১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করার মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। স্বল্প সংখ্যক বিরোধীদলীয় সদস্য ছিলেন পার্লামেন্টে। তাদের ওয়াক আউটের পর কোন আলোচনা না করেই তড়িঘড়ি করে পাস করা হয় ওই সংশোধনী। এ সংবিধান দেশে প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রিপরিষদ (যাদের পার্লামেন্টের সদস্য হতেই হবে এমন কথা নেই) ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। বিচক্ষণ প্রেসিডেন্টের অধীনে এই সংশোধনী বলে যে, দেশ হবে একদলীয় এবং অন্য সব বিরোধী রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হবে।এ সংশোধনী পাস করার মাধ্যমে ৫ বছর মেয়াদের জন্য অটোমেটিকভাবে প্রেসিডেন্ট হলেন মুজিব। ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি জাতীয় সংসদে পাস হয় বহুল আলোচিত সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী। এ নিয়ে ওইদিনই ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অফিসে একটি তারবার্তা পাঠায়। এর নম্বর ক্যানোনিক্যাল আইডি: ১৯৭৫ঢাকা০০৪৫৭-বি। সমপ্রতি সাড়া জাগানো ওয়েবসাইট উইকিলিকস যে নতুন ১৭ লাখের বেশি মার্কিন কূটনৈতিক গোপন তারবার্তা প্রকাশ করেছে তাতে এসব কথা বলা হয়েছে। নতুন প্রকাশিত এই বার্তাগুলোর নাম দেয়া হয়েছে ‘কিসিঞ্জার ক্যাবলস’। ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি মার্কিন দূতাবাস যে তারবার্তা পাঠায় তার শিরোনাম ‘কনস্টিটিউশন ইজ চেঞ্জড: মুজিব নাউ প্রেসিডেন্ট’। এতে আরও বলা হয়, একই সঙ্গে সংশোধনী পাস হওয়ার সময় থেকে জাতীয় সংসদের মেয়াদ বাড়িয়ে ৫ বছর করা হয়েছে। দেশের সমস্যা ও শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যকার অসুস্থ শৃঙ্খলা মোকাবিলার জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনীয়তার পক্ষে কথা বলেন। নতুন মন্ত্রিসভা আগামী সপ্তাহে ঘোষণা করা হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। জাতীয় সংসদ জরুরি ক্ষমতাবিষয়ক বিল অনুমোদন করেছে। প্রেসিডেন্ট গত মাসে যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তাই অনুমোদিত হলো। এতে আরও বলা হয়, ২৫শে জানুয়ারি সকালে জাতীয় সংসদের দু’ঘণ্টার সাজানো গোছানো অধিবেশনে বাংলাদেশ পার্লামেন্ট প্রথম পাস করলো জরুরি ক্ষমতাবিষয়ক বিল। প্রেসিডেন্ট এ বিলটি গত মাসে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছিলেন। দ্রুততার সঙ্গে উপস্থাপন করা হয় সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী এবং তা পাস হয়। এর মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্টের শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলো। প্রস্তাবিত সংশোধনী নিয়ে বিরোধীদের কোন আলোচনা করতে দেয়া হয় নি। তারা ওয়াক আউট করেন। ফলে কোন বিরোধিতা ছাড়াই ২৯২ ভোটে পাস হয় ওই সংশোধনী। এই সংশোধনী পাস ও কার্যকর হওয়ার ফলে অটোমেটিক্যালি প্রেসিডেন্ট হলেন মুজিব। দুপুরে জাতীয় সংসদ মুলতবি ঘোষণার পর পরই সংক্ষিপ্ত ও অনানুষ্ঠানিকতায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন তিনি। সংবিধানে যেসব মূল পরিবর্তন আনা হয়েছে তা হলো:
প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট। প্রথম অধ্যায়ের চতুর্থ ভাগে নির্বাহী এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ বিষয়টিকে পরিবর্তন করা হয়েছে প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রিপরিষদবিষয়ক দুটি নতুন অধ্যায় ব্যবহার করে। রাষ্ট্রের প্রধান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন সরাসরি নির্বাচনে। সংবিধান সংশোধনবিষয়ক আইনের শেষ আর্টিকেল অনুযায়ী বিদায়ী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদুল্লাহ এই আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতা হারাবেন এবং মুজিবুর রহমান হবেন প্রেসিডেন্ট। তিনি ক্ষমতায় আসবেন যেন তিনি একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। ভাইস প্রেসিডেন্টকে নিয়োগ দেবেন প্রেসিডেন্ট। এ দু’জনেরই মেয়াদ হবে ৫ বছর করে। তাদের কেউই পার্লামেন্টের সদস্য হতে পারবেন না। আজই মুজিব তার পদ ছেড়েছেন। সংশোধিত সংবিধান প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টকে সরকারি দায়িত্বের ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দিয়েছে। তাদেরকে পার্লামেন্টে অভিশংসন করা যাবে না। অদক্ষতার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টকে সরাতে পারবে না পার্লামেন্ট। প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ খালি হলেই ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করবেন স্পিকার। প্রজাতন্ত্রের সব নির্বাহী ক্ষমতা থাকবে প্রেসিডেন্টের হাতে। তিনি ক্ষমা করে দেয়ার এবং শাস্তি লাঘব করার পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা ভোগ করবেন।
মন্ত্রীদের কাউন্সিল: প্রেসিডেন্ট যে মন্ত্রীদের কাউন্সিল নিয়োগ দেবেন তারা তার সন্তুষ্টির জন্য কাজ করবেন। তারা প্রেসিডেন্টকে তার কাজে সহায়তা ও পরামর্শ দেবেন। তারা কি ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন সে বিষয়ে কোন আদালত তদন্ত করতে পারবে না। এমপি অথবা এমপি নির্বাচিত হতে পারেন এমন যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্য থেকে প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী নিয়োগ করা যাবে। প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী যাদেরকে নিয়োগ দেয়া হবে তারা ওই কাউন্সিলের সদস্য হবেন না। সব মন্ত্রী পার্লামেন্টে কথা বলতে এবং পার্লামেন্টারি কার্যক্রমে অংশ নেয়ার অধিকার পাবেন। কিন্তু তাদের মধ্যে যারা এমপি তারাই ভোট দেয়ার অধিকার পাবেন।
স্থানীয় সরকার: সংবিধান থেকে স্থানীয় সরকারবিষয়ক তৃতীয় অধ্যায় বাতিল করেছে এই সংশোধনী। এর পরিবর্তে সেখানে কিছু নতুন করে বসানো হয়নি।
পার্লামেন্ট: সংশোধনীর ফলে এমপিদের সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার ক্ষমতায় বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। কোন এমপি’র পদ শূন্য হবে যদি তিনি তার রাজনৈতিক দল থেকে পদত্যাগ করেন অথবা এর বিরুদ্ধে ভোট দেন। সংশোধনীতে বলা হয়েছে- যদি কোন এমপি ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকেন অথবা দলের অনুমতি ছাড়া অনুপস্থিত থাকেন তাহলে ধরা হবে যে, তিনি তার দলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। মুলতবি হয়ে যাওয়ার ১২০ দিনের মধ্যে পার্লামেন্টের যে অধিবেশন ফের ডাকার নিয়ম ছিল তা বাতিল করা হয়েছে। সংশোধনীর মাধ্যমে বছরে কমপক্ষে দু’বার পার্লামেন্ট ডাকার কথা বলা হয়েছে।
বিচার বিভাগ: প্রধান বিচারপতি অথবা সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে কোন আলোচনা ছাড়াই প্রেসিডেন্ট সব বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়ার ক্ষমতা পেয়েছেন। আগে এক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নিতে হতো। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালকে হাইকোর্ট ডিভিশনের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট, বিচার বিভাগীয় ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ ও ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে তা নেয়া হয়েছে প্রেসিডেন্টের অধীনে। এতে আরও বলা হয়েছে, যারা বিচার বিভাগে থাকবেন এবং ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন তারা তাদের বিচারিক কার্যক্রমে স্বাধীনতা পাবেন। অশোভন আচরণ ও অদক্ষতার অভিযোগে শুনানির পর প্রেসিডেন্ট এখন একজন বিচারককে সরিয়ে দিতে পারবেন। আগে এমনটা ছিল না। আগে এক্ষেত্রে দরকার হতো পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা।
মৌলিক অধিকার: আর্টিকেল ১ ডব্লিউ অনুযায়ী, সংবিধানসম্মত কোন মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন নির্দেশ ও নির্দেশনা দেয়ার ক্ষেত্রে হাইকোর্ট ডিভিশনের রেফারেন্স দেয়া বাতিল করা হয়েছে। রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিবিষয়ক সংবিধানের পার্ট-২, আর্টিকেল ১১কে সংশোধন করে প্রশাসনের সব স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে রেফারেন্স বাতিল করা হয়েছে। মৌলিক অধিকার বিষয়ক তৃতীয় অধ্যায়ের আর্টিকেল ৪৪, যেখানে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টকে গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে তা পাল্টে একটি নতুন আর্টিকেল যুক্ত করা হয়েছে।
ন্যাশনাল পার্টি: নতুন একটি পার্ট ৬-এ ‘দ্য ন্যাশনাল পার্টি’ বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট যদি সন্তুষ্ট হন যে, রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি বাস্তবায়ন করতে দরকার তাহলে তিনি দেশে মাত্র একটি রাজনৈতিক দল থাকবে বলে নির্দেশ ও নির্দেশনা দিতে পারেন তিনি (সেটা হলো দ্য ন্যাশনাল পার্টি)। এমন নির্দেশের ফলে সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত হবে এবং প্রেসিডেন্ট ন্যাশনাল পার্টি গঠনের পদক্ষেপ নেবেন। তিনি দলের কর্মকাণ্ড, সদস্যপদ, সাংগঠনিক, শৃঙ্খলা, অর্থায়ন ও কার্যকলাপ নির্ধারণ করবেন। যখন ন্যাশনাল পার্টি গঠন হয়ে যাবে তখন একজন এমপি যদি প্রেসিডেন্ট বেঁধে দেয়া সময়সীমার মধ্যে ওই দলের সদস্য না হন তাহলে তার পার্লামেন্ট সদস্য পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে। কেউ যদি ন্যাশনাল পার্টির সদস্য না হন তাহলে তিনি প্রেসিডেন্ট বা এমপি নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে যোগ্য হবেন না। ন্যাশনাল পার্টি ছাড়া কেউ এসব পদে আসতে পারবেন না। মুজিবের ভাষণ: সংশোধনী পাস হওয়ার পর মুজিব পার্লামেন্টে ভাষণ দিয়েছেন। এতে তিনি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করেন এবং জাতির দুর্ভোগের কথা তুলে ধরেন। তিনি এই সংশোধনীকে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, দেশ ঔপনিবেশিক আমলের আইনকানুন দিয়ে চলতে পারে না। মুজিব তার বক্তব্যে জোর দিয়ে তুলে ধরেন যে, দেশের শতকরা মাত্র ৫ ভাগ মানুষ শিক্ষিত। তারাই দেশের দুর্নীতি, রাজনৈতিক হত্যা এবং বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনার জন্য দায়ী। তারাই বাংলাদেশের সমস্যার সমাধানকে কঠিন করে তুলেছেন। কিন্তু শিক্ষিতরা কোন দায় নেয় না। তারা অনুসরণ করেন ফ্রিস্টাইল। দেশের ভবিষ্যতের জন্য যা দরকার তার বিরোধী এটা। মুজিব জোর দিয়ে বলেন, জনসংখ্যার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবেই। শ্রম হতে হবে উৎপাদনমুখী, যাতে বাংলাদেশ তার সাহায্যকারী বন্ধুদের কাছে ভিক্ষা চাওয়ার পরিবর্তে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ হতে পারে। তিনি পার্লামেন্টের সব সদস্যের প্রতি আহ্বান জানান দেশের সমস্যা সমাধানে তার উদ্যোগে যুক্ত হতে।
মন্তব্য: এই সংশোধনী নিয়ে জনগণের ভাবনা কি বা তাদের প্রতিক্রিয়া কি তা এখনই জানা যাচ্ছে না। কিন্তু যা ধারণ করা হয়েছিল এবং অনেকেই জানতেন নতুন এই ব্যবস্থায় যেসব বড় বিষয় রয়েছে তা বিস্ময়কর বলে মনে হয় না। নতুন মন্ত্রীদের কাউন্সিল ও মুজিব কখন তার ন্যাশনাল পার্টি গঠনের সিদ্ধান্ত নেন তাই দেখার বিষয়। আজ বিকালেই কূটনৈতিক কোরকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাকা হয়েছে একটি বৈঠকে সম্ভবত তাতে নিশ্চয়তা দেয়া হবে যে সংশোধিত সংবিধানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে কোন প্রভাব পড়বে না।
পৃষ্ঠার উপরে আসুন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন