, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইকে এসব গালগল্প বাজারে ছড়ানোর কাজে নিয়োগ করা হয়।
পূর্ণাঙ্গ তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার আগেই যেন মঞ্জুরকে জিয়ার হত্যাকারী হিসেবে প্রচার করা না হয়, তা নিয়ে জেনারেল এরশাদ ও ডিজিএফআইয়ের প্রধান মেজর জেনারেল মহব্বত জান চৌধুরীর সঙ্গে মেজর জেনারেল মইন কীভাবে তর্ক করেছেন তার বিশদ বিবরণ এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য বইটিতে তিনি দিয়েছেন।
কোনো তদন্ত ছাড়াই এমন কোনো দাবিকে মইন বলেছেন অর্থহীন। মঞ্জুর মইনের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে জিয়ার বিরুদ্ধে পরিচালিত অভুত্থানে তাঁর সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছিলেন। ৩০ ও ৩১ মে চট্টগ্রাম থেকে ফোনে তিনি মইনের কাছে এসব কথা বলেন। কিন্তু ডিজিএফআই চট্টগ্রামের ঘটনা সম্পর্কে তাদের নিজস্ব বিবরণ প্রকাশ করতে বদ্ধপরিকর ছিল।
সাংগঠনিকতার দিক থেকে এই ‘বিশেষ অভিযান’টি ডিজিএফআই-ই সব পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছে বলে মনে হয়। সুবেদার-২-এর সাক্ষ্যে দেখা যায়, পরদিন ২ জুন সকালে তিনি শুনতে পান ‘উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকেরা’ মঞ্জুরকে হত্যা করেছে। এতে তিনি বিস্মিত হন। কারণ, তাঁর সাক্ষ্য অনুসারে, ‘ক্যান্টনমেন্ট ঢুকে ইবিআরসি পর্যন্ত আসার পথে রাস্তায় বা আশপাশে কোনো উচ্ছৃঙ্খল বা উত্তেজিত সৈনিক’ তিনি দেখেননি। এই খবরটি রেডিও পেল কোত্থেকে? ২ জুন ১৯৮১ তারিখে রেডিও, টেলিভিশন ও সব পত্রিকায় এ খবরটি প্রচারিত হয়।
‘ফল্স ফ্ল্যাগ’ অপারেশনের কথা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। আবার মঞ্জুরের খুনের চাক্ষুষ সাক্ষী হিসেবে দাবিদার সৈনিকদের সাক্ষ্য অনুযায়ী সে রাতে ফায়ারিং রেঞ্জে কোনো ‘উচ্ছৃঙ্খল সৈনিক’ ছিলেন না। সেখানে উপস্থিত ছিলেন কেবল আদেশ পালনকারী সৈনিকেরাই। তাঁরা হাটহাজারী থানা থেকে মঞ্জুরকে নিয়ে এসে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চোখের সামনে ‘সুবিধামতো জায়গায়’ তাঁকে হত্যা করেন। (সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দা তৎপরতায় কীভাবে ‘ফল্স ফ্ল্যাগ’ অভিযান ব্যবহূত হয়, তা বোঝার জন্য দেখুন, ‘মেজর জেনারেল মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড’, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)।
দাবার এই ছকে ঘোড়া (ব্রিগেডিয়ার ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল) ও হাতিরা (মেজর ও ক্যাপ্টেন) তাদের বড়েগুলো (সুবেদার ও নায়েক) অঙ্গুলিহেলনে চালনা করেছেন। বেশ। কিন্তু আরও বড় একটি দাবার ছকে আবার এই ঘোড়া ও হাতিরা যাঁদের অঙ্গুলিহেলনে কাজ করেছেন, তাঁরা সেনাবাহিনীর ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা’ (মেজর জেনারেল) এবং সিআইডির অভিযোগপত্র অনুযায়ী এরশাদ নামক একজন ‘লেফটেন্যান্ট জেনারেল’। এই ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’ প্রথম দিন থেকেই এক অবিশ্বাস্য গল্প ফেঁদে বসে, ‘ক্ষুব্ধ সৈনিকেরা’ নাকি উত্তেজিত হয়ে মঞ্জুরকে হত্যা করেছেন।
ধরে নেওয়া হয়েছিল, এই গল্পটি বাজারে চালু থাকলে এবং বিশ্বাসযোগ্যভাবে যত দিন সম্ভব একদল সাধারণ সৈনিকের ওপর এ খুনের দায় চাপাতে পারলে, উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তারা এ হত্যাকাণ্ডের সব দায়দায়িত্ব থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন। এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দীন ও পুলিশের আইজিপি এ বি এম জি কিবরিয়ার মতো অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হকও ১৯৯৫ সালে এই ‘মিথ্যা আখ্যান’-এর মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন। ২ জুন ১৯৮১ সকালে সদরউদ্দীন এরশাদকে ফোন করে বলেন, ‘আপনারা জেনারেল মঞ্জুরকে মেরে ফেললেন। এটা কিন্তু ভালো করলেন না।’
এরশাদ সদরউদ্দীনকে উত্তর দেন, ‘কিছু সৈন্য...মঞ্জুরকে হত্যা করেছে।’ ১৯৯৫ সালে সদরউদ্দীন সিআইডির তদন্তকারীদের বলেছিলেন, এরশাদের এ কথার প্রত্যুত্তরে অবিশ্বাসের সুরে তিনি বলেছিলেন, ‘অন্য কাউকে বলেন, আমাকে বিশ্বাস করতে বলবেন না।’
৩২ বছর পর এরশাদের অন্যতম সহ-অভিযোক্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তফা কামাল ভূঁইয়াকে (১৯৮১ সালে মেজর কামাল নামে পরিচিত ছিলেন) উদ্ধৃত করে ঢাকা ট্রিবিউন ২১ নভেম্বর ২০১৩ লিখেছে, ‘পথে কিছু ক্ষুব্ধ সৈনিক মঞ্জুরকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে গার্ডদের সঙ্গে তাঁদের গুলিবিনিময় হয়। এ সময় মঞ্জুর গুলিবিদ্ধ হন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই তিনি মারা যান।’ মজার ব্যাপার হলো, সৈনিকেরা, অর্থাৎ ‘গার্ডরা’ কিন্তু ভিন্ন
সাক্ষ্য দিচ্ছেন। তিনজন সৈনিক উল্টো তাঁদের সাক্ষ্যে বলেছেন, মঞ্জুর মারা গেছেন কি না, তা পরীক্ষা করে দেখতে তাঁরা এই মোস্তফা কামাল ভূঁইয়াকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামস, ক্যাপ্টেন এমদাদসহ মঞ্জুরের মৃতদেহের কাছে যেতে দেখেছেন।
এই সৈনিকেরা যা বলেছেন তা সত্য হলে মঞ্জুরের মৃত্যু তাঁকে সিএমএইচে নেওয়ার পথে হয়নি। বরং নায়েক মালেক তাঁকে গুলি করে হত্যা করার পর তাঁর মৃতদেহ সিএমএইচে নেওয়া হয়। আশা করি, লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামালউদ্দিন আদালতে এই চিত্তাকর্ষক বৈপরীত্য মীমাংসা করার অবকাশ পাবেন।
বিশেষ অভিযান
যেসব নায়েক ও সুবেদারের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, ক্যাপ্টেন এমদাদ ১ জুন ১৯৮১ তাঁদের জড়ো করেছিলেন। তাঁদের বলা হয়, তাঁরা একটি ‘বিশেষ অভিযান’-এ অংশ নিতে যাচ্ছেন। সংবাদপত্রের তথ্য অনুসারে, ক্যাপ্টেন এমদাদ
চট্টগ্রামে এসব ঘটনাপ্রবাহের সময় একজন কর্তব্যরত সক্রিয় কর্মকর্তা ছিলেন। সিআইডির কাছে দেওয়া পাঁচজন সাধারণ সৈনিকের সাক্ষ্য ও হলফনামা থেকে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
আমরা এই সৈনিকদের নাম প্রকাশ করছি না, কারণ তাঁদের পরিচয় গোপন রাখার বিষয়টি আমরা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করি। জেনারেল এরশাদ ও তাঁর সহযোগীদের কাছে তাঁদের নাম সুপরিচিত, তা জানা সত্ত্বেও এ সাবধানতা আমরা অবলম্বন করছি। তাঁদের নাম রটিয়ে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব নয়। যাঁদের নাম আমরা প্রকাশ করেছি, তাঁদের তুলনায় এ সৈনিকদের সামাজিক অবস্থান দুর্বল হওয়ায় তাঁদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
এ সতর্কতার আরও একটি কারণ আছে। এসব সাক্ষ্য ও ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের জবানবন্দি থেকে দেখা যায় যে
ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের একটি ‘মিথ্যা আখ্যান’ ছিল। একটা ভিত্তিহীন গল্পের মাধ্যমে এই সৈনিকদের মঞ্জুর হত্যা-মামলায় জড়ানো হয়। এভাবে সরাসরি জড়িত ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের দিক থেকে সবার দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে আনা হয়। এসব সাক্ষ্য যথার্থ হলে এটা পরিষ্কার যে এই সুবেদার ও নায়েকদের সুপরিকল্পিতভাবে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে, যাতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরে তাঁদের ওপর মঞ্জুর হত্যার দায় চাপিয়ে দিতে পারেন।
সুবেদার-১ তাঁর সাক্ষ্যে বলেছেন, ‘ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) এমদাদ সাহেব আমাদের সর্ট আউট করেন এবং বলেন, বিশেষ একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের নির্দেশ ওপর থেকে এসেছে যে মেজর জেনারেল মঞ্জুর হাটহাজারী থানা পুলিশের হেফাজতে আছেন। সেখান থেকে তাঁকে আনতে হবে। আনার পথে রাস্তায় অথবা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে কোথাও সুবিধামতো জায়গায় তাঁকে শেষ করে ফেলতে হবে।’
হাবিলদার-১ সিআইডিকে বলেছেন, ‘ক্যাপ্টেন এমদাদ আমাদের বলেন, মেজর জেনারেল মঞ্জুর ও তাঁর সঙ্গীয় অন্যান্যরা হাটহাজারী থানায় পুলিশের নিকট আছেন। তাঁদের আনতে হবে এবং আনার পথে মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে সুবিধামতো জায়গায় মেরে ফেলতে হবে। এটা ওপরের নির্দেশ। আমাদের কিছু করার নাই।’
সুবেদার-২ তাঁর সাক্ষ্যে বলেছেন, ‘ক্যাপ্টেন এমদাদ (হামিদ কোম্পানির কোম্পানি কমান্ডার) আমাদের উদ্দেশে ব্রিফিং দেন। তিনি বলেন যে মেজর জেনারেল মঞ্জুর, তাঁর পরিবারবর্গ, অন্যরাসহ পুলিশের কাছে ধরা পড়েছেন, তাঁরা হাটহাজারী থানায় আছেন। সেখান থেকে তাঁদের নিয়ে আসতে হবে। ওপরের নির্দেশ, আনার পথে জেনারেল মঞ্জুরকে সুবিধামতো জায়গায় হত্যা করতে হবে।’
‘সুবিধামতো জায়গায়’ শব্দবন্ধটি প্রায় সব সাক্ষ্যেই পাওয়া যায়। নায়েক-১ বলেন, ‘ক্যাপ্টেন এমদাদের ব্রিফিং অনুসারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ অনুযায়ী, থানা থেকে সেনানিবাসে নিয়ে আসার সময় কোনো সুবিধামতো জায়গায় ও সময়ে মঞ্জুর সাহেবকে খুন করতে হবে।’
হাবিলদার-১-এর ভাষ্যমতে, যে জায়গাটা শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে সুবিধাজনক বলে মনে হলো, সেটি হচ্ছে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে, ফায়ারিং রেঞ্জের কাছাকাছি একটি স্থান: ‘সেখানে গাড়ি থেকে মঞ্জুর সাহেবকে নামিয়ে হাঁটিয়ে উত্তর দিকে আনুমানিক ৩০০ গজ দূরে এবং পরে সেখানে বাঁ দিকে কিছু দূরে পাহাড়ের কাছে আমরা নিয়ে যাই। সেখানে যাওয়ার পর এমদাদ সাহেব জেনারেলের সঙ্গে আস্তে আস্তে কথা বলেন। পরে তিনি আমাকে জেনারেলকে গুলি করতে পারব কি না, জিজ্ঞাসা করেন। আমি বলি, আমার দ্বারা সম্ভব হবে না। পরে নায়েক-২-কে জিজ্ঞাসা করেন। তিনিও রাজি হননি। পরে হাবিলদার মালেককে জিজ্ঞাসা করলে তিনি গুলি করতে রাজি হন। ক্যাপ্টেন এমদাদ সাহেবের নির্দেশে হাবিলদার মালেক জেনারেল মঞ্জুরের মাথায় চায়নিজ রাইফেল দিয়ে গুলি করেন। জেনারেল মঞ্জুর মাটিতে পড়ে যান।’
হাবিলদার-১ এরপর কী দেখেছেন তা-ও বর্ণনা করছেন, ‘আমরা যেখানে গাড়ি দাঁড়ানো ছিল সেখানে চলে আসি। তখন ওই গাড়ির
পাশে আরেকটি জিপ দাঁড়ানো দেখি। সেখান থেকে দুজন অফিসার এগিয়ে আসেন। তাঁদের একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামস (শামসুর রহমান) এবং অন্যজন মেজর কামাল (মোস্তফা কামালউদ্দিন ভূঁইয়া)। কাজ সেরেছে কি না, তাঁরা জিজ্ঞাসা করেন। তখন এমদাদ সাহেব কাজ হয়েছে বলে জানান। এরপর তাঁরা জেনারেল মঞ্জুরের লাশ দেখার জন্য...ক্যাপ্টেন এমদাদকে...নিয়ে যেতে চান।’
সুবেদার-১ যা দেখেছেন তার বর্ণনা এ রকম: ‘আমাদের গাড়ির কাছে এলে দেখি, গাড়ির কাছে আরেকটি জিপগাড়ি দাঁড়ানো। জিপগাড়ির কাছে দাঁড়ানো একজন জিজ্ঞাসা করেন, এমদাদ নাকি? তখন ক্যাপ্টেন এমদাদ তাঁর পরিচয় দেন। তখন জিজ্ঞাসা করেন, তোমাদের খবর কী? কাজ হয়েছে কি না? তখন দেখি তাঁদের একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসুর রহমান শামস এবং অন্যজন মেজর মোস্তফা কামালউদ্দিন ভূঁইয়া (বর্তমানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল)। তখন তাঁরা বলেন, চলো, দেখে আসি। তখন এমদাদ সাহেবসহ দুজন রওনা হন। আমরা বলি, স্যার, আপনি একা যাবেন না। আমরাও সঙ্গে যাব। তখন আমরা সবাই একসঙ্গে...মঞ্জুরকে যেখানে মারা হয়েছে সেখানে যাই। যাওয়ার পর লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামস জেনারেল মঞ্জুরের শরীর হাতিয়ে দেখেন এবং মরে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হন।’ সুবেদার-১ সময়টাও উল্লেখ করেছেন, ‘হাবিলদার মালেক তাঁর হাতে থাকা চায়নিজ রাইফেল দিয়ে জেনারেলের মাথায় গুলি করেন। তখন রাত আনুমানিক ১১ থেকে সাড়ে ১১টা হবে।’
হাবিলদার-১ বর্ণনা করেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামস মঞ্জুরের লাশ পরীক্ষা করার পর কীভাবে সৈনিকেরা সেটি সিএমএইচে নিয়ে যান। হাবিলদার-১ বলেন: এরপর ‘মর্গে লাশ পৌঁছিয়ে আমরা গাড়ি নিয়ে ইবিআরসিতে (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টার) চলে যাই। হাতিয়ার জমা দিয়ে ব্যারাকে চলে যাই।’ এভাবেই সে রাতের রক্তাক্ত ‘দায়িত্বের’ অবসান ঘটে।
জেনারেল এরশাদ বছরের পর বছর ধরে বলে আসছেন মঞ্জুর ‘ক্ষুব্ধ’ ও ‘উত্তেজিত’ সেনাদের হাতে মারা পড়েছেন। এ ব্যাপারে সুবেদার-২ যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক, বিশেষ করে এ অপরাধটিকে বিবেচনার মধ্যে নিলে। সুবেদার-২ বলেন, ‘ক্যান্টনমেন্ট ঢুকে ইবিআরসি পর্যন্ত আসার পথে রাস্তায় বা আশপাশে কোনো উচ্ছৃঙ্খল বা উত্তেজিত সৈনিক দেখিনি। পরদিন ২ জুন ১৯৮১ তারিখ সকালে রেডিওতে শুনতে পাই যে মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকেরা ছিনিয়ে নিয়ে মেরে ফেলেছেন।’
সুবেদার-২ ও তাঁর অন্য সহকর্মীরা যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তা সত্য হলে কাজটা খুব সন্তর্পণে ঘটেছে; আর কোনো উত্তেজনাও সেখানে ছিল না। তাঁরা ‘ক্ষুব্ধ’ বা ‘অনিয়ন্ত্রিত’ কোনোটাই ছিলেন না। তাঁদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে তাঁরা ‘ওপরের নির্দেশ’ অনুযায়ী কাজ করছিলেন। নায়েক-১-এর ভাষ্য অনুযায়ী, তাঁদের আর ‘কিছু করার’ ছিল না।
একজন সেনা কর্মকর্তা তাঁদের হেফাজতে থাকা অবস্থায় কোনো সৈনিক যে তাঁকে হত্যা করার অবৈধ নির্দেশ পালন করলেন, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। হেফাজতে থাকা অবস্থায় কোনো সেনা কর্মকর্তা, সৈনিক বা বেসামরিক লোককে হত্যা করা স্রেফ খুনের পর্যায়ে পড়ে। এটা অপরাধ। যদিও তা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়।
যে বিষয়টির দিকে নজর দেওয়া দরকার সেটি হচ্ছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁদের অধীনের সৈনিকদের সঙ্গে বেশ সতর্কভাবে যোগাযোগ করছিলেন। হাবিলদার-১ স্পষ্টভাবেই বলেছেন, ক্যাপ্টেন এমদাদ তাঁদের এই ‘বিশেষ অভিযান’-এর অন্তিম পর্যায়টুকু যখন তাঁকে ও নায়েক-২-কে সম্পন্ন করতে বলেন, তখন তাঁরা মঞ্জুরকে হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানান। হাবিলদার-১ বলেন, নায়েক মালেক নামে এক সৈনিক ক্যাপ্টেন এমদাদের নির্দেশ পালন করেন, অর্থাৎ কি না, মঞ্জুরকে গুলি করে হত্যা করেন।
সৈনিকেরা যে বিবরণ দিয়েছেন তা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা যেমন: লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামস, মেজর কামাল, ক্যাপ্টেন এমদাদ ফায়ারিং রেঞ্জের কাছাকাছি ছিলেন, কিন্তু এই ‘দায়িত্ব’টি সম্পন্ন করার দায় তাঁরা কেউই নিজের কাঁধে না নিয়ে নায়েক, সুবেদার বা হাবিলদারদের তা করতে বলেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামস, মেজর কামাল, ক্যাপ্টেন এমদাদ তাঁরা কেন নিজেরাই এগিয়ে এসে মঞ্জুরকে গুলি করে হত্যার ‘দায়িত্ব’টা না সেরে সাধারণ একজন সৈনিককে দিয়ে তা করালেন? পক্ষান্তরে, সাধারণ কোনো সৈনিকের হাতে মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হলো কি না, তাঁরা ছায়ার ছায়ায় থেকে সে তথ্য নিশ্চিত করলেন। এটা তাঁরা কেন করলেন? একজন সাধারণ সৈনিককে দিয়ে মঞ্জুরকে হত্যা করানোটা কেন এত জরুরি ছিল?
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, মঞ্জুর-হত্যার দায় একদল সাধারণ সৈনিকের ওপর চাপানোটা ‘পরিকল্পনার’ অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। যেমন: ধরা যাক, অপরাধস্থলে কোনো সেনা কর্মকর্তার আঙুলের ছাপ থাকা চলবে না। পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠলে একদল সাধারণ সৈনিকের কাঁধে দোষ চাপিয়ে একটি বিশ্বাসযোগ্য গল্প ফাঁদা যাবে।
পরিস্থিতি সে রকম হলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পক্ষে এ হত্যার দায় একদল ‘ক্ষুব্ধ’ ও ‘নিয়ন্ত্রণহীন’ সৈনিকদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকবে। ক্যাপ্টেন, মেজর, লেফটেন্যান্ট কর্নেলদের কথার চেয়ে কিছু নায়েক, সুবেদার ও হাবিলদারের কথা কি মানুষ বেশি বিশ্বাস করবে? আর প্রয়োজন হলে ‘দ্রুত’ কোর্ট মার্শালের আয়োজন করে তীব্র নির্যাতনের মাধ্যমে কয়েকজনের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করে নেওয়া যাবে, একদল মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া যাবে। সমীকরণটা কী অসম্ভব? ঘটনার এক মাস পর ১৩ জন তরুণ সেনা কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ঠিক এই কায়দাতেই ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এমনকি মিলিটারি কোড অব জাস্টিসে আসামির জন্য যেসব সুরক্ষার ব্যবস্থা আছে, সেগুলোও তাতে অবলীলায় লঙ্ঘন করা হয়।
বাস্তবে ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা’ ‘অনিয়ন্ত্রিত সেনাদের’ হাতে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার কাহিনি-সংবলিত তথ্যবিজ্ঞপ্তি ফাঁদছিলেন বলে মনে হয়। সেনাবাহিনীর তৎকালীন অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর ভাষ্য অনুযায়ী, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইকে এসব গালগল্প বাজারে ছড়ানোর কাজে নিয়োগ করা হয়।
পূর্ণাঙ্গ তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার আগেই যেন মঞ্জুরকে জিয়ার হত্যাকারী হিসেবে প্রচার করা না হয়, তা নিয়ে জেনারেল এরশাদ ও ডিজিএফআইয়ের প্রধান মেজর জেনারেল মহব্বত জান চৌধুরীর সঙ্গে মেজর জেনারেল মইন কীভাবে তর্ক করেছেন তার বিশদ বিবরণ এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য বইটিতে তিনি দিয়েছেন।
কোনো তদন্ত ছাড়াই এমন কোনো দাবিকে মইন বলেছেন অর্থহীন। মঞ্জুর মইনের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে জিয়ার বিরুদ্ধে পরিচালিত অভুত্থানে তাঁর সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছিলেন। ৩০ ও ৩১ মে চট্টগ্রাম থেকে ফোনে তিনি মইনের কাছে এসব কথা বলেন। কিন্তু ডিজিএফআই চট্টগ্রামের ঘটনা সম্পর্কে তাদের নিজস্ব বিবরণ প্রকাশ করতে বদ্ধপরিকর ছিল।
সাংগঠনিকতার দিক থেকে এই ‘বিশেষ অভিযান’টি ডিজিএফআই-ই সব পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছে বলে মনে হয়। সুবেদার-২-এর সাক্ষ্যে দেখা যায়, পরদিন ২ জুন সকালে তিনি শুনতে পান ‘উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকেরা’ মঞ্জুরকে হত্যা করেছে। এতে তিনি বিস্মিত হন। কারণ, তাঁর সাক্ষ্য অনুসারে, ‘ক্যান্টনমেন্ট ঢুকে ইবিআরসি পর্যন্ত আসার পথে রাস্তায় বা আশপাশে কোনো উচ্ছৃঙ্খল বা উত্তেজিত সৈনিক’ তিনি দেখেননি। এই খবরটি রেডিও পেল কোত্থেকে? ২ জুন ১৯৮১ তারিখে রেডিও, টেলিভিশন ও সব পত্রিকায় এ খবরটি প্রচারিত হয়।
‘ফল্স ফ্ল্যাগ’ অপারেশনের কথা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। আবার মঞ্জুরের খুনের চাক্ষুষ সাক্ষী হিসেবে দাবিদার সৈনিকদের সাক্ষ্য অনুযায়ী সে রাতে ফায়ারিং রেঞ্জে কোনো ‘উচ্ছৃঙ্খল সৈনিক’ ছিলেন না। সেখানে উপস্থিত ছিলেন কেবল আদেশ পালনকারী সৈনিকেরাই। তাঁরা হাটহাজারী থানা থেকে মঞ্জুরকে নিয়ে এসে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চোখের সামনে ‘সুবিধামতো জায়গায়’ তাঁকে হত্যা করেন। (সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দা তৎপরতায় কীভাবে ‘ফল্স ফ্ল্যাগ’ অভিযান ব্যবহূত হয়, তা বোঝার জন্য দেখুন, ‘মেজর জেনারেল মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড’, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)।
দাবার এই ছকে ঘোড়া (ব্রিগেডিয়ার ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল) ও হাতিরা (মেজর ও ক্যাপ্টেন) তাদের বড়েগুলো (সুবেদার ও নায়েক) অঙ্গুলিহেলনে চালনা করেছেন। বেশ। কিন্তু আরও বড় একটি দাবার ছকে আবার এই ঘোড়া ও হাতিরা যাঁদের অঙ্গুলিহেলনে কাজ করেছেন, তাঁরা সেনাবাহিনীর ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা’ (মেজর জেনারেল) এবং সিআইডির অভিযোগপত্র অনুযায়ী এরশাদ নামক একজন ‘লেফটেন্যান্ট জেনারেল’। এই ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’ প্রথম দিন থেকেই এক অবিশ্বাস্য গল্প ফেঁদে বসে, ‘ক্ষুব্ধ সৈনিকেরা’ নাকি উত্তেজিত হয়ে মঞ্জুরকে হত্যা করেছেন।
ধরে নেওয়া হয়েছিল, এই গল্পটি বাজারে চালু থাকলে এবং বিশ্বাসযোগ্যভাবে যত দিন সম্ভব একদল সাধারণ সৈনিকের ওপর এ খুনের দায় চাপাতে পারলে, উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তারা এ হত্যাকাণ্ডের সব দায়দায়িত্ব থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন। এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দীন ও পুলিশের আইজিপি এ বি এম জি কিবরিয়ার মতো অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হকও ১৯৯৫ সালে এই ‘মিথ্যা আখ্যান’-এর মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন। ২ জুন ১৯৮১ সকালে সদরউদ্দীন এরশাদকে ফোন করে বলেন, ‘আপনারা জেনারেল মঞ্জুরকে মেরে ফেললেন। এটা কিন্তু ভালো করলেন না।’
এরশাদ সদরউদ্দীনকে উত্তর দেন, ‘কিছু সৈন্য...মঞ্জুরকে হত্যা করেছে।’ ১৯৯৫ সালে সদরউদ্দীন সিআইডির তদন্তকারীদের বলেছিলেন, এরশাদের এ কথার প্রত্যুত্তরে অবিশ্বাসের সুরে তিনি বলেছিলেন, ‘অন্য কাউকে বলেন, আমাকে বিশ্বাস করতে বলবেন না।’
৩২ বছর পর এরশাদের অন্যতম সহ-অভিযোক্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তফা কামাল ভূঁইয়াকে (১৯৮১ সালে মেজর কামাল নামে পরিচিত ছিলেন) উদ্ধৃত করে ঢাকা ট্রিবিউন ২১ নভেম্বর ২০১৩ লিখেছে, ‘পথে কিছু ক্ষুব্ধ সৈনিক মঞ্জুরকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে গার্ডদের সঙ্গে তাঁদের গুলিবিনিময় হয়। এ সময় মঞ্জুর গুলিবিদ্ধ হন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই তিনি মারা যান।’ মজার ব্যাপার হলো, সৈনিকেরা, অর্থাৎ ‘গার্ডরা’ কিন্তু ভিন্ন
সাক্ষ্য দিচ্ছেন। তিনজন সৈনিক উল্টো তাঁদের সাক্ষ্যে বলেছেন, মঞ্জুর মারা গেছেন কি না, তা পরীক্ষা করে দেখতে তাঁরা এই মোস্তফা কামাল ভূঁইয়াকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামস, ক্যাপ্টেন এমদাদসহ মঞ্জুরের মৃতদেহের কাছে যেতে দেখেছেন।
এই সৈনিকেরা যা বলেছেন তা সত্য হলে মঞ্জুরের মৃত্যু তাঁকে সিএমএইচে নেওয়ার পথে হয়নি। বরং নায়েক মালেক তাঁকে গুলি করে হত্যা করার পর তাঁর মৃতদেহ সিএমএইচে নেওয়া হয়। আশা করি, লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামালউদ্দিন আদালতে এই চিত্তাকর্ষক বৈপরীত্য মীমাংসা করার অবকাশ পাবেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন